Wednesday, October 4, 2023
বাড়িউত্তরণ-২০২১দ্বাদশ বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, ডিসেম্বর-২০২১মুক্তিযুদ্ধে শিল্পী সাহিত্যিক সংস্কৃতিকর্মী

মুক্তিযুদ্ধে শিল্পী সাহিত্যিক সংস্কৃতিকর্মী

সাদিকুর রহমান পরাগ

এক
“দেশের গণমুখী সংস্কৃতিকে বিকশিত করার উদ্দেশ্যে সাহিত্য-সংগীতে কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা, সুখ-দুঃখকে প্রতিফলিত করতে হবে। সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন। তাই মাটি ও মানুষকে কেন্দ্র করে গণমানুষের সুপ্ত শক্তি ও স্বপ্ন এবং আশা-আকাক্সক্ষাকে অবলম্বন করে গড়ে উঠবে বাংলার নিজস্ব সাহিত্য-সংস্কৃতি।” ১৯৭১ সালের ২৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান শিল্পী-সমাজ কর্তৃক প্রদত্ত সংবর্ধনা প্রদান অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ-কথাগুলো বলেছেন। একই বক্তৃতায় তিনি ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “’৫২-এর ভাষা আন্দোলন শুধু বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আদায়ের আন্দোলন ছিল না, এই আন্দোলন ছিল বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির আন্দোলন।”
বাঙালির ধারাবাহিক মুক্তি সংগ্রামের দিকে ফিরে, আজকেও আমরা বঙ্গবন্ধুর সেদিনের সে-কথাগুলোর যথার্থতা খুঁজে পাই। তার কথার সূত্র ধরেই বলা যায় যে একটি জাতির পথপরিক্রমায় এবং আগামীর অভিযাত্রায় সেই জনগোষ্ঠীর শিল্প-সাহিত্যের ভূমিকা অপরিসীম। দেশ ও জনগণের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও কৃষ্টিকে ধারণ করে ভবিষ্যতের পথরেখা তৈরি করে তার শিল্প-সাহিত্য।
১৯৪৭ সালের পর যখন বাঙালি জনগোষ্ঠীর মোহভঙ্গ ঘটে। তারা উপলব্ধি করে, শোষণ মুক্তি তো দূরের কথা, পাকিস্তান নামের নতুন একটি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের জাঁতাকলে পিষ্ট তার মুক্তির আকাক্সক্ষা। সেই অবস্থানে দাঁড়িয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে ঘুরে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। জন-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটে তার রাজনৈতিক পথপরিক্রমায়। ফলে নেমে আসে দমন-পীড়ন, জেল-জুলুম। কিন্তু কোনো কিছুতেই পিছু না হটে ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি বাঙালি জাতিকে প্রস্তুত করেন স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য।
বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর যখন আঘাত আসে, তখন বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই নিষ্ক্রিয় ও নীরব ছিল। তাদের এই নীরবতা বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টি এড়ায়নি। ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ভাষা আন্দোলনের স্মরণ সপ্তাহের আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রদত্ত উদ্বোধনী বক্তব্যে এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “বাঙালির স্বজাত্যবোধকে টুঁটি চেপে হত্যার জন্য প্রতিক্রিয়াশীল চক্র বারবার এই অঞ্চলের সংস্কৃতি ও ভাষার উপর আঘাত হেনেছে, আর তাকে প্রাণ দিয়ে প্রতিহত করেছে এদেশের তরুণরা। কিন্তু তাদের মধ্যে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ক’জন আছেন? বিবেকের কাছে তাদের জবাবদিহি করতে হবে। আপনাদের লেখনী দিয়ে বের হয়ে আসা উচিত ছিল এদেশের গণমানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কথা। স্বাধীনতা আন্দোলনের বীর সন্তান সূর্যসেনের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের প্রচেষ্টাই করা হয় নাই। তাঁর কথা বলতে আপনারা ভয় পান। কারণ তিনি ছিলেন হিন্দু।”
বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ষাটের দশকের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ৬-দফার আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে শামিল হয় এদেশের শিল্পী-লেখক-সাহিত্যিক-সাংবাদিক-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীরা। শুধুমাত্র রাজপথে নয়, স্ব-স্ব মাধ্যমে তাদের সৃজনশীল কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে তারা মানুষের চেতনাকেও শাণিত করে তোলেন। বিভিন্ন কাব্য, উপন্যাস, ছোট গল্প, কবিতা, চিত্রকলা, নাটক, চলচ্চিত্র এবং যাত্রাপালায় তার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই এবং তা এতটাই বিস্তৃত যে এই স্বল্প পরিসরে মুক্তিযুদ্ধে শিল্পী-সাহিত্যিক-সংস্কৃতিকর্মীদের ভূমিকার পূর্ণ চিত্রটি তুলে ধরা সম্ভব নয়।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর অনবদ্য সৃষ্টি ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’, আবদুল লতিফের ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’ কিংবা ‘একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’, ‘শোনো একটি মুজিবরের কণ্ঠ থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি’, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘বিজয় নিশান উড়ছে অই’-এর মতো কালোত্তীর্ণ গান মানুষকে মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত করে। ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘জয় বাংলা’ কিংবা ‘স্টপ জেনোসাইড’-এর মতো কালজয়ী চলচ্চিত্র কিংবা মনির চৌধুরীর ‘কবর’ নাটকটি বাঙালি জাতিকে সাহসী করেছে। ‘আসাদের শার্ট’, ‘তোমাকে পাবার জন্য হে স্বাধীনতা’, ‘স্বাধীনতা তুমি’ কিংবা অ্যালেন গিন্সবার্গের ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’-এর মতো কবিতা বাঙালির রক্তে স্বাধীনতার উন্মাদনা সৃষ্টি করে।
চিত্রশিল্পীরাও রং-তুলি নিয়ে নেমে পড়েছিলেন যুদ্ধে। পোস্টার ও চিত্রকর্মের মাধ্যমে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেন। পটুয়া কামরুল হাসানের ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, ‘রক্ত যখন দিয়েছি আরো রক্ত দেবো’, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ ঘরে তোলো’, ‘মুক্তিবাহিনী আপনার পাশেই আছে’, দেবদাস চক্রবর্তীর ‘বাংলার হিন্দু-বাংলার বৌদ্ধ বাংলার মুসলমান আমরা সবাই বাঙালি’, প্রাণেশ ম-লের ‘বাংলার মায়েরা মেয়েরা সকলেই মুক্তিযোদ্ধা’ কিংবা নিতুন কু-ুর ‘সদা জাগ্রত বাংলার মুক্তিবাহিনী’Ñ এই পোস্টারগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা জুগিয়েছে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ‘শরণার্থী’, পটুয়া কামরুল হাসানের ‘মুক্তিযোদ্ধা রমণী’ শীর্ষক চিত্রকর্ম, আমিনুল ইসলামের ‘গণহত্যা’ শীর্ষক তৈলচিত্র, কাইয়ুম চৌধুরীর ‘গণহত্যা-৭১’, প্রাণেশ ম-লের ‘শরণার্থী ’ শিল্পকর্ম আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবেরই অংশ।

দুই
বাঙালির মুক্তির আকাক্সক্ষাকে নস্যাৎ করতে পাকিস্তানিরা ব্যুরো অব রিকনসট্রাকশন বা বিএনআর গঠন করে আমাদের সংস্কৃতির মূলে আঘাত করতে চেয়েছে। পাকিদের এই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সোচ্চার ছিলেন। ১৯৭০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার হোটেল পূর্বাণীতে সাপ্তাহিক পূর্বাণীর ষষ্ঠ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে প্রদত্ত বক্তব্যে এই অপতৎপতার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তিনি বলেছিলেন, “ধর্ম ও জাতীয় সংস্কৃতির নামে আমাদের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়েছে। বাংলা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এই চক্রান্ত আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। কিন্তু আমাদের জনগণ এই চক্রান্ত প্রতিহত করেছে। বাংলা ভাষা ও বঙ্গ সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার জন্য জাতীয় পুনর্গঠন ব্যুরো স্থাপন করা হয়েছে। পাকিস্তান বেতার এবং টেলিভিশনও এই ষড়যন্ত্রের দোসর। তারা রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধ করে দিয়েছিল এবং আজও এ ব্যাপারে উঁচুমহলে জোর আপত্তি রয়েছে। জনগণ তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এই চক্রান্ত সহ্য করবে না।”
বাঙালি সংস্কৃতি ধ্বংসের এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে সাড়া দিয়ে রাজপথে নেমে এসেছিল এদেশের লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিক-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী সমাজ। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ প্রতিটি পর্যায়ে লেখক-সাংবাদিক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীরা অসামান্য অবদান রেখেছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও শিল্পী-সাহিত্যিকরা মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।

বিক্ষুব্ধ শিল্পী-সমাজ ও অসহযোগ আন্দোলন
অসহযোগ আন্দোলনের আগেই ’৭১-এর ফেব্রুয়ারিতে সৈয়দ হাসান ইমামকে আহ্বায়ক, ওয়াহিদুল হক এবং আতিকুল ইসলামকে যুগ্ম-আহ্বায়ক করে গঠিত হয় ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী-সমাজ’। ৭ মার্চ বেতারে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচারে সামরিক জান্তারা বাধা প্রদান করায় শিল্পী-সমাজ ও কলাকুশলীরা ক্ষুব্ধ হয় এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তারা পাকিস্তান বেতার ও টেলিভিশনের অনুষ্ঠান বর্জন করে। তাদের ক্ষোভের মুখে পরদিন সকালে ভাষণ প্রচার করা হয়। দেশের শিল্পী-সমাজ স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। ৮ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বেতার-টেলিভিশনের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের হাতে। ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে রাতে ডিআইটিতে অবস্থিত টেলিভিশন কেন্দ্র হতে পাকিস্তানের পতাকা দেখানো থেকে বিরত থেকে দেশপ্রেম ও উদ্দীপনামূলক গান পরিবেশন করা হয়। বিক্ষুব্ধ শিল্পী-সমাজ টিএসসি, পল্টন, তোপখানা রোড, বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণ, বাহাদুর শাহ পার্ক, সদরঘাট টার্মিনাল, হাজারীবাগ, শান্তিনগর, মগবাজারসহ শহরের বিভিন্ন এলাকায় গণসংগীত, গণনাট্য অনুষ্ঠান, কবিতা পাঠের আসর, ছড়া পাঠের আসর ও পথসভার আয়োজন করে। অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানিদের নির্বিচার গুলিতে বাঙালি হত্যার প্রতিবাদে পাকিস্তান সরকারের খেতাব বর্জন করেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, শিক্ষাবিদ ইব্রাহীম খাঁ, কবি আহসান হাবীব ও কথাশিল্পী সরদার জয়েনউদ্দিন, সংগীতজ্ঞ আবদুল আহাদ প্রমুখ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২৮ জন শিক্ষক ৩ মার্চ এক বিবৃতিতে অভিযোগ করেন যে, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য শোষক শ্রেণি ও কায়েমি স্বার্থবাদী মহল দায়ী। বিভিন্ন ষড়যন্ত্র ও কারসাজির মাধ্যমে তারা শোষিত জনসাধারণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির দাবিকে নস্যাৎ করে দেয়ার চেষ্টায় লিপ্ত। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ জন শিক্ষক বাংলাদেশের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতি সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি প্রদান করেন। পূর্ব-পাকিস্তান সরকারি কলেজ শিক্ষক সমিতি বঙ্গবন্ধুর ভূমিকার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে এক বিবৃতিতে বলেন, তারা যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত।
পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন পূর্ব বাংলার স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে সামরিক আইন প্রত্যাহারের দাবি জানায়।
৩৩ জন চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, অভিনেতা-অভিনেত্রী ও সংগীত পরিচালক এক যুক্ত বিবৃতিতে ঘোষণা করেন যে, পূর্ব বাংলার ন্যায্য দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত চলচ্চিত্র সমাজ জনতার সংগ্রামের সঙ্গে থাকবে। উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী ১০ মার্চ বাংলার মুক্তি অন্দোলনের পটভূমিতে বাংলার সর্বস্তরের লোকদের কাছ থেকে গণমুখী সংগীত রচনা করার আহ্বান জানান। ‘স্বা ধী ন তা’- এই ৪টি অক্ষরকে বুকে নিয়ে চারুশিল্পী সংসদের উদ্যোগে রাজপথে শিল্পীদের মিছিল মুক্তির সংগ্রামে মানুষকে উজ্জীবিত করেছিল। ১২ মার্চ অনুষ্ঠিত চারু ও কারুশিল্প মহাবিদ্যালয়ের এক সভায় শিল্পীরা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রতীক জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আন্দোলনমুখী পোস্টার ফেস্টুনসহ মিছিলের আয়োজন করা প্রভৃতি কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাকে সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ও কলাকুশলীরা কালুরঘাটে স্থাপন করেন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’। পরবর্তীতে নাম থেকে বিপ্লবী শব্দটি বাদ দিয়ে ২৫ মে কলকাতার বালিগঞ্জ থেকে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’। সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যশিল্পী, গীতিকার, সুরকার, যন্ত্রশিল্পীসহ অন্যান্য শিল্পীও অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নিয়মিত অনুষ্ঠানের মধ্য উল্লেখযোগ্য ছিলÑ চরমপত্র, মুক্তিযুদ্ধের গান, সংবাদ, রণাঙ্গনের সাফল্যগাথা, বজ্রকণ্ঠ, নাটক, গীতি আলেখ্য, ইত্যাদি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল ‘চরমপত্র’। এম আর আখতার মুকুল উপস্থাপিত এই অনুষ্ঠানে পুরান ঢাকার আঞ্চলিক ভাষায় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে ব্যঙ্গ করে হাস্যকরভাবে উপস্থাপন করা হয়। এর পরিকল্পনায় ছিলেন আবদুল মান্নান। কল্যাণ মিত্রের পরিচালনায় পরিবেশিত হতো ‘জল্লাদের দরবার’ যেখানে ইয়াহিয়া খানকে ‘কেল্লা ফতে খান’ হিসেবে ব্যঙ্গাত্মকভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়। ‘বজ্রকণ্ঠ’ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের অংশবিশেষ সম্প্রচার করা হতো। যা বাঙালি জাতিকে নতুন করে উদ্দীপ্ত করত।

মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী দল
সংস্কৃতিকর্মী সনজিদা খাতুন ও ওয়াহিদুল হকের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’। যুদ্ধদিনগুলোতে নানারকম কর্মকা-ে ব্যস্ত ছিল তারা। শরণার্থী শিবির ও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পগুলোতে ট্রাকে করে ঘুরে ঘুরে মুক্তিযুদ্ধ ও দেশের গান শুনিয়ে তারা মুক্তিযোদ্ধা ও দেশের মানুষকে উদ্দীপ্ত করত। মার্কিন বিজ্ঞাপন নির্মাতা লিয়ার লেভিন এদের সঙ্গে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে ভিডিও চিত্রধারণ করেন। পরবর্তীতে সেই ফুটেজের ওপর ভিত্তি করে প্রয়াত চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ নির্মাণ করেন ‘মুক্তির গান’। এখানে উল্লেখ্য, ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার লিয়ার লেভিনকে ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ প্রদান করে।

বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সংস্থা
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হামলার প্রেক্ষিতে দেশের অনেক শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মী ভারতের ত্রিপুরার আগরতলাতে আশ্রয় নেয়। তাদের সম্মিলিত প্রয়াসে ১৯৭১ সালের ৩ জুন ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় গঠিত হয় বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সংস্থা। মুক্তিযোদ্ধা শিবির, শরণার্থী শিবির, যুব শিবিরসহ বিভিন্ন ক্যাম্পে মুক্তির গান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছে।

কনসার্ট ফর বাংলাদেশ
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য এগিয়ে আসে বিভিন্ন দেশের শিল্পীরাও। বিটলস ব্যান্ডের জর্জ হ্যারিসন এবং প্রখ্যাত সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশংকরের উদ্যোগে ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ারে প্রায় ৪০ হাজার দর্শকের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয় ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। আলি আকবর খান, আল্লা রাখা খান, কমলা চক্রবর্তী, বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, জর্জ হ্যারিসন, বিলি প্রিস্টন, লিয়ন রাসেল, ব্যাড ফিঙ্গার, রিঙ্গোস্টার, ক্লস ভোরম্যান, জিম কেল্টনারসহ বিশ্বের খ্যাতনামা সংগীতশিল্পীরা এই কনসার্টে অংশ নিয়েছিল।

বাংলাদেশ সহায়ক শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমিতি
ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে বাংলাদেশ সহায়ক শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমিতি। এই সমিতির সভাপতি ছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সহ-সভাপতি ছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সমর্থনে এবং নিরস্ত্র মানুষের ওপর বর্বোরোচিত নির্যাতনের প্রতিবাদে এই সংগঠনের ডাকে ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ কলকাতায় বনধ পালিত হয়। কলকাতার লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা মানবিক বোধ থেকেই বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে কলম ধরার তাগিদ অনুভব করেন। এই সংগঠনের হয়ে কলম ধরেছিলেন অন্নদাশংকর রায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, শংখ ঘোষ, নীরেন চক্রবর্তী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তরুণ সান্যাল, অমিতাভ দাশগুপ্ত, সৈয়দ মুস্তফা সিরাজসহ আরও অনেকে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সহযোগিতা করার জন্য এই সংগঠনের উদ্যোগে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতার বিড়লা একাডেমিতে বাংলাদেশের ১৭ শিল্পীর ৬৬টি শিল্পকর্মের একটি ঐতিহাসিক প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। পরবর্তীতে দিল্লিতেও এই প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। এই শিল্পকর্মগুলোতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতা, গণহত্যা, ধর্ষণ এবং প্রতিরোধের চিত্র তুলে ধরা হয়। শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন- মুস্তফা মনোয়ার, দেবদাস চক্রবর্তী, নিতুন কুণ্ডু, প্রাণেশ ম-ল, কামরুল হাসান, বীরেন সোম, হাসি চক্রবর্তী, আবুল বারক আলভী, গোলাম মোহাম্মদ, অঞ্জন বনিক, কাজী গিয়াসউদ্দিন, রঞ্জিত নিয়োগী, স্বপন চৌধুরী, চন্দ্র শেখর দে, বরুণ মজুমদার, নাসির বিশ্বাস, বিজয় সেন।

তিন
১৯৭১ সালে পাকহানাদার বাহিনীর নৃশংসতা থেকে লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিক-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীরাও রেহাই পায়নি। নির্মমভাবে তাদের হত্যা করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই পাকবাহিনীর আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্যবস্তু ছিল তারা। তবে ১৯৭১ সালের ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বর সময়টিতে এটি সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। এটি পরিকল্পিতভাবেই করা হয়েছিল। পরাজয় আসন্ন জেনে নীলনকশা অনুসারে পাকিস্তানি বাহিনীর সহায়তায় জামায়াতে ইসলামী কর্তৃক গঠিত আলশামস, আলবদর ও রাজাকার বাহিনী জাতির মেধাবী সন্তানদের নির্বিচারে হত্যা করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ একটি অকার্যকর ও পঙ্গু রাষ্ট্রে পরিণত হয় এবং স্বাধীনতা মুখ থুবড়ে পড়ে। সারাদেশে এ পর্যন্ত ৯৪২টি বধ্যভূমি শনাক্ত করা হয়েছে।
এ-সময় যেসব মেধাবী সন্তানদের হত্যা করা হয় তাদের মধ্যে ছিলেনÑ শহীদুল্লাহ কায়সার (সাংবাদিক), নিজামুদ্দীন আহমেদ (সাংবাদিক), সেলিনা পারভীন (সাংবাদিক), সিরাজুদ্দীন হোসেন (সাংবাদিক), আ ন ম গোলাম মুস্তফা (সাংবাদিক), আলতাফ মাহমুদ (গীতিকার ও সুরকার), ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (রাজনীতিবিদ), রণদাপ্রসাদ সাহা (সমাজসেবক এবং দানবীর), যোগেশচন্দ্র ঘোষ (শিক্ষাবিদ, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক), জহির রায়হান (লেখক, চলচ্চিত্রকার), মেহেরুন্নেসা (কবি), আবুল কালাম আজাদ (শিক্ষাবিদ, গণিতজ্ঞ), নজমুল হক সরকার (আইনজীবী), নূতন চন্দ্র সিংহ (সমাজসেবক, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক); চিকিৎসক : মোহাম্মদ ফজলে রাব্বি (হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ), আব্দুল আলিম চৌধুরী (চক্ষু বিশেষজ্ঞ), শামসুদ্দীন আহমেদ, হুমায়ুন কবীর, আজহারুল হক, সোলায়মান খান, আয়েশা বদেরা চৌধুরী, কসির উদ্দিন তালুকদার, মনসুর আলী, মোহাম্মদ মোর্তজা, মফিজউদ্দীন খান, জাহাঙ্গীর, নুরুল ইমাম, এস কে লালা, হেমচন্দ্র বসাক, ওবায়দুল হক, আসাদুল হক, মোসাব্বের আহমেদ, আজহারুল হক (সহকারী সার্জন), মোহাম্মদ শফী (দন্ত চিকিৎসক); ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক : গোবিন্দ চন্দ্র দেব (দর্শনশাস্ত্র), অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী (বাংলা সাহিত্য), মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (বাংলা সাহিত্য), আনোয়ার পাশা (বাংলা সাহিত্য), আবুল খায়ের (ইতিহাস), জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা (ইংরেজি সাহিত্য), সিরাজুল হক খান (শিক্ষা), এএনএম ফাইজুল মাহী (শিক্ষা), হুমায়ূন কবীর (ইংরেজি সাহিত্য), রাশিদুল হাসান (ইংরেজি সাহিত্য), সাজিদুল হাসান (পদার্থবিদ্যা), ফজলুর রহমান খান (মৃত্তিকা বিজ্ঞান), এনএম মনিরুজ্জামান (পরিসংখ্যান), এ মুকতাদির (ভূ-বিদ্যা), শরাফত আলী (গণিত), এআরকে খাদেম (পদার্থবিদ্যা), অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য (ফলিত পদার্থবিদ্যা), এম সাদেক (শিক্ষা), এম সাদত আলী (শিক্ষা), সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য (ইতিহাস), গিয়াসউদ্দিন আহমদ (ইতিহাস), রাশীদুল হাসান (ইংরেজি), এম মর্তুজা (চিকিৎসক); রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক : হবিবুর রহমান (গণিত বিভাগ), শ্রী সুখারঞ্জন সমাদ্দার (সংস্কৃত), মীর আবদুল কাইউম (মনোবিজ্ঞান)।
বাংলাদেশকে অকার্যর করতে শুধুমাত্র লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেই সেই ঘাতক চক্র চুপ করে বসে ছিল না। সদ্য স্বাধীন দেশের বিরুদ্ধেও তারা চক্রান্তে লিপ্ত থাকে। সেই একই চক্রান্তের ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতা সৈয়দ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন (অব.) এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামান-কে। হত্যা করা হয় হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা ও প্রগতিশীল নেতাকর্মীকে।
জাতির পিতার অবর্তমানে সাময়িকভাবে থমকে গেলেও সকল চক্রান্তকে নস্যাৎ করে বাংলাদেশ আজ আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আর এই ঘুরে দাঁড়ানোর অভিযাত্রায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা দেশরতœ শেখ হাসিনা। জাতির পিতার স্বপ্নকে বুকে ধারণ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের এক বিস্ময়কর রোল মডেল। তাই এই জাতি আজ গর্বভরে পালন করছে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী, উদযাপন করছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী।
পরিশেষে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যের অংশ দিয়েই লেখাটির পরিসমাপ্তি ঘটাতে চাই। ১৯৭১ সালের ২৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে পূর্ব পাকিস্তান শিল্পী-সমাজ প্রদত্ত সংবর্ধনা প্রদান অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, “ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির সমৃদ্ধি ছাড়া কোন জাতিই উন্নতি করতে পারে না। আমি যখন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির কথা বলি তখন সিন্ধি, পাঞ্জাবি, বেলুচি, পশতু তথা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ভাষা ও সাহিত্যের সমান সমৃদ্ধি কামনা করি। কারণ আঞ্চলিক পরিবেশ ও জনগণের ধ্যান-ধারণার ভিত্তিতেই সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতে পারে। ধর্মের নামে ভাড়াটিয়া সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়া মানুষের আত্মার স্পন্দনকে পিষে মারার-ই শামিল।”

লেখক : সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, উত্তরণ

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য