Sunday, September 24, 2023
বাড়িউত্তরণ-২০২২দ্বাদশ বর্ষ, পঞ্চম সংখ্যা, এপ্রিল-২০২২মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার: বৈশিষ্ট্য ও সাফল্য

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার: বৈশিষ্ট্য ও সাফল্য

এইচ. টি ইমাম: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জন্মলগ্ন ১০ এপ্রিল ১৯৭১। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র (Proclamation of Independence) হলো আমাদের ম্যাগনাকার্টা, স্বাধীনতার সনদ। এই ঘোষণায় সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে কেন, কোন্ ক্ষমতার বলে এবং পরিস্থিতিতে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হলো, যে-রাষ্ট্রের নাম হলো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ (People’s Republic)। যেহেতু এই সরকার মুজিবনগরে তার প্রধান দপ্তর স্থাপন করেছিল, তাই এর ব্যাপক পরিচিতি হলো ‘মুজিবনগর সরকার’ রূপে। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে এই সরকারের প্রধান কার্যালয় কলকাতায় স্থাপন করা হয় প্রধানত নিরাপত্তা এবং মুক্তিযুদ্ধে নির্বিঘœ নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে। আমাদের সরকারের বিভিন্ন কার্যাবলি পর্যালোচনা করলেই বোঝা যাবে কত ব্যাপক এবং সুসংগঠিত ছিল সরকারের কর্মসূচি এবং গঠন-কাঠামো।

বিপ্লবী প্রবাসী সরকার
পঁচিশে মার্চের ভয়াল রাতের পর আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি জেনারেল তাজউদ্দীন আহমদ, ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ২৭ মার্চ প্রথমে ঝিনাইদহ যান। সেখানকার এসডিপিও মাহবুব আহমদ এবং মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক এলাহী চৌধুরীর সহায়তায় তারা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। মার্চের ৩০ তারিখে পশ্চিম বাংলা সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ২ এপ্রিল দিল্লিতে গমন করেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাদের সর্বপ্রকার সাহায্য প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিলে তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের এমএনএ এবং এমপিএ-দের কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তে অধিবেশন আহ্বান করেন। অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে মুক্তিযুদ্ধ ও সরকার পরিচালনার জন্য মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয়। এই মন্ত্রিপরিষদ এবং এমএনএ ও এমপিএ-গণ ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি এবং বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়। তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও এএইচএম কামারুজ্জামান-কে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য নিয়োগ করা হয়। ১১ এপ্রিল এমএজি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। প্রধানমন্ত্রী ১১ এপ্রিল বাংলাদেশ বেতারে মন্ত্রিপরিষদ গঠনের ঘোষণা দেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিপরিষদ ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে শপথ গ্রহণ করেন।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার আকারে বিশাল না হলেও অত্যন্ত সুসংগঠিত ছিল। প্রচ- প্রতিকূলতার মধ্যে এই সরকার গঠন করে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে একদিকে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব, অন্যদিকে ১ কোটির ওপর শরণার্থীর জন্য ত্রাণব্যবস্থা দেশের অভ্যন্তর থেকে লক্ষ লক্ষ মুক্তিপাগল ছাত্র-জনতা যুবাদেরকে যুবশিবিরে পাঠিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে গেরিলা বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানিদের মধ্যে ত্রাসের সৃষ্টি, স্বাধীন বাংলা বেতারের মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ রাখা এবং সাথে সাথে সারাবিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিÑ এসবই ছিল প্রবাসী সরকারের অবিস্মরণীয় কীর্তি, যা সমকালীন ইতিহাসের বিচারে অতুলনীয়। সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতি-পদ্ধতি অনুসরণ করে যেভাবে রাষ্ট্রের শাসনকাজ পরিচালিত হয়ে থাকে তা থেকে যুদ্ধকালীন অস্বাভাবিক অবস্থায় দুটো বিষয়ে ব্যত্যয় করা হলোÑ
এক. অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি প্রতিটি মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে উপস্থিত থেকে সভাপতিত্ব করতেন।
দুই. যেহেতু অধিকাংশ বৈঠকে প্রতিরক্ষা এবং যুদ্ধ পরিচালনা বিষয়সমূহ মুখ্য আলোচ্য বিষয় থাকত, তাই কর্নেল ওসমানী প্রায় প্রত্যেক বৈঠকেই যোগদান করতেন। মূলত প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরেই সরকারের কাজকর্ম পরিচালিত হতো। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিল প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ, শিক্ষা, স্থানীয় প্রশাসন, শ্রম, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পরিকল্পনা। খন্দকার মোশতাক আহমেদকে দেওয়া হয়েছিল পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদীয় বিষয়। ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর ওপর দায়িত্ব ছিল অর্থ, জাতীয় রাজস্ব, বাণিজ্য ও শিল্প, পরিবহন। এএইচএম কামারুজ্জামান ছিলেন স্বরাষ্ট্র সরবরাহ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের গঠন : মন্ত্রণালয় ও দপ্তরসমূহ
তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব ১৯৭১ সালের ২০ অক্টোবর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংগঠন এবং কার্যাবলির ওপর একটি প্রতিবেদন পেশ করেন। এতে সরকারের কার্যাবলি সম্পর্কে একটা চিত্র পাওয়া যাবে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার নিম্নলিখিত মন্ত্রণালয়/বিভাগে সংগঠিত হয়েছিলÑ
১. প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ২. পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৩. অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ৪. মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয় ৫. সাধারণ প্রশাসন বিভাগ ৬. স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয় ৭. তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয় ৮. স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৯. ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয় ১০. সংসদ বিষয়ক বিভাগ ১১. কৃষি বিভাগ ১২. প্রকৌশল বিভাগ।
মন্ত্রণালয়ের বাইরে আরও কয়েকটি সংস্থা ছিল যারা সরাসরি মন্ত্রিপরিষদের কর্তৃত্বাধীনে কাজ করত, যেমনÑ
১. পরিকল্পনা কমিশন ২. শিল্প ও বাণিজ্য বোর্ড ৩. নিয়ন্ত্রণ বোর্ড, যুব ও অভ্যর্থনা শিবির ৪. ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটি ৫. শরণার্থী কল্যাণ বোর্ড।

বিভিন্ন অঙ্গ-সংগঠন
* যুব নিয়ন্ত্রণ পরিষদ ও প্রশিক্ষণ বোর্ড * বাংলাদেশ হাসপাতাল * স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র * জয় বাংলা পত্রিকা * বাংলাদেশ বুলেটিন * বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী সংগঠন * বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি * স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল * বঙ্গবন্ধু শিল্পী গোষ্ঠী * বাংলাদেশ তরুণ শিল্পী গোষ্ঠী * বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কুশলী সমিতি * বাংলাদেশ সংগ্রামী বুদ্ধিজীবী পরিষদ * নিউইয়র্ক বাংলাদেশ লীগ * বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটি, লন্ডন * লিবারেশন কাউন্সিল অব ইন্টেলিজেন্টসিয়া।

সরকারের নিজস্ব ভূখ- : বৈশিষ্ট্য ও সাফল্য
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার শুধুমাত্র প্রবাসী ছিল না। সরকারের সদর দপ্তর মুজিবনগরে হলেও দেশের অভ্যন্তরে বিস্তীর্ণ এলাকা যুদ্ধ চলাকালে শত্রুমুক্ত করা হয়েছিল। তাছাড়া দেশের অভ্যন্তরে বহু এলাকা শত্রুবাহিনী আদৌ দখল করতে পারেনি। সেসব অঞ্চল দীর্ঘ ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধকালে শত্রুমুক্ত ছিল। এসব অঞ্চলে সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা এবং জনগণ সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করেছিল। জনগণের আন্তরিক সহযোগিতা মুজিবনগর সরকারের অগ্রগতিতে বিপুল প্রাণসঞ্চার করেছিল। রংপুরের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে, উত্তরে, দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে যেসব এলাকা মুক্তিবাহিনী দখল করেছিল, তা মুক্তই রাখা হয়েছে সর্বশক্তি দিয়ে। শুধু তাই নয়, ক্রমান্বয়ে সেই মুক্ত-অঞ্চল সম্প্রসারণ করা হয়েছে। আমাদের লাল-সবুজ পতাকা যেখানে একবার উড্ডীন হয়েছে সেখানে আর নামেনি। রৌমারি মুক্ত এলাকার কথা প্রায় সবাই জানেন। সেখানে আমাদের আঞ্চলিক প্রশাসন সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। চিলমারী এবং দিনাজপুরের বড় অংশ মুক্ত ছিল। ফেনী-বেলোনিয়াতেও মুক্ত-অঞ্চল আমাদের বেসামরিক প্রশাসনের আওতায় ছিল।
বিদেশি সংবাদমাধ্যম, পত্র-পত্রিকার প্রতিনিধিরা মুজিবনগরে এসেই মুক্ত-অঞ্চল পরিদর্শনে যেতে চাইতেন। Time Magazine, Newsweek, Reader’s Digest, London Times, Guardian, New York Times, Washington Post, La Monde, Reuter, AFP, AP, অচ-সহ আরও অনেক সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা মুক্ত-অঞ্চল পরিদর্শন করে ফিরে এসে তাদের প্রতিবেদন ছেপেছেন। এসব প্রতিনিধিদের মুক্ত-অঞ্চল পরিদর্শনের যাবতীয় ব্যবস্থা বাংলাদেশ সরকারই করতেন।
প্রাসঙ্গিকভাবে মুজিবনগর সরকারের সদর দপ্তরে যে-শক্তিশালী প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল সে-সম্বন্ধে এখানে সংক্ষেপে পরিচয় তুলে ধরা আবশ্যক। প্রকৃতপক্ষে মুজিবনগর সরকারের সদর দপ্তর পশ্চিম বাংলার কলকাতায় অবস্থিত ছিল। সেনাবাহিনীর দপ্তরও একই সঙ্গে ছিল। সরকারের সদর দপ্তরে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী যোগ দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অনেক বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারী পূর্ব বাংলার সরকারি দপ্তর পরিত্যাগ করে সীমান্ত অতিক্রম করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত হন; সরকারের প্রশাসনেও দায়িত্ব¡ পালন করেন। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান থেকেও কিছু বাঙালি কর্মকর্তা পালিয়ে এসে মুজিবনগর সরকারে যোগ দেন। মুজিবনগর সরকারের শক্তিশালী প্রশাসন গঠনে যাদের অবদান অনস্বীকার্য তাদের কয়েকজনের নাম নিচে দেওয়া হলোÑ

মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তাদের নাম ও পদবি
১. খন্দকার আসাদুজ্জামান, সিএসপি; সচিব অর্থ, যুগ্ম-সচিব, অর্থ মন্ত্রণালয়
২. নূরুল কাদের, সিএসপি; সচিব সংস্থাপন; পাবনার ডিসি
৩. এমএ সামাদ (সিএসপি), সচিব প্রতিরক্ষা, সিলেটের ডিসি
৪. মাহবুবুল আলম চাষী, (প্রাক্তন পিএফএস), সচিব, পররাষ্ট্র
৫. আনোয়ারুল হক খান, সচিব তথ্য
৬. আবদুল খালেক, পিএসপি; সচিব স্বরাষ্ট্র ও ডিজি পুলিশ; অধ্যক্ষ, পুলিশ একাডেমি, সারদা
৭. ডা. টি. হোসেন, সচিব স্বাস্থ্য
৮. নূরুদ্দীন আহমেদ; সচিব কৃষি, প্রধান বন সংরক্ষক
৯. আবদুল হান্নান চৌধুরী, সচিব আইন; জেলা জজ, দিনাজপুর
১০. এমদাদ আলী, প্রধান প্রকৌশলী
১১. জিয়গোবিন্দ ভৌমিক, ত্রাণ কমিশনার
১২. রুহুল কুদুস, প্রাক্তন সিএসপি, মহাসচিব
১৩. ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, গণহত্যা ও স্নায়ুযুদ্ধ সেলের দায়িত্বে এবং
১৪. এইচ. টি ইমাম, সিএসপি; মন্ত্রিপরিষদ সচিব, (পার্বত্য চট্টগ্রামের ডিসি)
এছাড়া আবদুল মান্নান, এমএনএ বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও বেতারের দায়িত্বে ছিলেন। তাছাড়া তিনি মুক্তিযুদ্ধের মুখপাত্র ‘জয় বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদক পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন। যুবশিবির বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী, এমএনএ এবং পরিচালক ছিলেন উইং কমান্ডার মির্জা। পরিকল্পনা বোর্ড সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে ভিন্ন অধ্যায়ে।

আঞ্চলিক প্রশাসন
আঞ্চলিক প্রশাসন স্থাপনা ও পরিচালনা ছিল একটি সম্পূর্ণ নতুন চিন্তাধারার ফসল। পূর্ণাঙ্গ একটি সরকার প্রতিষ্ঠা, যার অধীনে আঞ্চলিক প্রশাসনসহ বিভিন্ন বিভাগীয় কার্যক্রম চালু থাকবে, যার ভিত্তি হবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং মূল লক্ষ্য হবে যুদ্ধে নিয়োজিত সেক্টর কমান্ড এবং মুক্তিবাহিনীকে সর্বাত্মক সাহায্য এবং সহযোগিতাÑ এই ছিল আমাদের ভাবনা। এই লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ১১ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ১১টি সেক্টরের সাথে ১১টি আঞ্চলিক পরিষদ (Zonal Councils) প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই পরিষদগুলোতে নির্দিষ্ট এলাকার নির্বাচিত এমএনএ/এমপিএ-রা এবং অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সদস্য ছিলেন। তাদের মধ্য থেকেই আবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এই কাউন্সিলকে প্রশাসনিক সাহায্য দেওয়ার জন্য একজন করে আঞ্চলিক প্রশাসনিক কর্মকর্তা (Zonal Administrative Officer) নিয়োগ করা হয়। সেইসাথে নিযুক্ত হন বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা। বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর শাসনভার গ্রহণ করার পূর্ব পর্যন্ত এই প্রশাসনিক কাঠামো কার্যকর ছিল।

যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্বাসনের জন্য কার্যকর কর্মসূচি
যুদ্ধে জয় আমাদের নিশ্চিতÑ এই বিশ্বাস থেকেই আমরা স্বাধীনতা-পরবর্তী বিভিন্ন সমস্যাবলি সম্পর্কে অগ্রিম চিন্তা-ভাবনা এবং কার্যকর কর্মসূচি (Plans and Programs) গ্রহণ ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছি। এই আগাম পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য ছিল-

ক. পুলিশ প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে আইনশৃঙ্খলা পুনস্থাপন;
খ. বেসামরিক প্রশাসন চালু করে সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা এবং
গ. ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা।
উপরে যেসব কর্মসূচি ও সাফল্যের কথা উল্লেখ করলাম তা সামগ্রিকভাবে বিচার ও বিশ্লেষণ করলে ৩টি বিষয় আমাদের সামনে সুস্পষ্ট হয়; এগুলো হচ্ছেÑ
(১) আইন ও শৃঙ্খলা এবং বেসামরিক প্রশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা (২) অর্থনীতি পুনর্গঠন (৩) গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। প্রতিটি ক্ষেত্রেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছিল।

অগ্রিম পরিকল্পনা : প্ল্যানিং সেল
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন সাফল্যের পেছনে যে-পদক্ষেপটি উল্লেখযোগ্য তা হলো পূর্ব-পরিকল্পনা প্রণয়ন। বিজয়ের অনেক আগে সরকার (মন্ত্রিপরিষদ সিদ্ধান্ত) ‘পরিকল্পনা সেল’ গঠন করেন। দেশের কয়েকজন বরেণ্য চিন্তাবিদ, অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষক এই সেলের সদস্য নিযুক্ত হন। এরা হলেনÑ (১) ড. মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী (২) ড. খান সরওয়ার মুর্শিদ (৩) ড. মুশাররফ হোসেন (৪) ড. স্বদেশ বোস ও (৫) ড. আনিসুজ্জামান। পরবর্তীকালে এই সেলকেই ‘পরিকল্পনা বোর্ডে’ রূপান্তরিত করা হয়। ড. মুজাফফর চৌধুরী ছিলেন চেয়ারম্যান। পরিকল্পনা সেল/বোর্ড দুই রকমের পরিকল্পনা হাতে নেনÑ একটি স্বল্পমেয়াদি (যা মূলত পুনর্বাসন পরিকল্পনা); অপরটি দীর্ঘমেয়াদি (যা হবে ভবিষ্যৎ অর্থনীতির ভিত্তি)।
গণহত্যা সেল
গণহত্যা সেল গঠন ছিল সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তৎপরতা। বাংলাদেশ হাইকমিশনে এই সেল প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রাথমিকভাবে দায়িত্বে¡ ছিলেন মওদুদ আহমদ। পরে রাষ্ট্রদূত ফাতেহ সাহেব এবং মোমেন সাহেব দায়িত্ব নেন। প্রতিটি অঞ্চলেরÑ (ুড়হব-এর) কর্মকর্তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল তারা যেন তথ্য সংগ্রহ করেন, সাক্ষী-সাবুদ প্রস্তুত রাখেন, পরবর্তীকালে আদালতে ব্যবহারের জন্য। দেশের ভেতরে এবং বিভিন্ন ক্যাম্পে ঘুরে ঘুরে প্রচুর তথ্য, সাক্ষী সংগ্রহ করা হয়। আমাদের মস্তবড় দুর্ভাগ্য যে, আমরা স্বাধীনতার পর এইসব তথ্য ও সাক্ষী-সাবুদ ব্যবহার করে গণহত্যার বিচার করতে ব্যর্থ হয়েছি।

উপদেষ্টা পরিষদ গঠন
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একটি বিশেষ প্রচেষ্টা ছিল স্বাধীনতাযুদ্ধে ধর্ম-দল-মত নির্বিশেষে সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে তাদের সমর্থনে যুদ্ধ পরিচালনা করা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সব কয়টি আসনে জয়লাভ করলেও, স্বাধীনতাযুদ্ধে ন্যাপ (ভাসানী), ন্যাপ (মোজাফফর), কংগ্রেস ইত্যাদি দলও প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে। এই কারণে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তাদের সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট ছিলেন। মুজিবনগর সরকারের আন্তরিক চেষ্টায় সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা সম্ভব হয়। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, প্রফেসর মোজাফফর আহমদ, মণি সিং, শ্রী মনোরঞ্জন ধর প্রমুখ ছিলেন এই উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য।

বঙ্গবন্ধুর মুক্তিলাভের জন্য বিশ্বব্যাপী প্রচার, পাকিস্তানের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ
পাকিস্তানি দস্যুদের কবল থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করার জন্য কতভাবেই-না চেষ্টা করেছে মুজিবনগর সরকার। সরকারের মন্ত্রিপরিষদের দুটি সভার সিদ্ধান্ত দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরলেই এ-কথা বুঝা সহজ হবে যে, বঙ্গবন্ধুর জন্য মুজিবনগর সরকারও কত উদ্বিগ্ন ছিল। ১৯৭১ সালের ২ মে তারিখে গৃহীত একটি সিদ্ধান্তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ে চাপ সৃষ্টির ওপর জোর দেওয়া হয়। যখন মুজিবনগর সরকার বিভিন্ন সূত্রে জানতে পারে যে, পাকিস্তানি কারাগারে বঙ্গবন্ধু বন্দী আছেন এবং তার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার প্রহসনমূলক বিচার করার আয়োজন করা হয়েছে তখন উদ্বিগ্ন প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিপরিষদের সভায় নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত নেন : জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সকল পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হলো। আবার ৫ মে তারিখে সংবাদ মাধ্যম, গোয়েন্দা মাধ্যম ও কূটনৈতিক মাধ্যমে প্রাপ্ত সংবাদের ভিত্তিতে মন্ত্রিপরিষদের সভায় নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ­­­ মন্ত্রিপরিষদ এই মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থান সম্বন্ধে অবহিত হওয়ার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিতে হবে। পাকিস্তান সরকারের দাবি অনুযায়ী মহান নেতার গ্রেফতারের খবর সত্যি হলে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার সম্ভাব্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসন বন্ধ করার অনুরোধ জানিয়ে মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে নিবিড় কূটনৈতিক তৎপরতা ছাড়াও প্রচার মাধ্যমেরও সহায়তা নেওয়া হয়েছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন সরকার, বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত, ব্রিটেন ইত্যাদি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এবং রেডিও টেলিভিশনের মাধ্যমে জনমত সৃষ্টি করে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। এ-কথা তো সকলেরই জানা যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট পদগর্নি ব্যক্তিগত পর্যায়ে পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে এ-বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। এসবই মুজিবনগর সরকারের কর্মতৎপরতার ফল ছিল।

বৈদেশিক নীতি ও স্বীকৃতি আদায়
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ কেন? এটা বহির্বিশ্বে প্রচার করা এবং এর প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি এবং সম্ভব হলে স্বীকৃতি আদায় করাও ছিল আমাদের অন্যতম লক্ষ্য। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে, ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে আমাদের দেশের প্রতি, বাঙালির প্রতি যে-সহানুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল, তা প্রবাসী সরকারের বিভিন্নমুখী প্রচেষ্টার ফলেই। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার যে সে-দেশের একমাত্র বৈধ সরকার, তা অধিকাংশ দেশ ও সরকারের কাছে স্পষ্ট হতে বেশি সময় লাগেনি। তার কারণ আমাদের নৈতিক ও আইনগত ভিত্তি এবং পাকিস্তানিদের গণহত্যা। পাকিস্তান ও তার দোসরদের ব্যাপক অপপ্রচার সত্ত্বেও আমাদের সরকারের প্রতি সহানুভূতি ও নৈতিক সমর্থন বিশ্বব্যাপী গড়ে উঠেছিল, তার প্রধানতম কারণ ছিল আমাদের প্রবাসী সরকারের স্বাধীন ও সার্বভৌম নীতিসমূহ এবং কার্যকলাপ।

সেনাবাহিনী পুনর্গঠন, শক্তি বৃদ্ধি, সশস্ত্র বাহিনী প্রতিষ্ঠা
মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যে কয়টি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্যাটালিয়ান ছিল তাদের পাকিস্তানিরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বিচ্ছিন্ন ও শক্তিহীন করে ফেলার অপচেষ্টা চালিয়েছিল। ঐ কঠিন সময়ে দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে আমাদের বাঙালি অধিনায়করা যে যেখানে পেরেছেন সেখানেই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন অধীনস্থ সেনাদের নিয়ে। অন্যান্য পাকিস্তানি ইউনিটে যে সমস্ত বাঙালি অফিসার ও সেনা ছিলেন তারাও হাতিয়ার তুলে নিয়ে সুবিধামতো স্থানে মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করেন। এছাড়াও ছিলেন মুক্তিবাহিনীতে ইপিআর, পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্য। বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীও পিছিয়ে ছিলেন না। এই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাহিনীকে গড়ে তোলার দায়িত্ব নেন কর্নেল এমএজি ওসমানী। তাকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সাহায্য করেন গ্রুপ-ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। কর্নেল রবও ডেপুটি চিফ অব স্টাফ ছিলেন; কিন্তু তার কোনো সক্রিয় ভূমিকা লক্ষ করা যায়নি।
মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন সিনিয়র অফিসার, পরবর্তীতে যারা সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন যোগ্যতা এবং বীরত্বের সাথে, তারা প্রথমে বিচ্ছিন্ন থাকলেও অতিসত্বর নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অধীনস্থ সেনা কমান্ডের নেতৃত্বে চমৎকার শৃঙ্খলার সাথে চেইন অব কমান্ড স্থাপন করেন। পারস্পরিক সমঝোতার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন আমাদের কমান্ডারবৃন্দ। মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর সফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর মীর শওকত আলী, ক্যাপ্টেন রফিক, মেজর মঞ্জুর, মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, মেজর সিআর দত্ত, মেজর নূরুজ্জামান (অব.), মেজর তাহের, উইং কমান্ডার বশর, মেজর জলিল, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হামিদুল্লাহÑ এদের সকলের নামই করতে হয় একসাথে। এই সেক্টর কমান্ডারদের সাথে অনেক সাব-সেক্টর কমান্ডারও তাদের বীরত্ব, সাহস আর দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন মুক্তিযুদ্ধে। এদের মধ্যে তৎকালীন ক্যাপ্টেন শাফায়ত জামিল, মেজর হায়দার, ক্যাপ্টেন মতিন, মেজর মইনুল, ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান, মেজর শামসুদ্দিন, ক্যাপ্টেন ভুইঞা, লেফটেন্যান্ট ইমামুজ্জামান, স্কোয়াড্রন লিডার সদরুদ্দীন, ক্যাপ্টেন অলি আহমেদ, মেজর জাফর ইমাম, ক্যাপ্টেন মাহফুজ, ক্যাপ্টেন মেহেদী আলী ইমাম, ক্যাপ্টেন আবদুস সালেক চৌধুরী, মেজর আমিনুল হক, ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন এমএ গাফফার, মেজর জিয়াউদ্দীন প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এদের পাশাপাশি নৌ কমান্ডো অফিসারদের কথাও অবশ্যই মনে রাখতে হবে। আরও অনেক, অনেক সেনানায়ক ছিলেন যাদের স্মৃতি মুক্তিযুদ্ধে স্মরণীয়। এইসব বীরের স্মৃতি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। বাংলাদেশ সরকারের আরেকটি সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ ছিল সামরিক বাহিনী গঠনের জন্য নিজস্ব ‘অফিসার কোর (core)’ তৈরি করা। এই লক্ষ্যে মুক্তিবাহিনী থেকে বাছাই করে প্রথম অফিসার ক্যাডেট নিয়োগ করা হয়। মুর্তী নামক একটি জায়গায় অস্থায়ী মিলিটারি কলেজ স্থাপন করা হয়। নভেম্বর মাসের কোনো একসময় প্রথম ব্যাচের পাসিং আউট প্যারেড (Passing out Parade) অনুষ্ঠিত হয়। সালাম গ্রহণ করেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। সাথে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ।

লেখক : মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য