ছোট্ট উঠোনটুকু কয়েক কদমে ফুরিয়ে যায়। আচমকা পাহাড় ছুঁয়ে আসা বুনো বাতাসের একটা ঝাপটা আছড়ে পড়ে আলিমার মুখে। বিদ্যুৎতাড়িতের মতো কেঁপে ওঠে সে। জজমিয়াকে বিভ্রান্ত করে সে ছুট লাগায় পেছনে। দু-হাতে আঁকড়ে ধরে নিজের শেকড়।
মিলা মাহফুজা: থরথর করে কেঁপে উঠল মেঝে! ঝনঝন করে কাচের দরজা-জানলা ভেঙে পড়ছে! পুরো বাড়িটাই ভয়ংকরভাবে দুলছে! এখনই হুড়মুড়িয়ে মুখ থুবড়ে পড়বে! কারা যেন চিৎকার করছে। কানে খুব চাপ লাগছে। দু-হাতে কান চেপে ধরে আলো। দুদিকে মাথা নাড়ায়। আর চিৎকার করে ওঠে, না। না, না, না।
একটানা চিৎকার করে করে একসময় থামে সে। ধপ করে বসে পড়ে সোফায়। মাথাটা নুয়ে পড়ে হাঁটুর ওপর। বড় বড় করে শ্বাস নিচ্ছে। পিঠ ফুলে ফুলে উঠছে হাঁপরের মতো।
কিছু সময় পরে শান্ত হয়ে আসে তার দেহ। মনও। সোজা হয়ে সামনের দিকে তাকায়। বিবর্ণ মুখটাই প্রথমে চোখে পড়ে। ভয়ে কুঁকড়ে আছে। একটু স্থির দৃষ্টিতেই দেখে তাকে। ভয়ার্ত সেই দৃষ্টির সামনে ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে সোজা চলে যায় নিজের ঘরে। দরজাটা খোলাই থাকে। সবই তো আজ খোলা হয়ে গেছে, আড়াল করার কিছু নেই। কিছুই নেই। দরজা বন্ধ করে কী হবে?
বিছানার দিকে তাকিয়ে অসম্ভব শ্রান্তি বোধ করে, লুটিয়ে পড়ে আলো। এসি আগেই চালু করা ছিল, ঘরটা বেশ ঘন ঠাণ্ডা হয়ে আছে। তপ্ত মুখে আরাম ছড়াচ্ছে। চোখ বন্ধ করল। সব ভাববে পরে। এখন সে ঘুমাবে। উঠে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে একটা বালিশ বুকে জড়িয়ে নেয়। এভাবেই অভ্যেস। চার দিনের ঘুম বকেয়া আছে, তার কিছুটা এখন আলোর চায়-ই চায়। চোখের ওপর হাত চাপা দেয় অন্ধকার প্রগাঢ় করতে।
কিছুক্ষণ পরে টের পায় বালিশ ভিজে গেছে অনেকটা। চটচট করছে গাল। বালিশটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উঠে বসে। আরাম লাগে না। ঢোকে বাথরুমে। একটা লম্বা শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে আসে। ঘরের দরজা খুলে সোজা চলে যায় যেখান থেকে উঠে এসেছিল, সেখানেই।
সালমা আলী অবাক হয়ে তাকে দেখেন। খুব ইচ্ছে করে দু-হাত বাড়িয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরতে। পারেন না। সংকোচ হয়। প্রত্যাখ্যানের ভয় হয়।
আলিমা আলো অনেকটাই কাছে দাঁড়িয়ে অনুচ্চ স্বরে বলে, সরি। এ-রকম করা উচিত হয়নি।
সালমা আলী হতবাক। কী বলবেন? কোনো শব্দ তার মনে আসে না।
আলিমা আরও একবার বলে, সরি। খুব সরি।
সালমা আলী উঠে দাঁড়ান। হাত দুটো ওঠানোর আগেই আলো ফিরে যায় তার ঘরে। সালমা আলী দরজা লক করার শব্দের জন্য কান পেতে থাকেন। শুনতে পান না। মনে পড়ে, কানে কম শুনছেন ইদানীং।
আবার বসে পড়েন। না, অতটা কষ্ট তিনি পাচ্ছেন না। তিন মাসের প্রস্তুতি ছিল। প্রতিক্রিয়া কতটা হবে সেটি নিয়েই চিন্তিত ছিলেন। এখন একটু স্বস্তিই লাগছে।
দুদিন পর, আলিমা বলল, আমার ধারণা ঠিকানাটা তোমাদের কাছে আছে।
সালমা আলী সংশয় নিয়ে উত্তর দিলেন, আছে। বহু পুরনা। সেটি এখন ঠিক হবে কী না জানি না।
ওবায়দুল আলী বললেন, গ্রামের ঠিকানা কমই বদল হয়। সম্ভাবনা আছে ঠিক থাকার।
আলিমা বলল, আমাকে দিও।
হলুদ রং ধরা একটা টুকরো কাগজ হাতে দিলেন সালমা আলী। ভাঁজে ভাঁজে ক্ষয়ের চিহ্ন। খুলতে গেলে আস্ত থাকবে না হয়তো। বিহ্বল হাতে কাগজটা নিয়ে উঠে চলে গেল আলিমা।
সালমা এবং ওবায়দুল নাস্তার প্লেট ঠেলে রেখে চায়ের কাপ টেনে নিলেন। ওবায়দুল অনেকটাই স্বাভাবিক। তিনি সালমাকেও শান্ত থাকতে বলেছেন বারবার। তারপরও জানেন, বলা সহজ, করা কঠিন। সালমা তবু ততটাও ভেঙে পড়েননি। ভেতরের ভাঙচুরটা তো আর তেমন বোঝা যায় না বাইরে থেকে। বাইরে সুস্থ আছেন, স্বাভাবিক জীবনযাপনের চেষ্টা করছেন। আলিমার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। একদম ভেঙেচুরে গেছে। কিন্তু যা করেছেন, তা করতেই হতো, বিকল্প কিছু নেই। ওবায়দুল সময়ের হাতে পরিস্থিতি ছেড়ে দিয়েছেন।
সপ্তাহখানেক পরে, আলিমা শান্ত হয়ে এলো। কিন্তু ইতোমধ্যে সে একটা সিদ্ধান্তে মোটামুটি পৌঁছেই গেছে। তবু কোথায় যেন পিনের খোঁচা তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। সালমা আলী কিছুই লুকাননি। তারপরও বলেছেন, জজমিয়াও জানে সব কিছুই।
জজমিয়া আগে বাড়ির ড্রাইভার ছিল। পারকিন্সনস হওয়ার পর সে স্বেচ্ছায় দারোয়ানের কাজ নিয়েছে। বয়সের তুলনার বৃদ্ধ দেখায়। কোনো কথা মনে রাখতে পারে না। সে কতটা মনে রেখেছে তা নিয়ে আলেমার সন্দেহ প্রবল। তবু তার সাথেই কথা বলল আলেমা।
জজমিয়া শুনেই মাথা নামিয়ে চুপ করে থাকল অনেকক্ষণ। সে আর মাথা তোলেই না। আলিমা অধৈর্য হয়ে তাগাদা দিতে যাচ্ছিল, তখন সে ধীরে ধীরে মাথা তুলল। হতাশায় কালো দেখাল তাকে। বলল, এতকাল পরে এসব কি জানার প্রয়োজন আছে, আলো মা?
– আছে। তীব্র কঠোর গলা আলিমার।
জজমিয়া এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে শেষ করে। আকাশের দিকে তাকায় একবার। বিড়বিড় করে কী যেন বলে। তারপর যেন সেই সময়ে বসে টাটকা খবর শোনায়।
নতুন কিছু হবে না আলিমা জানত। দরিদ্র পরিবার, অনেকগুলো মেয়ে আগেই ছিল। নতুন আরেকজনকে জায়গা দেওয়ার জায়গাও নেই ঘরে, সংসারে। বাসাবাড়িতে কাজের মেয়ে সাপ্লাই দেওয়া হাসনাহেনাই নতুন পথ দেখায়। বড়লোকের বাড়িতে মেয়ে ভালো থাকবে। আর… ওই আরটাই আসল। ব্যাগ ভরে টাকাও দেবে। হাসিমুখেই মেয়ের দাবি ছেড়ে দেওয়ার মুচলেকায় টিপ ছাপ দিয়েছে মেয়ের বাপ। পরে মেয়ের কথা মনে পড়েছে কী না কে জানে! ঢাকা শহরে এসে মেয়ের খোঁজ নেওয়ার মতো সামর্থ্য-সাহস কোনোটাই ছিল না। তাছাড়া, যোগাযোগ না করার জন্য জজমিয়া তাদের বলে এসেছিল। এক গাছের বাকল অন্য গাছে সহজে লাগে না, লাগলেও দেরি হয়। দেরি সহ্য করতে হয়। এ-সময় কোনোরকম দোটানা হলে আর লাগবেই না। তাই নিজের বুদ্ধিমতো আসতেই বারণ করে দিয়েছে। আরও তো একগণ্ডা মেয়ে ঘরে আছে, তাদেরই ভালো করে দেখভাল করুক। টাকাগুলোর যোগ্য শ্রাদ্ধ হয় তাহলে। হাসনাহেনা অকালে ক্যানসারে মরে গিয়ে যোগসূত্রটা পুরোপুরি কেটে দিয়েছে।
জজমিয়ার কাছাকাছি হাঁটাহাঁটি করতে করতে শুনছিল আলিমা। এতটা গোছানো কথা সে আশা করেনি। এই ভুলোমনা লোকটা এতদিন আগের কথা এত ডিটেইলসে মনে রেখেছে কী করে!
জজমিয়া যেন তার মনের কথা পড়তে পারে। ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত একটা হাসি ফুটিয়ে বলে, আমার মায়েও আমাকে খালার কাছে পালতে দিছিল, খাওয়াইতে না পাইরা। আমি খালারে মা ডাহি।
আলিমা শান্ত। তার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে। পুরাতনে ফিরে যেতে পারবে না বাকল। তবু একবার দেখে নেওয়া। যা শুনেছে, তার ব্যতিক্রম হওয়ার কোনো কারণ নেই। ঊনত্রিশ বছর আগে পাওয়া লাখ টাকা দিয়ে কি জীবনের চেহারা বদলাতে পেরেছে?
সালমা চায়ে চুমুক দেবেন ভাবছিলেন, আলো তৈরি হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে কাছে বসল। সালমা ওর হাত দুটো হাতের ভেতর নিয়ে রোজকার অভ্যেসে চুমু দিলেন কয়েকটা। ঘরের বাইরে বেরোবার আগে বরাবর এটা করেন তিনি। ধীরে ধীরে বললেন, আজ আনবিরের বাবা-মায়ের আসার কথা ছিল।
– বারণ করেছি।
– আনবিরকে জানিয়েছ? উদ্বেগ গোপন করে জিজ্ঞেস করলেন সালমা।
– ওকে এখনও কিছু বলিনি। তুমি কিছু জানিও না।
– কিন্তু জানাতে তো হবে।
– ঘুরে আসি। পরে জানাব।
আলিমা উঠে দাঁড়ায়। তার হাত দুটো তখনও সালমার হাতের ভেতর। অন্যদিনের মতো আলগা হয়ে আসেনি। আলোর চোখের কোণা ভিজে ওঠার আগেই সে হাত টান দেয়। সালমা উঠে দাঁড়িয়ে হাত ছেড়ে দেন। মুখে মৃদু হাসি, চোখে টলটলে জল।
– সাবধানে যেও।
আলিমা মাথা নাড়ল।
হাইওয়ে উঠেই জজমিয়া বলল, এতকাল পরে রাস্তা চিনবার পারুম না, আলো মা।
– অসুবিধা নেই। গ্রামের নাম চুনিয়া, থানা ধোবাউড়া। চলেন আমি নিয়ে যাচ্ছি।
– হ, চাইর মুড়া পাখাড়। উচা নিচা জায়গা। খেতি করার জায়গা নাই। পাখাড়ে ফলফলাদির গাছ করে। নদী আছে, নদীর তন মাছ ধরে। আর কুনো খাদ্য-খাবার নাই।
জজমিয়ার কথা শুনতে শুনতে চোখ পড়ে ভিউ মিররে। হঠাৎই সে দেখে তার নাকটা কিছুটা বোঁচা ধরনের। মুখের উপরতল চ্যাপ্টা! আশ্চর্য এতদিন তো কখনও এমন মনে হয়নি! অন্য কেউও বলেনি। না-কি তার বিভ্রম হচ্ছে! হাতব্যাগ থেকে কসমেটিক মিরর বের করে মুখের সামনে ধরল আলো, ঠিক সেই মুহূর্তে গাড়িটা লাফিয়ে উঠল আকাশপানে। উঁচু গতিনিরোধক লক্ষ করেনি ড্রাইভার। ধাতস্থ হয়ে খেয়াল হলো আয়নাটা হাতে নেই। সেটি খোঁজার ইচ্ছে করল না।
হাইওয়ে ছেড়ে ডিস্ট্রিক বোর্ডের রাস্তায় গাড়ি চলছে। ধীরে ধীরে ভূ-প্রকৃতি বদলাচ্ছে। দূরে দিগন্ত রেখার দিকে পাহাড়ের আবছায়া। বুকের ভেতরে আছড়ে পড়ছে উত্তেজনা। উতপ্ত হয়ে উঠছে মুখমণ্ডল। খাঁড়া হয়ে গেছে পিঠ।
পথচারীদের জিজ্ঞেস করে চুনিয়া গ্রামের পথে এসে পড়ল গাড়ি। মিলল চানমালিকের খোঁজও। গাড়ি ছেড়ে পায়ে হেঁটে চানমালিকের বাড়ির উঠোনে যখন দাঁড়াল তখন আলিমা খুবই শান্ত। মুখ থুবড়ে পড়া টিনের একটি ঘর, কয়েকটা কলা আর পেঁপেগাছ ঘেরা ছোট্ট উঠোনে কয়েকটা মুরগি ঘুরছে- এই সব দেখল। বাড়িতে আর কেউ ছিল না। ওদের সাড়া পেয়েই হয়তো ঘরের পেছন থেকে এগিয়ে আসে একজন। পরনের শাড়ি দেখে বুঝতে হয় সে নারী। কেবল হাড় সর্বস্ব শরীরে নারী দেহের বৈশিষ্ট্য অদৃশ্য। সম্ভবত চোখেও ভালো দেখতে পায় না। ওদের অনেকটাই কাছে চলে আসে, পথ থেকে সংগ্রহ করা স্বেচ্ছাগাইড চেঁচিয়ে বলে, তুমারে হেরা বুলাইছে।
মহিলা বিহ্বল মুখে মাথা নাড়ে। কিছুক্ষণ মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবাইকে দেখে। তারপর আবার মাথা নাড়ে।
গাইড আবার বলে, তুমারে হেরা বুলাইছে।
মহিলা আরও কিছুক্ষণ তাদের দিকে তাকিয়ে থেকে কিছুই না বলে ঘুরে গিয়ে ঘরের দাওয়ায় পা ঝুলিয়ে বসে। যেন তার সামনে কেউ নেই। বয়সের ভাঁজ ফেলা মুখ নির্বিকার।
স্বেচ্ছাগাইড বিব্রত হয়ে বলে, আর কাউরে তো দেহিও না।
জজমিয়া পেছন থেকে এক এগিয়ে এসে বলে, আর কাউরে লাগব না।
আলিমা তার দিকে তাকায়। জজমিয়া মাথা নিচু করে।
আলিমা নিশ্চল পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। তার দৃষ্টি বয়সী মহিলার পিছন দিয়ে দিগন্তে হারিয়ে থাকে। তারপর হঠাৎ ঘুরে বলে ওঠে, চলেন, জজচাচা।
ছোট্ট উঠোনটুকু কয়েক কদমে ফুরিয়ে যায়। আচমকা পাহাড় ছুঁয়ে আসা বুনো বাতাসের একটা ঝাপটা আছড়ে পড়ে আলিমার মুখে। বিদ্যুৎতাড়িতের মতো কেঁপে ওঠে সে। জজমিয়াকে বিভ্রান্ত করে সে ছুট লাগায় পেছনে। দু-হাতে আঁকড়ে ধরে নিজের শেকড়।
লেখক : কথাসাহিত্যিক