Monday, October 2, 2023
বাড়িSliderমঙ্গল শোভাযাত্রা ও বর্ষবরণ

মঙ্গল শোভাযাত্রা ও বর্ষবরণ

শুভ নববর্ষ। বাঙালির কৃষ্টি ও চেতনার নাম পহেলা বৈশাখ। ১৪২৮-এর খোলস পাল্টে বাংলা পঞ্জিকায় ১৪২৯। সূচনা হয় বাংলা নববর্ষের। বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাস বৈশাখের ১ তারিখ বা বঙ্গাব্দের প্রথম দিন, তথা বাংলা নববর্ষ। বাংলার চিরকালীন ইতিহাস, সার্বজনীন উৎসব ও ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণের দিন পহেলা বৈশাখ। রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের মঙ্গল শোভাযাত্রার গল্প সাজিয়েছেন- শাহ্ সোহাগ ফকির

“মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।”

কবির এই পঙ্ক্তি যেন স্মরণ করিয়ে দেয় বাংলা নববর্ষের আগমন ঘটেছে। বিদায় ১৪২৮, স্বাগত ১৪২৯। পুরাতনকে ভুলে নতুন সূর্যোদয়ের সাথে সাথে পাতায় ঠাঁই নেয় নতুন আরও একটি বছর। চৈত্রের শেষ রাতের প্রহর পেরিয়ে সূর্য উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রবাদনের মধ্য দিয়ে রমনার বটমূলে সূচনা হয় ছায়ানটের বর্ষবরণ ১৪২৯-এর অনুষ্ঠান। চিরচেনা আমেজে এর পরপরই পরিবেশন করা হয় সম্মেলক কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত ‘মন, জাগ মঙ্গললোকে’। সুরের মূর্ছনায় অনবদ্য সৃষ্টি হয় রমনার বটমূলে। ছায়ানটের বর্ষবরণের এ অনুষ্ঠান সাজানো হয় ৩৭টি আয়োজন দিয়ে। এর মধ্যে পঞ্চকবির গান, ব্রতচারীদের ‘বাংলা ভূমির প্রেমে আমার প্রাণ হইল পাগল’, লোকগান ‘নাও ছাইড়া দে মাঝি, পাল উড়াইয়া দে’ প্রভৃতি গান। সঙ্গে ছিল আবৃত্তি পাঠের মতো বিষয়গুলোও। এবারের পরিবেশনে অংশ নেওয়া শিল্পী সংখ্যা ৮৫। শিল্পীদের এই সংখ্যা আগে ছিল প্রায় দেড়শ’। এবারের পহেলা বৈশাখের আয়োজন করোনা মহামারির কারণে দু-বছর বন্ধ থাকার পর সাড়ম্বরে উদযাপন হয়। তাতে সবার মাঝে বিরাজ করে অন্যরকম আনন্দ। রাজধানীসহ সারাদেশে এবার বর্ণিল আয়োজনে হয় বাংলা নববর্ষ ১৪২৯ উদযাপন। বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে রমনার বটমূলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মুখোশ পরে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। এছাড়া মঙ্গল শোভাযাত্রায় নিরাপত্তার চাদরে মুড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রত্যেককে চেক করে ঢুকানো হয় নিñিদ্র নিরাপত্তার মাধ্যমে রমনার বটমূলে। অনুষ্ঠানস্থলের চারপাশ ঘিরে ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকায় এবার স্বাভাবিক সময়ের মতোই মঙ্গল শোভাযাত্রা ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এছাড়া করোনা পরিস্থিতি আবার আগের মতো হতেও পারে, তাই সামাজিক দূরত্বের বিষয়টিও ছিল। এছাড়া ছায়ানটকে রমনার বটমূলে সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান করার অনুমোদন দেওয়া হয়। বাংলাদেশে প্রতি বছর নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে পালন করা হয় বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ। আর এই আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল পহেলা বৈশাখের নতুন ভোরে রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান, সম্মিলিত গানের মাধ্যমে নতুন বছরকে আমন্ত্রণ জানানো এবং পহেলা বৈশাখের সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের মঙ্গল শোভাযাত্রা। এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রা সকাল ৯টায় টিএসসি থেকে শুরু হয়ে স্মৃতি চিরন্তন আবার টিএসসিতে এসে শেষ হয়। প্রতি বছরের মতো পহেলা বৈশাখের সকালে বাদ্যযন্ত্রের তালে নানা ধরনের বাঁশ-কাগজের তৈরি ভাস্কর্য ও মুখোশ হাতে বের হয় বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা।
এ বছর পহেলা বৈশাখে রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান যেমন বর্ণিল ছিল, তেমনি বর্ণিল ছিল চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রাও। রমনার বটমূলে রাগালাপ ও সংগীতে শুরু হয় ছায়ানটের বর্ষবরণের আয়োজন। ছায়ানটের শিল্পীরা চৈত্র সংক্রান্তির আগেই মহড়া শেষ করে। তারপর শুরু হয় বর্ষবরণের পালা। ভোর থেকে রমনার বটমূলে হাজির হতে শুরু করে শিল্পীরা। তাদের সাথে যুক্ত হয় সংস্কৃতিপ্রেমী বাঙালিরাও।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের আয়োজনে ‘তুমি, নির্মল করো, মঙ্গল করে, মলিন মর্ম মুছায়ে’ প্রতিপাদ্যে অনুষ্ঠিত হয় এ বছরের বাংলা বর্ষবরণের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা ১৪২৯’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের একদল শিক্ষার্থীর হাতে তৈরি হয় এবারের বর্ষবরণের মঙ্গল শোভাযাত্রার পাখি, মুখোশ, প্যাঁচা ও পুতুল, বড় ঘোড়া, ফোক মোটিফ, টেপা পুতুল ও মাছের প্রতিরূপ। অন্যদিকে রমনার বটমূলে প্রভাতি অনুষ্ঠানে এ বছর ‘নব আনন্দে জাগো’ প্রতিপাদ্যে সকাল সাড়ে ৬টা থেকে বটমূলে রাগালাপ ও বৈশাখী সংগীতানুষ্ঠান করে ছায়ানট। বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে মানব সমাজ আজ হয়ে উঠেছে আলোর পথের অভিযাত্রী। তারই সূত্র ধরে বাঙালির এবারের বর্ষবরণের আয়োজন। করোনা মহামারির সময়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে এবং রাষ্ট্রীয় বিধান মান্য করে ছায়ানট গত দু-বছর বর্ষবরণের অনুষ্ঠান স্বল্প পরিসরে অনলাইনে আয়োজন করেছিল। এদিকে চারুকলার বর্ষবরণের মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি কার্যক্রম গত ৩১ মার্চ থেকে শুরু হয়। এই আয়োজনে তহবিল সংগ্রহের অংশ হিসেবে জয়নুল গ্যালারিতে শুরু হয় সপ্তাহব্যাপী ‘আর্ট ক্যাম্প’ কর্মসূচি। মঙ্গল শোভাযাত্রার কর্মযজ্ঞের ব্যয় মেটাতে কোনো করপোরেট প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা চাওয়া হয়নি। এ সব আয়োজনে শিক্ষকরা অনেক ছবি আঁকেন। সেসব ছবি বিক্রির অর্থ দিয়ে ব্যয় নির্বাহ করা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রার।
এছাড়াও পুরান ঢাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজন করে মঙ্গল শোভাযাত্রার। করোনার পরে এ বছর ‘প্রকৃতি’কে মূল প্রতিপাদ্য করে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করে। পহেলা বৈশাখ সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ মিনার প্রাঙ্গণ থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রাটি রায়সাহেব বাজার মোড় থেকে ঘুরে পুরান ঢাকার বিভিন্ন সড়ক হয়ে শোভাযাত্রাটি ক্যাম্পাসে এসে শেষ হয়। শোভাযাত্রার পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুজিবমঞ্চে আয়োজন করা হয় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
প্রতি বছরের মতো ছায়ানটের বর্ষবরণ ও চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রার পাশাপাশি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে রকমারি কারুপণ্যের সম্ভার নিয়ে চলে বৈশাখী মেলা। সাধারণত নববর্ষে পান্তা-ইলিশসহ নানারকম দেশি খাবারের আয়োজন থাকে। তবে এবার দিনের বেলায় এসব খাবারের আয়োজন ছিল না রমজানের মর্যাদা রক্ষা করতে। করোনার কারণে বাঙালির হারিয়ে যাওয়া ছন্দ যেন ফিরে পেয়েছে এবারের বর্ষবরণের প্রতিটি পর্বে। সব অবসাদ, জড়তা, মলিনতার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে বাঙালির দুয়ারে কড়া নাড়ে নববর্ষ ১৪২৯। সকল জড়তা-মলিনতা ঝেড়ে ফেলে নির্মলকে আহ্বান করে বাঙালি। এ আয়োজনে ছিল নব উদ্যমে জেগে ওঠার প্রত্যয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র
পরবর্তী নিবন্ধহাওরের অপার সম্ভাবনা
আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য