সাইদ আহমেদ বাবু
শ্রীলংকা দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ অর্থনীতির একটি দেশ ছিল। শুরু করেছিল তৈরি পোশাক রপ্তানি দিয়ে, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রথম পা রাখা শ্রীলংকা নির্ভরশীল ছিল পর্যটনে, শিক্ষিতের হার উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের তুলনায় ছিল অনেকটাই বেশি, তাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থাও দক্ষিণ এশিয়ার সেরা। এবং সামাজিক সূচকে শ্রীলংকা ছিল সবার চেয়ে এগিয়ে। শ্রীলংকান তামিল টাইগারদের ওপর সরকারি বাহিনীর বিজয়ের মাধ্যমে ১৯৮৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত চলা গৃহযুদ্ধের সমাপ্তির পর বিশ্বের কাছে একুশ শতকের সফল অর্থনৈতিক উন্নয়নের মডেল হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ধারণ করছিল দেশটি। দেশটির বিরাট সংখ্যক প্রবাসী বছরে ৩ থেকে ৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়ে থাকে আর পর্যটন খাত থেকে দেশটির আয় ৫ থেকে ৬ বিলিয়ন ডলার।
১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে শ্রীলংকা। স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এমন খারাপ অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হতে হয়নি দেশটিকে। বর্তমানে ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছে শ্রীলংকা। যেখান থেকে আদৌ দেশকে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব কি না, তা নিয়ে সন্দীহান বিশেষজ্ঞরাও। দেশবাসী এ পরিস্থিতির জন্য প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে-সহ গোটা রাজাপক্ষে পরিবারকে দায়ী করছে। প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতা ছাড়া করতে লাগাতার আন্দোলন শুরু হয়েছে। দল, মত, সম্প্রদায় নির্বিশেষে শ্রীলংকার নাগরিকরা একজোট হয়ে রাস্তায় নেমেছে। টানা ৩৬ ঘণ্টা কার্ফু এবং জরুরি অবস্থা। তার প্রতিবাদেই সরকারবিরোধী আন্দোলনে উত্তাল শ্রীলংকা। জনতা প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছে। গত মাসের শুরু থেকে চলছে এ আন্দোলন। সোয়া ২ কোটি মানুষের এদেশে পণ্যের বিশেষ জোগান নেই বাজারে, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আকাশছোঁয়া। বিদ্যুৎ বাঁচাতে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৩ ঘণ্টা লোডশেডিং করানো হচ্ছে। দামি ওষুধের অভাবে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচার বন্ধ হয়ে গেছে। শ্রীলংকাজুড়ে ১০ লাখেরও বেশি স্কুলে কাগজ সংকটে অনির্দিষ্টকালের জন্য পরীক্ষা বাতিল করার কথা ঘোষণা করে সরকার। মূল্যস্ফীতি জানুয়ারিতে ২৫ শতাংশ ছুঁয়ে রেকর্ড গড়েছিল। ফেব্রুয়ারিতে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে পৌঁছেছিল। শ্রীলংকা সরকারের কাছে সংকট কাটাতে আবেদনে স্বাক্ষরকারীরা অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসকদের দায়িত্ব দিয়ে বর্তমান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে ও তার বড় ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষের পদত্যাগের এবং শ্রীলংকার সংবিধানের ২০তম সংশোধনী বাতিলের দাবি জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে পদত্যাগ করেছেন। শ্রীলংকার দুরবস্থার কথা উল্লেখ করে বলা হয়, ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শ্রীলংকা ঋণ শোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে। শ্রীলংকার বৈদেশিক ঋণ এখন ৪৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। কেবল চীনের কাছেই তাদের দেনার পরিমাণ ৮ বিলিয়ন ডলার। এ কারণে দেশটি নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করেছে।
শ্রীলংকায় একসময় শুধু ‘উন্নয়নে’র আওয়াজ শোনা যেত। তারা স্বপ্নে বিভোর ছিল যে, তাদের অবকাঠামো থেকে শুরু করে জ্ঞানবিজ্ঞান, শিল্প, জ্বালানি, বাণিজ্য, নৌপরিবহন ও বিমান চলাচলসহ সবক্ষেত্রে যুগান্তকারী উন্নতি হবে। উন্নয়নের নামে দেশে-বিদেশের অর্থ সহায়তায়, বিশেষ করে চীনের সহায়তায় একদিকে যেমন হয়েছে বিশাল বিশাল প্রকল্পের উন্নয়ন, তেমনই অন্যদিকে হয়েছে ব্যাপক দুর্নীতি ও লুটতরাজ। তাদের উচ্চাভিলাষী অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প, অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ, ঋণ পরিশোধে বেহাল, আকস্মিকভাবে কর হ্রাস, করোনার প্রভাবে জাতীয় আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস পর্যটন ও রেমিট্যান্স খাতে চরম বিপর্যয়, অর্গানিক চাষাবাদে বাধ্যকরণ, সংকট সমাধানে অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি এবং পরিবারতন্ত্রের কারণে এ সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। শ্রীলংকায় বৈদেশিক মুদ্রার বড় জোগান আসে দেশটির পর্যটন খাত থেকে। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে প্রায় দু-বছর পর্যটন শিল্পে কর্মকা- বন্ধ থাকায় চরম সংকটে পড়েছে দেশটি। ফলে বিদেশি কর্মীরা শ্রীলংকা ছেড়েছেন। ঋণদানকারী বিভিন্ন সংস্থা শ্রীলংকাকে ঋণ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে দেশটির পর্যটন খাতে বিপর্যয় নেমে আসে। অভিযোগ, করোনা আবহে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে গিয়ে বিশ্ববাজার থেকে গত দু-বছরে লাগামহীনভাবে ঋণ নেয় দেশের সরকার। চলতি বছর বিদেশি ঋণ এবং সুদ মেটাতে অন্তত ৬৯০ কোটি ডলার ব্যয় করতে হবে শ্রীলংকাকে। অথচ বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয় মাত্র ২৩১ কোটি ডলার। জিডিপি’র ১১৯ শতাংশ সে-দেশটির ঋণ। বর্তমান সরকারের সঞ্চাধিক কর মওকুবের কারণেই শ্রীলংকায় অর্থের ভা-ার ক্রমাগত শূন্য হতে শুরু করে। সরকারের অর্থের অভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেছে ৭০ শতাংশ। মূলত তার থেকেই শুরু হয় অর্থনৈতিক অবমূল্যায়ন। নজিরবিহীন ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে দেশের মানুষ। এই জনতার বিপ্লবে যারা অংশ নিচ্ছেন তারা শুধু সরকার পরিবর্তন চাইছেন না, তারা চাইছেন রাজনৈতিক কাঠামো ও সংস্কৃতিতে আমূল একটা পরিবর্তন।
পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষে সব রাজনৈতিক দলগুলোকে নতুন সরকারে অন্তর্ভুক্ত করার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কিন্তু রাস্তায় বিক্ষোভরত জনতা বলছে মি. রাজাপক্ষে পদত্যাগ না করা পর্যন্ত তারা থামবে না। ২০১৯ সালের নির্বাচনে তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে। তিনি দেশে স্থিতিশীলতা এবং ‘দৃঢ় হাতে’ দেশ শাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক সব সূচকে শ্রীলংকা এখন একটি ডুবে যাওয়া দেশ। একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। আজকে দেশটির মন্ত্রীদের গরিষ্ঠ সংখ্যক পদত্যাগ করেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধানও দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। শ্রীলংকায় দেশের সর্বত্র খাদ্য এবং জ্বালানি সংকট। এর সঙ্গে বিষফোঁড়ার মতো এসেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাত। তার কারণে সারাবিশ্বে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে থাকার রেশ পুরোমাত্রায় শ্রীলংকা সরকারের ওপর পড়েছে। পেট্রোল ও ডিজেল সংকটে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে শ্রীলংকা সরকারকে দেশের সর্বত্র সেনা মোতায়েন করতে হয়েছে।
শ্রীলংকার এ সমস্যা রাতারাতি তৈরি হয়নি। গত ১৫ বছরে শ্রীলংকা বেশ কিছু মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, রাস্তা এবং আরও নানা ধরনের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও ঋণ নিয়েছে শ্রীলংকার বিভিন্ন সরকার। অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, ঋণের অর্থ অনেক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে ব্যবহার করা হয়েছে। এসব প্রকল্প থেকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যাচ্ছে না; কিন্তু এই অর্থ কীভাবে পরিশোধ করা হবে সে-ব্যাপারে খুব একটা চিন্তা-ভাবনা করেনি। এর মধ্যে অন্যতম উৎস হচ্ছে সার্বভৌম বন্ড। ২০০৭ সাল থেকে দেশটির সরকার অর্থ জোগাড়ের জন্য সার্বভৌম বন্ড ইস্যু করেছে। অর্থনীতিবিদরা বলেন, একটি দেশের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হলে এ ধরনের সার্বভৌম বন্ড বিক্রি করা হয়। আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজারে এ ধরনের বন্ড বিক্রি করে অর্থের জোগান দেওয়া হয়। শ্রীলংকা সেটিই করেছে।
আন্তর্জাতিক সার্বভৌম বন্ড বাবদ শ্রীলংকার ঋণ রয়েছে এখন সাড়ে ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এছাড়া দেশীয় উৎস থেকেও সরকার ঋণ করেছে। চীন হচ্ছে শ্রীলংকার সবচেয়ে বড় ঋণদাতা। এছাড়া আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মুদ্রাবাজার, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং জাপানের কাছ থেকেও ঋণ নিয়েছে শ্রীলংকা। শ্রীলংকার ঋণের আন্তর্জাতিক সার্বভৌম বন্ডে রয়েছে ৩৬.৪ শতাংশ, যার মধ্যে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ ১৪.৬ শতাংশ। চীন সরকার দিয়েছে ১০.৮ শতাংশ ঋণ। জাপানের থেকেও বড় পরিমাণ অর্থ ধার নিয়েছে রাজাপক্ষে সরকার। সর্বশেষ জানুয়ারি মাসে ৫০০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে শ্রীলংকা। ফলে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত না থাকায় শ্রীলংকা ইতোমধ্যে দেউলিয়া। সরকার বলছে, আপাতত কোনো বৈদেশিক ঋণের কিস্তি শোধ করতে পারবে না তারা। শ্রীলংকার বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্বব্যাংক গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আর্থিক সংকটে ধুঁকতে থাকা শ্রীলংকাকে সাহায্য করার ইঙ্গিত দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংক। আইএমএফ বলেছে, শ্রীলংকার ঋণ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সার্বিক বিষয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। এদিকে বিশ্বব্যাংক বলেছে, শ্রীলংকার জন্য একটি জরুরি সাহায্য প্যাকেজ প্রস্তুত করেছে তারা। ২ কোটি ২০ লাখ মানুষের দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলংকায় বৈদেশিক মুদ্রা মজুতের ভয়াবহ সংকট দেখা দিয়েছে। এ কারণে আমদানির মূল্য পরিশোধ করতে পারছে না শ্রীলংকা সরকার। এতে মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলছে। যে কারণে দেশটি জ্বালানি তেল এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে পারছে না। এতে চাল, গুঁড়া দুধ, চিনি, ময়দা ও ওষুধের সরবরাহ কমে যায়। লাগামহীন মূল্যস্ফীতি দুর্ভোগ আরও বাড়ায়।
ইতোমধ্যেই ভারত শ্রীলংকাকে জ্বালানি, খাদ্য ও ওষুধ কেনার জন্য গত তিন মাসে আড়াই বিলিয়ন ডলার দিয়েছে। এছাড়াও, সেদেশে তীব্র জ্বালানি ঘাটতি মোকাবিলায় ২ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন ডিজেল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় ভারত। পাশাপাশি ভারতের সরকারের পক্ষ থেকে পাঠানো হয়েছে ৪০ হাজার টন চাল। এ পরিস্থিতিতে শ্রীলংকা সরকার আইএমএফের থেকে আরও ঋণ নিতে চেয়েছিল; কিন্তু বিরোধী এবং বিশেষজ্ঞরা সরকারকে বাধা দিয়েছেন। আইএমএফ জানিয়েছে, তারা শ্রীলংকা সরকারকে সাহায্য করবে। এছাড়া ভারতও জানাচ্ছে তারা পাশে রয়েছে। শ্রীলংকাকে আনুমানিক ৫০ কোটি ডলার সাহায্যের বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের মুখপাত্র বলেছেন, শ্রীলংকাকে যে অর্থ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে, তা ব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত বিভিন্ন প্রকল্প, দ্রুত তহবিল স্থানান্তর করে জরুরি ওষুধ ক্রয়, স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা এবং দরিদ্র ও দুর্দশাগ্রস্ত পরিবারগুলোর কাছে নগদ অর্থ সহায়তা পাঠানোর ক্ষেত্রে ব্যয় করতে হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে শ্রীলংকাকে ২০ কোটি টাকার ওষুধ দেওয়ার ঘোষণা করেছে। শ্রীলংকা বর্তমানে বিদেশি ঋণের ভারে জর্জরিত। ফলে আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা ছাড়া রাজাপক্ষে সরকারের পক্ষে পরিস্থিতির মোকাবিলা কার্যত অসম্ভব বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদদের একাংশ।
বিরোধীরা বলছেন, ইতোমধ্যে জনসমর্থন এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছেন গোতাবায়া রাজাপক্ষে। কিন্তু এত কিছুর পরও গদি আঁকড়ে পড়ে রয়েছেন তিনি! তিনি যে কিছুতেই পদত্যাগ করবেন না, তা তার নতুন করে ১৭ সদস্যকে মন্ত্রিসভায় নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত থেকে স্পষ্ট। তবে, এতে জটিলতা নিরসনের কোনো রাস্তা দেখতে পাচ্ছে না সংশ্লিষ্ট মহল।
বিশ্লেষকরাও বলছেন বর্তমান সংকটের অন্যতম একটি কারণ ২০১৯ সালে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতা গ্রহণের পর মি. রাজাপক্ষে অর্গানিক কৃষি চালু করেন। সেজন্য কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। এর অংশ হিসেবে শ্রীলংকায় সার আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল কৃষিক্ষেত্রে। এতে চালের উৎপাদন ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। চালের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। একসময় চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ শ্রীলংকা বাধ্য হয় ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের চাল আমদানি করতে। চা রপ্তানি করে শ্রীলংকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। সেখানেও বড় ধাক্কা লাগে। কৃষকের ক্ষতি পুষিয়ে আনার জন্য সরকার ২০০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দেয়। দেশজুড়ে একই সাথে খাদ্য ঘাটতিও প্রকট আকার ধারণ করে। বড় ধরনের কর হ্রাস ও আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের মতো যেসব নীতি প্রণয়ন করেছেন, সেগুলো এ সংকটকে আরও গভীর করেছে। কিছু বড় প্রকল্প শ্রীলংকার জন্য ‘শ্বেতহস্তী’তে রূপান্তরিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে হাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দর। গত ১৫ বছর ধরে শ্রীলংকায় সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ তেমন একটি হয়নি। বিদেশি বিনিয়োগের পরিবর্তে বিভিন্ন সরকার ঋণ করার প্রতি মনোযোগী হয়েছে।
শ্রীলংকার মোট ঋণের ৪৭ শতাংশ বাণিজ্যিকভাবে বিভিন্ন বন্ড ইস্যু করে নেওয়া হয়েছে। ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট দেশটিতে ভ্যাট এবং ট্যাক্স কমানোর সিদ্ধান্ত নেন। এ ধরনের পদক্ষেপে অনেক বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। ভ্যাট প্রদানের হার ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮ শতাংশে আনা হয়। ভ্যাট-ট্যাক্স কমানোর মূল কারণ ছিল অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করা। ২০০৯ সালে শ্রীলংকায় গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষে (বর্তমান প্রেসিডেন্টের ভাই) একই ধরনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ফলে তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিতে গতি এসেছিল। সেই আলোকে বর্তমান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষেও একই পদক্ষেপ নেন। কিন্তু এর কয়েক মাসের মধ্যে বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হয়। কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক শ্রিমাল আবিরত্নে বলেন, আয়কর এবং ভ্যাট কমানোর ফলে সরকারের রাজস্ব আয় ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। ফলে সরকার আরও ঋণ নিতে বাধ্য হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। শ্রীলংকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক সিনিয়র ডেপুটি গভর্নর বলেন, ট্যাক্স কমানোর বিষয়টি ছিল একটি বড় ভুল।
এ বিষয়ে আপাতত বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ- বর্তমানে শ্রীলংকা সরকারের উচিত আগামী তিন বছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধের কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা। এমনটা করলে শ্রীলংকার নাগরিকদের ওপর চাপ কমবে বলেই আশা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। ঋণ পরিশোধের লক্ষ্যে বিচক্ষণ এবং যুক্তিপূর্ণভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত বলে মত দিয়েছেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। রাজাপক্ষের অপসারণেই দেশে সুবাতাস বইবে এমনটা যে নয়, তা গভীর জলে পড়ে যাওয়া শ্রীলংকাবাসীরা বুঝছেন না তা নয়। কিন্তু শিগগিরই কোনো সমাধান সূত্র না থাকায় ধৈর্য হারিয়েছে তারা।
এই অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে খাদের কিনারে শ্রীলংকা ডুবতে বসেছে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক সব সূচকে শ্রীলংকা এখন একটি ডুবে যাওয়া দেশ। একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। অন্ধকার টানেলের শেষ কোথায়, এখনও সুনিশ্চিতভাবে বলতে পারছেন না কেউই। আমাদের আশা, প্রতিবেশী দেশ শ্রীলংকা এই অচলাবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে পারবে।
লেখক : সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, উত্তরণ