Monday, December 4, 2023

“ভয়হারা এক নেয়ে…”

সম্পাদকের কথা: মারের সাগর পাড়ি দিয়ে ৭৬-এ পদার্পণ করছেন বাঙালির আদরের দুলালী বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা। অতুলনীয় সাহস, মরণজয়ী প্রতিজ্ঞা, দূরদর্শিতা, দেশ ও জনগণের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা, ক্লান্তিহীন কর্মসাধনা এবং সুগভীর প্রজ্ঞা আক্ষরিক অর্থেই তাকে ‘চ্যাম্পিয়ন অব দি আর্থ’ করে তুলেছে। একুশ শতকের প্রথম সিকি শতাব্দীর বিশ্ব নেতাদের মধ্যে শীর্ষে তার অবস্থান। পিতার মতোই তিনি হয়ে উঠেছেন বাঙালি জাতির গৌরবোজ্জ্বল মর্যাদার প্রতীক। আজকের এই শুভক্ষণে আমরা দেশবাসীর পক্ষ থেকে তাকে জানাই সূর্যকরোজ্জ্বল অভিনন্দন ও অতলান্ত ভালোবাসা।
এই যে পৌনে এক শতাব্দীর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে আজ তিনি বর্ণাঢ্য জীবনের সাফল্যের স্বর্ণচূড়া স্পর্শ করলেন, তা কিন্তু কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। পদে পদে বাধা, মৃত্যুর ফাঁদ। কখনও চোরাগুপ্তা হামলা, কখনও বা প্রকাশ্য জনারণ্যে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ, কখনও বোমা বিস্ফোরণের অগ্নিকু-ের থাবা আবার কখনও গ্রেনেড হামলার অনিবার্য মারণাঘাত এড়িয়ে অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়াÑ এই ছিল তার মারের সাগরের উত্তাল-রক্তাক্ত পথ পরিক্রমা। ভয়কে জয় করেই তিনি এ পথ পাড়ি দিয়েছেন। বিশ্বের আর কোনো রাষ্ট্রনেতাকে এ ধরনের মরণ শঙ্কুল পথ মাড়াতে হয়নি। এ জন্যই রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, তিনি ‘ভয়হারা এক নেয়ে।’
কেবল বিরোধী দলে থাকাকালেই শেখ হাসিনা হত্যা-ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেননি। রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেও তাকে মৃত্যুঝুঁকি নিতে হয়েছে। বিশেষত ২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহের আড়ালে নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা ও সরকার উৎখাতের দৃশ্যমান ষড়যন্ত্রের কথা দেশবাসী ভুলবে না। বিডিআর বিদ্রোহে সেনা কর্মকর্তা ও সহকর্মীদের নৃশংস হত্যাকা-ের পটভূমিতে ক্যান্টনমেন্টে সংক্ষুব্ধ জওয়ানদের দরবারে অতিমানবিক সাহস নিয়ে যেভাবে শেখ হাসিনা একটা বিস্ফোরণ¥ুখ পরিস্থিতি সামাল দেন, তা সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারাও ভাবতে পারেননি। জওয়ান ও কর্মকর্তাদের ক্ষোভ প্রশমিত করে তাদের মন জয় করেন প্রধানমন্ত্রী। জীবনের প্রবল ঝুঁকি নিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের নীলনকশা তিনি বানচাল করে দেন। এখনও তিনি মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি, ক্ষমতালিপ্সু অন্ধকারের শক্তি এবং মৌলবাদী-জঙ্গি সন্ত্রাসীদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু হয়ে আছেন। অন্যদিকে কেউ সাহস করে সেই বিচার না করলেও তিনি ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু ও পরিবারের সদস্যবৃন্দের হত্যাকা-ের বিচার করেছেন। ধৃত ও দ-প্রাপ্ত খুনিদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে বিচারের রায় কার্যকর করেছেন। এই বিচার করতে গিয়েও তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের বিচারের পর সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। ’৭১-এ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর জামাতে ইসলামী ও তাদের সহযোগী আলবদর-আলশামস প্রভৃতি গণহত্যা, নারী ধর্ষণ ও হত্যা, অগ্নিসংযোগ, বুদ্ধিজীবী হত্যা, লুটতরাজ ইত্যাদির জন্য দায়ীরা ছিল যুদ্ধাপরাধী। ইতোপূর্বে ক্ষমতায় থেকে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ ও ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ তকমাধারী জিয়া প্রথম যুদ্ধাপরাধীদের দল জামাতকে বৈধতা দান এবং এমন কী রাষ্ট্রক্ষমতায় অংশীদার (আলিমসহ কয়েকজনকে সামরিক সরকারের উপদেষ্টা করা) ও রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করেন। স্বৈরাচারী জেনারেল এরশাদ বঙ্গবন্ধুর খুনিচক্রের কয়েকজনকে রাষ্ট্রীয় কূটনৈতিক পদে নিয়োগ ছাড়াও তামাশার নির্বাচনে ‘সংসদ সদস্য’ বানিয়ে বিরোধী দলের নেতা বানানোর মতো ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেন, তেমনি যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গেও তলে তলে আন্ডারস্ট্যান্ডিং করেন। আর খালেদা জিয়া তো জিয়ার রেকর্ড ভঙ্গ করে তাদের দুজনকে (জামাতের আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদ) মন্ত্রিসভার সদস্য পর্যন্ত করেন। খালেদা পাকিস্তানিদের হয়ে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে তাদের পরাজয়ের ‘শান্তিপূর্ণ ও বৈধ’ প্রতিশোধ গ্রহণ করেন। ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্তের সাথে এত বড় বেইমানি আর কেউ করেনি।
বঙ্গবন্ধু-কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে অঙ্গীকার করেছিলেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবেন। ক্ষমতায় এসে সেই অঙ্গীকার তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। বাঙালি জাতির কলঙ্কমোচন করেছেন। সারাদুনিয়া এই বিচার ও রায়কে (একমাত্র পাকিস্তান ও তুরস্ক ছাড়া) স্বাগত জানিয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে এই বিচার শেখ হাসিনার জীবনের প্রতি কতটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, তা আর ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না।
অন্যদিকে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে তার ও তার সরকারের সাফল্য এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। দারিদ্র্য লাঞ্ছিত, পশ্চাৎপদ বাংলাদেশকে তিনি ‘উন্নয়নশীল দেশে’র মর্যাদায় উন্নীত করেছেন। মাথাপিছু আয় তিন ডিজিট থেকে চার ডিজিটে (২,৮২৪ ডলার) উন্নীত করার পাশাপাশি খাদ্যে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন, সবজি, মাছ-মাংস, ফল উৎপাদনে প্রথম চার দেশের মধ্যে অবস্থান প্রতিষ্ঠা, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানো, দারিদ্র্য দূরীকরণে নজির স্থাপন প্রভৃতি বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত করেছে। গড় আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি (৭৩ বছর), মাতৃমৃত্যু হার হ্রাসে উপমহাদেশে সর্বোচ্চ স্থান দখল, নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী শিক্ষায় ভারত-পাকিস্তানের তুলনায় এগিয়ে থাকা, সর্বোপরি বিপুল ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে চমকপ্রদ সাফল্য। বিশ্বব্যাংকের সাহায্য ছাড়া নিজস্ব অর্থে বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘ পদ্মা সেতু নির্মাণ বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। কর্ণফুলী টানেল, ঢাকা মহানগরে উড়াল রেল, গভীর সমুদবন্দর নির্মাণ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনা প্রভৃতি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ যে উন্নত দেশের স্তরে পা বাড়াবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইতোমধ্যে আমরা মহাকাশ যুগে প্রবেশ করেছি। আমরা ভারতের সাথে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন করে শান্তির সীমান্ত গড়ে তোলার পথে অগ্রসর হচ্ছি। সমুদ্রে আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মিয়ানমার ও ভারতের সাথে সমুদ্রসীমাও নিষ্পত্তি করেছি। মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনা হলোÑ একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ভেদ-বৈষম্যমুক্ত মানবিক সমাজ গড়ে তোলা। পরিবর্তিত বিশ্ব বাস্তবতায় গতানুগতিক পথে আর অগ্রযাত্রার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু ভেদ-বৈষম্যমুক্ত, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত একটা উন্নত-সমৃদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠা আমরা করবই। কোন পথে, কীভাবে সেই পথ রচিত হবে, বাংলাদেশকে তা নির্ধারণ করতে হবে।
দূরদর্শী প্রজ্ঞাবান রাষ্ট্রনায়ক জননেত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে সেই উন্নয়নের পথের সূচনা করেছেন। তার শতবর্ষ মেয়াদি ডেল্টা প্ল্যান, ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে শিল্পোন্নত দেশে পরিণত করা এবং সে-লক্ষ্যে প্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ইত্যাদি পদক্ষেপ আমাদের আশাবাদী করে তুলেছে। শারীরিকভাবে কোনো মানুষ অমর হয় না। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে তাকেও একদিন চলে যেতে হবে। কিন্তু এখনও তিনি যে কর্মক্ষমতা রাখেন, আমরা প্রার্থনা করব তার সেই কর্মক্ষমতা যেন অটুট থাকে; তিনি যেন দীর্ঘজীবী হোন এবং উন্নত-সমৃদ্ধ এবং ভেদ-বৈষম্যমুক্ত আধুনিক বাংলাদেশের ভিত্তিটা শক্তিশালী করে যেতে পারেন। ইতিহাস তাকে নিছক একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই নয়; বরং আধুনিক উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্নের রূপকার হিসেবে, মানবিক গুণের অধিকারী বিশ্বনেত্রী হিসেবে চিরস্মরণীয় করে রাখবে। তিনি মাতৃভূমি বাংলাদেশের উন্নয়ন ও মর্যাদার প্রতীক। দুঃখী মানুষের অতি আপনার জন।

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য