সম্পাদকের কথা: উনিশ শতকে কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালির পুনর্জাগরণ বা রেনেসাঁস-এর কথা সর্বজনবিদিত। এ ব্যাপারে এখন ভারত ও বাংলাদেশের ইতিহাসবিদ, সমাজতাত্ত্বিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীগণ একমত যে, ওই রেনেসাঁস ছিল খ-িত এবং একপেশে। সামাজিক রূপান্তরের যেসব বৈশিষ্ট্যকে রেনেসাঁসের লক্ষণ বলে ধরা হয়, উনিশ শতকের নবজাগরণে তার অনেকগুলোই যেমন অনুপস্থিত ছিল, তেমনি হিন্দু-মুসলমানসহ সকল ধর্মমতের মানুষের অংশগ্রহণ ছিল না বলে তা সর্বজনীন হয়ে উঠতে পারেনি। এমনকি হিন্দু বা ব্রাহ্ম-সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশই কেবল রেনেসাঁসের পতাকাবাহী হয়ে উঠলেও সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, মধ্যবিত্তদের প্রধান অংশ ছিল রেনেসাঁসের বাইরে।
কিন্তু বাইরে থাকলেও অথবা খ-িত হলেও উনিশ শতকের নবজাগরণের ঐতিহাসিক ও সামাজিক প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। পরাধীন ভারতে এই রেনেসাঁসই ভারতের আত্মজাগরণের মশালচী হিসেবে স্বদেশ-চেতনা, ধর্মসংস্কার, নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন, মধ্যযুগীয় কুসংস্কার মোচন, শিক্ষার বিস্তার, যুক্তিবাদিতা এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আধুনিকায়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।
মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণায় আচ্ছন্ন এবং ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণে বিরত থাকায় এই রেনেসাঁস থেকে মুসলমান-সমাজ বিচ্ছিন্ন ছিল। ‘বাঙালির পুনর্জাগরণ’ বলা হলেও ওই রেনেসাঁস সীমাবদ্ধ ছিল কেবল অগ্রসর হিন্দুদের মধ্যে। বাঙালির আইডেনটিটি তথা আত্মপরিচয় নিয়েও সংশয় ছিল। বাংলাভাষী তথা বাঙালি মুসলমানদের সে-সময়ে ‘বাঙালি’ বলে স্বীকার করা হতো না। হিন্দুরাই বাঙালির সমার্থক ছিল। জাতি-পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হতো, ‘আমরা হিন্দু, ওরা মুসলমান।’ মুসলমানরাও কিন্তু বাঙালি পরিচয় দিত না। নিজেদের জাতীয় পরিচয় বলতে তারাও অবলীলাক্রমে নিজেদের মুসলমানত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছিল।
উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে মুসলমানদের আধুনিক শিক্ষা-দীক্ষার প্রসার হতে শুরু করে। স্বভাবতই মুসলমান লেখক, কবিরা মাতৃভাষায় সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। আধুনিক ধ্যান-ধারণারও বিস্তার ঘটতে শুরু করে। মধ্যযুগের অচলায়তন ভাঙতে থাকে। মীর মোশাররফ, সৈয়দ এমদাদ আলী, ইসমাইল হোসেন সিরাজী থেকে শুরু হয়ে এর সার্থক পরিণতি ঘটে কাজী নজরুল ইসলামে। বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে মুসলমান লেখক, কবি, শিল্পী, গায়কদের আবির্ভাব ঘটতে থাকে। রাজনৈতিক নেতৃত্বেও হিন্দুদের একচেটিয়া কর্তৃত্বের অবসান ঘটে। হিন্দু-মুসলমানের মিলিত জাতি-পরিচয়ের প্রশ্নটি ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে।
কিন্তু মুসলমানদের বাঙালিত্বে উত্তরণের এই প্রক্রিয়াটি পাকিস্তান আন্দোলনের তোড়ে ভেসে যাওয়ার উপক্রম হয়। সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দেশভাগ আমাদের অখ- জাতি-পরিচয়কে সাময়িক হলেও স্তিমিত করে দেয়। কিন্তু ১৯৪৭-৪৮ এবং ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, মাতৃভাষার মর্যাদার জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দেওয়ার ঘটনা বাঙালি জাতির ইতিহাসে নতুন চেতনার এক সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্ফুরণ ঘটে। অঙ্কুরিত হয় বাঙালির জাতি-রাষ্ট্রের ধারণা। সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিমূলে আঘাত হানে। বাঙালি তার আপন আত্মপরিচয়ে জেগে ওঠে। উনিশ শতকের অসমাপ্ত ও খ-িত রেনেসাঁস পূর্ণতা অর্জনের পথ খুলে দেয়। ভাষা আন্দোলন আমাদের রেনেসাঁসের সূচনা করে। ওই পথ বেয়েই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আমাদের আত্মপরিচয়ের প্রধান বাধাটি দূর করে দেয়। আজ তাই ভাষা শহিদ, সকল ভাষা সংগ্রামী এবং ওই আন্দোলনের সার্থক পরিণতির মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আমাদের নমিত শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। বাংলা ভাষা আজ স্বকীয় মর্যাদায়ই প্রতিষ্ঠিত নয়; ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা পাওয়ায়, এই আত্মদানের উৎস ধারা হয়ে উঠেছে সর্বজাতির, সকল ভাষাভাষী মানুষের সর্বমানবিক ও সর্বজনীন গৌরবে ভূষিত।