ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ- জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন। কিন্তু আমরা জানি ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে শুরু হয় ইতিহাস
বিকৃতির কাজ।
মোজাফ্ফর হোসেন: ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরপরই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম ও সার্থক গণ-আন্দোলন হলো ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত এই চার বছরের ভাষা আন্দোলনে রক্তক্ষয়ী পরিণতির মধ্য দিয়ে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার মানুষের ভাষার অধিকার স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়। এই আন্দোলনে আরও অনেকের সঙ্গে অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ২৮ বছরের তরুণ, উদ্দীপ্ত ছাত্রনেতা। এ-সময় তিনি কেবল ভাষার অধিকার নয়, পূর্ব বাংলার স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা আন্দোলন ও জনমত তৈরিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ছুটে বেড়িয়েছেন। তিনি কোনো একক আন্দোলন নিয়ে থাকেননি, সকল ন্যায়সংগত ও পূর্ব বাংলার মানুষের অধিকার সংশ্লিষ্ট সব ধরনের আন্দোলনে সক্রিয় এবং নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা রাখেন। যার ধারাবাহিকতায় এই তরুণ ছাত্রনেতার বলিষ্ট নেতৃত্বেই পরবর্তীকালে (১৯৭১ সালে) রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ভেতর দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সূর্য উদিত হয়। চল্লিশের দশকের শেষ দিকেই শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্ব বাংলার জাতীয় নেতা হয়ে ওঠার বিষয়টি পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর চোখ এড়িয়ে যায়নি, যে-কারণে আরও অনেক প্রবীণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সামনে থাকলেও পাকিস্তানি গোয়েন্দা তখন শেখ মুজিবকেই গোয়েন্দা-নজরদারিতে রেখেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর তৎকালীন পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের গোপন নথি নিয়ে প্রকাশিতব্য ১৪ খণ্ডের বইয়ের মধ্য প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ শীর্ষক বইয়ের প্রথম খণ্ডটির সময়কাল ১৯৪৮-১৯৫০ এবং দ্বিতীয় খণ্ডের সময়কাল ১৯৫১-১৯৫২। অর্থাৎ ১৯৪৮ সাল থেকে এই নজরদারি শুরু করা হয়। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৪৮-৫২ এ-সময়টা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভাষা আন্দোলনের কারণে। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে এ-সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান নিজের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সম্পর্কে সজাগ হয়ে ওঠে। বৈষম্য, বঞ্চনা ও নিপীড়নের যে রাজনীতি পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে শুরু করে তার বিরুদ্ধে বাংলার জনগণ এ-সময় থেকেই সচেতন ও অধিকার আদায়ে আন্দোলনমুখী হতে শুরু করে। আর এ-সকল আন্দোলনে বাংলার হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকল মানুষকে নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন ও সেসব আদায়ে যূথবদ্ধ করে তোলেন তরুণ রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।
ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ- জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন। কিন্তু আমরা জানি ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে শুরু হয় ইতিহাস বিকৃতির কাজ। দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ও দেশ গঠনের কারিগর বঙ্গবন্ধুর সমস্ত অবদানকে খাটো ও বিকৃত করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস জ্বলে ওঠে আপন আলোয়। ফলে মেজর জিয়া শাসিত বিএনপি এবং পরবর্তী সময়ে মেজর জিয়ার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া শাসিত এই জাতীয়তাবাদী দলটি সেটি করতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা মানুষের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে বিভ্রান্ত করেছে। ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবস্থানকে তারা খাটো করেছে। বদরুদ্দীন উমর প্রায় প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছিলেন ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর কোনো ভূমিকা নেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারগারারের রোজনামচা’ এবং তার সম্পর্কিত পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদন প্রকাশের ফলে বদরুদ্দীন উমরের অভিযোগ মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে প্রমাণিত হয়েছে। আমাদের সামনে এখন ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে বঙ্গবন্ধুর দু-খণ্ডে আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ও পাকিস্তানি গোয়েন্দা প্রতিবেদন আছে। যদিও এখানে বঙ্গবন্ধুর ভাষা আন্দোলনে সংশ্লিষ্টতা নিয়ে যা উঠে এসেছে, তার অনেকটাই ইতোপূর্বে ’৫২-র ভাষাসৈনিকদের মধ্যে অনেকে তাদের লেখার ভেতর দিয়ে প্রকাশ করেছেন। ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করে তার নেতৃত্বের ঋণ স্বীকার করেছেন অধিকাংশ ভাষাসৈনিকেরা। সম্প্রতি সেসব তথ্যকে আরও অকাট্য করেছে উল্লিখিত ঐতিহাসিক দলিলসমূহ।
আমরা বঙ্গবন্ধুর ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব নিয়ে প্রচলিত পাঠকে এ-সকল নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে পুনর্পাঠ করার চেষ্টা করতে পারি। সেই সঙ্গে প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত সত্যের সঙ্গে সেগুলো মিলিয়ে দেখা যেতে পারে এর ঐতিহাসিক বস্তুনিষ্ঠতা। এর মধ্য দিয়ে বদরুদ্দীন উমরের মতো যে গুটিকতক মানুষ ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কেও জানা যাবে।
আমরা জানি, ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের জন্ম হয়। শেখ মুজিবুর রহমান এই সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে কার্যনির্বাহী কমিটিতে যুক্ত হন। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠিত হওয়ার ফলে বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের মধ্য সঞ্চারিত ভাষা আন্দোলনের উত্তেজনা ছাত্রসমাজের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তমদ্দুন মজলিস ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ যৌথভাবে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে। ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তান কর্তৃক উত্থাপিত বাংলা ভাষাবিষয়ক প্রস্তাব নাকচ করে দেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বলিষ্ঠ ভূমিকা এই আন্দোলনে শক্তি ও গতি এনে দেয়। নূরুল হক ভূঁইয়াকে আহ্বায়ক করে ১৯৪৭ সালের ২ জানুয়ারি গঠিত ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ শামসুল আলমকে আহ্বায়ক করে পুনর্গঠিত হয়। শেখ মুজিবুর রহমান এই কমিটির সদস্য মনোনীত হন। এই পরিষদের আহ্বানে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১১ মার্চ দেশব্যাপী ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ধর্মঘটের পক্ষে জনমত তৈরিতে সাংগঠনিক সফরে করেন ফরিদপুর, যশোর, দৌলতপুর, খুলনা ও বরিশালে। ১১ মার্চ পালিত ধর্মঘট থেকে অনেক ছাত্র ও যুবনেতাকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার হন শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সক্রিয়তায় প্রতিষ্ঠিত ছাত্রলীগের ১০-দফা দাবির মধ্যে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার ও সামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের নিয়োগ এবং বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষার দাবি ছিল অন্যতম দাবি।
১৩ জানুয়ারি রমনার বর্ধমান হাউজে মুসলিম লীগের পার্টি বৈঠকে যোগ দেন শেখ মুজিবসহ ছাত্রদের একাংশ। ওই বৈঠক নিয়ে পাকিস্তানের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে [ভলিউম-১, পৃ. ৪] বলা হয়, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র শেখ মুজিবসহ অন্য ছাত্ররা একটি বুকলেট বিতরণ করে। যাতে লেখা ছিল, পূর্ব পাকিস্তানের দুর্ভাগা জনতা, কৈফিয়ত দিতে হবে আমাদের।’
১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ফজলুল হক মুসলিম হলে তমদ্দুন মজলিস ও মুসলিম ছাত্রলীগের যৌথ সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠন করা হয়। এই সভায় যারা উপস্থিত ছিলেন, তাদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ, মুহম্মদ তোয়াহা, আবুল কাসেম, রণেশ দাশগুপ্ত, অজিত গুহ প্রমুখের নাম উল্লেখ্যযোগ্য। সভায় গণপরিষদ সিদ্ধান্ত ও মুসলিম লীগের বাংলা ভাষাবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে এই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এতে গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, তমদ্দুন মজলিস, ছাত্রাবাসগুলোর সংসদ প্রভৃতি ছাত্র ও যুবপ্রতিষ্ঠান দুজন করে প্রতিনিধি দান করে। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক মনোনীত হন শামসুল আলম। এই সংগ্রাম পরিষদ গঠনে শেখ মুজিব বিশেষভাবে সক্রিয় ছিলেন।
গোপন নথিতে ৩ মার্চ লালবাগ থানায় এক প্রতিবেদনে [ভলিউম-১, পৃ. ৫] বলা হয়, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাক্ষর করা একটি লিফলেট ছাড়া হয়েছে। যাতে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে কেন আলাদা ছাত্রলীগ গঠন করা হয়েছে।’
৪ মার্চ ঢাকা জেলা গোয়েন্দা তথ্যে বলা হয়, ‘শেখ মুজিবুর রহমানসহ যারা মুসলিম ছাত্রলীগ গঠনে কাজ করেছে তারাই বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে লিফলেট ছড়াচ্ছে।’ [ভলিউম-১, পৃ. ৭]
৩ মার্চ গোপালগঞ্জে শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ছাত্রদের সম্মেলনে বাংলা ভাষার অধিকার নিয়ে কথা বলেন। গোপন নথিতে এ সম্পর্কে বলা হচ্ছে : Sheikh Mujibur Rahman & other leaders delivered speeches in a meeting of the students over the Language Movement, which was held at the premises of the court mosque, Gopalganj on 3.3.1948. [ভলিউম-১, পৃ. ৩৪০]
আমরা জানি, ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সর্বাত্মক সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। এই ধর্মঘট সফল করতে ১ মার্চ ১৯৪৮ তারিখে প্রচার মাধ্যমে একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছিল। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন অধ্যাপক আবুল কাসেম (তমদ্দুন মজলিস সম্পাদক), শেখ মুজিবুর রহমান (পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য), নঈমুদ্দীন আহমদ (পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক) এবং আবদুর রহমান চৌধুরী (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যুব সম্মেলনে পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলের নেতা) জাতীয় রাজনীতি ও রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসে এ বিবৃতির গুরুত্ব অপরিসীম।
এই ধর্মঘট পালনের আগের রাতে অর্থাৎ ১০ মার্চ রাতে ফজলুল হক হলে দিনটির কর্মসূচি নিয়ে এক সভা বসে। পাকিস্তানি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে : Secret information was received on 12.3.48 that the subject (Sheikh Mujibur Rahman) along with others took part in the discussions held at Fazlul Haq Hall on 10.3.48 and gave opinion in favour of violating section 144 cr.p.c. on 11.3.48.
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পালিত এই ধর্মঘটটি ছিল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে প্রথম সফল ধর্মঘট। এই ধর্মঘটে বঙ্গবন্ধু নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়ে গ্রেফতার হন। পাকিস্তানি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে : [IB report on Sheikh Mujinur Rahman, who was arrested on 11.3.1948„ This subject (Sheikh Mujibur Rahman) was arrested on 11.3.48 for violating the orders„ He took very active part in the agitation for adopting Bengali as the State language of Pakistan, and made the propaganda at Dacca for general strike on 11.3.48 on this issue. (Secret Documents of Intelligence Branch (IB) on Father of the Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, V-1, page-7)]
দিনটি নিয়ে ‘কারাগারের রোজনামচা’য় বঙ্গবন্ধু জানাচ্ছেন : ‘প্রথম ভাষা আন্দোলন শুরু হয় ১১ই মার্চ ১৯৪৮ সালে। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ (এখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ) ও তমদ্দুন মজলিসের নেতৃত্বে। ঐদিন ১০টায় আমি, জনাব শাসমুল হক সাহেবসহ প্রায় ৭৫ জন ছাত্র গ্রেপ্তার হই এবং আবদুল ওয়াদুদ-সহ অনেকেই ভীষণভাবে আহত হয়ে গ্রেপ্তার হয়।’ [কারাগারের রোজনামচা, বাংলা একাডেমি, পৃ. ২০৬]
ভাষাসৈনিক অলি আহাদ তার ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫’ গ্রন্থে লিখেছেন : ‘আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার নিমিত্তে শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ হতে ১০ মার্চ ঢাকায় আসেন।’ ১১ মার্চের হরতাল কর্মসূচিতে যুবক শেখ মুজিব এতটাই উৎসাহিত হয়েছিলেন যে, এ হরতাল ও কর্মসূচি তার জীবনের গতিধারা নতুনভাবে প্রবাহিত করে। মোনায়েম সরকার সম্পাদিত বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : জীবন ও রাজনীতি’ শীর্ষক গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘স্বাধীন পাকিস্তানের রাজনীতিতে এটিই তাঁর প্রথম গ্রেফতার।’
শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতারের প্রতিবাদে ১৬ এপ্রিল গোপালগঞ্জে সর্বাত্মক হরতাল ডাকা হয়। এ নিয়ে ৩ এপ্রিল গোয়েন্দাদের দেওয়া এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৫ মার্চ গোপালগঞ্জে প্রায় ৪০০ ছাত্র বিক্ষোভ করে। তারা সেই বিক্ষোভ থেকে ১৬ তারিখে শহরে দিনব্যাপী হরতাল ডাকে। তারা শেখ মুজিবুরের মুক্তির দাবিতে এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সেøাগান দেয়। [ভলিউম-১, পৃ. ৮-৯]
এই অংশে বিবৃতির নিচে ‘সাইড নোট’ লিখে ফের বলা হচ্ছে : Was Muzibar Rahman arrested in Dacca city in connection with the language controversy? Why did the Gopalganj students take up his cause? Ask Faridpur to clarifz the latter point., Sd. S.K.G, 16/17.4.38
১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ-এর সঙ্গে তদানীন্তন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে আট-দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চুক্তি স্বাক্ষরের পূর্বে জেলখানায় আটক ভাষা আন্দোলনের কর্মী রাজবন্দিদের চুক্তিপত্রটি দেখানো হয় এবং অনুমোদন নেওয়া হয়, অনুমোদনের পর চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। কারাবন্দি অন্যদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও চুক্তির শর্ত দেখেন এবং অনুমোদন প্রদান করেন। এই ঐতিহাসিক চুক্তির ফলে সর্বপ্রথম বাংলাভাষা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল এবং চুক্তির শর্ত মোতাবেক বঙ্গবন্ধুসহ অন্য ভাষাসৈনিকরা কারামুক্ত হন।
১৯৪৮ সালের ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে এক সাধারণ ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদ ভবন অভিমুখে এক মিছিল বের হয়। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন সদ্য কারামুক্ত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।
রাস্তায়, দেয়ালে-দেয়ালে পোস্টার- ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ দাবি আদায়ের জন্য ভাষা সংগ্রাম কমিটি অক্লান্তভাবে কাজ করে যেতে লাগলো। এই ভাষা সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে ওতপ্রোত সম্পর্কে যারা নিরলস কাজ করেছেন সেইসব ছাত্রনেতার মধ্যে মুজিব ছিলেন অন্যতম। শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে ১৯৪৯ সালে দুবার গ্রেফতার হন।
১৯৪৮ সালের ১৩ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে শেখ মুজিবুর রহমান দৈনিক ইত্তেহাদে ‘ছাত্র সম্প্রদায়ের কর্ত্তব্য’ শিরোনামে একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। বিবৃতিটি পেপারের ছবিসহ সিকরেট দলিলে উপস্থাপন করা হয়েছে। বিবৃতির একটি অংশে ভাষা আন্দোলনের প্রসঙ্গ টেনে শেখ মুজিবুর রহমান লেখেন : রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে মুসলিম ছাত্র সমাজের উপর এবং আরও কতিপয় ক্ষেত্রে জনতার উপর লাঠী চার্জ্জ, কাঁদুনে গ্যাস ব্যবহার ও গুলী চালনা করিয়া তারা আজাদীকে কলঙ্কিত করিয়াছে। [ভলিউম-১, পৃ. ৪৪]
ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন ছাত্র আন্দোলনে পুলিশি অত্যাচারের প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের উদ্যোগে শেখ মুজিবুর রহমানকে আহ্বায়ক করে ‘জুলুম প্রতিরোধ কমিটি’ গঠন করা হয়। ১৯৪৯ সালের ৮ জানুয়ারি এই কমিটির উদ্যোগে প্রতিরোধ কর্মসূচি ও ছাত্রসমাবেশ ডাকা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার ছাত্রসভায় ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নাইমউদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে শেখ মুজিবুর রহমান বক্তৃতা করেন।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ নিয়ে বলা হয়েছে : In connection with the observance of the Anti-repression Day at Dacca on 8.1.49 the subject (Sheikh Mujinur Rahman) bitterly criticized the Government for it’s alleged repressive measures against the students and suggested Direct Action it the demands of the students were not met.Õ [V-1, P. 319]
১৯৪৯ সালের ৯ জানুয়ারি গোপন দলিলের ২৭ নম্বর ভুক্তিতে দেখা যায় শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক কার্যক্রমের কয়েকটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, আদালতের ভাষা হিসেবে বাংলাকে গ্রহণ ও চালু করার বিষয়ে শেখ মুজিবুর রহমান তার একাধিক ভাষণে জোর দিয়েছেন।
গোপন দলিলের ৪০ নম্বর ভুক্তিতে উল্লেখ আছে, ১৯৪৯ সালের ১২ মার্চ সদরঘাট থেকে প্রায় ২০০ জন ছাত্রের অংশগ্রহণে একটি মিছিলের নেতৃত্ব দিয়ে শেখ মুজিবুর রজমান, দবিরুল ইসলাম ও কল্যাণ দাস গুপ্ত নওয়াবপুর রোড হয়ে দুপুর ১২টার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে আসেন। তার এক ঘণ্টা পরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্র-ছাত্রীরা জমায়েত হয়।
গোপন নথিতে প্রতিবেদনটির শিরোনাম দেওয়া হয়েছে এভাবে : Report of a procession brought out Sheikh Mujibur Rahman at Nowabpur road & Sadarghat area on 12.3.1949. A meeting of students held at Dacca University ground. Nadira Begum & other student leaders spoke in the meeting. All of them delivered their speeches in support of Bengali as state Language„ „ [Secret Documents of Intelligence Branch (IB) on Father of the Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, V-1, page-101]
গোপন নথির ৪৪ নম্বর ভুক্তিতে উল্লেখ আছে :Daliy intelligence report of DIB, Dacca, no, 32 & 35 dated respectively 4.3.1949 & 13.3.1949. It was mentioned in the reports about holding of different meetings & procession of DU students, some boys & girls of different schools of Dacca led by Sheikh Mujibur Rahman & DU students protested against the Govt. policy of proposed introduction of Arabic script in East Bengal & placing armed Police pickets at the University.„ [Secret Documents of Intelligence Branch (IB) on Father of the Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, V-1, page-109]
গোপন নথিতে ৬৯ নম্বর ভুক্তিতে ১৯৪৯ সালের ৯ মে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কয়েকটি তথ্য তুলে ধরা হয়। সেখানে একটি জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে, রংপুরে ২৯শে মার্চের মিটিংয়ে শেখ মুজিবুর রহমান উপস্থিত ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মীদের বাংলায় আরবি স্ক্রিপ্ট চালু করার প্রস্তাবনার বিরুদ্ধে সরব হতে আহ্বান জানান। [ভলিউম-১, ভুক্তি ২৮, পৃ. ১৫৩]
গোপন নথির ১৫৪ নম্বর ভুক্তিতে ১৯৪৯ সালের ১০ ডিসেম্বর শেখ মুজিবুর রহমানের সার্বিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর গোয়েন্দা নজরদারির সারবস্তু তুলে ধরা হয়। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে :ÔHe (Sheikh Mujibur Rahman) took a very active part in the agitation for adopting Bengali as the State language of Pakistan, and made propaganda at Dacca for general strike on 11.3.48. on this issue. On 11.3.48 the subject was arrested for violating orders under section 144 Cr. P.C. [Secret Documents of Intelligence Branch (IB) on Father of the Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, V-1, page-319]
পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন থেকেও আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারি। ১৯৫১ সালের ১৩ই নভেম্বরের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ঐদিন সকাল নটায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। আনোয়ারা বেগম এমএনএ, খয়রাত হোসেন এমএনএ, তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, আহমদ হোসাইনসহ ৩০ জনের মতো মেডিকেল ছাত্র তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। [ভলিউম-২, পৃ. ১১৬]
লেখক : অনুবাদ-কর্মকর্তা, বাংলা একাডেমি, ঢাকা