Wednesday, October 4, 2023

বড় গলার দল বিএনপি জন্মই যার আজন্ম পাপ!

  • শেখর দত্ত

বড় গলা কার? বাংলা প্রবাদ যারা পড়েছেন, তারা সবাই তা জানেন। বিএনপি দলটি বিরোধী দলে থাকুক আর সরকারে থাকুক, ইতোমধ্যে প্রমাণ করেছে তাদের বড় গলা। নির্বাচনের আগে এটা করব, সেটা করব; এটা উপহার দেব, সেটা উপহার দেব- বড় গলায় বলে। কিন্তু ক্ষমতায় গেলে বিএনপি অষ্টরম্ভা হয়ে পড়ে। আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ-জীবনে বিএনপির অর্জন কি, তা নির্ণয় করা আসলেই দুঃসাধ্য। সব গোমর ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর বিএনপিও এখন আর তাদের অর্জনের গুণকীর্তন করে না। সুদীর্ঘ ১৫ বছর ধরে বিএনপি ক্ষমতার বাইরে। ক্ষমতার চামচ নিয়ে প্রতিষ্ঠা পাওয়া দল বিএনপির জন্য অসহনীয়। তাই সুদীর্ঘ বছর ধরে চাতক পাখির মতো ক্ষমতাপ্রত্যাশী দলটি ভাঙা কলের গানের মতো বড় গলার একই ধরনের জিগির গেয়ে চলছে।
বড়া গলা বিষয়ে আলোচনায় যাওয়ার আগে প্রথমেই বলে নিতে হয়, দেশের ইতিহাসে সামরিক বাহিনীর মধ্য থেকে উঠে আসা প্রথম দল বিএনপির দুর্ভাগ্য এই যে, দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়া সেনাপ্রধান হিসেবে ধাপে ধাপে উত্থান নাটকের ভেতর দিয়ে ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল পুরো সেনাবাহিনীকে দেশের ইতিহাসে প্রথম ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন। অদৃষ্টের পরিহাসে প্রতিফল হিসেবে সেই সেনাবাহিনী পরপর দুবার বিএনপির বাড়া ভাতে ছাই ঢেলে দিয়েছে। প্রথমবার ১৯৮১ সালের মার্চে অন্য সেনাশাসক এরশাদ এবং দ্বিতীয়বার ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে অন্য সেনাশাসক মঈন ইউ আহমদের নেতৃত্বে বিএনপি ক্ষমতা থেকে অপসারিত হয়েছে। মাঝে ১৯৯৬ সালে দলটির নেত্রী খালেদা জিয়া গণরোষের কাছে পরাজিত হয়ে ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে বেঁচেছেন। যে বা যারা অন্যায় করে পালায়, তার বা তাদেরই যে বড় গলা হয়, সেটা সবার জানা!
প্রথমবার নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি সাত্তার কোনো প্রতিবাদ না করে নত মস্তকে বঙ্গভবন থেকে বের হওয়াটাকে নিঃসন্দেহে বলা যাবে বিয়োগান্তক নাটক আর অনির্বাচিত পুতুল রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন বঙ্গভবনে থেকে গিয়েও ক্ষমতা বিএনপির হাতছাড়া হয়ে যাওয়া হলো প্রহসনের নাটক। আর মাঝে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ছেড়ে যাওয়াটা ছিল পলায়নের নাটক। জাতীয় রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে বিএনপি প্রযোজিত উত্থান-পতন-প্রহসন-পলায়ন নাটকের পর দলটির আষাঢ়ের তর্জন-গর্জনের মতো বড় গলা ছাড়া আর কি-ই-বা থাকতে পারে! এবারে বড় গলায় কথা বলা শুরু হয়েছে ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকেই। তা ক্লাইমেস্কে পৌঁছে আদালতের রায়ে অবৈধভাবে দখলে রাখা সেনানিবাসের বাড়ি থেকে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে অপসারণের পর। তখন থেকেই বড় গলায় সরকার উৎখাতের জিগির করে যাচ্ছে বিএনপি। ওই সময়ে সরকার উৎখাতের লক্ষ্যে ঘোষিত আন্দোলনে দলটি বিশেষত নেতারা মাঠে নামতে না পারায় নেত্রী খালেদা জিয়া ক্ষেপে গিয়ে বলেছিলেন দলীয় নেতারা ‘আঙ্গুল চোষা’।
এখন চেয়ারপারসান খালেদা জিয়া বিএনপির চেয়ারে নেই। শাস্তিপ্রাপ্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী সরকারের বদান্যতায় জেলের বাইরে থেকে বয়সের চাপে হুইলচেয়ারে ঘুরতে হয়। আর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন ‘হাওয়া ভবন’ খ্যাত তারেক জিয়া চেয়ার ছেড়ে প্রবাসে গিয়ে জেলের ভাত এড়িয়ে চলছেন। অদৃষ্টের কী পরিহাস! সততার পরকাষ্ঠা ‘ছেঁড়া গেঞ্জি ও ভাঙা সুটকেস’-এর মালিক নিহত রাষ্ট্রপতি জিয়ার স্ত্রী খলেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আর বড় পুত্র তারেক জিয়া দুর্নীতির মামলা এড়িয়ে পালিয়ে বিদেশে। এ-কারণে খালেদা জিয়া কথিত ‘আঙ্গুল চোষা’ নেতারাই এখন বিএনপির হর্তাকর্তা। এজন্যই ‘ভার্চুয়াল নেতা’ তারেক জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির এখন তর্জন-গর্জনই সার। ১৩ বছর ধরে দেশকে উন্নয়নের গতিধারায় ধরে রাখতে সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত আওয়ামী লীগ সরকারকে কথা দিয়ে উৎখাত করে চলছে।
২৭ জানুয়ারি ২০২২, ‘বাকশাল-গণতন্ত্র-হত্যার কালো দিবস’ পালনকালে আন্দোলনের মাঠে বিএনপি অবুঝ-অপরিপক্ব শিশু নেতারা (আঙ্গুল চোষা মানে শিশুই, তাই না!) হুঁশিয়ারি উচ্চরণ করে বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের কপাল ভালো। করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় অপাতত আন্দোলন স্তিমিত হয়েছে। জনগণ অলরেডি রাজপথে নেমেছে। জনতার স্রোতে ১৪৪ ধারা ভেঙে যাচ্ছে। সংক্রমণ একটু হ্রাস পেলে দেখবেন আন্দোলন কাকে বলে। আন্দোলনের তোড়ে এই সরকার ভেসে যাবে।’ দেশবাসীর নিশ্চয় মনে আছে, ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উৎখাতের পর আন্দোলন না করতে পেরে বলা হয়েছিল, রোজার পর দেখিয়ে দেওয়া হবে। আর এবারে বলা হচ্ছে, করোনা সংক্রমণ হ্রাসের পর দেখা যাবে। প্রথমবার নয় ‘মন তেলও পুড়েনি, রাধাও নাচেনি’। এবারেও শিশু নেতারা রাধাকে নাচাতে পারবে না। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন অবুঝ-অপরিপক্ব নেতা তারেক রহমান যদি মামলার ভয়ে পালিয়ে বিদেশে বহাল তবিয়তে থাকে, তবে নেতাকর্মীরা রাস্তায় নামবেÑ এমন আশা করা বাতুলতামাত্র।
সরকার উৎখাতের সঙ্গে সঙ্গে বড় গলায় আরেকটা কথা বলতে ভালোবাসেন বিএনপি নেতারা। আন্দোলনের তোড়ে না-কি সরকার পালানোর পথ পাবে না। এ-কথা গণতন্ত্রের সঙ্গে খাপ খায় না। তবে সামরিক আইনের মধ্যে ক্ষমতায় থেকে ক্যান্টনমেন্টে প্রতিষ্ঠা পাওয়া দল এবং যে দল ক্ষমতা থেকে তিনবার পালিয়ে বেঁচে গেছে, সেই দলের সঙ্গে বেশ মানানসই। প্রশ্নটা হলোÑ এমন কথা বিএনপি বলছে কেন? রাজনৈতিক নেতারা অনেক সময় শূন্যগর্ভ বুলি উচ্চারণ করেন, যা অনেকক্ষেত্রে সমালোচিত হলেও তা রাজনীতির অঙ্গ। সব দেশেই তা প্রচলিত। কিন্তু বড় গলায় বড় কথা আসলে বিএনপি কেবল সে-জন্য বলছে না। প্রবাদ বলে, আক্রমণ হচ্ছে সেরা প্রতিরক্ষা। বিএনপির প্রধান নেতা তারেক জিয়া এখন পালিয়ে আছেন, সেটা আড়াল করতেই আওয়ামী লীগ নেতাদের পালানোর কথা তুলছেন। আওয়ামী লীগ নেতারা কখনও পালিয়ে গেছেন, এমন ইতিহাসে নেই। একাত্তরে ভারতে যাওয়াটা পালানো নয়। চুরি বা অনৈতিক কাজ করে বিদেশ গিয়ে থাকাটাকে বলে পালানো। জিয়াউর রহমানও ভারত গেছেন। তিনি পালিয়ে গেছেন কেউ বলবে না। যাওয়ার ফলে বীরউত্তম হয়েছেন। স্বাধীনতার সুবাদে বঙ্গবন্ধুর আমলে পরপর প্রমোশন পেয়েছেন।
উল্টো দিকে পালিয়ে যাওয়া ছেলের ইমেজ কেমন? তারেক জিয়ার নামোচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে জেট ফুয়েল কেরাসিন আর বিদ্যুতের খুঁটি খাম্বা হওয়া এবং হাওয়া ভবন আর খোয়াব ভবনের লুণ্ঠন-যথেচ্ছাচার-অবৈধ কাজের কেচ্ছাকাহিনি জনগণের মনে ভাসে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ‘বাকশাল-গণতন্ত্র-হত্যার কালো দিবস’ পালনের দিনে বড় গলায় আরও একটি বড় কথা বলছেন, যা শূন্যগর্ভ নয়, অত্যন্ত অশুভ ইঙ্গিতবহ। তিনি বলেছেন, ‘বাকশাল করেও যেমন শেষ রক্ষা করা যায়নি, তেমনি নির্বাচন কমিশন গঠনের আইন করেও শেষ রক্ষা করা যাবে না।’ বঙ্গবন্ধু বাকশাল করেছিলেন, প্রথম বিপ্লব মুক্তিযুদ্ধ সফল, অর্থাৎ বাঙালির রাজনৈতিক স্বাধীনতার পর দ্বিতীয় বিপ্লব, অর্থাৎ বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়া একটুও দেরি না করে বাকশালে যোগ দেওয়ার জন্য সদস্য হতে আবেদন করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি অতি উৎসাহী হয়ে বাকশাল সরকার কর্তৃক নিযুক্ত জেলা গভর্নরদের অভিনন্দন জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন। সস্ত্রীক জিয়া বাকশালের ৭ মার্চের সভায় উপস্থিত ছিলেন বলেও জানা যায়। তাই বিএনপির নৈতিক অধিকার নেই বাকশালের বিরুদ্ধে বলার। বলতে হলে জিয়ার পক্ষ থেকে ক্ষমা চাইতে হবে।
এমন কথা বলার আগে মির্জা ফখরুলের প্রয়োজন ছিল, এ-কথার ভেতর দিয়ে তিনি যে মারাত্মক ইঙ্গিত করছেন, তা উপলব্ধিতে নেওয়া। হত্যা-ক্যুয়ের ভেতর দিয়ে বাকশাল সরকার অপসারিত হয়েছিল। কারা করেছিল? ১৫ আগস্টের ক্যু টোটল সামরিক বাহিনীর ক্যু ছিল না। নিয়মশৃঙ্খলা ভঙ্গকারী আর্মির কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত মেজররা সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে এই ক্যু সংগঠিত করেছিল। প্রশ্ন হলো- এ-রকম হত্যা-ক্যু করার উসকানি কি দিচ্ছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল! প্রেসিডেন্ট জিয়ারও কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। আর্মির বিদ্রোহী একাংশ জিয়াকে হত্যা করছিল। রাষ্ট্রপতি সাত্তারেরও শেষ রক্ষা হয়নি। খালেদা জিয়ারও তো শেষ রক্ষা হলো না, এতিমদের ট্রাস্টের ফান্ড কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে গেলেন। আদালত সাজা দিলেন। বর্তমান সরকারের শেষ রক্ষা হবে নাÑ বিষয়টি তোলার আগে বিএনপির শিশু নেতাদের ভাবা প্রয়োজন, তাদের বর্তমান নেতা তারেক জিয়ার শেষ রক্ষা হবে তো! কথায় বলে, ‘আগে ডিফেন্স পরে অফেন্স’। বিএনপি আসলে পরেরটা আগে করছে। তাই দলটি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রচার মাধ্যমভিত্তিক রাজনীতি আর বিদেশিদের কাছে ধন্না দিয়ে বেড়াচ্ছে।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকায় বিএনপি দলের রাজনীতি কোনোক্রমে জিইয়ে রাখতে পারছে। এখন বিদেশে আমেরিকায় লবিস্ট নিয়োগের সাফল্য পেয়ে দলটি যেন জেগে উঠেছে। দলটি যেন এখন ক্ষমতার মূলা দেখছে। উল্টো আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে লবিস্ট নিয়োগের অভিযোগ তুলছে। এই অভিযোগ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ কে মোনেমের বক্তব্যের প্রসঙ্গে টেনে জাতীয় সংসদের ষোড়শ অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ধন্যবাদ আনা প্রস্তাব এবং অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘সব সময় পিআর ফার্ম নেওয়া হয়। যাতে বিনিয়োগ বাড়ে, উৎপাদন বাড়ে। আর যেন বেশি রপ্তানি করতে পারি। দেশের অধিকার সংরক্ষণ করার জন্য। কিন্তু বিএনপির কাজটা কী ছিল?… কত লাখ ডলার বিএনপি খরচ করেছে, এটা আমার প্রশ্ন? এই অর্থ তারা কোথা থেকে পেল? এটা তো বৈদেশিক মুদ্রা।’
স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার স্বার্থে সরকারের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী সুস্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছেন। বিএনপির কাছ থেকে জনগণ এখন স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা দাবি করে। প্রসঙ্গত, পিআর ফার্ম আর লবিস্ট নিয়োগে পার্থক্য রয়েছে। পিআর ফার্ম পাবলিক গণসংযোগের কাজ করে এডিটরিয়েল কভারেজের মাধ্যমে মার্কিন সরকারকে প্রভাবিত করা আর লবিস্ট হচ্ছেÑ যোগাযোগ আছে এমন পেশাজীবী, যাদের নিয়োগ করা হয়, গণপ্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কাজ হাসিল করে আনার জন্য। এ-ব্যবস্থা আমেরিকাতে আইনসম্মতভাবে চালু থাকলেও ঘুষ কিংবা চাঁদাবাজি হিসেবে সাংবাদিক ও জনগণের একাংশের মধ্যে এই প্রথা সমালোচিত-নিন্দিত। এই সমালোচিত-নিন্দনীয় কাজে বিএনপি ও জামাত যুক্ত কি নাÑ এটাই এ ইস্যুতে বড় প্রশ্ন।
যতটুকু মনে পড়ছে, ২০০১-০৬ বিএনপি-জামাত আমলে বিএনপি আমেরিকায় লবিস্ট নিয়োগ করেছিল। পরে ইন্টারনেট ঘেঁটে কলাম লেখক আবদুল্লাহ হারুন জুয়েলের লেখা থেকে পড়লাম, ২০০৬ সালের ডেইলি স্টারের রিপোর্ট। তা থেকে জানা যায়, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সুদৃষ্টি লাভের আশায় ওয়াশিংটর গ্রুপ ও কেচুম ওয়াশিংটন নামের দুই লবিস্ট ফার্ম ও একজন নীতি-নির্ধারককে ভাড়া করেছে বিএনপি। এজন্য প্রতিটি ফার্মকে মাসে ৪৫ হাজার মার্কিন ডলার দেওয়া হবে। পকেট খরচ বাদে মাসে দেওয়া হবে ৭৫০ ডলার।… মানবাধিকার লঙ্ঘন, ক্রসফায়ার, দুর্নীতি ও ইসলামি জঙ্গিবাদের কারণে বিএনপির যে ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছিল, সে অবস্থার উত্তরণে তখন এই উদ্যোগ নেওয়া হয়।’
একটু খেয়াল করলেই স্মরণে আসবে, বিশ্ব মাফিয়া ভারতের ডন ইব্রাহিমের সঙ্গে তারেক রহমানের একাধিক বৈঠকের কথা তখন প্রকাশিত হয়েছিল। সেটা ছিল ‘বাংলাভাই’ আর মুফতি গংদের উত্থানের শেষ পর্ব। ক্ষমতার প্যারালাল কেন্দ্র হাওয়া ভবনের তৎপরতার ভেতর দিয়ে দেশ তখন ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’, ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ প্রভৃতি তালিকায় উঠেছিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন সংসদে বলেছেন, ২০১৪ সালে জামায়াতে ইসলামী মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করতে লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করে। আর বিএনপি তো লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করছেই। বিষয়টা নিঃসন্দেহে এখন জ্বলন্ত ইস্যু। তাই সরকারে থাকতে বিএনপি তা করেছিল কি না, এখন করেছে কি না, তাও দেশের স্বার্থে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আওতায় আনা প্রয়োজন।
বিএনপি র‌্যাব ও এর কয়েকজন বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তার ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকেও ইস্যু করতে অতি তৎপর। এ বিষয়ে আলোচনায় যাওয়ার আগে পূর্বাপর র‌্যাবের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা প্রাসঙ্গিক। এটা তো জানাই আছে, বিএনপি-জামাত আমলে র‌্যাব গঠিত হয়েছিল এবং এর ট্রেনিং ইত্যাদির সঙ্গেও আমেরিকা জড়িত। ওই আমলে র‌্যাব থাকা সত্ত্বেও ছিল উগ্র জঙ্গি বাংলাভাই আর মুফতি গংদের বাড়বাড়ন্ত। গুম, ক্রসফায়ার তখন ছিল তুঙ্গে। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী জামালউদ্দিন গুম-হত্যা-বিচারে বাধা প্রভৃতি ঘটনা থেকেই প্রমাণ করে গুম তখন কোন্ উচ্চতায় পৌঁছেছিল। তখন ক্রসফায়ারে মৃত্যু হয়েছিল ৩৮০ জনের। এর মধ্যে অনেকে ছিলেন নিরীহ মানুষ। সরকারের আদেশে র‌্যাব তা করেছিল বলেই তখন র‌্যাবকে দায়মুক্তি দিয়েছিল।
বর্তমানে আওয়ামী লীগ আমলে র‌্যাবের ভূমিকা দুই কারণে প্রশংসিত হতে বাধ্য। উগ্রজঙ্গি তৎপরতা শক্ত হাতে দমন করা হয়েছে। ২০১৬ সালের হোলি আর্টিজানের পর আর জঙ্গি তৎপরতা নেই। ক্রসফায়ার উবে গেছে। তবে আলো-অন্ধকারের মতোই রাষ্ট্রের যে কোনো সংস্থার প্রশংসা-সমালোচনা থাকবে। আমাদের দেশে অপরাধের যা ধরন, চেইন যতটা শক্তিশালী এবং গভীরে প্রোথিত ও বিস্তৃত, তাতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কোনো কাজের জন্য সমালোচিত হবে না এমন নয়। আমেরিকার ছোট শরিক পাকিস্তানি আমলে, মুক্তিযুদ্ধ, পঁচাত্তরের এবং প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামরিক শাসন প্রভৃতি ঘটনায় ঘা খেতে খেতে খেতে দেশবাসী এখন আর অন্ধ নয়। ভালো-মন্দ বোঝে। ভালো কাজের প্রশংসা ও মন্দ কাজের সমালোচনা দেশে রয়েছে। এর ভেতর দিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। আমেরিকা এখনও সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ বাতিল করেনি। তাই উগ্র-জঙ্গি দমনের কাজে সাফল্যের জন্য তো আমেরিকার র‌্যাবকে প্রশংসা করার নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে।
কিন্তু মহাশক্তিধর এদেশটি যে অন্ধ! কোথায় এখন তাদের পেয়ারের পাকিস্তান! ঋণে তো দেউলিয়া হওয়ার অবস্থা। আর তাদের বিরাগের দেশ বাংলাদেশ এখন রয়েল বেঙ্গল টাইগার হতে যাচ্ছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় বিরোধিতা করে, চুয়াত্তরের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত দেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আখ্যায়িত করে আমেরিকা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে হত্যা-ক্যু-পাল্টা ক্যু আর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামরিক শাসনের গাড্ডায় ফেলে দিয়েছিল। তখন কোথায় ছিল মানবাধিকার! এখন যখন মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে তখন আবার পিছে লেগেছে। মূলত ভূ-রাজনৈতিক কারণে আমেরিকা বাংলাদেশের পিছে লেগে আছে। মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইলে মাথায় মারে বাড়ি। আমেরিকাতে পুলিশের অমানবিকতা নেই! নিজের আয়নায় নিজে আগে মুখ দেখা দরকার। এক নম্বর পরাশক্তি হিসেবে আমেরিকার মোড়লিপনা না মেনে উপায় নেই। এ-দিকটি বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, অমানবিকতা বা বিচারের দুর্বলতা থাকলে আলোচনা করা যায়, সমালোচনা করা চলে, সাহায্য করাও দরকার। কিন্তু তা না করে নিষেধাজ্ঞা কেন? অভিজ্ঞতা থেকে দেশবাসী বুঝে, এই নিষেধাজ্ঞা মানবাধিকার সুরক্ষার জন্য আমেরিকার আগ্রহের বহিঃপ্রকাশ নয়, রাজনৈতিক বিবেচনার ফায়দা তোলার জন্য তা করা হয়েছে।
সমাজতন্ত্র-ধনতন্ত্র ঠা-া যুদ্ধ যুগে সেই সত্তরের দশক থেকে আফগানিস্তান দেশটির পেছনে লেগে আছে আমেরিকা। এতদিনে দেশটির মানবাধিকার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। পাকিস্তানেরও বারোটা বাজতে চলেছে। আলোচনা-সমালোচনা-সাহায্য না করে যদি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফায়দা লুটতে চায় আমেরিকা, তবে যত শক্তিধরই হোক না কেন, একাত্তরের বাংলাদেশের মতো আর বর্তমানের আফগানিস্তানের মতো ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে নাক কাটা যাবে দেশটির। আদি কবির লেখা রামায়ণের মতো নাক কাটা রাক্ষুসী সূর্পণখা হবে আমেরিকা! ইতিহাসের পাঠ নিতে হবে ছোট-বড় সব দেশকে। স্বাধীনতাপ্রিয় আমেরিকাকে ঔপনিবেশিক বন্ধনে বেঁধে রাখতে এককালের মহাশক্তিধর ব্রিটেন উঠে-পড়ে লেগেছিল, পারেনি। আমেরিকান কালোদের দাস বানিয়ে মানবাধিকারকে পদদলিত করতে চেয়েছিল আমেরিকারই সাদা দাস মালিকরা, পারেনি। বাংলাদেশকেও কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। মানব জাতির লাখ লাখ বছরের পথপরিক্রমায় মর্তের বিধাতা কেউ হতে পারেনি, পারবেও না। ‘ক্ষমা তোমার চাইতে হবে/নামিয়ে মাথা হে বিধাতা।’
ভারতের অভিজ্ঞতা থেকে জানাই আছে, আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা যতটা মানবিক, তার চেয়ে সহস্র গুণ রাজনৈতিক। আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা আজ আছে তো কাল থাকবে না। রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে স্বার্থ খুঁজবে দেশটি। সরকারকে চাপ দেবে। দেশটির বোঝা উচিত, চাপের কাছে নতি স্বীকার করার মতো দল নয় আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু-কন্যা বঙ্গবন্ধুর মতোই। মাথা নত করার দলে নেই; কিন্তু বিএনপি টোপ গিলবে। যেমন ২০০১ সালে বিএনপি আমেরিকারকে গ্যাস রপ্তানির ওয়াদা দিয়েছিল। বিএনপি-জামাত ক্ষমতায় বসেছিল। দেশবাসীর মনে থাকার কথা, ওয়াদা রাখতে কতটা ব্যাঘ্রতা দেখিয়েছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াও। দেশ বিক্রির কথা বড় গলায় বলে বিএনপি। গ্যাস রপ্তানির ওয়াদা দিয়ে দেশকে বিক্রি করে দিতে চেয়েছিল। ওয়াদা কি রেখেছে বিএনপি! এমন ওয়াদা বাস্তবায়ন সম্ভব? যেনতেন প্রকারে ক্ষমতা চায় বিএনপি। পরে কলা দেখায়। অতএব বুজহে দেশি-বিদেশি সুজন! দেশি সুজন! কবিগুরুর কথাই সঠিক : ‘বাবু যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ।’
সামনেই নির্বাচন। ২০১৪ সালে যুদ্ধাপরাধী ঘাতক-দালালদের বিচার বন্ধ করার দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র সামনে রেখে নির্বাচন বয়কট করে জ্বালাও-পোড়াও লাইনে গিয়েছিল বিএনপি-জামাত। কাজের কাজ হয়েছে, বিরোধী দল আর সেই সঙ্গে বিরোধীদলীয় নেত্রীর মর্যাদাটা খোয়া গেছে। ২০১৯ সালের নির্বাচনে নেতা প্রজেকশন না করে বিএনপি নির্বাচনে যেতে বাধ্য হয়েছে। সংসদীয় নির্বাচনে জনগণকে পক্ষে টানতে দলীয় নেতা সামনে রাখতে হয়। কিন্তু ‘হওয়া ভবন’ খ্যাত তারেক জিয়া নেতা হওয়ায় বিএনপি তা দেখাতে পারেনি। ফলাফল যা হওয়ার, তাই হয়েছে। তবে কাজের কাজ ঠিকই হয়েছে, লন্ডনে মনোনয়ন বাণিজ্য ভালোই জমেছে। সব দিক বিবেচনায় নিয়ে বলতে হয়, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বিএনপির অতি তৎপর হওয়া বোকার স্বর্গে বাস করারই শামিল। রাজনৈতিক দলের গণজোর আছে তো সব আছে, আর নাই তো সব শূন্য। আমেরিকার দিকে না তাকিয়ে জনগণ বা নিজ দলের দিকে দৃষ্টি ফেরালে বিএনপি দল হিসেবে বাঁচতে পারে। তবে ক্যান্টনমেন্টে জন্ম নেওয়া দলটির শুভ বুদ্ধির উদয় হবে না। ঠিক যেমন কয়লা ধুলেও ময়লা যায় না।
এটা তো সকলের জানা যে, রাজনৈতিক দল আগে দেখে দেশ, পরে বিদেশ। প্রথমে জাতীয় রাজনীতি পরে কূটনীতি। তবে বিএনপির প্রতিষ্ঠাই হয়েছিল বাংলাদেশকে তার জন্মলগ্নের মর্মবাণী, জাতীয় চার মূলনীতি থেকে এবাউটটার্ন করাতে। সূচনাতে উল্টোমুখি তাই বিএনপি সব ক্ষেত্রেই উল্টো দিকে যায়। যেই দেখেছে তার লবিস্টরা সাফল্য আনছে, তখন দেশের দিকে দৃষ্টি ফেরাচ্ছে। ২৮ জানুয়ারি ভার্চুয়াল ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তারেক রহমানের সভাপতিত্বে রাত ৯টা থেকে ৫ ঘণ্টা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচ্যসূচি হচ্ছে, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য বৃহত্তর ঐক্য ও আন্দোলন। তবে, অন্যান্য দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনের বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। সভায় নির্বাচন কমিশনসহ সামগ্রিক বিষয়ে আলোচনার জন্য বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় করে জোট বড় গঠন করে একদফা দাবি দাবিতে আন্দেলনে নামার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন নিয়ে সংলাপে অংশগ্রহণ করেনি, এমন দলগুলো হচ্ছে বিএনপির কাছে বিরোধী দল।
ইতোমধ্যে দলটি বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ অনেক দলের সঙ্গে বৈঠক বা যোগাযোগ করছে, মতবিনিময়ও হয়েছে। বৈঠকে ঠিক হয়েছে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যজোটে থাকা ১৪-দলকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। তবে জামাতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। উদ্দেশ্য হচ্ছে বড় জোট করে একদফা দাবিতে দুর্বার আন্দোলন। বিএনপি যখন বৃহত্তর জোট করতে উদ্যোগী, তখন দলটির ডান-বামে দুদিকে দুই জোট রয়েছে। জামাতসহ সাম্প্রদায়িক দলগুলোকে নিয়ে ২০-দলীয় জোট এবং গণফোরামের ড. কামাল হোসেনকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। বিগত নির্বাচনেই দেখা গেছে, দুই দিকের টানাটানিতে নির্বাচনী প্রচারের কেমন বিধ্বস্ত হাল হয়েছে। নির্বাচনের পর জোট দুটো আর সচল থাকেনি। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, বিএনপির সঙ্গে ঐক্যফন্ট করতে গিয়ে গণফোরাম নিজ দলের ঐক্যই অটুট রাখতে পারেনি। তিন খ- হয়েছে। ওই ঐক্যজোটের অন্য দলগুলো এখন কি অবস্থায় আছে, তা কেউ বলতে পারবেন কি না কে জানে!
বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর থেকে ছোট ছোট বাম-মধ্য যত দল বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছে, এমন দলগুলোর পূর্বাপর বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে, কোনো দলেরই লাভ হয়নি; বরং দলগুলো ভ্যানিস হয়েছে বা হওয়ার পথে গেছে। ডান দল বিশেষত বিএনপির সঙ্গী হয়ে জামাত লাভবান হয়েছে। যুদ্ধাপরাধী নেতাদের গাড়িতে-বাড়িতে জাতীয় পতাকা উঠেছে। তবে শেষ ফল হচ্ছে, বিএনপিসহ ওই জোটের সবগুলো দল গাড্ডায় পড়েছে। মূল কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশের জন্মেলগ্নে মর্মবাণীর বিপরীতমুখী এই দলগুলো হত্যা-ক্যুয়ের ভেতর দিয়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। জন্মই তাদের আজন্ম পাপ। এই পাপের ভোগ দেশবাসী কত দিন বয়ে বেড়াবে এটাই বড় প্রশ্ন। আওয়ামী লীগের সাফল্য ও অর্জনই কেবল দেশবাসীকে পাপমুক্ত হওয়ার পথে নিয়ে যেতে পাবে। দেশ পাপমুক্ত হোক, এটাই ভাষা শহিদদের স্মৃতিবিজড়িত মাস ফেব্রুয়ারির একান্ত কামনা।

লেখক : সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, উত্তরণ

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকটি হাতের সন্ধান চেয়ে বিজ্ঞাপন
পরবর্তী নিবন্ধকবিতা
আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য