Wednesday, October 4, 2023
বাড়িকৃষিবেড়েছে আবার দেশি চালের কদর

বেড়েছে আবার দেশি চালের কদর

রাজিয়া সুলতানা

“আমার বাড়ি যাইও ভোমর,
বসতে দেব পিঁড়ে,
জলপান যে করতে দেব
শালি ধানের চিঁড়ে।
শালি ধানের চিঁড়ে দেব,
বিন্নি ধানের খই,
বাড়ির গাছের কবরী কলা,
গামছা-বাঁধা দই।”

পল্লী কবি জসিম উদ্দীনের ‘আমার বাড়ি’ কবিতাটিতে শালি ধানের চিঁড়া আর বিন্নি ধানের খই-এর কথা বলা হয়েছে। যা ছাড়া অতীতে অতিথি অ্যাপায়নের কথা ভাবাই যেত না। আবার ফিরে আসছে সেই দিন। কদর বেড়েছে দেশি জাতের চালের। জায়গা করে নিচ্ছে ঢেঁকিছাঁটা লাল চাল। দৌরাত্ম্য কমছে মিলে ভাঙানো ছাঁটাই করা চকচকে সাদা চালের। দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। পূরণ হয়েছে খাদ্য নিরাপত্তা। মানুষের দৃষ্টি এখন পুষ্টি নিরাপত্তার দিকে। আর এ-কারণেই বাংলার সচেতন মানুষ বাংলার ঘরের সন্তানকে আবার সযতনে ঘরে ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছে। পাতে তুলে নিচ্ছে দেশি চালের ভাত। কারণ উফসি ও হাইব্রিড জাতের ধান হতে দেশি জাতের ধান পুষ্টিগুণ বিচারে অনেক উপরে। কিন্তু উফসি আর হাইব্রিড ধানের উচ্চ ফলনের ভিড়ে চাপা পড়ে গেছে কম উৎপাদনশীল দেশি ধান। খুঁজে পাওয়া যায় না দেশি জাতের ধানের চাল। কিছু বিপণি বিতানে মিলছে দেশি ধানের চাল। কিন্তু বিপরীতে গুনতে হচ্ছে চড়া দাম।
নির্দিষ্ট কিছু কারণে বাংলা হতে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে দেশি জাতের ধান। বাংলার মাটি খুবই উর্বর। তাই তো সকল ধরনের শস্যে ভরপুর ছিল বাংলা। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলায় খাদ্য ঘাটতি দেখা দিল। তাই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের খাদ্যের চাহিদা পূরণ করতে স্বাধীনতার অব্যাহতি পরেই সবুজ বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে বাংলার কৃষিবিদগণ মনোযোগ দিয়েছিলেন উফসি ও হাইব্রিড ফসল উৎপাদনের দিকে। মাছে ভাতে বাঙালি। বাঙালির প্রধান খাদ্য ভাত। তাই তো কৃষিবিদদের প্রথম ও প্রধান চেষ্টা ছিল ধানের উৎপাদন বাড়ানো। এর ফলে উচ্চ ফলনশীল ধান জায়গা করে নিল দেশি জাতের ধানের জায়গায়। দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্র্ণ। জাতিসংঘের তথ্যমতে, উৎপাদনের দিক দিয়ে বাংলাদেশ আজ কৃষির ১১টি সেক্টরে শীর্ষ ১০-এর তালিকায়। বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ আজ রোল মডেল। ধান উৎপাদনে আমরা আজ তৃতীয়। কিন্তু এত সাফল্য গাঁথার মধ্যেও রয়েছে বিরহের সুর। তা হলো উফসি আর হাইব্রিডের ভিড়ে হারিয়ে যেতে বসেছে দেশি জাতের ধান। বিজ্ঞানের উন্নতি তথা কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ফলে ধান আর ঢেঁকিতে ভাঙানো হয় না। মিলে ভাঙানো হয়। ধান কেটে নির্দিষ্ট আকার দেওয়া হয়। তৈরি করা হয় মিনিকেট চাল। পলিশ করে চকচকে করা হয়। এর ফলে আমরা ভোক্তা যারা আছি, তারা পাচ্ছি কম পুষ্টিকর চাল। অতীতকাল হতেই বাঙালির প্রধান খাদ্য ভাত। ফলে দেশের অধিকাংশ জনগণের পুষ্টির চাহিদা পূরণ হয় ভাতের মাধ্যমে। কারণ চালে রয়েছে মানবদেহের প্রয়োজনীয় প্রায় সব উপাদান। প্রতি ১০০ গ্রাম চালে রয়েছে ১২৯ কিলোক্যালরি শক্তি, ৭৮.০৯ গ্রাম শর্করা, ৭.১২ গ্রাম প্রোটিন, ০.২৮ গ্রাম চর্বি, ১.৩০ গ্রাম আঁশ, ০.০৭ মিলিগ্রাম থায়ামিন, ০.০১৫ মিলিগ্রাম রিভোফ্লাবিন, ১.০৯ মিলিগ্রাম জিঙ্ক, ২৮ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ০.৮০ মিলিগ্রাম আয়রন ও ২৫ মিলিগ্রাম ম্যাগনেসিয়াম। এসব উপাদান শরীরের বিপাকীয় প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। হরমোন নিঃসরণে সাহায্য করে। নানা ধরনের সুখ-বিসুখ নিয়ন্ত্রণ করে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। কিন্তু উফসি ও হাইব্রিড ধানে এসব উপাদান আনুপাতিক হারে কমে যায়। কারণ অনেক। তবে প্রধান কারণগুলো হলোÑ এ ধরনের ধান উৎপাদনে অতিরিক্ত মাত্রায় সেচ, সার, কীটনাশক ও জীবাণুনাশকের প্রয়োগ। মোদ্দাকথা দেশি জাতের ফলন কম কিন্তু পুষ্টিমান বেশি। তাই তো সঠিক পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সচেতন মানুষের কাছে আজ চাহিদা বেড়েছে দেশি জাতের পুষ্টিকর চালের। আধুনিক যুগের সচেতন মানুষ জেনে গেছে, দেশি জাতের ঢেঁকিছাঁটা রঙিন চালের ভাত, সাদা চালের ভাতের চেয়ে অধিক পুষ্টিকর। রঙিন চালের রং অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট এবং অ্যান্থোসায়ানিন নামক যৌগ সমৃদ্ধ। রঙিন চালের ভাতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার, অ্যান্টি-অক্সিডেন্টস, ফাইটোনিট্রিয়েন্টস, ফাইটোক্যামিক্যালস, ভিটামিন-ই, আয়রন এবং প্রোটিন। ফলে এটি প্রদাহ কমায়, কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে, উচ্চ রক্তচাপ হ্রাস করে এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখে। এমনকি এ চাল ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি কমায়। এ চালের ভাত হজম করতে বেশি সময় লাগে বলে ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ করে। যা ওজন হ্রাসেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে উপমহাদেশে সর্বাধিক প্রচলিত ও বহুল ব্যবহৃত হয় সাদা চালের ভাত। সাদা চাল উচ্চস্তরের পরিশোধনের মাধ্যমে তৈরি করা হয়। ফলে থায়ামিন, ভিটামিন-বি এর মতো অন্যান্য কিছু প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান হারাতে হয়। তাই তো সাদা চালের ভাতে পুষ্টি কম। তবে এটি শক্তির ভা-ার। এই চালে স্টার্চের ঘনত্বের কারণে যে কোনো চালের চেয়ে দেহে বেশি শক্তি দেয়।


আমাদের দেশে এক সময় হাজার হাজার জাতের দেশি ধানের জাত ছিল। এলাকা বিশেষে চাষও হতো। এখনকার মতো হাতে গোনা কয়েকটি জাতের চাষ হতো না। প্রায় ৭০ বছর আগে এক গবেষণায় উঠে এসেছে বাংলাদেশে দেশি ধানের জাতের সংখ্যা ছিল ১৮,০০০। তবে আশির দশকে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট সারাদেশ হতে আবাদকৃত দেশি ধানের জাত সংগ্রহ করতে পেরেছিল মাত্র ১২ হাজার ৫০০টির মতো। তবে সর্বশেষ ২০১১ সালে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৮ হাজার ৬০০ জাতের দেশি ধান। দেশি জাতগুলো কৃষক দ্বারাই উদ্ভাবিত ছিল। ধান চাষের আদি রূপকার ছিল বাংলার নারীরা। কারণ বাংলার রমণীরাই লাউয়ের বস, বাঁশের চোঙ, ডুলি ইত্যাদিতে বীজ ধান প্রস্তুত করত। আর প্রাকৃতিকভাবে মিউটেশনের ফলে বিভিন্ন জাতের ধানের জাত সৃষ্টি হতো। নামকরণ করা হতো ধানের বৈশিষ্ট্য, স্থান, কাল, ফুল, নদী, মাছ, পশু ইত্যাদি অনুযায়ী। অত্যন্ত ভালোবেসে তাদের নাম দেওয়া হতো। নাম শুনলেই বুঝা যায় কত যতেœ লালিত ছিল সেসব ধান। কত নান্দনিক ছিল আমাদের কৃষককুল। যেমনÑ লক্ষ্মীবিলাস, নাইজারশাল, রাজাশাইল, রাতাশাইল, পানিশাইল, ঘৃতকাঞ্চন, বিন্নি, শালি, দাদখানি, মালশালা, নীলকমল, ফুল বালাম, কাটারিভোগ, কালিজিরা, চিনিগুঁড়া, চিনি আতপ, বাদশাভোগ, খাসকানী, বেগুনবিচি, তুলসীমালা, ভাদই, কাকুয়া, এলাই, মইন্দাগিরি, ডুমরা, লোহাজাং, লালচল্লিশ, চন্দন, চামারা, বাঁশিরাজ, গান্জিয়া, বাঁশফুল, গচি, রাতা বোরো, বিরুই, নুনিয়া, চিনিশাইল, মাগুড়ি, বেতো, চাঁপাকলি, সিঙ্গারিয়া, আমলা কাঁচা, কাঁন্দিশাও, খলিশানীবেত, কালীমন, ফুলকাঁচা, মুড়িয়া, আবালী, কানশাহারা, কংশ, চাঁদা, দংশ, খোঁড়া, আগুর পাঠ, চেঙ্গা, আশ্বিনা, পাথর নুটি, ঠাকুরবীন, লাকাই, টেপি, রঙ্গিলা টেপি, বিচি, ধলাকাচাই, মৌমাইল ও গড়িয়া, মাছরাঙ্গা, ঘিকাঞ্চন, গৌরকাজল, সূর্যমনী, কলমীলতা, বনফুল, ভাটিয়াল, মেঘলাল, সাগরদিঘি, পঙ্খীরাজ, গোবিন্দভোগ, জামাইভোগ, মোগাইবালাম, রূপকথা, রাঁধুনীপাগল, দেবকন্যা, দুধসর, পাঙ্গাস ইতাদি।
আজও সগৌরবে বাংলার চাষিরা চাষ করছেন দেশি জাতের ধান। তবে পাহাড়িয়া এলাকায় জুম চাষ পদ্ধতিতে উপজাতিদের মধ্যে দেশি ধানের চাষের প্রচলন বেশি। জাতগুলোর মধ্যে কাটারিভোগ, কালিজিরা, বিন্নি, বাসমতি, চিনিগুঁড়া, চিনি আতপ, বাদশাভোগ, খাসকানী, বেগুনবিচি, তুলসীমালা ইত্যাদি উল্ল্যেখযোগ্য। কাটারিভোগ ধানের আতপ চালের পোলাও জনপ্রিয়তার শীর্ষে। আর চিঁড়া হয় হালকা ধবধবে সাদা। রয়েছে মিষ্টি সুগন্ধ। ব্যতিক্রমধর্মী সাদা চালের মধ্যে আছে বাসমতি চাল ও ‘হোল গ্রেইন’ চাল। বাসমতি চালে আছে ভিটামিন বি, কর্পূর এবং ম্যাগনেসিয়াম, যা রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। বাসমতি চাল ঢেঁকিছাঁটা হলে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি-কারসিনোজেনিক উপাদান সম্পূর্ণ হয়ে যায়। বিন্নি ধানের খৈ ছাড়া আজও লোকজ উৎসব জমতেই চায় না। চামারা টাঙ্গাইল অঞ্চলের জাত। এটি রোপণের পর বন্যা বা বৃষ্টি হলে খাল-বিলে যত হাত পানি হতো, ধানটিও তত লম্বা হতো। এমনকি বন্যার সময় ৫ থেকে ৬ ফুট পানির নিচ থেকেও এসব ধানের মাথা দেখা যেত। পানি কমার সাথে সাথে ধান গাছটিও নিজেকে গুটিয়ে নিত। পরে লম্বা হয়ে মাটি থেকে আবার ধান গাছটি দাঁড়িয়ে যেত। ধানটির গুরুত্ব বুঝাতে জনশ্রুতি ছিলÑ ‘ধানের মধ্যে চামারা আর ইষ্টির মধ্যে মামারা।’ কালোজিরা ধানের ভাত অসুস্থ রোগীকে খাওয়ানো হতো পথ্য হিসেবে। তাছাড়া গর্ভবতী মায়েদের জন্য খুবই উপকারী ছিল। এসব দেশি ধান আবাদ করতে জমিতে দিতে হয় না কোনো রাসায়নিক সার ও কীটনাশক। খরা, লবণাক্ত, জলাবদ্ধতা সহনশীল। এসব কারণে সাধারণ চালের থেকে দেশি চালে পুষ্টি উপাদান থাকে কমপক্ষে ৩ গুণ বেশি। তাছাড়া চাষ করতে খরচও পড়ে কম। এখনও আমরা চিড়া, মুড়ি, পিঠা, পায়েস তৈরিতে দেশি জাতের চালই ব্যবহার করতে চাই।
নতুন জাতের ধান আবাদে ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে মাটির উর্বরা ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। বালাইনাশক প্রয়োগে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। সেচের প্রভাবে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। হাজার হাজার বছর ধরে আবাদকৃত ধানের জাতসমূহ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ফসলের ক্ষেত হয়ে পড়ছে বৈচিত্র্যহীন। তাছাড়া জলবায়ু ও আবহাওয়ার পরিবর্তন হচ্ছে। অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে আধুনিক ধানের আবাদ। তাই তো আমাদের দেশি ধানের আবাদ বন্ধ করা যাবে না। পাশাপাশি আবাদ করতে হবে দেশি, উফসি ও হাইব্রিড ধানের জাত। দেশি ধানের জাত সংগ্রহ করে জিন ব্যাংকে রাখলে চলবে না। সরকারি কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। বীজের জোগান দিতে হবে। তাহলে আমাদের দেশের ভবিষ্যতের ২৫ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার পাশাপাশি পুষ্টি নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে।
আমাদের দূরদর্শী সরকার আগামী ২০৩১ সালে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। যেখানে প্রধান হাতিয়ার কৃষি তথা বাংলার কৃষক। তবে এখন আমাদের সমাজে যারা কৃষিকাজ করছে তাদের অধিকাংশের বয়স ৫০ হতে ৫৫ বছর। তাই এই হাতিয়ারকে সচল রাখতে গেলে যুবসমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। ধানের উৎপাদন বেড়েছে। বাড়াতে হবে রপ্তানি। করোনা মহামারির ধাক্কায় সব সেক্টর মুখ থুবড়ে পড়লেও কৃষির সকল সেক্টরেই ছিল জয়জয়কার ভাব। সুতরাং আমরা দৃঢ়ভাবে আশা করতে পারি, আমরা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অবশ্যই উন্নত দেশে পরিণত হব।

লেখক : শিক্ষক, পিএইচডি গবেষক, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ
শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরে বাংলা নগর, ঢাকা
raziasultana.sau52@gmail.com

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য