মুনতাসীর মামুন
বিজয় অর্জিত হয়েছে; কিন্তু কী যেন নেই। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে আমরা যারা বাংলাদেশে তাদের অনুভব তখন ছিল এ-রকম। বাংলাদেশ হলো কিন্তু বঙ্গবন্ধু নেই- এ কেমন কথা? তার নামেই তো যুদ্ধ হয়েছে। ৪০ বছর হয়ে গেল; কিন্তু এখনও আবছা আবছা মনে পড়ছে, অনেকে রোজা রেখেছেন, অনেকে নফল নামাজ পড়েছেন যাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নিরাপদে ফিরে আসতে পারেন। পাকিস্তানিরা তো নিষ্ঠুরেরও অধম। আল্লাহ্ কি বাঙালিদের প্রার্থনায় সাড়া দেবেন? সত্যিই সারাদেশের মানুষের মনোভাব ছিল সে-রকমই।
হঠাৎ খবর রটে গেল বঙ্গবন্ধু ফিরছেন। মুহূর্তে বিষণ্ণ ক্লান্ত, যুদ্ধে বিধ্বস্ত বাঙালি যেন জেগে উঠল। আমি দেখেছি, স্বজন হারানোর বেদনার পরও তখন অনেকের মুখে হাসি ফুটে উঠেছিল। মনোভাবটা ছিল এ-রকম- তিনি স্বাধীনতা এনেছেন, আমাদের ভার এখন তার ওপর, তিনিই দেখবেন আমাদের।
১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ফিরবেন। ৭ মার্চ আমরা যেমন ছুটে ছিলাম রমনা রেসকোর্সের দিকে, ১০ জানুয়ারিও ঢাকাবাসী রওয়ানা হলো রেসকোর্সের দিকে। একদল ছুটল তেজগাঁ বিমানবন্দরের দিকে। তেজগাঁ থেকে রমনা পর্যন্ত রাস্তার দু-পাশেও মানুষজন চাতকের মতো দাঁড়িয়ে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্লেনটি যখন নামল তখন কেউ আর কোনো কিছু মানতে চায়নি। প্লেনের দোরগোড়ায় তাকে জড়িয়ে ধরে তাজউদ্দীন আহমদ ও সহকর্মীদের কান্না। তারপর ট্রাকে করে রমনার দিকে যাত্রা। সেই দৃশ্য এখন বর্ণনা করা দুরূহ। আমরা সৌভাগ্যবান আমরা রমনা রেসকোর্সে তার ৭ মার্চের ভাষণ যেমন শুনেছিলাম, ১০ জানুয়ারির ভাষণও তেমন শুনেছি।
সেই একই উত্তেজনা, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আনন্দ। কারণ, তিনি ফিরে এসেছেন। ১০ জানুয়ারির ভাষণের পুরোটা এখন হাতের কাছে নেই, সারাংশটি আছে। কিন্তু, বঙ্গবন্ধুর সেই আবেগে ভরা কণ্ঠস্বর মনে আসে। ৭ মার্চ ছিল দৃঢ় প্রত্যয়, ১০ জানুয়ারি ছিল উদ্বেগ।
বক্তৃতায় তার মুক্তি পাওয়ার পটভূমি উল্লেখ করেছিলেন। এর পরেও ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে এক সাক্ষাৎকারে সে-প্রসঙ্গে কিছু বলেছিলেন, যা ১৮ জানুয়ারি (১৯৭২) নিউইয়র্কে টেলিভিশনে প্রচারিত হয়েছিল। ফ্রস্ট তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন-
“এমন কী শেষ মুহূর্তে ইয়াহিয়া খান এখন ভুট্টোর হাতে ক্ষমতা তুলে দেন, তখনো না-কি তিনি ভুট্টোর কাছে আপনার ফাঁসীর কথা বলেছিলেন? এটা কি ঠিক?
শেখ মুজিব : হ্যাঁ, ঠিক। ভুট্টো আমাকে সে কাহিনীটা বলেছিল। ভুট্টোর হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার সময় ইয়াহিয়া বলেছিল : মি. ভুট্টো, আমার জীবনের সব চাইতে বড় ভুল হয়েছে “শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসী না দেওয়া।”
ফ্রস্ট : ইয়াহিয়া এমন কথা বলেছিল!
শেখ মুজিব : হ্যাঁ, ভুট্টো এ কথা আমায় বলে তার পরে বলেছিল : ‘ইয়াহিয়ার দাবি ছিল, ক্ষমতা হস্তান্তরের পূর্বে সে পেছনের তারিখ দিয়ে আমাকে ফাঁসী দেবে।’ কিন্তু ভুট্টো তাঁর এ প্রস্তাবে রাজী হয়নি।
ফ্রস্ট : ভুট্টো কি জবাব দিয়েছিল? তাঁর জবাবের কথা কি ভুট্টো আপনাকে কিছু বলেছিল?
শেখ মুজিব : হ্যাঁ, বলেছিল।
ফ্রস্ট : কি বলেছিল ভুট্টো?
শেখ মুজিব : ভুট্টো ইয়াহিয়াকে বলেছিল, না আমি তা হতে দিতে পারি না। তাহলে তার মারাত্মক প্রতিক্রিয়া ঘটবে। বাংলাদেশে এখন আমাদের এক লাখ তিন হাজার সামরিক বাহিনীর লোক আর বেসামরিক লোক বাংলাদেশ আর ভারতীয় বাহিনীর হাতে বন্দি রয়েছে। তাছাড়া পাঁচ থেকে দশ লাখ অবাঙালি বাংলাদেশে আছে। মি. ইয়াহিয়া, এমন অবস্থায় আপনি যদি মুজিবকে হত্যা করেন আর আমি ক্ষমতা গ্রহণ করি তাহলে একটি লোকও আর জীবিত অবস্থায় বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত আসতে সক্ষম হবে না। তখন আমার অবস্থা হবে সঙ্কটজনক।” [আবদুল মতিন, বিজয় দিবসের পর]
বঙ্গবন্ধু ঢাকার পথে রওয়ানা হওয়ার আগে ভুট্টো তাকে জানান যে, পূর্ব পাকিস্তান এখন বাংলাদেশ। এবং সে-দেশের নেতা হিসেবে তিনি এখন ফিরবেন। তা, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে কি একটা কনফেডারেশন হতে পারে? এ-কথা জানিয়েছেন ভারতীয় কূটনীতিক শশাঙ্ক ব্যানার্জি, যিনি একই বিমানে লন্ডন থেকে দিল্লি যাচ্ছিলেন। উত্তরে কী বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু, জানতে চান শশাঙ্ক ব্যানার্জি। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমার জীবন কালে নয়।
১০ জানুয়ারিতে সেই বক্তৃতায় তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “পাকিস্তানি কারাগার থেকে আমি যখন মুক্ত হই তখন জনাব ভুট্টো আমাকে অনুরোধ করেছিলেন, সম্ভব হলে আমি যেন দু’দেশের মধ্যে একটা শিথিল সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করি। আমি তাঁকে বলেছিলাম, আমার জনসাধারণের নিকট ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত আমি আপনাকে এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারি না। আমি এখন বলতে চাই। জনাব ভুট্টো সাহেব, আপনারা শান্তিতে থাকুন।”
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আনার কৃতিত্ব তিনি সাধারণ মানুষকে দিয়েছিলেন। বলেছিলেনÑ “আপনারা বাংলাদেশের মানুষ সেই স্বাধীনতা এনেছেন।” আরও বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা উদ্ধৃতি করে- “‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি।’ কবিগুরুর এই আক্ষেপকে আমরা মোচন করেছি। বাঙালি জাতি প্রমাণ করে দিয়েছে যে, তারা মানুষ, তারা প্রাণ দিতে জানে। এমন কাজ তারা এবার করেছে যার নজির ইতিহাসে নাই।” বক্তৃতার শেষের দিকে বলেছিলেন- “বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এখন যদি কেউ বাংলাদেশের স্বাধীনতা হরণ করতে চায়। তাহলে সে স্বাধীনতা রক্ষার জন্য মুজিব সর্বপ্রথম তাঁর প্রাণ দেবে।” জোরগলায় বলেছিলেন, “একজন বাঙালিও প্রাণ থাকতে এই স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেবে না।”
ইসলামি দেশগুলো পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছিল- এ তথ্য তখনও হয়তো তার অজানা। কিন্তু ধর্ম যে বাঙালির সত্তাও ওতপ্রোতভাবে জড়িত সেটি তিনি ভুলেননি। মনে করিয়ে দিয়েছিলেন জনতাকে- “আপনারা আরও জানেন যে, আমার ফাঁসির হুকুম হয়েছিল। আমার সেলের পাশে আমার জন্য কবরও খোঁড়া হয়েছিল। আমি মুসলমান, মুসলমান মাত্র একবারেই মরে। তাই আমি ঠিক করেছিলাম, আমি তাদের নিকট নতি স্বীকার করব না।”
জনগণকে মনে করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন- “বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। ইন্দোনেশিয়ার পরেই এর স্থান। মুসলিম জনসংখ্যার দিক দিয়ে ভারতের স্থান তৃতীয় ও পাকিস্তানের স্থান চতুর্থ।”
ইসলামের কথা তিনি মনে করিয়ে দিয়েছিলেন অন্য কারণে। পাকিস্তান সব সময় ধর্মের দোহাই দিয়ে বাঙালিদের শোষণ করেছে, ভয় দেখিয়েছে। আন্দোলন শুরু হলেই পাকিস্তানি নেতারা বলতেন ইসলাম বিপণ্ণ। বাঙালিরা আঁতাত করছে ভারত বা ভারতীয় হিন্দুদের সঙ্গে। ধর্মের দোহাই দিয়ে শাসন করা- এ বৃত্ত তিনি ভাঙতে চেয়েছিলেন। নিজে মুসলমান দাবি করণেও তিনি যে বাঙালি তা ভোলেননি এক মুহূর্ত্বের জন্য। যে কারণে বক্তৃতার বিভিন্ন জায়গায় এ-কথাগুলো মনে করিয়ে দিয়েছিলেন- “ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ। বাংলা আমার ভাষা। জয় বাংলা।” তারপর বলেছিলেন, “পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী ইসলামের নামে এ দেশের মুসলমানদের হত্যা করেছে, আমাদের নারীদের বেইজ্জত করেছে। ইসলামের অবমাননা আমি চাই না। আমি স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে দিতে চাই যে, আমাদের দেশ হবে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক দেশ। এ দেশের কৃষক-শ্রমিক। হিন্দু-মুসলমান সবাই সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে।”
২
অনেকে বলেন, বামপন্থি, ভারত ও সোভিয়েতের চাপে পড়ে তিনি সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেছেন। এখনও অনেকে তাই মনে করেন। এটি ভুল। বঙ্গবন্ধু চীন গিয়েছিলেন ১৯৫২ ও ১৯৫৬ সালে। চীনের অভিজ্ঞতা তার ভালো লেগেছিল। ১৯৭০ সালের আগে ও মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি সমাজতন্ত্রের কথা বলেছেন। আমৃত্যু ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেছেন।
সুতরাং সমাজতন্ত্রের কথা তিনি ভেবে-চিন্তেই বলেছিলেন, ধর্মনিরপেক্ষতার কথাও। কিন্তু তার আত্মজীবনী পড়লে দেখা যায়, যৌবনেই তিনি সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। সমাজতন্ত্রের ধরনটা যেমন হবে সে-সম্পর্কে হয়তো স্পষ্ট চিন্তা ছিল না। এখানে ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর গুরুত্ব দিতে চাই। কারণ, ঐ রকম ঘোষণা ঐ সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ছিল একেবারে নতুন। আরও পরে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে তিনি কী বোঝেন সেটি বিশদভাবে বলেছিলেন- “বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষ মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে, খ্রিষ্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধও তার ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নাই ধর্মনিরপেক্ষতা আছে। এর একটা মানে আছে। এখানে ধর্মের নামে ব্যবসা চলবে না। ধর্মের নামে লুট করা চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাজাকার আলবদর পয়দা করা বাংলার বুকে আর চলবে না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে দেয়া হবে না।” সে-কারণে তিনি সংবিধানে মূল নীতি হিসেবে গণতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা ঘোষণা করেছিলেন। শুধু তাই নয়, এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার জন্য, ধর্মভিত্তিক রাজনীতিও নিষিদ্ধ করেছিলেন।
তার সমাজতন্ত্রের ভাবনা ছিল অন্যরকম। বলা যেতে পারে। গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র। ১৯৭১-এর আগে ও পরে এ দুটি প্রত্যয় নিয়ে তিনি বলেছিলেন তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিচ্ছি। এ-কারণে, যে বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র দর্শনের এ দুটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
চীনের আদর্শ, কমিউনিস্ট আদর্শ ছাড়া, তারা যে কাজ করেছে সেগুলো তিনি গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। ওই যে নতুনভাবে সব করার চেষ্টা এটিই ছিল তার কাছে আকর্ষণীয়। যে বাংলাদেশের স্বপ্ন তার মধ্যে অঙ্কুরিত হচ্ছে সে-দেশটিকে তিনি এভাবেই গড়তে চেয়েছেন, নতুনভাবে চিন্তা করতে চেয়েছেন। কিন্তু পাকিস্তানি রাজনীতিবিদদের এটি পছন্দ ছিল না। মুসলিম লীগপন্থিদের তো নয়ই। এমনকি মুজিব যাদের সঙ্গে রাজনীতি করেছেন, তারাও নয়। তবে মুসলিম লীগ নেতাদের থেকে তারা প্রাগ্রসর ছিলেন। আওয়ামী লীগের যারা গিয়েছিলেন চীন সরকারের কাজকর্ম তাদের ভালো লেগেছিল। তবে মুজিব তাদের থেকে এগিয়ে ছিলেন। কীভাবে? তার কয়েকটি উদাহরণ দেব।
আগেই বলেছি, চীন সফরের পর চীন ও বিশ্বশান্তি নিয়ে তিনি যে দু-একটি মন্তব্য করেছিলেন তা পশ্চিম পাকিস্তানিদের ভালো লাগেনি। পূর্ববঙ্গে এ নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি। লাহোরের সিভিল অ্যান্ড মিলিটারি গেজেট মন্তব্য করেছিল- আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান বলেছেন, চীনারা বিশ্বশান্তির সঙ্গে যুক্ত। যে লোকটি পিকিংয়ের বাইরে যায়নি [মিথ্যা কথা], চীনা ভাষা জানেন না, তিনি চীনাদের সম্পর্কে মন্তব্য করেন কী করে? তাঁর বক্তব্য এ দেশের মূল আদর্শবিরোধী। কেননা তিনি কমিউনিস্টদের পক্ষে মিথ্যা প্রচার চালাচ্ছেন। “It is preposterous for a man who perhaps never stopped the corporation limit of Peking to pronounce a verdict on what the Chinese people think and feel, specially when he does not know a word of chinese… it is an insult to the basic ideology of this state whose citizenship Mr. Mujibur Rahman is abusing for false procommunist propaganda to suggest that future of humanity lies in the hands of that immortal cult…” [সিক্রেট ডকুমেন্টস ১৯৫২, ৭.৪.৫২] পাকিস্তান বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তান এভাবেই সবাইকে বিচার করত। পাকিস্তানই ইসলাম- এছাড়া অন্য কিছুতে তাদের বিশ্বাস ছিল না। পূর্ববঙ্গের মানুষ এতটা অন্ধ ছিল না, কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে ছিল স্পর্শকাতর।
অন্যদের কথা বাদ দিই। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক গুরু সোহরাওয়ার্দীরও বিরূপ ধারণা ছিল কমিউনিস্টদের প্রতি। ১৯৫৩ সালে সোহরাওয়ার্দী শেখ মুজিবকে কড়া একটি চিঠি লেখেন ভাষা আন্দোলন নিয়ে। সেখানে পররাষ্ট্রনীতি নিয়েও তার কিছু মন্তব্য ছিল। লিখেছিলেন তিনি, মওলানা সাহেব সাম্রাজ্যবাদবিরোধী দিবসের ডাক দিয়েছেন। আরব দেশগুলোর প্রতি পাশ্চাত্যের মনোভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতেই বোধহয় এই আহ্বান। কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়াও যে তার তাঁবেদার রাষ্ট্র সৃষ্টি করে সাম্রাজ্যবাদী আচরণ করছে তার বিরুদ্ধে কোনো কথা নেই। ‘তোমাকে অনুধাবন করতে হবে এর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে। মনে হচ্ছে, এখন তোমরা সবাই পরোক্ষভাবে কমিউনিস্ট পার্টির কাঠামো ও রাজনীতির দ্বারা প্রভাবিত। তোমরা এখন যাদের বলা হয় প্রগতিশীল দল ও কমিউনিস্টদের সমর্থন পাচ্ছ, আমাদের লোকদের প্রতিক্রিয়া হলো, এটিকে সবাই বলে ছদ্মবেশী কমিউনিস্ট পার্টি।’ অনেকে এ ধারণা থেকে পার্টি ছেড়ে যেতে পারে। ‘তুমি কি মনে কর এই দিবস পালন করে আমাদের অভ্যন্তরীণ শক্তি বেড়েছে। তুমি অন্যদের মাঠ দখল করার সুযোগ করে দিচ্ছ। একটু আস্তে চলা যায় না? আন্তর্জাতিক রাজনীতির জন্য যথেষ্ট সময় আছে। আমাদের দলকে আগে শক্তিশালী করা উচিত, যাতে আমরা জিততে পারি। তোমরা যেভাবে প্রভাবিত হয়েছ কমিউনিস্টদের দ্বারা, তাতে আমার ধারণা আমার কথা ভালো লাগবে না। আরেকটি বিপদ আছে। পাকিস্তানের ভেঙে যাওয়া। বিচ্ছিন্নতাবাদী নীতি তোমাকে সহায়তা করবে না।’ [ঐ]
এ ছিল পরিস্থিতি। রাজনৈতিকভাবে সমাজতন্ত্রের [চীন/রাশিয়া] কথা বলা ছিল বিপজ্জনক। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সে ঝুঁকি নেওয়ার সাহস দেখিয়েছিলেন। সে-সময় মুসলিম লীগের রাজনীতি বর্তমান বিএনপি-জামাত রাজনীতির মতোই ছিল। এর বিপরীতে কমিউনিস্ট পার্টির নেতাকর্মীরা ছিলেন ত্যাগী ও সৎ। এ গুণটি বঙ্গবন্ধুকে আকর্ষণ করেছিল। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেছেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ও শামসুজ্জামান খান। সেখানে ছাত্রলীগের নেতৃস্থানীয় কয়েকজন ছিলেন। তারা অভিযোগের সুরে বলছিলেন, “আপনি ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলনেও তো গেলেন। তিনি বললেন ‘তোমাদের কাজে আমি সন্তুষ্ট হতে পারি না সব সময়। ছাত্র ইউনিয়নের ওরা পরিশ্রমী, নিষ্ঠাবান, ত্যাগী। ওরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সীডবেড করে উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে নিজদের যুক্ত করেছে। আমি একটিমাত্র জাতীয় পার্টি [বাকশাল] করছি। ত্যাগী সৎ লোকেরা কাজের মাধ্যমে সেই পার্টির সামনের কাতারে আসবে। অকর্মণ্য গলাবাজরা পিছনে পড়বে। দেখ না আমি আলতাফ সাহেবকে মন্ত্রী করেছি। এমন একটা লোক পাওয়া ভাগ্যের কথা’। [আলাপ] ছেলেবেলা থেকেই তিনি গরিবদের প্রতি সহানুভূতিশীল। কমিউনিস্টরাও শ্রমিক-কৃষকদের কথা বলে। সুতরাং তিনি কমিউনিস্ট না-হলেও এ ভাবধারার প্রতি অনুরাগী ছিলেন। এখানে উল্লেখ্য, ১৯৫২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগে অনেক সময় ডানপন্থিরা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে কিন্তু বঙ্গবন্ধু সব সময় পার্টিকে মধ্য বা মধ্যবামে রেখেছেন। ডানপন্থায় তার বিশ্বাস ছিল না। এখন অবশ্য তার হাতে গড়া দল ডানপন্থায় প্রবলভাবে আস্থাশীল।
চীনে তার আগ্রহ ছিল কয়েকটি বিষয় সম্পর্কে ভালোভাবে জানার। বা যে সমস্যাগুলো তিনি পাকিস্তানে আছে বলে মনে করেছেন তার মীমাংসা কীভাবে মাও সেতুং করেছেন তা জানার। বিষয়গুলো হলো ভূমির মালিকানা, শ্রমিকের মজুরি ও ধর্মনিরপেক্ষতা। একটি আদর্শিক রাষ্ট্র গড়তে হলে এ বিষয়গুলোর সমাধান দরকার। ১৯৫২ থেকে ১৯৭২Ñ দীর্ঘ দু-দশক। এ দু-দশক তিনি তার দলের কর্মী-নেতাদের প্রস্তুত করতে চেয়েছেন, একই সঙ্গে এ বিষয়গুলো পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশে কীভাবে সমাধান করতে হবে। আমি এসব বিষয়ে বিভিন্ন সময় তার বক্তব্যগুলো তুলে ধরব, তাহলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, চীনের সাধারণ মানুষ হতদরিদ্র; এর অর্থ অবস্থা আগে আরও খারাপ ছিল কিন্তু মাও সেতুং সে অবস্থার পরিবর্তন করছেন। এ বিষয়টি তাঁকে বেশ নাড়া দিয়েছিল। ১৯৫৩ সালের কাউন্সিল সভায় সাংগঠনিক রিপোর্টে বলেছিলেন- ‘শোষকের ওপর শোষিতের সংঘাত ভঙ্গুর ধ্বংসোন্মুখ সমাজকে ধ্বংসের হাত হইতে উদ্ধার করিবার জন্য শোষণের কেন্দ্রগুলোর ওপর আক্রমণই আমাদের প্রথম কাজ। পণ্য হিসেবে নয়Ñ মানুষ মানুষের পরিপূর্ণ মর্যাদা লইয়া বাঁচিতে চায়। আওয়ামী লীগ এই বাণী লইয়া বঞ্চিত মানুষের নেতৃত্ব গ্রহণ করিয়াছে। এই মানবিক সম্পর্কের প্রতিষ্ঠার শপথই আওয়ামী লীগের কর্মসূচির মধ্য দিয়া প্রতিভাত হইয়াছে। আওয়ামী লীগ ভালো করিয়াই বুঝিয়াছে জাতির সম্পদের উপযুক্ত উৎপাদন ও বণ্টনের মধ্য দিয়াই উহার সংকটের অবসান করিয়া মানুষের সমৃদ্ধি রচনা করিতে হইবে।’ ওই সময়ে যেসব দল প্রকাশ্য রাজনীতি করত তাদের কোনো নেতা এ ধরনের কথা বলতে পারেননি।
কৃষকের সঙ্গে যুক্ত ভূমি। বঙ্গবন্ধু দেখিয়েছেন, চীনে লাঙল যার জমি তার এই নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল এবং জমিদারদের জমি কৃষকদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল। কৃষকদের খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার উপায় সৃষ্টি হয়েছিল। জমিদারি প্রথাও বিলুপ্ত হয়েছিল।
১৯৭৫ সালে স্বাধীনতা দিবসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন- বাংলাদেশের ৬৫ হাজার গ্রামে সমবায় বা কো-অপারেটিভ করতে হবে।
“এর জমি মালিকদের জমি থাকবে, কিন্তু তার ফসলের অংশ সবাই পাবে। প্রত্যেকটি বেকার প্রত্যেকটি মানুষ যে মানুষ কাজ করতে পারে, তাকে এই কো-অপারেটিভের সদস্য হতে হবে। এগুলি বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে। পয়সা যাবে তাদের কাছে, ফার্টিলাইজার যাবে তাদের কাছে, টেস্ট রিলিফ যাবে তাদের কাছে, ওয়ার্কস প্রোগ্রাম যাবে তাদের কাছে। আস্তে আস্তে ইউনিয়ন কাউন্সিলে যারা টাউট আছে, তাদের বিদায় দেয়া হবে। তা না হলে দেশকে বাঁচানো যাবে না। এই জন্যই ভিলেজ কো-অপারেটিভ হবে। আমি ঘোষণা করছি আজকে যে, পাঁচ বৎসরের প্ল্যানে প্রত্যেকটি গ্রামে পাঁচশত থেকে এক হাজার ফ্যামিলি পর্যন্ত নিয়ে কম্পলসরি কো-অপারেটিভ হবে। আপনার জমির ফসল আপনি নেবেন, অংশ যাবে কো-অপারেটিভের হাতে, অংশ যাবে গভর্নমেন্টের হাতে।” [দৈনিক ইত্তেফাক, ১৯৭৫]
চীন যাওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধু ১৯৪৯ সাল থেকে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তের দাবি করছিলেন এবং তা লুপ্ত করা হয়েছিল। ১৯৫৩ সালে কাউন্সিল মিটিংয়ে তিনি বলেছিলেন- “আমরা ভূমি ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন চাই। কিন্তু ভূমি ব্যবস্থার সাথে সাথে শিল্পায়ন প্রচেষ্টাও আমাদের সংগঠিত করিতে হইবে। সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের কাঁচামাল, উৎপাদিত পণ্যের বাজার, নিয়োজিত মূলধনের জোগান হিসেবে আমাদের দেশকে ব্যবহার করিয়াছে বলিয়াই আমাদের কৃষি ও শিল্পের এই দুর্গতি।” [কাউন্সিল]
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চীনে কীভাবে মাও সেতুং বন্ধ করেছিলেন সে-সম্পর্কে সম্যক ধারণা জন্মেছিল বঙ্গবন্ধুর। তার উপলব্ধি ছিল, রাষ্ট্র ইচ্ছা করলে দাঙ্গা লাগাতে পারে, বন্ধ করতেও পারে। ১৯৫০ সালে মুসলিম লীগ দাঙ্গা লাগিয়েছিল। আরও পরে বিএনপি-জামাত আমল দেখুন। এরশাদ আমল দেখুন, কতবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে। বাবরি মসজিদ ভাঙার সময় কংগ্রেস ছিল ক্ষমতায়; এবং তাদের নমনীয় ভঙ্গির কারণেই বিজেপি বাবরি মসজিদ ভাঙতে পেরেছিল। এর সঙ্গে তুলনীয় বর্তমান সরকারের আহমদ শফীর প্রতি মনোভঙ্গি; এবং এ ভয়ানক খেলায় আওয়ামী লীগ জিততে পারবে না। এটি ইতিহাসের সাক্ষ্য। আমার ব্যক্তিগত কোনো অনুভূতি নয়। আজ ভারতের অবস্থা পর্যালোচনা করুন। অমিত শাহ-নরেন্দ্র মোদি রাষ্ট্রীয়ভাবে দাঙ্গা-হাঙ্গামার প্ররোচনা দিচ্ছেন।
বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। তার ধর্মমতের সঙ্গে এর কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। ইসলাম এর বিরোধী। সুতরাং এর বিরোধিতা করা ধর্মীয় নীতি পালন করাও বটে। ১৯৫৩ সালে কাউন্সিল সভায় তিনি ঘোষণা করেছিলেন, “গণতান্ত্রিক শক্তি [আওয়ামী মুসলিম লীগ] বুঝিয়াছে যে গণআন্দোলনকে ব্যাহত করিবার ইহা গণদুষমনদের একটি হাতিয়ার মাত্র। আর তাদের এই হাতিয়ারকে ধ্বংস করিয়া দিতে হইবে হিন্দু-মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মধ্য দিয়া। মানুষের এই চেতনাই ১৯৫০ সালে দাঙ্গার শিক্ষা।” [ঐ] তিনি আরও বলেন, ১৯৪৯ আর ১৯৫৩ ভিন্ন। তাদের এই অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে বিরোধকে তারা আজ আর সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে বিরোধ বলে মনে করেন না।
শেখ মুজিব লক্ষ করেছিলেন, চীনারা আমেরিকাকে প্রচ-ভাবে ঘৃণা করে। বঙ্গবন্ধুর কাছে ব্রিটেন ছিল কাছের, আমেরিকা দূরের। পাকিস্তান তখন কমনওয়েলথের অন্তর্ভুক্ত। ১৯৫৩ সালে সেই কাউন্সিল সভায় তিনি ঘোষণা করেন, আওয়ামী লীগ কৃষ্টি ও শিল্পে প্রগতিবাদী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে, যা সামন্তবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার একান্ত পরিপন্থী। তাই আওয়ামী লীগ শুধু কমনওয়েলথ নয় সাম্রাজ্যবাদী জোটের সঙ্গে সম্পর্কহীন সক্রিয় নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করছে এবং আওয়ামী লীগ এখন থেকে সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তির মহান নেতা।
ওই সময় আওয়ামী লীগ নেতা ভাসানীও ঘোষণা করেছিলেন, অধিক স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে, জমিদারি উচ্ছেদ করতে হবে, পাট ও প্রধান শিল্প জাতীয়করণ করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু চীন গিয়েছেন দুবার ১৯৫২ এবং ১৯৫৬ সালে। আবার চৌ এন লাইও এসেছিলেন ঢাকায়। অর্থাৎ ১৯৫২ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত চীনা নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল। ১৯৫৬ সালের চীন ভ্রমণ সম্পর্কে তিনি লিখে যাননি। তবে ওই চার বছর চীনের মৌল নীতির পরিবর্তন হয়নি। দেশেরও উন্নতি হচ্ছিল। কিন্তু প্রথম প্রেম বলে একটা কথা আছে। প্রথম চীন ভ্রমণ তাকে আচ্ছন্ন করেছিল।
সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর মন্তব্য নেই বললেই চলে। যদিও সমাজতন্ত্রের প্রতিভূ তখন চীন ও রাশিয়া। এর কারণ বোধহয় রাশিয়ায় না যাওয়া। আর রাশিয়াও ‘তাঁবেদার রাষ্ট্র’ সৃষ্টি করে সাম্রাজ্য গড়াচ্ছে। সোহরাওয়ার্দীর এই মন্তব্যও তাকে প্রভাবিত করতে পারে। ‘সোভিয়েত সাম্রাজ্যবাদ’ শব্দটি তার এক দশকের মধ্যেই চালু হয়ে যায়।
আমেরিকা ভ্রমণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সে-সম্পর্কেও মন্তব্য নেই। তাছাড়া চিরদিন সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে তিনি বলে এসেছেন। আমেরিকা তার প্রতিভূ। অনুমান করতে পারি, আমেরিকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, প্রতিষ্ঠান ও সম্পদ তাকে আকর্ষণ করেছিল। গণতন্ত্রের কথা তো তিনি চিরদিন বলে এসেছিলেন। আর মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে লড়াই তো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্যই লড়াই।
৩
১৯৭১ সালের ঘটনাবলি কিছুটা হলেও তার মনে অভিঘাত সৃষ্টি করেছিল। চীন তার মানুষের বিরুদ্ধে, যুক্তরাষ্ট্রও তা-ই। কিন্তু চীনের বিষয়টিকে কি তিনি মানতে পেরেছিলেন? অন্যদিকে যে সোভিয়েতের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল না, সেই সোভিয়েতের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়েছিল এবং সোভিয়েত তো সমাজতন্ত্রেরই ধারক। সুতরাং সমাজতন্ত্রের সঙ্গে তার আপস করতে হয়নি। আর আমেরিকা বিরোধিতা করবে কিন্তু তার সঙ্গেই বসবাস করতে হবে।
১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমির কয়েকজন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য ৩২ নম্বরে যান। শামসুজ্জামান খান ছিলেন সেই দলে। তিনি লিখেছেন, “একজন বঙ্গবন্ধুকে বলছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে তো চীন বাংলাদেশকে সমর্থন করেনি। বঙ্গবন্ধু বললেন- ‘দুটো বিষয় তো আলাদা, মাও একজন বড় নেতা। জীবনে বহু সংগ্রাম করেছেন। তাঁর জীবন ও চিন্তাটা জানা ও বোঝা দরকার। একটা অনুন্নত বিশাল দেশকে তিনি স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। সে দেশটায় এত মানুষ হওয়া সত্ত্বেও কত উন্নত হয়েছে। এই ব্যাপারটা কীভাবে ঘটেছে তা উপলব্ধি করার চেষ্টা করছি।’
হঠাৎ তাঁর মুখে একটু বেদনার ছায়া পড়লো। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, রাজনীতি বড় জটিল, নিষ্ঠুর। এর ফলে কত অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে। তা না হলে চীনের আমাদের সমর্থন না করার ক্ষেত্রে কোন যুক্তিই নেই। চীন খুব অন্যায় কাজ করেছে।” [বিস্তারিত, আলাপ]
আমেরিকান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের মি. মরিশাসের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- “আমি সোভিয়েত ও ভারতের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি- কেননা এই দুটি মহান দেশ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সহায়তা করেছে।” [বিস্তারিত : এবিসি]
যে ধারণাগুলো চীন থেকে নিয়ে এসেছিলেন তার দুটি দিক ছিল- এক. তাত্ত্বিক, দুই. ব্যবস্থা। তাত্ত্বিক দিক থেকে অসুবিধা ছিল না। সমাজতন্ত্রের মূল নীতিই তার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল। ‘মাও-এর চিন্তাধারা’ তখনও ব্যাপ্তি পায়নি, সুতরাং সে-ধারণা তার মানসজগতের বাইরে ছিল। আমি কয়েকটি ধারণা দিই :
১৯৬০-এর দশকের আগে জাতীয় সমৃদ্ধির জন্য শোষণহীন সমাজের কথা বলেছেন। পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজিপতিদের দাপট, বৈষম্য তাঁকে অস্থির করেছে। ষাটের দশক থেকে দেখি সমাজতন্ত্র ও শ্রমিকদের বিষয়টি তিনি আলোচনায় নিয়ে আসছেন। এবং ১৯৭০ সালের দিকে এ বিষয়ে মনস্থির করে ফেলেছিলেন। তিনি জানতেন, তিনি এখন চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছবেন এবং যে রাষ্ট্র তিনি গঠন করতে চাইছেন তার একটা নীতি থাকতে হবে। আদর্শ রাষ্ট্রের খোঁজ করছেন আজীবন, অবশেষে আদর্শ রাষ্ট্রের খোঁজ পেয়েছেন। ১৯৭০ সালে নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে [৪-৫ জুন] ঘোষণা করা হয়-
“সাম্যবাদী অর্থনীতি প্রবর্তন (ভূমিকা) : ক. একচেটিয়া পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ, জমিদার জায়গিরদারি, সরদারির বিলোপ সাধন করে গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে দেশব্যাপী সাম্যবাদী অর্থনীতি প্রবর্তনের মাধ্যমে মানুষকে মানুষের মর্যাদায় সমুন্নত করা; খ. ন্যায় পরায়ণতার আলোকে মানুষে-মানুষে এবং অঞ্চলে-অঞ্চলে সাম্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নয়া শাসনতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির মাধ্যমে দেশে বিপ্লব সাধনই হবে আওয়ামী লীগের কর্মসূচির মূল লক্ষ্য।” [কাউন্সিল, পৃ. ১২৮]
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ঘোষণা করেন- “রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা শুধু তাই নয় তাঁর লক্ষ্য হবে শোষণমুক্ত দেশ তথা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা।” [এই দেশ]
কলকাতায় গেলেন মার্চ মাসে। ৬ মার্চ ১৯৭২ সালে কলকাতার ব্রিগেড গ্রাউন্ডে বললেন- অনেকেই তাঁকে প্রশ্ন করেন- “ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আপনার মিল কেন? আমাদের মিল আদর্শের মিল, তিনি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, আমিও গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। তিনি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, আমিও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি। আমি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করি, শ্রীমতি গান্ধীও জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করেন। আমরা উভয়েই ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী… আমি আপনাদের আশ্বাস দিতে পারি যে, আমরা জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি প্রতিষ্ঠার কাজ চালিয়ে যাব।
এ বিষয়টি আরও বিশাদ করে ১৯৭২ সালে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে, সমাজতান্ত্রিক কাঠামো স্থাপনে এ দিন তিনি জাতীয়করণের গতি ঘোষণা করেন। উপমহাদেশে এ ধরনের ঘটনা ছিল প্রথম। ইন্দিরা গান্ধীও ব্যাংক-বীমা জাতীয়তকরণ করেছিলেন, আরও পরে। নীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি ভারত গ্রহণ করে পরে।
বঙ্গবন্ধু ভাষণে বলেছিলেন-
“আমার সরকার অভ্যন্তরীণ সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাসী। পুরাতন সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন করিতে হইবে। অবাস্তব তালিকা নয়, আমার সরকার ও পার্টি বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। দেশের বাস্তবিক প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে পুরাতন সামাজিক কাঠামোকে ভাঙ্গিয়া নতুন সমাজ গড়িতে হইবে। শোষণ ও অবিচারমুক্ত নতুন সমাজ আমরা গড়িয়া তুলিব এবং জাতির এই মহাক্রান্তি লগ্নে সম্পদের সামাজিকীকরণের পর্যায়ক্রমিক কর্মসূচির শুভ সূচনা হিসাবে আমার সরকার নিম্নলিখিত বিষয়গুলো জাতীয়করণ করিতেছে :
১. ব্যাংকসমূহ (বিদেশী ব্যাংকের শাখাগুলো ভিন্ন)
২. সাধারণ ও জীবন বীমা কোম্পানিসমূহ (বিদেশী কোম্পানি শাখাসমূহ ভিন্ন)
৩. সকল পাটকল
৪. সকল বস্ত্র ও সুতাকল
৫. সকল চিনিকল
৬. আভ্যন্তরীণ ও উপকূলীয় নৌ-যানের বৃহদাংশ
৭. ১৫ লক্ষ টাকা মূল্যের ও তদূর্ধ্ব সকল পরিত্যক্ত ও অনুপস্থিত মালিকানাভুক্ত সম্পত্তি
৮. বাংলাদেশ বিমান ও বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনকে সরকারি সংস্থা হিসাবে স্থাপন করা হইয়াছে
৯. সমগ্র বহির্বাণিজ্যকে রাষ্ট্রীয়করণের লক্ষ্য নিয়ে সাময়িকভাবে বহির্বাণিজ্যের বৃহদাংশকে এই মুহূর্তে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে আনা হইয়াছে। [ইত্তেফাক, ২৭.৩.১৯৭২]
অধ্যাপক হারুন-অর-রশীদ লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু যখন ১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবন করেন তখন বলেছিলেন- “একমাত্র সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিই জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি সাধন করতে সক্ষম বলে ধীরে ধীরে তা প্রবর্তন করতে হবে।” তিনি আরও বলেনÑ “… যে শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা আমরা বলেছি সে অর্থনীতি আমাদের, সে ব্যবস্থা আমাদের। কোন জায়গা থেকে হায়ার করে এনে, ইম্পোর্ট করে এনে কোন ‘ইজম’ চলে না। এদেশে, কোন দেশে চলে না। আমার মাটির সঙ্গে, আমার মানুষের সঙ্গে আমার কালচারের সঙ্গে, আমার ব্যাকগ্রাউন্ডের সঙ্গে, আমার ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত করেই আমার ইউনিক সিস্টেম গড়তে হবে।” [বিস্তারিত, কাউন্সিল]
১৯৬৪ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি জনসভায় তিনি শ্রমিক-কৃষকের ব্যাপারটি এনেছেন। যেমনÑ ১৩ জুন ১৯৬৪ সালে এক জনসভায় বলেন, পাকিস্তানি ব্যবস্থায় শিল্পপতিরা করমুক্ত আর কৃষক করভারে জর্জরিত। আসলে হওয়া উচিত তো উল্টোটা।
১৯৬৬ সালের ৯ অক্টোবর দিনাজপুরে আওয়ামী লীগের এক কর্মিসভায় পার্টির মেনিফেস্টোতে সমাজতন্ত্রের আদর্শ, অন্তর্ভুক্তিকরণ অভিনন্দিত করা হয়।
১৯৫০ থেকে যা ভেবেছেন, ২১ বছর পর ১৯৭২ সালে সেসব ধারণা তিনি কার্যকর করতে চাইলেন। বিষয়টি এভাবে বিবেচনা করা যায়, বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ, বিভিন্ন আদর্শের সঙ্গে পরিচয়ে তিনি নতুন দেশের জন্য কী করবেন তার একটা ধারণা মনে তৈরি করেছিলেন।
২৭ মার্চ ১৯৭২ সালে শ্রমিক সমাবেশে বলেন, “শ্রমিক ভাইদের বলি শ্রম ও পুঁজির মধ্যে আবহমানকাল ধরিয়া যেই পরস্পরের বিরোধিতা রহিয়াছে তা আমাদের নতুন নীতি গ্রহণের ফলে বাংলাদেশ হইতে অনেকখানি বিলুপ্ত হইবে। শ্রমিক কর্মচারীকে আর সর্বদা মালিকের সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত থাকিতে হইবে না।” চীনে তিনি দেখেছিলেন শ্রমিক প্রতিনিধি ও মালিক একসঙ্গে বসে কারখানার কর্মসূচি গ্রহণ করছেন।
ডাকসুর আজীবন সদস্যপদ যখন তাকে দেওয়া হয় ৬ মে ১৯৭২ সালে তখন বলেছিলেন-
“রাতারাতি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না। সমাজতন্ত্রের বিরোধী ঘাঁটিকে ধ্বংস করে দিয়ে সমাজতন্ত্রের পথে আসতে হয়। সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় কোন প্রকার দরকষাকষির স্থান নেই। সকল কলকারখানার মালিক শ্রমিক শ্রেণীও দেশের জনগণ।” [এই দেশ]
বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক রাষ্ট্র স্থাপনের বিষয়টি আগেই উল্লেখ করেছি। চীন ভ্রমণের সময় তিনি লিখেছিলেন, গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি তার ভালো লাগেনি। সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র দুটিই তিনি চান। ১৯৭২ সালের দিকে তার মনে হয়েছে তিনি ঐ সমস্যার সমাধান করতে পেরেছেন। সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রথম বার্ষিক সম্মেলনে [৬.৭.১৯৭২] তিনি তার ভাষণে বলেন-
“আমি জানি আমার মতো আপনারাও চারটি আদর্শ সমর্থন করেন। এই চারটি আদর্শের ভিত্তিতে আমরা দেশকে বাঁচাতে চাই। আমরা সমাজতন্ত্র কায়েম করতে চাই। আমরা নতুন প্রচেষ্টা নিয়েছি গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু আমরা স্বাধীনতা দিচ্ছি। দুনিয়ায় দেখা গেছে, সমাজতন্ত্র কায়েম করতে গিয়ে অনেক সময় মানুষের মঙ্গলের খাতিরে বাধা দৃঢ় করবার জন্য রূঢ় হতে হয়েছে। সেটা আমি করতে চাই না। এ জন্যে যে আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় কিনা, আমি চেষ্টা করে দেখছি।” [বিস্তারিত, বঙ্গবন্ধু দর্শন]
সংবিধান বিল এর ওপর ৪ নভেম্বর ১৯৭২ সালে এক দীর্ঘ বক্তৃতা দেন বঙ্গবন্ধু। সেখানে বলেন-
“সমাজতন্ত্রের মূল কথা হলো শোষণহীন সমাজ। সেই দেশের কী climate, কী ধরনের মনোভাব, কী ধরনের আর্থিক অবস্থা সব কিছু বিবেচনা করে স্টেপ বাই স্টেপ এগিয়ে যেতে হয় সমাজতন্ত্রের দিকে…।”
তিনি আরও বলেছেন- সমাজতন্ত্র কায়েমে সবাই এক পন্থা গ্রহণ করেনি। চীন একরকম করেছে, রাশিয়া অন্যরকম, রুমানিয়া, যুগোশ্লোভিয়া বা বুলগেরিয়া তাদের দেশের সমাজ পরিবেশের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজতন্ত্র কায়েম করেছে।
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- “একদিনে সমাজতন্ত্র হয় না। কিন্তু, আমরা ডায়াসে যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছি, তা আমার মনে হয়, দুনিয়ার কোন দেশ, যারা বিপ্লবের মাধ্যমে সোশালিজম করেছে, তারাও আজ পর্যন্ত তা করতে পারে নাই- আমি চ্যালেঞ্জ করছি।”
১৯৭৫ সালের ১৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলেও তিনি দীর্ঘ এক বক্তৃতা দেন। সেখানে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে যা বলেন, তাতে মনে হয় তার এই প্রতীতি জন্মেছিল আওয়ামী লীগ দিয়ে সমাজতন্ত্র কায়েম দুরূহ। বাকশালের দিকে তাই তিনি এগিয়েছিলেন। গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র কায়েমের সমস্যা এভাবে সমাধান করতে চেয়েছেন। তিনি বলেন, “এ দেশ স্বাধীন তোমরা করেছ। এবার বাংলার মানুষকে মুক্তি দিতে হবে। দিতে হবে অর্থনৈতিক মুক্তি, সমাজতান্ত্রিক সমাজ। সমাজতন্ত্র ছাড়া রাস্তা নাই। শোষণহীন সমাজ গাছ থেকে পড়ে না। শোষণহীন সমাজ বা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গড়তে হলে আমার কর্মীভাইদের সমাজতন্ত্রের কর্মী হতে হবে। ক্যাডার তৈরি করতে হবে। ট্রেনিং দিতে হবে। না হলে পারব না কিছু করতে।”
“সমাজতন্ত্রে আমরা গণতন্ত্রের মাধ্যমে যাবার চাই এবং আমরা দুনিয়াকে দেখাতে চাই যে, গণতান্ত্রিক পন্থায় নতুন সিস্টেমে আমরা শোষণহীন সমাজ গড়ে তুলব।” [বঙ্গবন্ধুর দর্শন]
চীনে তিনি যেমন দেখেছিলেন মালিক-শ্রমিক মিলে পরিকল্পনা করে কারখানা চালায় তেমনি ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠনের সময় বলেছিলেন- “শ্রমিক ভাইয়েরা আমি শ্রমিক প্রতিষ্ঠান করেছি। আপনাদের প্রতিনিধি ইন্ডাস্ট্রিজ ডিপার্টমেন্ট, লেবার ডিপার্টমেন্টের প্রতিনিধি বসে একটা প্ল্যান করতে হবে। সেই প্ল্যান অনুযায়ী কি করে আমরা বাঁচতে পারি তার বন্দোবস্ত করতে হবে।”
৪
আজীবন বঙ্গবন্ধু সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে বড় হয়েছেন এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। ছেলেবেলায় জাতিগত কারণে, ১৯৪৬, ১৯৫০ এবং তার পরবর্তী সময়ের দাঙ্গা দেখেছেন। ১৯৪৬ সালের দাঙ্গায় কলকাতায় এবং ১৯৬৪ সালে ঢাকায় দাঙ্গা নিবারণে প্রাণপণে চেষ্টা করেছেন।
বায়তুল মোকাররমে ২৭ এপ্রিল [১৯৭২] মিলাদুন্নবী পালন উপলক্ষে বলেন, ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের নীতি। এর অর্থ এ নয় যে কাকেও ধর্মচর্চা করতে দেওয়া হবে না। অন্যের ধর্ম হস্তক্ষেপ করা ইসলামের নীতি নয়। [ইত্তেফাক, ২৯.৪.১৯৭২]
সংবিধান বিল-এর ওপর বক্তৃতা দিতে গিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে তার ধারণা তিনি আরও স্পষ্ট করেন। দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন, “ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়।… আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করব না।… ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা চলবে না যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলব, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছি।
ধর্মনিরপেক্ষ নীতি কী অভিঘাত সৃষ্টি করেছিল তা বোঝা যায় বঙ্গবন্ধু খুনী সৈয়দ ফারুক রহমানের এক চিঠিতে যা রক্ষিত আছে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। ‘খোলা চিঠি’তে ফারুক রহমান বঙ্গবন্ধুর খুনের কারণ উল্লেখ করেন। চিঠিটি ফারুক ব্রিটিশ কোনো কর্মকর্তাকে পাঠিয়েছিলেন। তার চিঠির শিরোনাম ছিল ‘দ্য ইসলামিক সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশন ইন বাংলাদেশে’।
চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন-
১. “একাত্তরে বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বাস করেছিলেন যে শেখ মুজিব তাঁদের অভিপ্রায় পূরণের জন্য সঠিক নেতা। তাঁকে সব ক্ষমতাই দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, তিনি তাঁর ধর্ম ইসলামের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। অথচ, এটাই ছিল বিপ্লব ও মানুষের ধর্মের মূল আদর্শগত প্রতিপাদ্য। এই বিশ্বাসঘাতকতার কারণেই তাঁকে ধ্বংস করেছি। কেউ তাঁকে বাঁচাতে পারেনি।”
২. “পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ইসলামি বিপ্লবের প্রয়োজনে আমি সর্বশক্তিমান আল্লাহর ‘হাম্বল ইনস্ট্রমেন্ট’ হিসেবে শেখ মুজিবকে ধ্বংস করি। আর সেই মুহূর্তেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাংলাদেশের প্রকৃত পরিবর্তন তথা ইসলাম বাস্তবায়নের দায়িত্বভার গ্রহণ করি।”
৩. “পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের অ্যাকশন এবং ইসলামি বিপ্লবের আদর্শবলি ৭ নভেম্বরে বিপ্লবী সৈনিকরা অনুমোদন দিয়েছেন। এর সকল দায়-দায়িত্ব আমার। বেঁচে থাকি আর মারা যাই, এর দায় আমারই থাকবে।” [মিজানুর রহমান খান, ‘ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ করায় মুজিবকে ধ্বংস করেছি’, প্রথম আলো, ১৮.৮.২০২০; অনুবাদ মিজানুর-এর]
২৮ এপ্রিল ১৯৭২ সালে বলেছেন, “ধর্মনিরপেক্ষতা বর্তমান সরকারের নীতি ইহার অর্থ এই নয় যে, কাহাকেও ধর্মচর্চা করতে দেওয়া হইবে না। অন্যের ধর্মে হস্তক্ষেপ করা ইসলামের নীতি নহে।” তিনি আরও বলেন, “ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবও না।” অর্থাৎ এক কথায়, ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার। [ইত্তেফাক, ২৯.৪.১৯৭২]
খন্দকার ইলিয়াসকে এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ১৯৭২ সালে “জিন্নাবাদ এ দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সৃষ্টি করে সাম্প্রদায়িকতাবাদের বিষবাষ্প। তার জবাবে আমি বলি যার যার ধর্ম তার তারÑএরই ভিত্তিতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের কথা।”
চীনে এই কারণেই তিনি বিভিন্ন জায়গায় মুসলমানদের সঙ্গে আলাদা কথা বলতে চেয়েছেন। তাদের মনোভাব বুঝতে চেয়েছেন। ১৯৯০ সালে যখন চীনে যাই, তখনও এ খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছি। সেদিক থেকে দেখলে এক্ষেত্রে ১৯৫২ সালে চীনে যে নীতি ছিল, ধর্ম সম্পর্কে ১৯৯০ সালেও তা-ই ছিল। মুসলমানরা বঙ্গবন্ধুকে দৃঢ়ভাবে জানিয়েছেন, তাদের ধর্মকর্মে বাধা দেওয়া হয় না। বরং ধর্মের নামে যে শোষণ তা বন্ধ করার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধুও তা-ই চেয়েছিলেন। তার আমলের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা সংযোজন। তিনি আরেকটি বিপ্লবী কাজ করেছিলেন, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছিলেন। চীন ছাড়া আর কেউ ওই সময়ে এ কাজ করার সাহস পায়নি।
১৯৭২ সালের মার্চ মাসে তিনি বলেছেন, “আমার সরকার অভ্যন্তরীণ সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাসী এবং সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। সমাজ তো চাট্টিখানি কথা নয়। এ দেশের বাস্তবিক প্রয়োজনের ভিত্তিতে পুরাতন সামাজিক কাঠামো ভেঙে দিয়ে নতুন সমাজ গড়তে হবে। শোষণ, অবিচারমুক্ত নতুন সমাজ কাঠামো আমাদের গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে। শুভ সূচনা হিসেবে আমরা উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো জাতীয়করণ করছি।” কৃষকদের খাজনা চিরদিনের [২৫ বিঘার কম] জন্য মওকুফ করেছেন। তিনি সোনার বাংলা গড়ে তুলতে চান এবং সোনার বাংলায় থাকবে শোষণমুক্ত সমাজ। শ্রমিকদের বলেছেন [২৭ মার্চ ১৯৭২], “শ্রম ও পুঁজির মধ্যে আবহমানকাল ধরিয়া সেই পরস্পরের বিরোধিতা রহিয়াছে। তা বিলুপ্ত করা হবে।”
সমাজতন্ত্র পছন্দ করেন কিন্তু তিনি কমিউনিস্ট নন। তিনি পুঁজিবাদে বিশ্বাসী নন, গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। এই কন্ট্রাডিকশন কীভাবে মেটাবেন তার একটি ফর্মুলা তিনি করেছিলেন। ১৯৭২ সালের আগস্টে এক বক্তৃতায় তা বলেছিলেনÑ চার মূলনীতি যেন সবাই সমর্থন করেন এই নিশ্চয়তা চেয়ে তিনি বলেন, “এই চার নীতির ভিত্তিতে দেশ গড়তে চান। আমরা সমাজতন্ত্র কায়েম করতে চাই। আমরা একটি নতুন ইয়ে দিয়েছি যে গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র কায়েম করা যায় কিনা তা আমরা চেষ্টা করেছি। আমরা স্বাধীনতা দিচ্ছি কারণ দেখা যায় সমাজতন্ত্র করতে গেলে অনেক সময় বাধার সৃষ্টি হয়। মানুষ চটানোর জন্য এটা করতে চাচ্ছি না এই জন্য যে, আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। দেখছি গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র হবে কি না এবং চেষ্টা করে দেখছি বাঙালি জাতীয়তাবাদ তার ভিত্তিতে আবার আন্দোলন, এ না থাকলে আমার স্বাধীনতার ঐক্য নষ্ট হয়ে যায়। আর ধর্মনিরপেক্ষতা আমার রয়েছে।”
খন্দকার ইলিয়াসকে এসব প্রসঙ্গে তিনি আরও অনেক কথা বলেছিলেন যা এ বিষয়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছিলেনÑ “এ দেশে চিরদিন আমলা, টাউট, মহাজন, বা ফড়িয়া পুঁজিবাদের শোষণ চলেছে। শোষণ চলে ফড়িয়া বাজারী ও পুঁজিবাদের। শোষণ চলে সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও নয়া উপনিবেশবাদের। এদেশের সোনার মানুষ, এদেশের মাটির মানুষ শোষণে শোষণে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়ে। কিন্তু তাদের মুক্তির পথ কী? এই প্রশ্ন আমাকেও দিশেহারা করে ফেলে। পরে আমি পথের সন্ধান পাই। আমার কোন কোন সহযোগী রাজনৈতিক দল ও প্রগতিশীল বন্ধুবান্ধব বলেন, শ্রেণী সংগ্রামের কথা। কিন্তু আমি বলি জাতীয়তাবাদের কথা।
সেই সঙ্গে বলি, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের কথা। শোষণহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সমাজতন্ত্র চাই। কিন্তু রক্তপাত ঘটিয়ে নয়- গণতান্ত্রিক পন্থায়, সংসদীয় বিধিবিধানের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠা করতে চাই সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা।
আমার এই মতবাদ বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা ও ঐতিহাসিক পরিস্থিতি বিচার-বিশ্লেষণ করেই দাঁড় করিয়েছি। আমি মনে করি, বাংলাদেশকেও অগ্রসর হতে হবে জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রÑ এই চারটি মূল সূত্র ধরে, বাংলাদেশের নিজস্ব পথ ধরে।” [বিস্তারিত, প্রশ্ন]
জাতীয়তাবাদ ও উগ্র-জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তিনি তার ধারণা স্পষ্ট করেন। “জাতীয়তাবাদ উগ্রতা কিংবা সংকীর্ণতায় পর্যবসিত হলে হিটলারের জার্মানি, মুসোলিনির ইতালি, ডক্টর ভেরউডের দক্ষিণ আফ্রিকা, পাঞ্জাবি খানদের পাকিস্তান বা ইসরাইলের ইহুদিবাদের মতো অতি জঘন্য রূপ ধারণ করতে পারে। সে জাতীয়তাবাদ দক্ষিণপন্থী ও প্রতিক্রিয়াশীল জাতীয়তাবাদ। কিন্তু আমার জাতীয়তাবাদ বামপন্থী ও প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদ। নাৎসী জার্মানি, ফ্যাসিবাদী পাঞ্জাব, বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইহুদিবাদের মতো উগ্র ও সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের চরিত্র ও তার বিকাশধারা লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন যে, একচেটিয়া পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও নয়া-উপনিবেশবাদ এবং আমলাতন্ত্রবাদ ও জঙ্গিবাদ উগ্র ও সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের মূল শক্তি। তারা গণতন্ত্রেরও শত্রু, সমাজতন্ত্রেরও শত্রু। তাদের জাতীয়তাবাদ শোষকদের জাতীয়তাবাদ। আমার জাতীয়তাবাদ শোষিতের জাতীয়তাবাদ। কারণ, আমার জাতীয়তাবাদের নেতৃত্বে রয়েছেন কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর সমন্বয়ে গঠিত আওয়ামী লীগ। কাজেই যে জাতীয়তাবাদ আমার মতবাদের অন্যতম প্রধান অঙ্গ, সেই বিপ্লবী ও প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদ ফ্যাসিবাদে রূপান্তরিত হবার কোন ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও বাস্তব কারণ নেই।” [ঐ]
চীন ভ্রমণ করে বঙ্গবন্ধু আকৃষ্ট হয়েছিলেন সমাজতন্ত্রের প্রতি এ ধরনের সরল ধারণা করা বোধহয় ঠিক নয়। তারা যখন তরুণ, প্রধানত মওলানা ভাসানী ও শামসুল হকের নেতৃত্বে কাজ করছেন এবং বিদ্যমান শাসন ব্যবস্থার উচ্ছেদ চাচ্ছেন তখন তারা এ বিষয়গুলোর প্রতি সচেতন হন। এই শব্দগুলোর মাঝেই তারা নতুন ভূমির সন্ধান পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তারপর চীন গেছেন দুবার। রচনা করেছেন নয়াচীন ভ্রমণ সম্পর্কিত পা-ুলিপি। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে বোধহয় ধারণাটি পাকাপোক্ত হয়েছিল দু-অঞ্চলের বৈষম্যের কারণে। এ বিষয়ে বিনায়ক সেন এক ধারাবাহিক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন [তুমুল গাঢ় সমাচার]
১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্রেও এর উল্লেখ ছিল- “আওয়ামী লীগের আদর্শ শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা। সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মাধ্যমেই বর্তমানের শোষণ, বৈষম্য ও দুর্দশার হাত হইতে মুক্তিলাভ সম্ভব বলিয়া আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে।” এখানেই বলা হয়েছিল, জাতীয়করণ ও একচেটিয়া ব্যবসা বাতিলের কথা।
৫
১৯৭২ সালে সংবিধানে সমাজতন্ত্র মূলনীতি হলো। বঙ্গবন্ধু তার বক্তৃতায় [১২.১০.১৯৭২] বলেছিলেন-
“এবং যতদূর সম্ভব, যে শাসনতন্ত্র পেশ করা হয়েছে, সেটা যে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার মূর্ত প্রতীক হয়ে থাকবে, তা সম্বন্ধে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের আদর্শ পরিষ্কার হয়ে রয়েছে। এই পরিষ্কার আদর্শের ভিত্তিতে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এবং সে আদর্শের ভিত্তিতে এদেশ চলবে। জাতীয়তাবাদÑ বাঙালি জাতীয়তাবাদ- এই বাঙালি জাতীয়তাবাদ চলবে বাংলাদেশে। বাংলার কৃষ্টি, বাংলার ঐতিহ্য, বাংলার আকাশ-বাতাস, বাঙালির রক্ত দিয়ে বাঙালির জাতীয়তাবাদ। আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, জনসাধারণের ভোটের অধিকারকে বিশ্বাস করি। আমরা বিশ্বাস করি সমাজতন্ত্রে। যেখানে শোষণহীন সমাজ থাকবে। শোষক শ্রেণি আর কোনোদিন দেশের মানুষকে শোষণ করতে পারবে না। এবং সমাজতন্ত্র না হলে সাড়ে সাত কোটি মানুষ ৫৪,০০০ বর্গমাইলের মধ্যে বাঁচতে পারবে না। সে জন্য অর্থনীতি হবে সমাজতান্ত্রিক। আর হবে ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়।… কেউ কারও ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না, বাংলার মানুষ ধর্মের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ চায় না। রাজনৈতিক কারণে ধর্মকে ব্যবহার করা যাবে না। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ধর্মকে বাংলার বুকে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না।… এই চারটি আদর্শের ভিত্তিতে বাংলার শাসনতন্ত্র তৈরি হবে। এটা জনগণ চায়, জনগণ এটা বিশ্বাস করে। জনগণ এজন্য সংগ্রাম করেছে। লক্ষ লক্ষ লোক এই জন্য জীবন দিয়েছে। এই আদর্শ নিয়েই বাংলার নতুন সমাজ গড়ে উঠবে।”
বিনায়ক ড. কামাল হোসেনের উদ্ধৃতি এবং নিজের মন্তব্য যোগ করে তা স্পষ্ট করেছেন। সে-কারণে, উদ্ধৃতিটি বড় হলেও তুলে ধরছি-
১. অনুন্নত দেশের পটভূমিতে ‘সমাজতন্ত্র’ আর উন্নত পুঁজিবাদী দেশের ‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’-এর মধ্যে পার্থক্য আছে : ‘আমাদের কাছে সমাজতন্ত্র বলতে বোঝায় অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তি। সমাজতান্ত্রিক সমাজ বলতে আমরা বুঝি এমন এক সমাজ ব্যবস্থা, যেখানে জাতিকে এবং জাতীয় অর্থব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য যে আত্মত্যাগের প্রয়োজন, সকলে তা ভাগ করে নেবে। আবার সকলের প্রচেষ্টায় যে সম্পদ গড়ে উঠবে, তাও সকলে সুষমভাবে ভাগ করে নেবে। আমাদের সংবিধানে তাই সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা রাষ্ট্র পরিচালনার একটা মূলনীতি বলে ঘোষিত হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে মালিকানার নীতিতে বলা হয়েছে যে, প্রধান প্রধান অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জনগণের পক্ষে রাষ্ট্রের মালিকানা থাকবে। আর আইন যে সীমা নির্ধারণ করবে, সেই সীমার মধ্যে সমবায়গত বা ব্যক্তিগত মালিকানা থাকবে।’ অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির চরিত্র হবে মালিকানা-সম্পর্কের দিক থেকে ‘মিশ্র চরিত্রের’, যদিও গরীবফ Mixed Economy শব্দটি সেদিন ব্যবহৃত হয়নি।
২. শুধু রাষ্ট্রীয় মালিকানা নয়, এই সমাজতন্ত্রের মূল লক্ষ্য মানুষকে শোষণ থেকে মুক্তি দেওয়া এবং তাকে জীবনধারণের মৌলিক উপকরণ ও সুযোগের অধিকার দেওয়া : ‘সর্বপ্রকার শোষণ থেকে কৃষক ও শ্রমিককে এবং জনগণের অনগ্রসর অংশকে মুক্তিদানের দায়িত্ব রাষ্ট্রের ওপর অর্পণ করা হয়েছে। জীবনধারণের মৌলিক উপকরণ যাতে সকল নাগরিক লাভ করতে পারেন, সেই দায়িত্বও রাষ্ট্রের ওপর ন্যস্ত হয়েছে। সকল নাগরিক যাতে সমান সুযোগ পেতে পারেন এবং রাষ্ট্রের সর্বত্র যাতে সমান স্তরের অর্থনৈতিক উন্নয়ন লাভ করা যায়, রাষ্ট্র তা নিশ্চিত করবেন।’ অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে নাগরিকেরা দার্শনিক জন রাউলস (Rawls)-এর ভাষায় শুধু ormal Equality of Opportunity নয়, তারা Substantive Equality of Opportunity-রও অধিকারী হবেন। এর অর্থ, এটা শুধু যেনতেনভাবে পাওয়া মৌলিক সুযোগের সমতা বিধান নয়। এখানে গুণে-মানের সমতারও (Equality of Standards) কথাও থাকছে। দ্বিতীয়ত, এখানে শুধু Equality of Opportunity বা সুযোগের সমতার মধ্যেই আলোচনা সীমিত রাখা হয়নি। Equality of Outcomes-র কথাও অনুমিত থাকছে। সুযোগের সমতার পাশাপাশি, নাগরিকেরা যাতে করে সর্বত্র ‘সমান স্তরের অর্থনৈতিক উন্নয়ন’ লাভ করেন, রাষ্ট্র তা ‘নিশ্চিত করবে’- এটার ওপরে বিশেষ জোর দেওয়া হচ্ছে।
[বিস্তারিত, ঐ, ৩০.১০.২০২০]
বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্র চান আবার সমাজতন্ত্র চান, এটি কী করে সম্ভব? বঙ্গবন্ধু ওই সাক্ষাৎকারে বলেন- “শোষক শ্রেণীকে দমন করার মতো যথেষ্ট ক্ষমতা দেশবাসীর আছে। সমাজতন্ত্র রাতারাতি হয় না- দীর্ঘদিনের ব্যাপার। শান্তিপূর্ণভাবে এবং ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে হবে, ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে হবে। রক্তপাত অনেক হয়েছে, আর নয়। এবার সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে আমরা দেশকে ঐক্য, প্রগতি ও সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে নিতে চাই। এ কাজে আমি মনে করি- শক্তির উৎস বন্দুকের নল নয়, শক্তির উৎস আমার জনগণ।
পুঁজিবাদী ও সামন্তবাদী শোষণ ব্যবস্থায় ধ্বংস সাধনের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয় সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা, শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা। কাজেই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশেই পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদ প্রতিরোধ গড়ে তুলবার চেষ্টা করে। তাদের সঙ্গে কখনো প্রকাশ্যে, কখনো গোপনে যুক্ত হয় শোষকদের আন্তর্জাতিক দোসর-সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও নয়া-উপনিবেশবাদ। বাংলাদেশেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটা অস্বাভাবিক নয়। বাঙালির স্বাধীনতাযুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদের বৈরী ভূমিকায় আমরা ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছি, কিন্তু বিস্ময় প্রকাশ করিনি। কারণ, জাতীয় স্বাধীনতা বিরোধিতা করাই তাদের বিঘোষিত নীতি। তবে সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহেও প্রগতিশীল সংগঠন ও ব্যক্তি আছেন। তাঁরাও তাঁদের দেশে শান্তি, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের জন্যে সংগ্রাম করছেন। আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামে আমরা তাঁদের সক্রিয় সমর্থন লাভ করেছি। আশা করি, আমাদের সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও শান্তির সংগ্রামেও তাঁদের সক্রিয় সমর্থন আমরা লাভ করব।” [ঐ]
১৯৭৫ সালে শামসুজ্জামান খান ও কবীর চৌধুরীকে বলেছিলেনÑ “আমাকে পরামর্শ দেয়া হয়েছিলো দালাল ও রাজাকারদের ক্ষমা না করতে। খুব কঠোর পরামর্শও দেয়া হয়েছিল- শামসুজ্জামান জানে বোধহয়, প্রতিবিপ্লবীদের ধ্বংস করে দিতে। আমি তা করিনি। তাদের কুকীর্তির কথা জেনেও করিনি। আমার চোখেমুখে ভেসেছে অসংখ্য মা, বাবা, স্ত্রী ও শিশুর মুখ। আমার মনে হয়েছে আল্লাহর আরশ কাঁপবে না? আমি মানবিক হতে চেয়েছি। অনেকগুলো পরিবারকে ধ্বংস করিনি। আমি জাতির স্রষ্টা হয়ে সেটা করতে পারি না। আমি ভুল করেছি কি ঠিক করেছি ইতিহাস একদিন সে বিচার করবে। তবে খুনি ও প্রকৃত অপরাধীরা রেহাই পাবে না। তাদের বিচার করবো।” [বিস্তারিত, আলাপ]
সারাজীবন যা চেয়েছেন তার নির্যাস তিনি ১৯৭২ সালের সংবিধানে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। তিনি জানতেন যে, সমাজতন্ত্র বা ধর্মনিরপেক্ষতা বাঙালি সম্পূর্ণ মেনে নেবে না। বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তাই তিনি জাতীয়তাবাদের কথা ভেবেছেন। চীনে তিনি নারী-পুরুষ সমতা দেখেছেন, আমাদের সংবিধানেও তার নিশ্চয়তা আছে। ওই আমলের পরিপ্রেক্ষিতে খুবই আধুনিক ছিল আমাদের সংবিধান। শুধু তা-ই নয়, পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও তিনি সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়Ñ এই অবস্থান নিয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার পরপর লেনিন বা মাও সেতুং যেভাবে আদর্শ ও নীতির ক্ষেত্রে সমস্যাগুলো সমাধান করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। লেনিন বা মাও তাদের দর্শন প্রচার করেছেন, ক্যাডার সৃষ্টি করেছেন এবং জয়লাভের পর তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছেন। তাদের ম্যান্ডেটও ছিল তা।
বঙ্গবন্ধুর ম্যান্ডেট ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। আওয়ামী লীগে বহু ধরনের মানুষ জমায়েত হয়েছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ যেমন ছিলেন, খন্দকার মোশতাকও ছিলেন। সমাজতন্ত্রের কথা বঙ্গবন্ধু দীর্ঘদিন ধরে বলেছেন, কিন্তু সে সম্পর্কে কারও কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না। এ লক্ষ্যে তিনি যখন জমির সিলিং ঘোষণা করেন এবং জাতীয়করণ করেন তা স্বার্থান্বেষী একটি মহল মেনে নেয়নি। মাও সেতুং বা লেনিন স্বাধীনতার পর শত্রুপক্ষকে যতটা পারেন নির্মূল করেছেন। বাংলাদেশের যারা বিরোধিতা করেছিল তাদের ব্যাপারে তিনি ব্যবস্থা নিয়েছিলেন কিন্তু ধনী এলিট, আমলাতন্ত্র, বিভিন্ন চরম বাম দল এবং নিজের দলের বিভক্তি- একসঙ্গে এত ফ্রন্ট সামাল দেওয়া ছিল মুশকিল। ছোট দেশ, তার ওপর সব বিধ্বস্ত, খাদ্যাভাব, অর্থাভাব সব সমস্যা প্রকট হয়ে উঠেছিল। এসব সমস্যা সমাধানে তিনি আবার সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর ফর্মুলা গ্রহণ করতে চেয়েছেন। ডাক দিয়েছিলেন দ্বিতীয় বিপ্লবের, গঠন করেছিলেন বাকশাল, এবং লক্ষ করুন এই নামে কৃষক ও শ্রমিকদের নামই রাখা হয়েছিল। এ পরিপ্রেক্ষিতেই তাকে হত্যা করা হয়।
তিনি বলেছিলেন “চৌধুরী সাহেব, ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস, সারাজীবন গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করলাম, কতো জেল খাটলাম আর এখন এক পার্টি করতে যাচ্ছি। আগস্ট মাস থেকে বাকশালের কাজ পুরোপুরি শুরু হবে। আমি এটা চাইনি। বাধ্য হয়ে করতে হচ্ছে। পাকিস্তানপন্থী, বিভিন্ন ইসলামী দল এবং অস্ত্রধারী জাসদের গণবাহিনী, সর্বহারা পার্টি প্রভৃতি প্রশাসন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ভেঙে ফেলার উপক্রম করে ফেলেছে। আমার বহু লোককে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে। ঈদের দিন নামাজের মধ্যে হত্যা করা হয় শুনেছেন কখনো? অতএব, অন্য কোনো পথ খোলা না দেখে আমি স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের নিয়ে সমমনাদের একটি রাজনৈতিক মঞ্চ হিসেবে বাকশাল গঠন করছি। আমি সমাজতন্ত্র-বিরোধী, ধর্মনিরপেক্ষ-বিরোধী এবং সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কোনো দল বা ব্যক্তিকে বাকশালে নেব না। আরও একটি কথা, আমার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য নয়, দেশকে বাঁচানোর জন্য এই পদক্ষেপ। আমি ক্ষমতা অনেক পেয়েছি, এমন আর কেউ পায় নাই। সে ক্ষমতা হলো জনগণের ভালোবাসা ও নজিরবিহীন সমর্থন। প্রফেসর সাহেব শোনেন, তুমিও লিখে রেখ, আমার এই একদলীয় ব্যবস্থা হবে সাময়িক। দেশটাকে প্রতিবিপ্লবের হাত থেকে রক্ষা করে আমি আবার গণতন্ত্রে ফিরে যাবো। বহুদলীয় গণতন্ত্রে ফিরে যাবো। তবে চেষ্টা করবো আমার গণতন্ত্র যেন শোষকের গণতন্ত্র না হয়। আমার দুঃখী মানুষ যেন গণতন্ত্রের স্বাদ পায়।” [ঐ]
৬
অনেকে বলেন, স্বাধীনতার পর যে সংবিধান রচিত হয় তা ভারত ও সোভিয়েতের চাপে। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। সমাজতন্ত্রের কথা, অসাম্প্রদায়িকতার কথা [ধর্মনিরপেক্ষতা] বঙ্গবন্ধু পঞ্চাশ দশক থেকেই বলেছিলেন। চীন তিনি দেখেছেন, চীন যেভাবে সমস্যাগুলোর সমাধান করেছে তা তিনি ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছেন। পরে সোভিয়েত ব্যবস্থাও তাকে অনুপ্রাণিত করেছে সমস্যা সমাধানে। কিন্তু গণতন্ত্রের কথা তিনি ভোলেননি; এবং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা এটি ছিল তার কাছে অস্বস্তিকর, যা তিনি নয়াচীনে লিখেছিলেন। বাকশাল করার সময় তিনি বলেছিলেন, কম দুঃখে তিনি বাকশাল গঠন করেননি। কিন্তু অবস্থা ফিরলে তিনি আবার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যাবেন। সেদিন আর আসেনি। কিন্তু বাকশালের পর শৃঙ্খলা ফিরে আসছিল, উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছিল। মুজিব যে সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রয়াস চেয়েছিলেন তা মওদুদ আহমদও তার গ্রন্থে স্বীকার করেছেন। তার মতে, ‘আওয়ামী লীগ ছিল একটি দ্বন্দ্ববহুল বিশৃঙ্খল পেটি-বুর্জোয়া রাজনৈতিক সংগঠন। অসংখ্য ধরনের শ্রেণি ও পেশার প্রতিনিধিত্ব নিয়ে দলটি একটি বহুমুখী শ্রেণিচরিত্রের ধ্বজাধারী হিসেবে বিকশিত হচ্ছিল। দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে চিন্তাগত অভিন্নতার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। ফলে অসংখ্য ধরনের বিক্ষিপ্ত চিন্তা-চেতনাকে একসূত্রে গ্রথিত করে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের দিকে তাদের উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব ছিল না।’ কিন্তু এ দলটির ওপরই তাকে নির্ভর করতে হচ্ছিল।
১৯৭৫ সালে জেনারেল জিয়া এসব মূলনীতি উৎপাটন করেন। কারণ, মানসিকভাবে তিনি পাকিস্তানের কাছাকাছি থাকতে চেয়েছিলেন। আমাদেরও তার সহযাত্রী করতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ঠিকই বুঝেছিলেন ধর্মের নামে আবারও রাজাকার আলবদর পয়দা হবে। ১৯৭৫ সালের পর আমরা তাই দেখি। এ কারণে বোধহয় বক্তৃতার শুরুতে বলেছিলেনÑ “ষড়যন্ত্র এখনও শেষ হয়নি।” তার কথা সত্য হয়েছিল। লে. জেনারেল জিয়া পাকিস্তান যাত্রা শুরু করেছিলেন। তার অনুগামীদের পাকিস্তানে পৌঁছাবার আকুল বাসনা এখনও লক্ষ করি।
আগেই উল্লেখ করেছি, ১০ জানুয়ারির বক্তৃতায় এক ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল। কী হবে? যে আশা তিনি দেখিয়েছিলেন তা পূরণ করতে না পারলে? তাই উদ্বেগ চাপা না রেখে বলেছিলেনÑ “আজ সোনার বাংলার কোটি কোটি মানুষ গৃহহারা, আশ্রয়হারা, তারা নিঃসঞ্চল। আমি মানবতার খাতিরে বিশ্ববাসীর প্রতি আমার এই দুঃখী মানুষদের সাহায্য দানের জন্যে এগিয়ে আসতে অনুরোধ করছি।
নেতা হিসেবে নয়, ভাই হিসেবে আমি আমার দেশবাসীকে বলছি আমাদের সাধারণ মানুষ যদি আশ্রয় না পায়, খাবার না পায়, যুবকরা যদি চাকরি বা কাজ না পায়, তাহলে আমাদের এই স্বাধনিতা ব্যর্থ হয়ে যাবেÑ পূর্ণ হবে না। আমাদের এখন চাই অনেক কাজ করতে হবে।”
গণহত্যার কথা তিনি ভোলেননি, যদিও পশ্চিম পাকিস্তানে থাকার কারণে এর ব্যাপকতা হয়তো তখনও অনুধাবন করতে পারেননি। বলেছিলেন তিনিÑ “যারা অন্যায়ভাবে আমাদের মানুষদের মেরেছে তাদের অবশ্যই বিচার হবে। বাংলাদেশে এমন পরিবার খুব কমই আছে, যে পরিবারের লোক মারা যায়নি।… পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশে যে নির্বিচারে গণহত্যা করেছে তার অনুসন্ধান ও ব্যাপকতা নির্ধারণের জন্য আমি জাতিসংঘের নিকট একটা আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠনের আবেদন জানাচ্ছি।”
জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, মতিউর রহমান নিজামী ও বেগম খালেদা জিয়া বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ থেকে আমাদের নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন পাকিস্তানে। কিন্তু বাঙালি যে পাকিস্তান যেতে চায় না তার প্রমাণ, বঙ্গবন্ধু-কন্যাকে গত নির্বাচনে একতরফা ম্যান্ডেট দেওয়া। বঙ্গবন্ধুর করা সেই চার মূলনীতি, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠন ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে আমরা আবার বঙ্গবন্ধুর সেই বাংলাদেশে ফিরতে পারি। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতার প্রথমে যা বলেছিলেন তা দিয়েই শেষ করবÑ “বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই টিকে থাকবে। বাংলাকে দাবিয়ে রাখতে পারে এমন কোন শত্রু নেই।”
তিনি ফিরে এঁছেছেন, তার একটি আলাদা গুরুত্ব ছিল ১৯৭২ সালে। বাংলাদেশে ৩০ লাখের বেশি মানুষ শহিদ হয়েছিলেন। প্রতি পরিবারের ১০ জন করে সদস্য থাকলে ধরতে হবে ৩ কোটি মানুষ বিষণœ ও বিপর্যস্ত ছিলেন। বাংলাদেশে ৫ লাখের বেশি মানুষ ধর্ষিত হয়েছিলেন। আগের হিসাব ধরলে ৫০ লাখ পরিবার ছিল বিষণœ ও বিপর্যস্ত। ভারতে শরণার্থী হয়েছিলেন ১ কোটি। তারা এসে পেয়েছিলেন শুধু ভিটে। বিপর্যস্ত ও বিষণœ ছিলেন তারা । এছাড়া আহত হয়েছিলেন, নির্যাতিত হয়েছিলেন অনেকে। এ হিসাব ধরলে দেখা যাবে অধিকাংশ মানুষই ছিলেন বিষণ্ণ। তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন কি না এ সন্দেহ আরও হতাশার সৃষ্টি করেছিল। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশে কিছুই ছিল না। দিন দিন কীভাবে সে চিন্তায়ও মানুষ ছিল বিপর্যস্ত ও বিষণ্ণ। তাই এ কারণে তারা একজন ত্রাতার খোঁজে ছিল আর এ ত্রাতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
তার ডাকে তারা যুদ্ধে গিয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন। তাই সাগ্রহে তারা ত্রাতার অপেক্ষা করছিল। তিনি ফিরেছিলেন। এ ফিরে আসা মানুষ-কে সাহস জুগিয়েছিল, মানুষ ভেবেছিল তিনি তাদের এখন নিয়ে যাবেন সিরাজুল মোস্তাকিমে। মানুষ বিষণ্ণতা কাটিয়ে, হতাশা ভেঙে উঠে দাঁড়িয়েছিল।
বাংলাদেশের তখন যে অবস্থা ছিল, বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কেউ বাংলাদেশে শাসন করতে পারতেন না। যারা ঐ সময়ের মানুষ বা রাজনৈতিক ইতিহাস পড়েছেন তারা বিষয়টি জানেন। বঙ্গবন্ধু সাড়ে তিন বছরে বাংলাদেশে প্রতিটি ক্ষেত্রে কাজ করে গেছেন। তার ওপর ভিত্তি করে আজকের বাংলাদেশ গড়ে উঠেছে। এ-কথা অস্বীকার সত্যের অপলাপ মাত্র।
লেখক : অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু চেয়ার ও ইতিহাসবিদ