চীনের গণমাধ্যম ছিল সর্বৈবভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে এবং তারা তীব্র বিরোধী প্রচার চালায়।
শেখর দত্ত:
এক
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাংলাদেশের জনগণের হাজার বছরের স্বাধীনতা ও মুক্তির স্বপ্ন-আকাক্সক্ষা এবং লড়াই-সংগ্রামের শ্রেষ্ঠতম বহিঃপ্রকাশ। দেশের ইতিহাসের এক মাহেন্দ্রক্ষণে অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ, ঘোষণা ও অনুপ্রেরণায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে কতিপয় ঘাতক-দালাল ব্যতীত আপামর জনগণের নির্ভিকতা-দৃঢ়তা-অবিচলতা-একাগ্রতা-একাত্মতা-সাহস-আত্মত্যাগ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ সশস্ত্র লড়াইয়ের ভেতর দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। হঠাৎ করে স্বাধীনতার জন্য অপরাজেয় এই সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়নি। পাকিস্তানি আমলের সুদীর্ঘ ২৪ বছরের অবহেলা-বঞ্চনা, শাসন-শোষণ, নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামের চরমলগ্নে পাকিস্তানি শাসকরা নির্বাচনী রায় বানচালের জন্য বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার, গণহত্যা ও আওয়ামী লীগসহ গণতান্ত্রিক-দেশপ্রেমিক-প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোকে নিশ্চিহ্ন করার সর্বাত্মক তৎপরতা শুরু করলে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়।
মুক্তিযুদ্ধ বিজয়ের জন্য বিশ্বের গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল ও মানবমুক্তির পক্ষের রাষ্ট্র ও জনগণের সাহায্য ও সহযোগিতা ছিল অপরিহার্য। কিন্তু প্রথম থেকে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী গণহত্যাকে আড়াল করে শাসন ও শোষণ অব্যাহত রাখার জন্য সমগ্র বিশ্ব থেকে বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। বাস্তবে প্রতিক্রিয়ার প্রতিভূ নিষ্ঠুর শাসক-শোষকরা সব সময়েই সত্য ঘটনাকে আড়াল করার জন্য সংবাদপত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে হরণ করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করে। পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক ধরনের শাসক-শোষকরা ছিল এক্ষেত্রে নিকৃষ্টতম উদাহরণ। তবে বিশ্ব ইতিহাসের জঘন্যতম মানবতাবিরোধী গণহত্যা ও গণতান্ত্রিক অধিকার দমনের জঘন্যতম অপরাধকে পাথরচাপা দিয়ে রাখা ছিল তাদের পক্ষে অসম্ভব। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে বিজয় পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেভাবে সংবাদ সংগ্রহ করে হানাদার-কবলিত দেশের বাইরে পাঠিয়েছেন এবং নিজ দেশের সরকারের অবস্থান বিবেচনায় না নিয়ে সংবাদমাধ্যমে খবর ও প্রতিবেদন ছাপিয়েছেন, তা লোমহর্ষ গল্পকেও হার মানাবে।
প্রসঙ্গত, বিশ্ব মানবের তৃতীয় নয়ন সংবাদমাধ্যম এক প্রচ- শক্তি; যার হাতে সৈন্য-অস্ত্র নেই; কিন্তু আছে সত্য তুলে ধরার ভাষা। এর কারণ মত-পথ-চিন্তা ও সত্য ঘটনা জনগণকে লক্ষ্যাভিমুখী অগ্রসর হতে অনুপ্রেরণা জোগায়। কোনো দেশের রাষ্ট্রশক্তি যখন জনগণের মতামত দমন করতে নিষ্ঠুর-ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠে এবং জনগণ যখন নেতা-চেতনা ও কর্মসূচি পেয়ে ইতিহাসের স্রষ্টা হয়ে ওঠে, তখন জনগণের প্রতিরোধ-প্রতিবাদ-বিজয়ের হাতিয়ার হয়ে ওঠে সংবাদমাধ্যম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিজয়ের জন্য বিশ্বের সংবাদমাধ্যম যে ভূমিকা রেখেছে, তা বাঙালি জাতি চিরকাল কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণে রাখবে। বিজয়ের মাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব পালনের মধ্যে কৃতজ্ঞতার প্রকাশ করতে বিশ্বের সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের অবদান স্মরণ করা হচ্ছে।
দুই
মুক্তিযুদ্ধ যতই সাহসিকতা-ক্ষিপ্রতা-তীব্রতা-ব্যাপকতা নিয়ে বিজয়ের লক্ষ্যে এগিয়ে গেছে, ততই বিশ্বের দেশে দেশে প্রচারমাধ্যম বাংলাদেশের স্বপক্ষে প্রচার অব্যাহতভাবে বাড়িয়ে গেছে। আলোচনার শুরুতেই ৩টি বিষয় বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন।
প্রথমত; আমেরিকা-চীন-সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশের মুক্তি-সংগ্রামকে বিরোধিতা করার প্রেক্ষিতে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের সরকারের সমর্থন বাংলাদেশ পায় না। বাংলাদেশ-ভারতের যৌথবাহিনীর আক্রমণে মুক্তিযুদ্ধ যখন বিজয়ের দুয়ারে করাঘাত করছে, তখনই ৭ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় শান্তির জন্য যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব উত্থাপিত হলে তাতে পড়ে ১০৪ ভোট, বিপক্ষে অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ১১ ভোট এবং ১০টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। অর্থাৎ শেষ পর্যন্তও ছিল বিশ্বের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে। এ অবস্থায়ও বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যম ছিল সাধারণভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। কোনো দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামই সফল হতে পারে না, বিশ্বের জনগণের সাহায্য-সহযোগিতা ও একাত্মতা-সংহতি ছাড়া। সরকারগুলোর ভিন্ন অবস্থান সত্ত্বেও বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যম তৃতীয় নয়ন হিসেবে সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে বিশ্ববিবেককে জাগ্রত করতে ভূমিকা রেখেছে।
দ্বিতীয়ত; গণমাধ্যমে প্রচার ও জনমতের দিক থেকে ভারত ছিল সব থেকে এগিয়ে। সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের দেশগুলোর সংবাদমাধ্যম ও জনমত ছিল সর্বৈবভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। চীনের গণমাধ্যম ছিল সর্বৈবভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে এবং তারা তীব্র বিরোধী প্রচার চালায়। গণমাধ্যমের ভূমিকার ফলে ব্রিটেন ও আমেরিকায় জনমত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আলোড়িত হয়। যেসব দেশে জনমত খুব সামান্য আলোড়িত হয় সে-দেশগুলো হলোÑ জাপান, ফিলিপাইনস, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, সুইডেন, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, কানাডা। নেপাল ও শ্রীলংকার কিছু আলোড়ন সৃষ্টি হয়। আফ্রিকায় মুক্তিযুদ্ধ তেমন দাগ কাটতে সক্ষম হয়নি। মধ্যপ্রাচ্য থেকে মুক্তিযুদ্ধ সহায়তা পায়নি। বাস্তবে যেখানে বাঙালিরা ছিল সেখানেই জনমত কম-বেশি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আসে। বিদেশে বাংলাদেশের কূটনীতিকরা পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে দূতাবাস ছেড়ে এসে বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য ঘোষণা করার পর সংবাদ পরিবেশিত হলে সেসব দেশের জনমত আন্দোলিত হয়। বাস্তবে গণমাধ্যমের ভূমিকা ছাড়া বিশ্বের জনমতকে প্রভাবিত করে সক্রিয় জনমত পক্ষে আনা দুঃসাধ্য ছিল।
তৃতীয়ত; মুক্তিযুদ্ধের ছিল ৫টি পর্যায়।
এক. ২৫ ডিসেম্বর থেকে মে পর্যন্ত : স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ, যা আধুনিক প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হানাদার বাহিনীকে হতচকিত করে দিলেও শক্তির আকাশ-পাতাল পার্থক্যের জন্য ভেঙে পড়া ছিল স্বাভাবিক।
দুই. জুন-জুলাই : বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী গঠন, ভারতের সহায়তায় অস্ত্র প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রপ্রাপ্তি।
তিন. আগস্ট-সেপ্টেম্বর : সংগঠিত আক্রমণ শুরু; দেশের অভ্যন্তরে গেরিলা যুদ্ধ ও সীমান্তজুড়ে সম্মুখযুদ্ধ।
চার. অক্টোবর-নভেম্বর : পাকহানাদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর সহায়তায় মুক্তিবাহিনীর সম্মুখযুদ্ধ ও সফলতা অর্জন।
পাঁচ. বিজয় পর্ব : ৩-১৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্র ভারতীয় বাহিনী মিলে যৌথবাহিনী গঠন, ক্ষিপ্র ও সর্বাত্মক আক্রমণ ও বিজয়।
স্বাভাবিকভাবে এই ৫টি পর্বে বিশ্ব সংবাদমাধ্যমে প্রচারের যেমন তেমনি বিশ্ব জনমতও ছিল বাংলদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ক্রমাগ্রসরমান। বিশ্ব খ্যাত অমেরিকার দুই সাময়িকী নিউজউইক ৫ এপ্রিল, ২ আগস্ট ও ৬ ডিসেম্বর অর্থাৎ তিনবার এবং টাইমস ২ আগস্ট ও ৬ ডিসেম্বর অর্থাৎ দুবার প্রচ্ছদ কাহিনি হিসেবে বাংলাদেশের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরে। নিউজউইকের তারিখগুলোর দিকে তাকালে অনুধাবন করা যাবে, স্বতঃস্ফূর্ত, সংগঠিত, আক্রমণ ও বিজয় পর্বে তখনকার বিশ্বের দুই পরাশক্তির এক শক্তি আমেরিকার সরকার মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে থাকলেও গণমাধ্যম ছিল বাংলাদেশের পক্ষে। সংগঠিত পর্বে দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিবাহিনীর গেরিলাযুদ্ধ, সীমান্তে সম্মুখযুদ্ধ আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভারতে শরণার্থীর সংখ্যা যখন বাড়তে থাকে এবং বিজয় যখন দুয়ারে আঘাত হানছে, তখন প্রতিবেদন প্রকাশ করে। অন্যান্য দেশের সংবাদমাধ্যমের জন্যও এটা সত্য। এ থেকে প্রমাণিত হয়, বাংলাদেশের আপামর জনগণের জীবনপণ লড়াইয়ের কারণেই মুক্তিযুদ্ধ বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়।
তিন
মুত্তিযুদ্ধের উষালগ্নে অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে গণহত্যা শুরু হলে বাংলাদেশের বাইরে ২৬ মার্চ প্রথম সংবাদ প্রকাশিত হয় শিলং থেকে প্রকাশিত এক সংবাদপত্রে। পরদিন ২৭ মার্চ কলকাতার যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত ওই খবরের উদ্ধৃতি দিয়ে হেডিং করা হয়, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন/সার্বভৌম রাষ্ট্র বলে মুজিবরের ঘোষণা/যে কোন মূল্যে শত্রুকে প্রতিরোধ করার আহ্বান।’ একই সঙ্গে কলকাতার বেতার কেন্দ্র আকাশবাণী গণহত্যার বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশের প্রতিরোধ যুদ্ধের পক্ষে প্রচার চালায়। ভারত নিবাসী কিশোরগঞ্জের সন্তান অমর রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাসের ‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে…’ গানটি এবং দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথিকা দারুণভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এই প্রচার হানাদার-কবলিত বাংলাদেশের মুক্তিপাগল রাজনৈতিক নেতৃত্ব, ছাত্র-যুবক ও জনগণকে দারুণভাবে ভরসা জোগায় এবং অনুপ্রাণিত করে। এই প্রচারে ভারতের বিশেষত বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন রাজ্যগুলোতে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টি হয়।
একই দিনে কারফিউ স্বল্প সময়ের জন্য শিথিল হলে হানাদার বাহিনী চরমতম নির্লজ্জতা প্রদর্শন করে ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে বিদেশি সব সাংবাদিকদের একত্র করে কড়া সেনা পাহারায় বিমান বন্দরে নিয়ে যায় এবং বিশেষ বিমানে ঢাকা ত্যাগে বাধ্য করে। হোটেলে ছিলেন আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন, জাপান প্রভৃতি দেশের ৩৭ সাংবাদিক। হানাদার বাহিনীর ধারণা ছিল সবাইকে বের করা হয়েছে। কিন্তু বেহুলার লোহার বাসরঘরে যেমন থাকে ছিদ্র, তেমনি হানাদার বাহিনীর কাজেও থেকে যায় চিচিং ফাঁক।
ডেইলি টেলিগ্রামের সাংবাদিক সাইমন ড্রিং ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েট প্রেসের আলোকচিত্র শিল্পী মাইকেল লরেন্ট জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হোটেলে পালিয়ে থেকে বাংলাদেশে থেকে যান। হোটেল কর্মচারীদের সহায়তায় একটি মোটরভ্যানে ২৭ মার্চ তারা দুজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল, রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক ও পুরান ঢাকায় ঘুরে সংবাদ সংগ্রহ করেন। তাই বহির্বিশে^ প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে পাকিস্তানি নৃশংসতার সংবাদ পেতে প্রথম থেকেই অসুবিধা হয় না।
২৭ মার্চ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ বলেন, “পূর্ব পাকিস্তান সংকটে ব্রিটেন অংশ নেবে না।” ২৮ মার্চ ব্রিটিশ পত্রিকা ‘দ্য অবজারভার’ প্রতিবেদনে লেখে “রাশিয়া স্বীকৃতি দিতে পারে। পরাশক্তি স্বীকৃতি দিলে গণহত্যা বন্ধ হতে পারে। বন্দি বঙ্গবন্ধু ঢাকা কিংবা চট্টগ্রাম কোথায়, কীভাবে আছেন এবং জীবনের সংশয় রয়েছে বলেও আশঙ্কা করা হয়।” ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, “পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। উপযুক্ত সময় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
চার
প্রথম থেকেই পাকবাহিনীর নির্বাচারে অত্যাচার-নৃশংসতা-বীভৎস্যতা নিয়ে বিবিসি প্রচার শুরু করে। বিবিসির দক্ষিণ এশীয় বিষয়ক সংবাদদাতা মার্ক টেলি ২৫ মার্চের প্রথম প্রহর থেকেই বর্বর হামলা প্রত্যক্ষ করেন। একপর্যায়ে ঢাকা ত্যাগ করতে বাধ্য হন। জুনের তৃতীয় সপ্তাহে বিদেশি সাংবাদিকদের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেও তিনি আর অবরুদ্ধ বাংলাদেশে আসেননি। সীমান্ত ঘুরে তিনি সংবাদ সংগ্রহ করেন এবং তা বিবিসিতে প্রচারিত হয়। বিশ্ব জনমত গঠনে বিবিসির ভূমিকা ছিল অপরিসীম। মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই দেশবাসী বিবিসি শুনতে অভ্যস্ত থাকায় এ-মাধ্যমটি মুক্তিপাগল জনগণের কাছে খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
নিউইয়র্ক টাইমস দক্ষিণ এশীয় সংবাদদাতা সিডনি শ্যানবার্গ শুরু থেকেই ঢাকায় ছিলেন। ২৮ মার্চ ‘ইন ঢাকা, ট্রুপস ইউজ আর্টিলারি টু হল্ট রিভল্ট’ প্রতিবেদনের ভেতর দিয়ে তিনি পাকবাহিনীর পাইকারী হত্যাকা-ের বর্বরতা তুলে ধরেন। টিক্কা খানকে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ পরিচালনার জন্য ওই পত্রিকা ‘বুচার অব বেঙ্গল’ বলে আখ্যায়িত করে। তিনিও বহিষ্কৃত হন। ১৬ ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনীর ট্রাংকে তিনি ঢাকা প্রবেশ করেন। ২৯ মার্চ ‘দ্য এজ ক্যানবেরা’ সাময়িকীর সম্পাদকীয় হেডিং ছিল ‘পাকিস্তানের দুঃখ’।
২৮ মার্চ নয়াদিল্লি থেকে পাঠানো ডেভিড লসাকের প্রেরিত ‘পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধের অগ্নিতরঙ্গ’ শিরোনামের খবরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বক্তব্য তুলে ধরে বলা হয়, ‘শেখ মুজিব বিশ্বাসঘাতক’। ২৯ মার্চ অস্ট্রেলিয়ার ‘সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, “এখন স্পষ্টতই পাকিস্তান দুই টুকরো হয়ে গেছে… বল প্রয়োগ করে সংহতি পুনরুদ্ধার করা যায় না।” আমেরিকার ‘দ্য বাল্টিমোর সান’ লেখে “প্রকৃত সত্য হচ্ছে, পাকিস্তান সরকার জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাসীন হতে না দেওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এবং সেই প্রতিজ্ঞা থেকেই এই পরিকল্পিত আক্রমণ।” ভুট্টোকে উদ্ধৃত করে ‘দ্য ইভিনিং স্টার’ লেখে “ঘূর্ণিঝড় (’৭০-এর) এখনও পুরো পাওনা বুঝে নেয়নি।” অর্থাৎ পরবর্তী গণহত্যার মাধ্যমে পুরো পাওনা বুঝিয়ে দেওয়াই ভুট্টোর পরিকল্পনার অংশ।
ব্রিটেনের ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ ৩০ মার্চ প্রচারিত ‘ট্যাংকস ক্রাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রত্যক্ষদর্শীর রিপোর্ট ও সংবাদ প্রকাশ ছিল বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে সাড়া জাগানো খবর। হানাদার বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে ঢাকায় থেকে যাওয়া সাংবাদিক সাইমন ড্রিং অবরুদ্ধ ও লাঞ্ছিত ঢাকা থেকে প্রতিবেদনটি প্রেরণ করেন। তাতে লেখা ছিলÑ “আল্লাহর নামে আর অখ- পাকিস্তান রক্ষার অজুহাতে ঢাকা আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত ও সন্ত্রস্ত এক নগর।” পাকিস্তানি সৈন্যদের ঠা-া মাথায় টানা ২৪ ঘণ্টা গোলাবর্ষণ করে প্রায় ১৫ হাজার মানুষকে হত্যা করে। ওইদিনই তিনি জোরপূর্বক বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কৃত হন এবং ১৬ ডিসেম্বর যৌথবাহিনীর সঙ্গে ময়মনসিংহ হয়ে স্বাধীন দেশের রাজধানী ঢাকা আসেন। অন্যদিকে ফাঁকি দিয়ে ঢাকায় থেকে যাওয়া আলোকচিত্র শিল্পী মাইকেল লরেন্ট তার তোলা ছবি জার্মান দূতাবাসের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিতে সক্ষম হন।
৩১ মার্চ লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘দ্য গার্ডিয়ান’ ও ‘নিউইয়র্ক টাইমস’Ñ এ দুই পত্রিকার সম্পাদকীয় হেডিং ছিল যথাক্রমে ‘পাকিস্তানের জঘন্য হত্যাকা-’ ও ‘পাকিস্তানের নামে’। ওইদিন ভারতের রাজ্যসভায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ‘গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা রক্ষার্থে’ বাংলাদেশের জনগণের পাশে দাঁড়াতে দেশবাসীকে আহ্বান জানান। পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণ এবং গণহত্যার সমালোচনা ও নিন্দা করে সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব পাস হয়। ওইদিন জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে সেখানে নোট প্রেরণ করেন। লোকসভার প্রস্তাবে ‘পূর্ব বাংলার সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে গভীর দুঃখ ও উদ্বেগ প্রকাশ’ করে ‘জনগণের গণতান্ত্রিক জীবনযাত্রার সংগ্রামে একাত্মতা ও গভীর সহানুভূতি’ প্রকাশ এবং ‘৭৫ মিলিয়ন মানুষ তাদের ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানে’ জয়ী হবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বক্তৃতা ও লোকসভার প্রস্তাব সংবাদমাধ্যমে প্রচার হলে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ ও গণহত্যার খবর ভারতসহ সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
পাঁচ
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেই কেবল নয়, বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসে একাত্তরের এপ্রিল ছিল অনন্যসাধারণ ও গৌরবময়। বাঙালি স্বপ্নসাধ পূর্ণ করে এই মাসে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়।
এপ্রিলের প্রথম দিকে আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না। ৩ এপ্রিল লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘দ্য টাইমস’ পত্রিকার সম্পাদকীয় হেডিং ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তানের হত্যাকা-’। ৬ এপ্রিল সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট পোদগোর্নি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে প্রেরিত পত্রে শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতারে উদ্বেগ প্রকাশ এবং সমস্যা রাজনৈতিকভাবে সমাধানের আহ্বান জানান। এ দুই সংবাদ আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়। রাজনৈতিক দলসহ জনগণ যখন চরমভাবে বিপদাপন্ন ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় তখন এক পরাশক্তির কার্যত বিরোধিতা সত্ত্বেও আরেক পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন জনগণের মনে আশার সঞ্চার করে।
৪ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ দিল্লি গিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা করার পরদিন দিল্লি দূতাবাসের প্রেস অ্যাটাশে আমজাদুল হক ও সাহাবুদ্দিন রাত ১২টায় সাংবাদিক সম্মেলন করেন। এ দুই বাঙালি ২৮ মার্চ পাকিস্তানের চাকরি ত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেন এবং ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ের প্রার্থনা করেন। ভারতের রাজধানীতে তখন ৪৯ বিদেশি সাংবাদিক ছিলেন। তারা সবাই এবং ভারতীয় মিডিয়ার ৪৪১ সাংবাদিক সেখানে উপস্থিত থাকেন। সাংবাদিকরা ‘কোন কর্তৃত্ব বলে’ সংবাদ সম্মেলন করেন প্রশ্নের উত্তরে তারা বলেন, “আমরা এখন গেরিলা। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে। নতুন রাষ্ট্র হয়েছে বাংলাদেশ।” এটা ছিল সাহসী, দেশপ্রেমে উজ্জীবিত এক অনন্য ঘটনা। এই সংবাদ সম্মেলন সারাবিশ্বে ঘটনা ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে।
৬ এপ্রিল ঢাকার আমেরিকান দূতাবাসের কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লার্ডসহ ২০ জন কূটনীতিক ডিসেন্ট চ্যানেলে (এই চ্যানেল ফরেন সার্ভিসের অফিসারবৃন্দ এবং মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও ইউএস এইড কর্তৃক নিয়োগকৃত মার্কিন নাগরিকদের জন্য খোলা থাকে। তাতে ‘গঠনমূলক সমালোচনা’ প্রকাশ করা যায়) মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টে টেলিগ্রাম রিপোর্ট প্রেরণ করেন, যাতে মার্কিন সরকারের ‘গণহত্যা সমর্থন’কে ‘নৈতিক দেউলিয়াত্ত’ বলে সমালোচনা করা হয়। এই রিপোর্ট মার্কিন কূটনীতির ইতিহাসে ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’ হিসেবে সুবিখ্যাত। এই রিপোর্ট জানাজানি হলে পাকিস্তানের অভিযোগের প্রেক্ষিতে আর্চার ব্লাডকে জুন মাসে ক্ষুব্ধ হয়ে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট ঢাকা থেকে প্রত্যাহার করে নেয়। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে এই কূটনীতিকের টেলিগ্রাম বিশেষভাবে আমেরিকান জনগণকে গণহত্যার নৃশংস স্বরূপ বোঝাতে সাহায্য করে। মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকার ভূমিকা কিংবা খবর প্রচারের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলে ‘আর্চার ব্লাড’ নামটি তাই ইতিহাসে অমোচনীয় হয়ে থাকবে।
৫ এপ্রিল নিউজ উইক ‘পাকিস্তান প্লাঞ্জেস ইনটু সিভিল ওয়ার’ প্রতিবেদন প্রচার করে। ১২ এপ্রিল ‘দ্য টাইমস’ এক প্রতিবেদনে লেখে যে, পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনী সম্ভবত কিছু সময়ের জন্য ঢাকাসহ পূর্বাংশের শহরগুলো নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারবে। কিন্তু অনির্দিষ্ট সময় ধরে বাগে রাখতে পারবে না। ১২ এপ্রিল ‘নিউজ উইক’ ‘একটি আদর্শের মৃত্যু’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বাঙালির আত্মবিশ্বাস, গণজাগরণ ও পাকিস্তানিদের প্রতি ঘৃণা প্রভৃতি তুলে ধরে এই প্রতিবেদনে লেখে যে, “লিকলিকে রোগা এক বাঙালি সড়কি বল্লম বাঁশের লাঠি দিয়ে যশোহরে ১ হাজার আধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত পাকবাহিনীকে আটকে রেখেছিল।”
১৪ এপ্রিল আমেরিকার মিশিগানের সুবিখ্যাত পত্রিকা ‘ডেট্রয়েত ফ্রি প্রেস’ প্রতিবেদন লেখে “পাকিস্তানের সঙ্গে গৃহযুদ্ধে লিপ্ত বাংলাদেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী সরকার গত মঙ্গলবার পূর্ব পাকিস্তানের ওপর নিজের সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করেছে এবং বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দেশের প্রতি স্বীকৃতি ও সহায়তার আবেদন করেছে।” ওইদিন ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ এক পৃষ্ঠাজুড়ে ১৪ জন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবী একটি আবেদন প্রকাশ করেন। এতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে গণহত্যা বন্ধ করতে আহ্বান জানান। তাদের বক্তব্য ছিল, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বিবেচনায়ও বাংলাদেশ একটি উত্তম ও অবিসম্ভাবী সমাধান। ১৬ এপ্রিল লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘নিউ স্টেটসম্যান’ পত্রিকার সম্পাদকীয় হেডিং ছিল ‘রক্তাক্ত বাংলাদেশ’। ১৮ এপ্রিল লন্ডনের ‘দ্য অবজারভার’ ‘স্বপ্নভঙ্গের পথে বাংলদেশ’ প্রতিবেদনে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ছাত্র ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হত্যার বিবরণ তুলে ধরে। ১৯ এপ্রিল ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এর সাংবাদিক নিকোলাস টোমালিন লিখিত ‘ফার ফ্রম দ্য হলোকাস্ট’ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। হলোকাস্ট শব্দ দিয়ে জাতিকে নির্মূল, হত্যাকা-, আগুনে মহাধ্বংস, ধ্বংসস্তূপ প্রভৃতি বোঝানো হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নাজি জার্মানিতে যে ইহুদি গণহত্যার তা-ব চলে, তার সঙ্গে পাকবাহিনীর গণহত্যাকে তুলনা করা হয়।
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে হানাদার-কবলিত দেশের সকল পত্রিকায় বন্দি অবস্থায় বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ছবি ওঠে। ছবিটি করাচির বিমান বন্দরে তোলা হয়েছিল বলে পরে জানা যায়। তারপর কোথায় কীভাবে আছেন পাক-জান্তা গোপন রাখে। এটা তো চিরায়ত সত্য যে, গর্হিত অন্যায়-অপরাধ কেবল ন্যায় ও অপরাধকেই নানাদিক থেকে বাড়াতে থাকে। নির্বাচনে বিজয়ী পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ইয়াহিয়া-ভুটোচক্র চরমতম অন্যায় ও অপরাধ করে। তাই পুরো মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধু স্বশরীরের না থেকেও তিনিই হয়ে ওঠেন বিশ্বমিডিয়ার আগ্রহ-কেন্দ্র এবং প্রচারের বড় বিষয়।
ছয়
অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে নির্বাচনী রায় বানচাল, গণহত্যা, বিদেশি সাংবাদিকদের বহিষ্কার প্রভৃতি ফ্যাসিবাদী ধরনের কাজ অব্যাহত রাখলে এবং তা বিশ্ব সংবাদমাধ্যমে প্রচার হতে থাকলে ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা প্রচ- চাপের মুখে পড়ে। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি পাকহানাদার বাহিনী শহরসহ বিভিন্ন এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়। তখন সরকার স্বাভাবিক অবস্থা দেখাতে পাকিস্তান থেকে আট সাংবাদিককে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে নিয়ে আসে। ঢাকা কুমিল্লা যশোরের যেসব এলাকা তখন স্বাভবিক ছিল এবং ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষত ছিল না, সেসব জায়গায় সরকারি নিয়ন্ত্রণে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়। সাত সাংবাদিক ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এর স্বাভাবিক অবস্থার রিপোর্ট তাদের পত্রিকায় তুলে ধরেন। এর মধ্যে ব্যতিক্রম ছিলেন গোয়ায় জন্মগ্রহণকারী পাকিস্তানি নাগরিক, কারাচির মর্নিং নিউজের সম্পাদক, ব্রিটেনের ‘সানডে টাইমস’ পত্রিকার পাকিস্তান সংবাদদাতা অ্যান্থনি মাসকার্নহাস।
১৮ মে ওই পত্রিকার প্রতিবেদনে তিনি লেখেন, “পূর্ব বাংলার শ্যামল প্রান্তরজুড়ে আমি আমার প্রথম চাহনীতেই জমাট রক্তপুঞ্জের দাগ দেখতে পেয়েছিলাম। এই সংঘবদ্ধ নিপীড়নের শিকার কেবল হিন্দুরাই নয়, হাজার হাজার বাঙালি মুসলমানও এ নির্মমতার শিকার।” ইতোমধ্যে তিনি তার স্ত্রী-সন্তানকে পাকিস্তান থেকে লন্ডনে নিয়ে আসেন। ২৭ মে লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকার সম্পাদকীয় হেডিং ছিল ‘পূর্ব বাংলার দুঃখ’। এদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্রে প্রতিরোধ, গণহত্যা প্রভৃতি সম্পর্কে প্রতিনিয়ত খবর প্রকাশিত হতে থাকে। নিউইয়র্ক, লন্ডনসহ অনেক শহরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সৃষ্ট বিভিন্ন সংগঠন সভা-সমাবেশ-মিছিল-গানের আসর-বুলেটিন-স্বাক্ষর সংগ্রহ ইশতেহারসহ বিভিন্নভাবে প্রচারের কাজ চলতে থাকে। এর মধ্যে বিশ্ব খ্যাত স্থপতি ফজলুর রহমান খানের উদ্যোগে শিকাগো শহরে প্রতিষ্ঠিত বাঙালিদের নিয়ে ‘বাংলাদেশ ডিফেন্স লীগ’ সংগঠনের ১৭ মে থেকে শুরু করে মোট ৭২টি পাক্ষিক নিউজ লেটার প্রকাশ করে।
সাত
জুন মাসে ভারত সরকারের সাহায্যে বাংলাদেশ সরকার যখন মুক্তিবাহিনী গঠন, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প স্থাপন, মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট ও তাদের ট্রেনিং-এ পাঠিয়ে সর্বাত্মক আক্রমণের প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে তৎপর; তখন পাকবাহিনী গণহত্যা-অগ্নিসংযোগ-ধর্ষণ প্রভৃতির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। স্রোতের মতো রিক্ত ও অসহায় মানুষ শরণার্থী হিসেবে ভারতে যেতে থাকে, তেমনি দেশের ভেতরেও মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য এদিক-ওদিক ছুটতে থাকে। কিন্তু অবরুদ্ধ-লাঞ্ছিত বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করায় এবং বিদেশি সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ থাকায় বিশ্ববাসী পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি ‘স্বাভাবিক’, শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’, তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধ ভারত ও হিন্দুদের ‘উসকানির ফল’ প্রভৃতি প্রচারই বিশ্বাস করতে থাকে। ইয়াহিয়া-ভুট্টো চক্র মনে করতে থাকে ‘পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে এবং গণরায় বানচাল ও গণহত্যার চাপ কমে আসবে।’
এ অবস্থায় ১৩ জুন ব্রিটেনের ‘সানডে টাইমস’ পত্রিকায় ‘জেনোসাইড’ শিরোনামে অ্যান্থনি মাসকার্নহাসের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। দুই পাতায় ১৬ কলামব্যাপী ছবিসহ প্রতিবেদনটি গুরুত্বসহকারে ছাপা হয়। এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে ফাঁস হয়ে যায় বাংলাদেশের বাস্তব চিত্র, উন্মোচিত হয় ইয়াহিয়া-ভুটো চক্রের মুখোশ, মানবতাবিরোধী অপকর্ম। এই প্রতিবেদনে ব্যাখ্যা করা হয়, কেন পূর্ব পাকিস্তান থেকে ৫০ লাখ মানুষকে ভারতে শরণার্থী হতে হয়েছে। সারাবিশ্বের বিবেকবান ও গণতন্ত্রমনা মানুষ এতে শিহরিত হয়ে ওঠে এবং বাংলাদেশের মানুষের ন্যায্য দাবি স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়াতে শুরু করে। এই প্রতিবেদন পাল্টে দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের গতিপথ। ভারতকে কতটা অনুপ্রাণিত করেছিল তা অনুধাবন করা যাবে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বক্তব্যে। পরবর্তীতে সানডে টাইমস সম্পাদক হ্যারল্ড ইভান্সকে তিনি বলেন, এই প্রতিবেদন তাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। ইউরোপীয় রাজধানীগুলো ও মস্কোয় ব্যক্তিগতভাবে কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে উৎসাহ জোগায়; যাতে ভারত হস্তক্ষেপ করতে পারে। ওইদিন সন্ধ্যায় আইটিভি’র ‘ম্যান ইন দ্য নিউজ’ প্রোগ্রামে বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরীর সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়।
এরপর জুন-জুলাই মাসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বব্যাপী প্রচার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে। বিশ্বের নামিদামি পত্রিকাগুলোর প্রতিবেদনের তারিখ ও হেডিং কিংবা বিষয়বস্তু ছিল নিম্নরূপ। ১৯ জুন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘দ্য স্পেকটেটর’ লেখে “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটিই বিশ্বের সবচেয়ে জঘন্য গণহত্যা।” ২০ জুন ‘দ্য উইকলি নিউ এজ’ ‘পাকিস্তানে সংঘবদ্ধ নির্যাতন’ প্রতিবেদনে বলা হয়, হত্যা-গায়েব-গেস্টাপো কায়দায় চলছে তল্লাশি ধর্ষণ নির্যাতন। ২০ জুন ‘সানডে টাইমস’ এক প্রতিবেদনে লেখে যে “তিন রঙে নাগরিকদের চিহ্নিত করা হয়েছে। সাদা হচ্ছে নিরীহ, গ্রে/ধূসর হচ্ছে চাকরি শেষ ও গ্রেফতার করতে হবে এবং কালো হচ্ছে দ্রুতই গুলি করতে হবে।” ২৫ জুন ‘দ্য হংকং স্টান্ডাড’ পত্রিকার সম্পাদকীয় হেডিং ছিল ‘আরেক চেঙ্গিশ খান’। ৩০ জুন ওয়াশিংটন থেকে প্রকাশিত ‘ডেইলি নিউজ’ পত্রিকা সম্পাদকীয় প্রকাশ করে।
১ জুলাই ইন্দিরা গান্ধী লন্ডনের সুবিখ্যাত পত্রিকা ‘দ্য টাইমস’-এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গণরায় বানচাল ও গণহত্যার নিন্দা এবং শরণার্থী ইস্যুতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “উপনির্বাচন করা ও বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা প্রদানের বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নতুন পরিকল্পনা বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত ও অনিশ্চিত করে তুলবে।” ৩ জুলাই বিদেশে বাংলাদেশের বিশেষ দূত আবু সাঈদ চৌধুরীকে ‘জলিয়াত’ আখ্যায়িত করে পাকিস্তান বলে যে, এই ব্যক্তি ভারত-ব্রিটিশ অর্থে অপপ্রচার চালাচ্ছে। ৪ জুলাই পাকিস্তান ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ও বিবিসির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বলে যে, সেই দেশে সভা-সমাবেশ ও বিবিসি রেডিও ও সংবাদপত্রে পাকিস্তানবিরোধী প্রচার হচ্ছে। ৮ জুলাই বেলগ্রেড থেকে প্রকাশিত ‘দ্য নভস্তি’ পত্রিকার সম্পাদকীয়র হেডিং ছিল ‘বেয়োনেটের মাথায় শাস্তি’। ২৩ জুলাই ‘নিউইয়র্ক ওয়াল স্টিট জর্নাল’ পত্রিকার হেডিং ছিল ‘দ্বিখ-িত জাতি’। ২৪ জুলাই ওয়াশিংটনের প্রবাসী বাঙালি ও তাদের সমর্থকদের উদ্যোগে গঠিত ‘বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার’ নামের সংগঠন প্রথম বুলেটিন প্রকাশ করে। এতে বাংলাদেশের সংগ্রামকে সমর্থন এবং পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার উদ্দেশে চিঠি ও তারবার্তা এবং টেলিফোনের মাধ্যমে কংগ্রেসম্যানদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য বুলেটিন পাঠকদের অনুরোধ করা হয়। এই বুলেটিন থেকে জানা যায়, আন্তর্জাতিক জাহাজ শ্রমিক ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন ইউনিয়নের সদস্যরা পাকিস্তানগামী অস্ত্র জাহাজে বোঝাই করবেন না। ৩০ জুলাই ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় ‘পূর্ববঙ্গে গণহত্যা’ শীর্ষক অর্ধপৃষ্ঠাব্যাপী একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়।
আট
আগস্ট-সেপ্টেম্বর থেকে দেশের ভেতরে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণ ও সীমান্তে সম্মুখ যুদ্ধ যখন বাড়তে থাকে, তখন পাকিস্তানের নিষ্ঠুরতা-নৃশংসতা আরও দুর্দমনীয় হয়ে ওঠে এবং ভারতে শরণার্থীর স্রোতও বেগবান হয়।
১ আগস্ট শরণার্থীদের জন্য তহবিল সংগ্রহের জন্য নিউইয়র্কে জর্জ হ্যারিসন, রবি শংকর ও আলী আকবর খান ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ ছিল মুক্তিযুদ্ধের জন্য বিরাট অনুপ্রেরণা। একই দিনে লন্ডনের ট্রাফালগর স্কোয়ারে গণসমাবেশে ‘বিটলস’ গ্রুপের জর্জ হেরিসন কর্তৃক ‘বাংলাদেশ’ নামে যে নতুন রেকর্ড তৈরি করা হয়েছে তা বাজিয়ে শোনানো হয়। বিভিন্ন দেশে এভাবে বাংলাদেশের পক্ষে সমাবেশ-গানের অনুষ্ঠান প্রভৃতি হতে থাকে এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচার বাড়ে। মরিয়া হয়ে পাকিস্তান চীন-মার্কিন সহায়তা পেয়ে যুদ্ধোন্মদনা তুঙ্গে তোলে। ওইদিনই পাকিস্তান টিভি ও ২ আগস্ট বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া খান বলেন, “পূর্ব পাকিস্তান ও ভারতের সীমান্ত বরাবর সংঘর্ষ অব্যাহত থাকলে, তা ভয়াবহ যুদ্ধে পরিণত হতে পারে।” ২ আগস্ট ইয়াহিয়া খান তেহরানের এক সংবাদপত্রে বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না সিভিল সরকার গণপ্রতিনিধিদের দ্বারা নির্বাচিত না হবে, ততদিন পর্যন্ত ক্ষমতা ছাড়া হবে না। ইতোমধ্যে প্রচার জোরদার হয় যে বঙ্গবন্ধুর বিচার করা হবে। ২ আগস্ট নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘নিউজউইক’ এক প্রতিবেদনে লেখে যে “মুজিব ছাড়া এমন কেউ নেই, যিনি পাকিস্তান রক্ষা করতে পারে। ইয়াহিয়া খান মুজিবকে ফাঁসিতে ঝোলাতে চাচ্ছেন। কিন্তু মুজিবকে ফাঁসিতে দিলে পাকিস্তানের মৃত্যু হবে। বঙ্গবন্ধুর বিচারে তখন সারাবিশ্বের গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল-বিবেকবান মানুষ সোচ্চার হয়ে ওঠে।” ৯ আগস্ট প্যারি থেকে প্রকাশিত ‘ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন’ পত্রিকায় রফিক আনোয়ার ‘জনৈক বাঙালির দৃষ্টিকোণ থেকে’ শিরোনামে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে প্রতিবেদন লেখেন। ১৬ আগস্ট স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটির উদ্যোগে ৬৮টি প্রতিষ্ঠান একত্রিত হয়ে ‘দ্য টাইমস’ পত্রিকায় অর্ধপৃষ্ঠাব্যাপী এক বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করার জন্য বিশ্বজনমতের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এতে বঙ্গবন্ধুর ছবি এবং নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন, পাকসামরিক বাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণ ও গণহত্যা এবং সামরিক আদালতে গোপন বিচার সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত তথ্য সংযোজন করা হয়।
১ সেপ্টেম্বর প্যারিস থেকে প্রকাশিত ‘লা ফিগারো’ পত্রিকার সাথে এক সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া বলেন, “আমি এই মর্মে সমগ্র বিশ্বকে হুঁশিয়ারি করে দিতে চাই যে, তারা যদি মনে করে থাকে বিনা যুদ্ধে তারা একবিন্দু জমি দখল করতে পারবে, তবে তারা মারাত্মক ভুল করছে। এর অর্থই হবে সর্বাত্মক যুদ্ধ।” তিনি প্রশ্নের উত্তরে বলেন, “কিছু কিছু সীমান্ত ছাড়া সবই সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।… আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করে দেশদ্রোহীদের বিতাড়িত করেছি।”
১৩ সেপ্টেম্বর ‘টরেন্টো টেলিগ্রাম’ এক প্রতিবেদনে বলে যে, দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে ৩০ লাখ টন খাদ্য এবং ভারতে ৮০ লাখ শরণার্থীর জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা করতে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। ২৬ সেপ্টেম্বর নয়াদিল্লি থেকে প্রকাশিত ‘দ্য উইকলি নিউ এজ’ ‘বিজয় নিশ্চিত’ শিরোনামে প্রতিবেদনে লেখে, “গত সপ্তাহে আমরা ৬ মাসের লড়াইয়ের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখতে পাই, মুক্তিযোদ্ধারা বর্তমানে যেভাবে হয়রানি করছে, তা আরও তীব্র হলে সামরিক দিক থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবস্থান ভেঙে পড়বে। মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের আর কোনো সন্দেহ নেই। এখন কাজ হচ্ছে এটিকে তরান্বিত করা।” সেপ্টেম্বর মাসে বন্যার পানিতে ডুবন্ত বনগাঁ নৌকায় পার হয়ে সীমান্তে পৌঁছান মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ। তিনি তখন কবিতা লেখেন ‘সেপ্টেম্বর অন যশোহর রোড’। এটি গানে সুরও দেন তিনি। আমেরিকায় ফিরে তার বন্ধু বব ডিলান ও অন্য গায়কদের দিয়ে এই গান গেয়ে কনসার্ট করে শরণার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা হয়। ১৮ সেপ্টেম্বর লন্ডনের ওভাল ক্রিকেট মাঠে শরণার্থীদের সাহায্যার্থে পপসংগীতের অনুষ্ঠানে বিশাল জমায়েতে টিকিট বিক্রি হয় ১৫ হাজার ২০০ পাউন্ড। ১৮ ও ১৯ সেপ্টেম্বর কনওয়ে হলে বাংলাদেশ গণসংস্কৃতি সংসদ-এর উদ্যোগে ‘অস্ত্র তুলে নাও’ নৃত্যনাট্য দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করে।
এদিকে ‘দ্য টাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, ৪ সেপ্টেম্বর ইসলামাবাদে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত যোসেফ ফারল্যান্ড ইয়াহিয়াকে প্রস্তাব দেন যে, বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাককে জানিয়ে রাখতে চান ইয়াহিয়া মোশতাকের সাথে গোপন আলোচনা শুরু করতে সম্মত রয়েছেন। এদিকে পররাষ্ট্র দপ্তরের সেক্রেটারি জন অরউইন, ডেপুটি অ্যাসিস্টেন্ট সেক্রেটারি ভ্যান হোলেন এবং ইউএস এইডের কনস্যুলেট সদস্যরা আমেরিকায় ভারতের রাষ্ট্রদূত এল কে ঝা-কে জানান, যুক্তরাষ্ট্রের কনস্যুলেট সদস্যরা বাংলাদেশের প্রতিনিধির সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে আলোচনার পন্থা উদ্ভাবন করছেন। বাংলাদেশের জাতীয় পরিষদের একাংশকে প্রভাবান্বিত করে ৬-দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে পাকিস্তানের অখ-তা রক্ষার জন্য একটি রাজনৈতিক আপস ফর্মুলা এবং বাস্তবায়নের ব্লু প্রিন্ট তৈরি করাই ছিল পরারাষ্ট্রমন্ত্রী মোশতাকের দেশবিরোধী-গণবিরোধী অসৎ উদ্দেশ্য।
নয়
১ অক্টোবর সাধারণ পরিষদের সভাকে কেন্দ্র করে নিউইয়র্কের জাতিসংঘ ভবনের বিপরীত দিকে অবস্থিত চার্চ সেন্টারে বাংলাদেশের প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী ও তার সহকর্মীরা এক সাংবাদিক সম্মেলন করেন। এতে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি, স্বাধীনতা সংগ্রামের আদর্শ-উদ্দেশ্য তুলে ধরা হয়। বলা হয়, সমস্যার সমাধান ৩টি পূর্বশর্তের ওপর নির্ভরশীল : এক. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতিদান, দুই. অবিলম্বে বিনা শর্তে গণতান্ত্রিক প্রথায় নির্বাচিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে মুক্তিদান, তিন. ইয়াহিয়া খানের হানাদার বাহিনীকে বাংলার মাটি থেকে অবিলম্বে অপসারণ। এই সাংবাদিক সম্মেলন প্রচারিত হলে বিশ্ব জনমত আরও সক্রিয় হয়ে ওঠে।
২৪ অক্টোবর থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানের গণহত্যা ও ভারতের শরণার্থী সমস্যা, বাংলাদেশ সংকটে ভারতের ভূমিকা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের ন্যায্যতা প্রভৃতি তুলে ধরার জন্য ১৯ দিনব্যাপী বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স, ব্রিটেন, পশ্চিম জার্মানি ও আমেরিকা সফরের উদ্দেশে রওয়ানা হন। আগের দিন তিনি রেডিও ভাষণে ভারতবাসীকে ‘ধৈর্য ঐক্য ও শৃঙ্খলা সুরক্ষার’ আহ্বান জানান। ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘ দিবসে শরণ সিং দিল্লিতে ‘শরণার্থীদের সম্মানের সঙ্গে দেশে ফেরার আশা’ ব্যক্ত করে ভাষণ দেন। ইন্দিরা গান্ধীর এই সফরের সময় সারাবিশ্বের মিডিয়াতে মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ প্রধান হয়ে ওঠে। এর মধ্যে ২৯ অক্টোবর ‘দ্য টাইমস’ পত্রিকায় তিনি বলেন, “৯০ লাখ শরণার্থীর জন্য সাহায্য বরাদ্দ করে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে তাদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। চীন-মার্কিন মদদে ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের যুদ্ধ প্রস্তুতির প্রেক্ষাপটে ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তির পর এই সফরের ভেতর দিয়ে সুস্পষ্ট হয়ে যায়, মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মিত্রবাহিনী হিসেবে ভারতীয় সেনাবাহিনী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হবে।”
১ নভেম্বর ইয়াহিয়া ‘ডেইলি মেল’ পত্রিকার এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “ভারত-পকিস্তান যুদ্ধ দোরগোড়ায়। ভারত ও পাকিস্তান যদি পরস্পরে যুদ্ধে নামে, তবে চীন সহ্য করবে না।” একই দিনে ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “জাতি চাইলে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেওয়া হবে।… পরিস্থিতির আরও অবনতি হোক, এমনটি চাই না। তবে ভারত যদি দুর্বৃত্তদের অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করতে থাকে, তবে যুদ্ধ অনিবার্য।” নভেম্বরে ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ভবন হোয়াইট হাউসের নিকটবর্তী লাফায়েত পার্কে প্রবাসী বাঙালিরা এক ব্যতিক্রমী আয়োজন করে, যা গণমাধ্যমে সাড়া জাগায়। তারা শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশার চিত্র তুলে ধরতে ভারতের শরণার্থী শিবিরের মতো শিবির বানায় এবং ছিন্ন লুঙ্গি-গেঞ্জি এবং শাড়ি পরে এই শিবিরের বিরাটাকার কার্ডবোর্ড নির্মিত পাইপের ভেতর আশ্রয় গ্রহণ করে। সংবাদপত্র, টিভি ও রেডিওতে এই খবর ও দৃশ্য ফলাও করে প্রচার করা হয়।
দশ
ডিসেম্বরে পাকিস্তান ভারতের পশ্চিম সীমান্তে আক্রমণ করলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। ৩ ডিসেম্বর শুরু হয় পুনোর্দ্যমে যুদ্ধ। প্রথম থেকেই মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণে বিপর্যস্ত পাকহানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে ভারত-বাংলাদেশ যৌথবাহিনী বিজয়ী হতে থাকে। সারাবিশ্বের মিডিয়া বিজয়ের এই বার্তা প্রতিদিন জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়। জনমত সম্পূর্ণরূপে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পক্ষে সমবেত হয়। ১২ ডিসেম্বর লন্ডনের হাইড পার্কের সমাবেশ শেষে বিশাল মিছিল ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে যায় এবং স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকা এই মিছিলকে ‘ভিক্টরি প্যারেড’ (বিজয় মিছিল) বলে অভিহিত করে।
১৬ ডিসেম্বর ঠিক ৪টা ৩১ মিনিটে, যখন ঢাকায় পাকবাহিনী ভারত-বাংলাদেশ যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করছে, তখন ভারতীয় পার্লমেন্টে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মুক্তিযুদ্ধের বিজয়বার্তা ঘোষণা করেন। তিনি আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা ঘোষণা করে বিজয়দৃপ্ত ও আবেগমথিত কণ্ঠে বলেন, “আমরা মুক্তিবাহিনীর সাহসী যুবক ও ছেলেদের দুঃসাহস ও আত্মত্যাগের জন্য অভিনন্দন জানাই।… আমাদের উদ্দেশ্য সীমাবদ্ধ ছিল নিষ্ঠুর নির্যাতনের রাজত্ব থেকে তাদের দেশকে মুক্ত করার জন্য বাংলাদেশের সাহসী জনতা ও মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করা এবং আমাদের নিজস্ব ভূমিতে আগ্রাসন বন্ধ করা। ভারতের সেনাবাহিনী প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সময় বাংলাদেশে অবস্থান করবে না।… আমি বিশ্বাস করি নতুন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর জনগণের মধ্যে সঠিক স্থান পাবেন এবং বাংলাদেশকে শান্তি প্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করবেন।” এ ঘোষণার পর ওইদিনই কলকাতা থেকে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং পরদিন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে বিজয়বার্তা ঘোষণা করেন।
এদিকে আত্মসমর্পণের পরপরই ‘অ্যাসোসিয়েট প্রেস অব আমেরিকা’ প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়, ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আয়োজিত এক সামরিক অনুষ্ঠানে পূর্ববঙ্গে নিয়োজিত পাকিস্তানি বাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল নিয়াজী পূর্বাঞ্চলে নিয়োজিত ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর যুক্ত কমান্ডের সর্বাধিনায়ক লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে ৪টা ৩১ মিনিটের সময় আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। এভাবে সারাবিশ্বের জনগণের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়বার্তা ছড়িয়ে পড়ে।
২০ ডিসেম্বর ‘দ্য টাইমস’ ‘যুদ্ধের ভেতর দিয়ে একটি জাতির জন্ম’ শিরোনামের প্রতিবেদনে লেখে যে, “জয় বাংলা হচ্ছে বাংলার বিজয়ধ্বনি। পদ্মা আর ব্রহ্মপুত্রের মতো বিশাল নদীর তীর, সবুজ প্রান্তর আর অসংখ্য গ্রামের অগণন চত্বর থেকে উঠেছে বাংলার এই বিজয়ধ্বনি।” মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের ভেতর দিয়ে ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের… ’ গানটি বাঙালির জীবনে সত্য হয়ে ওঠে।
লেখক : সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, উত্তরণ