১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা, বিজয়ের পূর্ণতা লাভ করেছিল। শুরু হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রার। বাংলাদেশ প্রবেশ করেছিল অন্ধকার থেকে আলোর দিকে।
সাইদ আহমেদ বাবু: ২৫ মার্চ ১৯৭১, রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করে। ২৬ মার্চের সূচনালগ্নে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এর কিছুক্ষণ পর পাকবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন বঙ্গবন্ধু। তাকে দীর্ঘ ৯ মাস করাচিতে বন্দী রাখা হয়।
জুলাই মাসে ইয়াহিয়া বলেছিল, “সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের বিচার ও মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা করার জন্যে আমার জেনারেলরা চাপ দিচ্ছে। আমি সম্মত হয়েছি এবং খুব শিগগিরই বিচার অনুষ্ঠিত হবে।” অবশেষে ৯ আগস্ট এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হলো যে, ১১ আগস্ট থেকে সামরিক আদালতে গোপন বিচার শুরু হবে। রায় চূড়ান্ত হওয়ার আগেই পাকিস্তান সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি সফি মন্তব্য করেন, “তাকে অবশ্যই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে।”
৩ ডিসেম্বর চূড়ান্ত রায়ে বঙ্গবন্ধুকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু ইতোমধ্যে মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায় শুরু হয়েছিল। পাকিস্তানের আক্রমণের শিকার হয়ে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়। উপরন্তু, বিশ্ব নেতৃবৃন্দ (চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া) ও বিশ্ব জনমত বঙ্গবন্ধুর সম্ভাব্য ফাঁসির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল।
ফলে দেখা যায়, পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ইয়াহিয়াকে পরামর্শ দেয় বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি না দিতে। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার পতন ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর বঙ্গবন্ধুর ফাঁসি স্থগিত হয়ে যায়। ১৬ ডিসেম্বর বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর পুরো জাতি অধীর আগ্রহে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির প্রতীক্ষার প্রহর গুনছিলেন। এ পরিস্থিতিতে সারাবিশ্বের মিডিয়ার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ। সদ্য-স্বাধীন দেশ ও তার নেতার প্রতিমুহূর্তের খবরের জন্য উন্মুখ বিশ্ববাসী। বঙ্গবন্ধুর এ মুক্তির খুঁটিনাটি বিষয় বিশ্ব গণমাধ্যমে তাৎক্ষণিক প্রচারিত হচ্ছিল।
এদিকে ’৭২-এর ৬ জানুয়ারি ভুট্টো এক জনসভায় বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ঘোষণা করে। ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। রেডিও পাকিস্তান জানায়, শেখ মুজিব একটি বিশেষ বিমানে পশ্চিম পাকিস্তান সময় বেলা ৩টায় রাওয়ালপিন্ডি ত্যাগ করেছেন। রেডিও পাকিস্তান জানায়, শেখ মুজিবের ইচ্ছানুযায়ী তিনি কোথায় যাচ্ছেন, এ সম্পর্কে কিছুই জানানো হবে না। ঘোষক আরও জানান, শেখ তার গন্তব্যে পৌঁছার পর নিজেই ঘোষণা দেবেন। এদিকে রয়টার্স ঢাকায় রেডক্রস মুখপত্র ও বিদেশি সংবাদদাতাদের টেলিফোন করেছিল, সেখানে শেখ মুজিবের গন্তব্য সম্পর্কে কোনো খবর পৌঁছায়নি। এমন কী কোনো গুজবও পূর্ব পাকিস্তানে পৌঁছায়নি। রেডিও পাকিস্তান জানায়, মি. ভুট্টো শেখ মুজিবকে রাওয়ালপিন্ডিতে বিদায় সংবর্ধনা জানান।
নানা ঘটনা ও নাটকীয়তার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি ভোররাতে তিনি মুক্তি পান, এদিন তিনি মুক্তি পেয়ে লন্ডনে পৌঁছেন। ১০ জানুয়ারি নয়াদিল্লি হয়ে বেলা ১টা ৪১ মিনিটে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় তিনি প্রত্যাবর্তন করেন। তার এ প্রত্যাবর্তন ছিল অন্ধকার থেকে আলোয় প্রত্যাবর্তন। বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন একটি স্মরণীয় দিন ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের স্বদেশে প্রত্যাবর্তন দিবস।
সে-সময় বিদেশি গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের উল্লেখযোগ্য সংবাদ
২২ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে পেনাং ‘স্ট্রেইট ইকো’ পত্রিকায় ‘ঘড়িতে অনেক সময় বয়ে গেছে’ শিরোনামে লেখা হয় : “গ্রেফতারকৃত ৮০ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য এবং ৯০ লাখ পাকিস্তানিদের মুক্তি দেয়ার ব্যাপারটি এখনও বাঙালি জনগণের ইচ্ছার ওপর। এ পরিস্থিতিতে মি. ভুট্টো যদি শেখ মুজিবুর রহমানকে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করতে চান, তাহলে দ্রুতই তার মোহমুক্তি ঘটবে। মুজিব বাংলাদেশের জাতির পিতা, তিনি কখনও চান না যে তার জাতি অন্য কোনো আদর্শের পতাকাতলে পরিচালিত হোক।
যদি মি. ভুট্টো উপলব্ধি করে থাকেন, তার এ ক্ষমতা পাওয়া পূর্ব খণ্ডের মতোই একটি গণতান্ত্রিক বিজয়, তবে তিনি বাংলাদেশের জন্ম ও বাস্তবতাকে অস্বীকার করে ঘড়ির কাঁটা পেছনে ফিরিয়ে নেয়ার মতো এক ব্যর্থ চেষ্টা করছেন।”
৩ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বিখ্যাত পত্রিকা ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ ‘ভুট্টোর তুরুপের তাস’ শিরোনামে সম্পাদকীয়তে লেখে : “ধূর্ত রাজনৈতিক খেলোয়াড় মি. জুলফিকার আলী ভুট্টো দুই সপ্তাহ আগে পরাজিত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হওয়ার সাথে সাথে এক হাত খারাপ তাসের উত্তরাধিকারী হয়েছেন। কিন্তু মি. ভুট্টো উত্তরাধিকারীভাবে একটি তাস পেয়েছেন, যেটাকে তিনি পাকিস্তান বিভক্তি, ভারত ও বিদ্রোহী পূর্ব বাংলার (যেটা এখন বাংলাদেশ) সাথে কূটনৈতিক খেলার কঠোরভাবে কাজে লাগাতে চেষ্টা করবেন।”
৩ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে কুয়ালালামপুরের ‘স্ট্রেইট টাইমস’ পত্রিকা সম্পাদকীয়তে ‘বাস্তবতার মুখোমুখি ভুট্টো’ শিরোনামে লেখে : “প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। যদিও তিনি বলছেন, পাকিস্তানের প্রদেশ দুটি। তবু তিনি তার জনগণকে একটি প্রদেশ হারানোর বাস্তবতাকে গ্রহণ করার দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, শেখ মুজিবকে শিগগিরই বিনাশর্তে মুক্তি দেয়া হবে। কারণ প্রেসিডেন্ট ভুট্টো উপলব্ধি করতে সমর্থ হয়েছেন, মুজিবকে আটকে রেখে যেমন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মেজাজ পরিবর্তন করা সম্ভব হবে না, তেমনি ইসলামাবাদের ভাবমূর্তি বাড়ানো সম্ভব নয়। বরং পাকিস্তানের এ মুহূর্তে বেশি প্রয়োজন ভারতের সাথে একটি সমঝোতায় আসা। যেহেতু অফিসারসহ ৯০ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য ভারতের কাছে বন্দী। কেবল শেখ মুজিবের মুক্তিই যুদ্ধবন্দিদের ফেরত পাওয়ার লক্ষ্যে ভারতের সাথে আলোচনার দ্বার খুলতে সমর্থ হবে।
৫ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বিখ্যাত ‘ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর বোস্টন’ পত্রিকায় সম্পাদকীয়তে ‘বিজ্ঞ পদক্ষেপ’ শিরোনামে লেখা হয় : “পাকিস্তানের নেতা মি. ভুট্টো জানিয়েছেন, তিনি পূর্ব বাংলার সাথে ফেডারেশনের মতো একটি সম্পর্ক রাখতে চান। বাস্তবে এ ধরনের আশা করা ভুলের স্বর্গে থাকারই সমান। কারণ পূর্ব বাংলা এখন গর্বিত স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। বরং পূর্ব প্রদেশে দুঃখজনক পদক্ষেপ গ্রহণ এবং শেষ পর্যন্ত সামরিক বিপর্যয়ের পর পাকিস্তানের জন্য এ মুহূর্তে বিজ্ঞ পদক্ষেপ হবে উপমহাদেশের সৌহার্দ্যপূর্ণ প্রতিবেশী গড়ে তোলার চেষ্টা। এ লক্ষ্যে তার অবিলম্বে ভারতের সাথে আলোচনায় বসা প্রয়োজন। আর এ আলোচনার পথ খোলা সম্ভব একমাত্র শেখ মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তি দেবার মধ্য দিয়ে।
৯ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে ‘সানডে মেল’, ‘মালয় এশিয়া’ পত্রিকায় ‘মুজিব মুক্তি পেয়েছে’ শিরোনামে লেখা হয় : “শেখ মুজিবুর রহমান ৮ জানুয়ারি খুব সকালে রাওয়ালপিন্ডি থেকে লন্ডনে পৌঁছেন। বিশেষ বিমান পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারওয়েজ ৬৩৫-এ তিনি লন্ডন পৌঁছেন।
তিনি বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে ব্রিটিশ বিদেশ সম্পর্কীয় এবং কমনওয়েলথ অফিসের তিন সিনিয়র মুখপাত্রের সাথে দেখা করেন। মুখপাত্র জানান, শেখ তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছুই বলবেন না তার বাংলাদেশ সমর্থকরা তাকে সদ্যোজাত দেশটির প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেছে।”
৮ জানুয়ারি ১৯৭২ ‘রয়টার্স’ ‘লন্ডনে শেখ মুজিব’, ৯ জানুয়ারি লন্ডনের ‘সানডে টাইমস’ ‘শেখ মুজিবের সাথে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ, ১০ জানুয়ারি ‘জাম্বিয়া ডেইলি মেইল’ ‘শেখ মুজিব দিল্লির পথে’, ১০ জানুয়ারি ইউএনআই ‘নয়াদিল্লির জনসভায় শেখ মুজিবের ভাষণ’, ১০ জানুয়ারি নেপালের ‘রাইজিং নেপাল, কাঠমান্ডু’ পত্রিকায় ‘পরিবর্তনের সূচনা : শেখ মুজিবের মুক্তি’ শিরোনামে সম্পাদকীয়, এদিনই ‘আল আয়আম খাতুম’ পত্রিকায় ‘জিন্দাবাদ শেখ মুজিব’ শিরোনামে সম্পাদকীয়, ১০ জানুয়ারি ‘দি অ্যাডভোকেট’, ‘ব্রুনাই’, ‘তাজমেনিয়া’, ‘অস্ট্রেলিয়া’ পত্রিকায় ‘শেখের দায়িত্ব’ শিরোনামে সম্পাদকীয়, ১০ জানুয়ারি নেপালের ‘নিউ হেরাল্ড’ কাঠমান্ডু পত্রিকায় ‘চিরান সত্য’ শিরোনামে সম্পাদকীয়, ১১ জানুয়ারি নয়াদিল্লির ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ ‘দিল্লিতে শেখ মুজিবের স্মরণীয় সংবর্ধনা’ শিরোনামে বঙ্গবন্ধুর প্রতিমুহূর্তের সংবাদ পরিবেশন করেছে।
‘টাইম ম্যাগাজিন’ লিখেছে : ৯ জানুয়ারি দিনটি ছিল রবিবার। বাংলাদেশের সাপ্তাহিক ছুটির মধ্যে সারাদেশ আনন্দ-উল্লাসে উত্তাল। অধীর আগ্রহে সবাই অপেক্ষা করছে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের। বিধ্বস্ত যোগাযোগব্যবস্থার মধ্যেও লোকজন ছুটতে শুরু করেছে ঢাকার দিকে। ১০ জানুয়ারি বদলে গেছে বাংলাদেশ।
‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এর ১১ জানুয়ারির প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল : ‘শেখ মুজিব হোম, গিভ হিম রাউজিং ওয়েলকাম’। ১০ জানুয়ারি এই প্রতিবেদন ঢাকা থেকে লিখেছিলেন নিউইয়র্ক টাইমসের ফক্স কাটারফিল্ড। এটা ছিল পত্রিকার বিশেষ প্রতিবেদন। উপশিরোনামে প্রতিবেদক লিখেছিলেন : লক্ষ্য পূর্ণ করার আহ্বান। পাকিস্তানিরা বলেছিল তাদের সঙ্গে যে কোনো প্রকারে সম্পর্ক রাখতে। তিনি বলেছেন, ঐক্য শেষ হয়ে গেছে।
‘দি ওয়াশিংটন পোস্ট’ পত্রিকা ১১ জানুয়ারি লিখেছিল : জুবিল্যান্ট বেঙ্গালিস ওয়েলকাম মুজিবুর। ছোট করে উপ-শিরোনামে দিয়েছিল : ‘শেখ রিজেক্টেড হেট বাট হেট সেজ ওল্ড টাইস আর কাট ডাউন’। প্রতিবেদনটি সরাসরি ঢাকা থেকে পাঠিয়েছিলেন তাদের স্টাফ রাইটার লুইস সেমেনসভ।
লন্ডনের ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনের নাম ছিল : ‘মুজিব কাটস টাইস উইথ পাকিস্তান’। লেখক ক্লেরে হলিংওয়ার্থ।
নয়াদিল্লির ‘দি স্টেটসম্যান’ পত্রিকার ১১ জানুয়ারি শিরোনামে ছিল : ‘ঢাকা গোস জেলিরিয়াস-মিলিয়ন আউট টু গ্রেট রমনা’। ‘সাপ্তাহিক টাইম ম্যাগাজিন’ ২৪ জানুয়ারি দীর্ঘ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। শিরোনাম ‘বাংলাদেশ হিরো রিটার্ন হোম’।
‘সাপ্তাহিক টাইম ম্যাগাজিন’ লিখেছে : ঠিক দুপুর দেড়টায় প্রখর রোদের মধ্যে ঢাকার আকাশে ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর একটি কমেট জেট দেখা গেল, ঠিক তখনই জেটটি নামল না। আকাশ থেকে শেখ মুজিব তাঁর সোনার বাংলাকে দেখার ইচ্ছে করেছেন। সে কারণে প্রায় ৪৫ মিনিট আকাশ চক্কর মেরে মেরে পাইলট তাকে সোনার বাংলাকে দেখালেন। সোনার বাংলা তখন শ্মশান। শেখ মুজিব অবশেষে স্বদেশে ফিরতে পারলেন।
‘টাইম ম্যাগাজিন’ ২৪ জানুয়ারি ১৯৭২-এ লিখেছে : লন্ডনে বঙ্গবন্ধু উঠেছেন ক্লারিজ হোটেলে। প্রেসিডেন্ট মর্যাদায় একটি সুইটে রাখা হয়েছে তাকে। সারাদিনটাই তিনি বিশ্রাম নিলেন। দেখা করলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিথের সঙ্গে। বিকেলে একটি প্রেস কনফারেন্স করলেন।
১১ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বিখ্যাত ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকা শিরোনাম করে ‘শেখ মুজিব নিজ দেশে : পাঁচ লাখ লোকের উচ্ছ্বসিত সংবর্ধনা’। এছাড়া ‘মুজিব ভারতের সাথে চিরস্থায়ী বন্ধুত্বের কথা বললেন’ শিরোনামেও ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ আরেকটি স্টোরি প্রকাশ করে। এদিনই লন্ডনের ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’ ‘মুজিব পাকিস্তানের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করলেন’ শিরোনামে বিস্তারিত সংবাদ প্রকাশ করে। সারাবিশ্বের গণমাধ্যম বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সচিত্র বিস্তারিত সংবাদ প্রকাশ করে।
১১ জানুয়ারি নয়াদিল্লির বিখ্যাত পত্রিকা ‘স্টেটসম্যান’ ‘ঢাকা এখন উল্লসিত : লাখ লাখ লোক মহান মুজিবকে স্বাগত জানায়’ শিরোনামে লেখে : “ঢাকা, ১০ জানুয়ারি, শেখ মুজিবুর রহমান আজ তার জনগণের কাছে ফিরে এলেন। নয় মাস কারাভোগের পর শেখ মুজিবের এ স্মরণীয় প্রত্যাবর্তন। লাখ লাখ লোক তাকে স্বাগত জানানোর জন্য বর্ণনাতীত উল্লাসে ফেটে পড়ে। জনগণ বস্তুত ছিল উল্লাসে দিশেহারা; তারা কেউ নাচছিল, কেউবা চিৎকার করে জয়ধ্বনি দিতেছিল। রয়েল এয়ারফোর্স জেটটি মাটি ছোঁয়ামাত্রই বিশাল জনতা এগিয়ে আসে এবং প্রায় বিমানটির দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়। খুব কষ্টে এ জনতাকে ঠেকিয়ে রেখে তাকে তিন বাহিনী গার্ড অব অনার প্রদর্শন করে এবং তার সাথে কূটনীতিকদের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়।
জনতার করতালির ভেতর শেখ মুজিব ৩৫ মিনিট ভাষণ দেন। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ জানান। ধন্যবাদ জানান সোভিয়েত ইউনিয়নকে।”
১১ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে ‘দ্য মারকুরি’, ‘হাবার্ট’, ‘তাজমানিয়া’, ‘অস্ট্রেলিয়া’ পত্রিকায় ‘শেখ মুজিবের প্রত্যাবর্তন’ শিরোনামে লেখে : “উত্তাল জনতা শেখ মুজিবকে ঢাকায় আবেগঘন সংবর্ধনা জানিয়েছে। শেখ মুজিবকে তার জনগণ যে ধরনের সংবর্ধনা জানিয়েছে উপমহাদেশে এ ধরনের সংবর্ধনা এর আগে দেখা যায়নি। শেখ মুজিবের প্রতি জনগণের ভালোবাসার উচ্ছ্বাস উপমহাদেশ থেকে যেদিন ব্রিটিশ চলে গিয়েছিল, সেদিনের সবদিক থেকে মøান করে দিয়েছে।… অবশ্য একটি দেশের স্বাধীনতার জন্য তার নেতাকে যতদূর ত্যাগ করতে হয়, শেখ মুজিব তার চেয়ে অনেক বেশি পথ অতিক্রম করে এলেন।”
বঙ্গবন্ধুকে নেওয়ার জন্য একটি ভারতীয় ৭০৭ বোয়িং বিমান প্রস্তুত ছিল হিথরো বিমানবন্দরে। তিনি ভারতীয় বিমানে উঠলেন না। ‘টাইম ম্যাগাজিন’ লিখেছে : “দুটি কারণে তিনি ভারতীয় বিমান এড়িয়ে গেলেন। প্রথমত; ভারতীয় বিমানে উন্মাদ পাকিস্তানিদের নাশকতার আশঙ্কা ছিল। দুই. শেখ মুজিব সবাইকে বোঝাতে চাইলেন, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। ভারতের ওপর তারা নির্ভরশীল হতে চায় না। স্বদেশে ফেরার জন্য বঙ্গবন্ধু উঠে পড়লেন ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবহরের কমেট জেটে।
বাংলাদেশে ফেরার পথে বিমানটি দুই ঘণ্টার সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতি করেছিল দিল্লিতে। সেখানে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন।
৯ মাসব্যাপী যুদ্ধে তেজগাঁও বিমানবন্দরটি বোমায় ক্ষতবিক্ষত। মাইলখানেক রানওয়ে কোনোক্রমে ঠিকঠাক করার চেষ্টা হয়েছে। দীর্ঘদিন পরে কমেট জেটের মতো ধরনের বিমান এখানে নামেনি। নামার মতো পরিস্থিতি ছিল না। ব্রিটিশ কমেট জেটটি প্রথম তেজগাঁও বিমানবন্দরের ক্ষতিগ্রস্ত রানওয়েতে নেমে এলো। পাইলট খুব সাবধানে টারমাকে জেটটি থামালেন।”
‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ লিখেছে : “হাওয়ায় প্রচুর ধুলা উড়ল।”
‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় লেখা হয় : “জনতা সেøাগান দিচ্ছেÑ জাতির জনক দীর্ঘজীবী হোক। মুজিব ভাই দীর্ঘজীবী হোক। তখন এছাড়া আর কোনো কথা নেই।”
‘টাইম ম্যাগাজিন’ লিখেছে : “সোমবার দুপুরের মধ্যে শত শত হাজার হাজার উৎফুল্ল বাঙালি রাস্তার দুধারে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের হাতে উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা। আর গলা ফাটিয়ে সেøাগান দিচ্ছেÑ শেখ মুজিব, শেখ মুজিব।
তেজগাঁও থেকে ঢাকার কেন্দ্রস্থল রমনার রেসকোর্স ময়দানের দূরত্ব মাত্র পাঁচ কিলোমিটার। এই রাজপথজুড়েই মানুষের ঢল। কেউ বাদ্য-বাজনা বাজাচ্ছে। কেউ কেউ নাচছে। কেউ কেউ গান গাইছে। আর ট্রাকের সামনে ফুলের পাপড়ি ছুড়ে দিচ্ছে। শেখ মুজিব ফুলের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। চারদিকে গগনবিদারী সেøাগান উঠেছেÑ জয় বাংলা, বঙ্গবন্ধু জিন্দাবাদ।”
‘নিউইয়র্ক টাইমস’ লিখেছে : “উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে শেখ মুজিব বললেন, আমার আশা পূর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। বলতে বলতে তাঁর গলা ভেঙে এলো।”
তিনি বলেছেন, পাকিস্তানি বাহিনী ৯ মাসে ৩০ লাখ বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। তবে আজ প্রতিশোধ গ্রহণের দিন নয়। তিনি রুমালে চোখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। স্তব্ধ রেসকোর্স। সবার চোখে জল। পাকিস্তানের উদ্দেশে তিনি বললেন, তোমরা আমার দেশের লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছ। মা-বোনদের সম্ভ্রমহানি করেছ। ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছ। এক কোটি মানুষকে তাড়িয়ে ভারতে পাঠিয়েছ। তোমাদের সঙ্গে আর কোনো ধরনের ঐক্য সম্ভব নয়। আমরা স্বাধীন দেশের মানুষ। তোমাদের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ। আমাদের আমাদের মতো করে থাকতে দাও।
শুধু কি বাঙালিরাই ছুটে এসেছিলেন সেদিন! ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ তাঁর সরকারি সফর সংক্ষিপ্ত করে ফিরে এসেছিলেন লন্ডনে। শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুকে সম্মান জানাতে। ৮ তারিখ বিকাল ৫টায় ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে এক বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। যাবতীয় রীতি উপেক্ষা করে প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ বঙ্গবন্ধুকে বহন করা গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়েছিলেন যতক্ষণ না বঙ্গবন্ধু গাড়িতে ওঠেন।
উল্লেখ্য, ব্রিটেন তখনও বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়নি। বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসার প্রায় এক মাস পর ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখ বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল।
যদিও এডওয়ার্ড হিথের বঙ্গবন্ধুকে দেওয়া সম্মান নিয়ে অনেকেই সমালোচনা করেছিলেন, উত্তরে হিথ বলেছিলেন, ‘আমি জানি কাকে সম্মান জানাচ্ছি, তিনি হচ্ছেন একটি জাতির মুক্তিদাতা মহান বীর। তাঁকে এই সম্মান প্রদর্শন করতে পেরে বরং আমরাই সম্মানিত হয়েছি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে সেদিন ছুটে এসেছিলেন ব্রিটেনের সেই সময়ের ফরেন মিনিস্টার অ্যালেকডক্লাস হিউ।’
৯ জানুয়ারি ‘সানডে টাইমস’ ‘ব্রিটেনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শেখ মুজিবের বৈঠক’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে। ৯ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া বিশেষ বিমানটি হিথ্রো বিমানবন্দর ছাড়ার পর ‘বিবিসি’ ঘোষণা দেয় ‘বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের উদ্দেশে যাত্রা করেছেন’। সেই বিশেষ বিমানে ভারতে যাত্রাবিরতি করে ১০ জানুয়ারি বিজয়ের দেশে, বিজয়ীর বেশে, স্বপ্নের সোনার বাংলার মাটিতে পা রাখেন জাতির জনক। যে স্বপ্নের জন্য জীবনের ১৩টি বছর কাটিয়েছেন পাকিস্তানিদের জেলে, সহ্য করেছিলেন নির্যাতন নিপীড়ন। ‘দি ওয়াশিংটন পোস্ট’ লিখেছে : “তেজগাঁও বিমানবন্দরের শৃঙ্খলা সকালে ভালোই ছিল। কিন্তু মুজিব যখন জেট থেকে নেমে এলেন তখন অধীর আগ্রহে থাকা বাঙালিদের আর আটকানো গেল না। বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো সব শৃঙ্খলা ভেসে গেল। মুক্তিবাহিনীর টগবগে সদস্যরা সংবাদপত্রের প্রতিনিধি, সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার ও অন্য কর্মকর্তাদের ঠেলেঠুলে শেখ মুজিবের কাছে চলে গেল। তাঁকে ঘিরে ধরেছিল।”
১১ জানুয়ারি ভারতের বাংলা-ইংরেজি পত্রিকার পাতাজুড়ে ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সংবাদ ও প্রতিবেদন। দিল্লির সংবর্ধনার আয়োজন ছিল আবেগ উচ্ছ্বাসের পরিপূর্ণতায় ভরপুর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১০ জানুয়ারিতে লন্ডন থেকে নয়াদিল্লিতে এসে পৌঁছলেন। সে এক অভাবনীয় দৃশ্য। দিল্লিতে এমন সংবর্ধনা বঙ্গবন্ধুর পূর্বে আর কেউ পাননি বলে সংবাদপত্রের মত। দিল্লি থেকে ‘যুগান্তর’ জানিয়েছিল : কলকাতার একটি পত্রিকা বঙ্গবন্ধুর দিল্লিতে পৌঁছানোর সংবাদ ছাপালো। ‘অন্ধকার থেকে আলোকে, ভারতকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন’ শীর্ষক শিরোনামের সংবাদে বলা হয় : “কিন্তু ওদের রোষানল থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশের মাটিতে পা রাখতে সময় লেগে যায় আরও এক সপ্তাহ। ৮ জানুয়ারি পিআইএ-র একটি বিশেষ বিমান বঙ্গবন্ধুকে বহন করে লন্ডনের উদ্দেশে রাওয়ালপিন্ডি ত্যাগ করে ১০ ঘণ্টা পর হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরণ করে।”
‘বিবিসি’ ও ‘ভোয়া’ (ভয়েস অব আমেরিকা)-সহ বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে বারবার বঙ্গবন্ধুর মুক্তিলাভ ও লন্ডন রওনা হওয়ার খবর প্রচারিত হতে থাকলে কেবল ৫৬ হাজার বর্গমাইল এলাকায় বসবাসকারী লক্ষ-কোটি দেশবাসী নয়, বিদেশেÑ বিশেষ করে লন্ডনে অবস্থানরত বাঙালি ও বাংলাদেশ সমর্থকদের মাঝেও ব্যাপক আনন্দ, প্রাণচাঞ্চল্য ও কৌতূহলের সৃষ্টি হয়।
কৌতূহলের সৃষ্টি হয় বিদেশি সাংবাদিকদের মাঝেÑ নতুন দেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব এলে কেমন হবে পরিস্থিতি? পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়ে এসে তিনি প্রথমে কী বলেন এবং কী করবেন? বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে বঙ্গবন্ধু উন্নতশিরে প্রবেশ করেন জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলন কক্ষে।
সংবাদ সম্মেলন কক্ষে প্রবেশের সময় তিনি ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে সমবেত অন্তত ২০০ সাংবাদিককে অভিনন্দন জানান। সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু প্রথমেই বলেন, “আমি বেঁচে আছি, সুস্থ আছি।” শত শত বাঙালি ও বাংলাদেশ সমর্থক ‘জয় বাংলা’ সেøাগান দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানায়।
লন্ডনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু বলেন, “আমি আমার জনগণের মাঝে ফিরে যেতে চাই। এখানে আর একমুহূর্ত থাকতে রাজি নই আমি।” তিনি বলেন, “… যখন আমার জনগণ আমাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেছে, তখন আমি ‘রাষ্ট্রদ্রোহের’ দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে সেল-এ বন্দিজীবন কাটাচ্ছি। অবশ্য ট্রাইব্যুনালের বিচারের রায় কখনও প্রকাশ করা হয়নি।
একটি খুব খারাপ স্থানে কল্পনাতীত একাকীত্বে বন্দিজীবন কাটাতে হয়েছে। কোনো রেডিও না, চিঠি না, বাইরের জগতের সঙ্গে কোনো যোগাযোগই ছিল না…।” উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে আবেগঘন পরিবেশে পিনপতন নীরবতায় এসব ঘটনা ও দুঃসহ সময় অতিবাহিত করার বর্ণনা দেন বঙ্গবন্ধু।
এর কয়েকদিন পর, ১৮ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ দৈনিক ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’-এর প্রথম পাতায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল : ‘ঐব ঞবষষং ঋঁষষ ঝঃড়ৎু ড়ভ অৎৎবংঃ ধহফ উবঃবহঃরড়হ’। এখানেই প্রথমবারের মতো তিনি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেন একাত্তরে তার গ্রেফতার ও বন্দিদশার আখ্যান। এটি ছিল প্রখ্যাত সাংবাদিক সিডনি শ্যানবার্গের (১৯৩৪-২০১৬) একটি বিশেষ প্রতিবেদন। কম্বোডিয়া যুদ্ধে সাহসী সাংবাদিকতার জন্য পুলিৎজার পুরস্কার জেতা এই আমেরিকান সাংবাদিকের বিশেষ ভূমিকা ছিল।
১২ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে ‘দি ওয়েস্ট অস্ট্রেলিয়ান, পার্থ’ পত্রিকায় ‘শেখ মুজিবের দায়িত্ব গ্রহণ’ শিরোনামে সম্পাদকীয়তে লেখে : “লাখো বাঙালির আবেগমথিত সংবর্ধনার ভিতর দিয়ে শেখ মুজিব ঢাকায় প্রবেশ করলেন। আর এর সাথে সাথেই তিনি প্রবেশ করলেন নতুন জাতিকে গড়ে তোলার এক বিশাল কর্মরাজ্যে। বাংলাদেশ এখন স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। শেখের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে। বাংলাদেশ পাকিস্তানের শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে এসেছে। এখন চোখের সামনে একমাত্র যুদ্ধ তার স্বপ্নের জাতিকে বাস্তবে রূপ দেবার।”
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা, বিজয়ের পূর্ণতা লাভ করেছিল। শুরু হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রার। বাংলাদেশ প্রবেশ করেছিল অন্ধকার থেকে আলোর দিকে। কিন্তু মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতের মধ্য দিয়ে আবারও চেষ্টা চালানো হয়েছিল অন্ধকারের দিকে টেনে নেওয়ার। কিন্তু সব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ তার গৌরবোজ্জ্বল বিজয় সমহিমায় ধরে রেখেছে। প্রতি বছর ১০ জানুয়ারি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় অন্ধকার থেকে আলোয়। প্রত্যাবর্তনের ইতিহাসকে।
লেখক : সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, উত্তরণ