অপারেশন ক্লিনহার্টের নামে যারা আমাদের নেতাদের হত্যা করেছে, আগুনসন্ত্রাস করে যারা মানুষ খুন করেছে, হত্যা, খুন এটাই তো ওদের চরিত্র। তাদের সঙ্গে বসতে হবে? তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে, তাদের খাতির করতে হবে? তাদের নির্বাচনে আনতে হবে? এত আহ্লাদ কেন আমি তো বুঝি না। বাংলাদেশে কী মানুষ নেই?
উত্তরণ প্রতিবেদন: প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ২১ আগস্টের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে দেশবাসীকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, এই আঘাত হয়তো আরও আসবে সামনে। কারণ যখন আমার আব্বা (বঙ্গবন্ধু) দেশটাকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখনই তো ১৫ আগস্ট ঘটেছে। আর আজকেও বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হয়েছে, উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। তাই যারা দেশের উন্নয়ন চায় না তারা অলস হয়ে বসে থাকবে না।
ভয়াল-বীভৎস্য ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ১৮তম বার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা বিএনপি-জামাতের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সংঘটিত হয়েছিল। দেশের চলমান অগ্রযাত্রায় পুনরায় আঘাত আসতে পারে। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশ হয়েছে, উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে, স্বাধীনতার চেতনায় আবার সেই ‘জয় বাংলা’ ফিরে এসেছে। আবার জাতির পিতার নাম বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হচ্ছে। এগুলো যারা সহ্য করতে পারবে না, তারা বসে থাকবে না। তারা আঘাত করবেই। বাংলাদেশকে আবারও সেই জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা করবে। প্রধানমন্ত্রী আবারও বিএনপির নেতৃত্বের শূন্যতার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, তারা (বিএনপি) নির্বাচন করবে কীভাবে? তাদের তো নেতাই নাই, সাজাপ্রাপ্ত অথবা পলাতক।
তারা কীভাবে নির্বাচন করবে আর ভোট পাবে? জনগণ কাকে দেখে ভোট দেবে? তারপরেও নানারকম চক্রান্ত নির্বাচন আসলেই তাদের শুরু হয়। যদিও এদেশের মানুষের প্রতি আমার আস্থা ও বিশ্বাস আছে। কেননা আজকে দেশকে আমরা উন্নয়নশীল দেশে পরিণত করতে সমর্থ হয়েছি। জাতীয় নির্বাচনে বিএনপিকে অংশ নিতে অনুরোধ করার বিষয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, যারা মানুষ খুন করেছে তাদের নির্বাচনে আনতে হবে- এত আহ্লাদ কেন আমি বুঝি না। তিনি বলেন, অপারেশন ক্লিনহার্টের নামে যারা আমাদের নেতাদের হত্যা করেছে, আগুনসন্ত্রাস করে যারা মানুষ খুন করেছে, হত্যা, খুন এটাই তো ওদের চরিত্র। তাদের সঙ্গে বসতে হবে? তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে, তাদের খাতির করতে হবে? তাদের নির্বাচনে আনতে হবে? এত আহ্লাদ কেন আমি তো বুঝি না। বাংলাদেশে কী মানুষ নেই?
বিরোধী দলের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিদেশিদের কাছে কান্নাকাটি। সেখানে গিয়ে তারা অনুরোধ করে কোনোরকম তাদের একটু জায়গা দেওয়া যায় কি না! জায়গা দেবে কি দেবে না সেটা ভাববে জনগণ। সে সিদ্ধান্ত দেবে বাংলাদেশের জনগণ। বাংলাদেশের জনগণের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আবার কি সন্ত্রাসীর যুগে ফেরত যাবে? না-কি আজকে যে বাংলাদেশে উন্নয়ন হচ্ছে সেই উন্নয়নের যুগে থাকবে। এই সিদ্ধান্ত তো জনগণকে নিতে হবে।
দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপি সভায় বক্তৃতা করেন। দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ এমপি অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে ’৫২-র ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধের শহিদ, ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা ও তার পরিবারের সদস্য এবং ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
এর আগে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এসেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহতদের স্মরণে সেখানে নির্মিত শহিদ বেদিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে সব শহিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। তিনি আওয়ামী লীগ সভাপতি পৃথক একটি পুষ্পস্তবক শহিদ বেদিতে অর্পণ করেন। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুর কাদের এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন। এরপর ওই হামলায় আহত ও নিহতদের স্বজনদের সঙ্গে কুশলবিনিময় করেন প্রধানমন্ত্রী।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সম্পৃক্ততার কথা জানিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, খালেদা জিয়ার বক্তব্যগুলো অনুসরণ করবেন। কোটালীপাড়া বোমা পুঁতে রাখার আগে বলেছিল আওয়ামী লীগ শত বছরেও ক্ষমতায় আসতে পারবে না। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার আগে বলেছিল- শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী তো দূরের কথা, বিরোধী দলের নেতাও কোনোদিন হতে পারবে না। এগুলোর তো রেকর্ড আছে। এই বক্তব্য সে আগাম দিল কীভাবে, যে বিরোধী দলের নেতা হতে পারব না? তার মানে আমাকে হত্যা করবে। এই পরিকল্পনাটা তারা নিয়ে ফেলেছে। ২০০৪ সালে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ঘটনা প্রবাহ অনুষ্ঠানে তুলে ধরার পাশাপাশি ওই হামলার পর সরকারি চেষ্টায় আলামত ধ্বংসের অভিযোগ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এ জাতীয় ঘটনা ঘটতে পারে না। লক্ষ্য তো ছিল আমাকে হত্যা করা এবং আমাদের নেতাকর্মী মানে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করা।
হামলার পর বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আলামত ধ্বংসের প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরে ওই ভয়াল হামলা থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ঘটনাস্থলে একটি অবিস্ফোরিত গ্রেনেড একজন আর্মি অফিসার আলামত হিসেবে সংরক্ষণের জন্য বললে খালেদা জিয়া তাকে চাকরিচ্যুত করেন। সিটি কর্পোরেশন থেকে পানির গাড়ি এনে ঘটনার পরই ঘটনাস্থল ধোয়া শুরু করে, যেখানে চিহ্ন রাখার জন্য তিনি তার দলের নেতাকর্মীদের দিয়ে লাল পতাকা লাগিয়ে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, হতাহতদের উদ্ধারে দলের নেতাকর্মীরা এগিয়ে আসলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে এবং টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। তাছাড়া যে কোনো সমাবেশ করলে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অতীতে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের বিভিন্ন ভবনের ছাদে নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মী বা ভলান্টিয়ার রাখলেও সেদিন তা রাখতে দেওয়া হয়নি।
জাতির পিতার খুনি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কর্নেল রশিদ এবং শরীফুল ইসলাম ডালিম ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সময় বাংলাদেশে অবস্থান করছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সময় কর্নেল রশিদ এবং ডালিম বাংলাদেশে ছিলÑ এই চক্রান্তের সঙ্গে। হামলার পর খালেদা জিয়া তাদেরও দেশ থেকে পালিয়ে যেতে সে-সময় সাহায্য করেছিল। আমার রক্তাক্ত শরীর দেখে তারা প্রথমে ভেবেছিল অপারেশন সাকসেসফুল; কিন্তু যখন দেখল আমি মরি নাইÑ তখন তারা পালিয়ে গেছে।
প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন রেখে বলেন, এদেরকে (বঙ্গবন্ধুর খুনি) কারা এনেছিল? বিএনপি সরকারের পক্ষ থেকে যদি ব্যবস্থা করা না হয়, তারা আসল এবং তারা চলেও গেল। বিভিন্ন দেশে তারা ফিউজিটিভ হয়ে আছে। সেগুলোকে কি কেউ গুম হওয়া বলবে? তা তো বলবে না। হামলার পর খুনিরা দেখল আমি বেঁচে আছি, তখন তারা দেশ থেকে পালিয়ে যায়। খুনিরা আসল আবার চলেও গেল কীভাবে যদি বিএনপির পক্ষ থেকে ব্যবস্থা করা না হয়?
বারবার হামলার শিকার হয়েও প্রাণে বেঁচে যাওয়ার কথা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, ‘আল্লাহ বাঁচিয়ে রেখেছেন এদেশের কল্যাণের জন্য, এদেশের মানুষের জন্য। আসলে রাখে আল্লাহ মারে কে, মারে আল্লাহ রাখে কেÑ এটাই কথা। আমাকে সেজন্য বারবার বাঁচিয়েছেন। বাংলাদেশের এমন কোনো অঞ্চল নেই যেখানে গিয়ে আমি গুলি, নয় বোমা বা গাড়িতে আক্রমণÑ এগুলোর শিকার না হয়েছি। তারপরও বেঁচে আসছি, দেশের কাজ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ঘটনা বর্ণনা করে শেখ হাসিনা বলেন, যখন বক্তৃতা শেষ করে মাইকটা টেবিলে রাখতে যাব, এমন সময় ফটোগ্রাফার গোর্কি এসে আমাকে বলে, ‘আপা আমি ছবি নিতে পারনি, আপনি একটু দাঁড়ান। কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার। অন্যান্য ফটো সাংবাদিকরাও ট্রাকের ওপর বসে চিৎকার করছে, বলছে আপা একটু দাঁড়ান, আপা একটু দাঁড়ান। ওই একটা বা দুইটা সেকেন্ডের বিষয়। এরপরই চারদিকে বোমাবাজি, গ্রেনেড হামলা।’ তিনি বলেন, প্রথমে আমাদের ঘটনা ধরতেই কষ্ট হয়েছে, এত বোমাবাজি কেন? শুধু একটার পর একটা গ্রেনেড ছোড়া হচ্ছে। আমার পাশে হানিফ ভাই দাঁড়িয়েছিলেন, সেদিন তিনি একটু বেশি দাঁড়াচ্ছিলেন, তখন আমি বললাম আপনি এইভাবে দাঁড়াচ্ছেন কেন? আমি সবাইকে দেখতে পাই না। উনি বলে আপনি বুঝবেন না, এটা আমাদের নিয়ম, আমরা এইভাবে দাঁড়াব। চারদিকে আমাদের নেতারা ছিল। হামলার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে টান দিয়ে বসিয়ে ফেলে। আমাকে ধরে রাখে, আমার সঙ্গে নজিব ও মামুন (নিরাপত্তা কর্মকর্তা) ওরা আমাকে ঘিরে ধরে। পাশে মায়া ছিল। আমরা যারা সেইদিন ট্রাকে ছিলাম, একটা গ্রেনেড যদি ট্রাকের ওপর পড়ত তাহলে হয়তো কেউ রেহাই পেতাম না। জানি না ভাগ্যে কী ছিল। ট্রাকের ডালার সঙ্গে লেগে গ্রেনেড নিচে পড়ে যায়।
২১ আগস্টের হামলার আগে ও পরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিভিন্ন বক্তব্য তুলে ধরেও সেখানে ষড়যন্ত্রের আভাস থাকার কথা উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গ্রেনেড হামলা নিয়ে তাদের জাতীয় সংসদে কথা তো বলতে দেওয়াই হয়নি, এমনকি তিনি বিরোধী দলের নেতা হলেও তার মাইক বন্ধ করে দেওয়া হয় বলেও জানান। খালেদা জিয়া এমন কথাও বলেন, ‘তিনি (শেখ হাসিনা) ভ্যানিটি ব্যাগে করে সমাবেশে গ্রেনেড নিয়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন’ বলেও উল্লেখ করেন তিনি।