উত্তরণ ডেস্ক: ভোটারদের ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা ও উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের (নাসিক) নির্বাচনে মেয়র পদে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী। গত ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আইভী পেয়েছেন ১ লাখ ৬১ হাজার ২৭৩ ভোট। আর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি নেতা তৈমুর আলম পেয়েছেন ৯২ হাজার ১৭১ ভোট। হ্যাটট্রিক বিজয়ের পর নারায়ণগঞ্জের উন্নয়ন ও নারায়ণগঞ্জকে পরিকল্পিত নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে নব উদ্যমে কাজ শুরু করার প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন মেয়র আইভী।
গত ১৬ জানুয়ারি প্রার্থী এবং ভোটারদের ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের (নাসিক) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলে টানা ভোটগ্রহণ। কনকনে শীত উপেক্ষা করে সকাল থেকেই কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোটাররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেন। দিন যত বাড়ে ভোটারদের উপস্থিতিও তত বাড়ে। নারী ভোটারদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রতিদ্বন্দ্বী দুই মেয়র প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী ও তৈমুর আলম খন্দকারসহ সব প্রার্থীই বলেছেন, সুষ্ঠু ভোট হয়েছে। এই নির্বাচন সর্বমহলের প্রশংসা অর্জন করেছে। এবার নাসিক নির্বাচনে সব কেন্দ্রে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণ করা হয়। বিকাল ৪টায় ভোটগ্রহণ শেষে কেন্দ্র কেন্দ্রে গণনার পর ফল ঘোষণা করা হয়। পরে সব কেন্দ্রের ভোটের হিসাব যোগ করে রিটার্নিং কর্মকর্তা মেয়র ও কাউন্সিলর পদে চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করেন। নাসিক নির্বাচনে ২৭ ওয়ার্ডের ১৯২ ভোটকেন্দ্রের সব কটিতেই ভোট হয় ইভিএমে। সব কেন্দ্রে মোট ভোটকক্ষ ছিল ১ হাজার ৩৩৩টি। নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ছিল ৫,১৭,৩৬১।
এবার নাসিক নির্বাচনে মেয়র পদে নির্বাচন করেছেন সাতজন। এছাড়া সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে ৩৪ জন এবং সাধারণ কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করেছেন ১৪৫ প্রার্থী। মেয়র পদে নির্বাচন করেন আগের দুবারের মেয়র আওয়ামী লীগের সেলিনা হায়াৎ আইভী (নৌকা), স্বতন্ত্র থেকে বিএনপির সাবেক নেতা তৈমুর আলম খন্দকার (হাতি), খেলাফত মজলিসের এবিএম সিরাজুল মামুন (দেয়াল ঘড়ি), বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির মো. রাশেদ ফেরদৌস (হাত ঘড়ি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মাওলানা মো. মাছুম বিল্লাহ (হাত পাখা), বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মো. জসীম উদ্দিন (বটগাছ) ও স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল ইসলাম (ঘোড়া)।
২০১৬ সালে ভোটার ছিল ৪ লাখ ৭৪ হাজার ৯৩১ জন। এবার নতুন ভোটার ৪২ হাজার ৪৩০ জন। আর এবার নারী ভোটার ২ লাখ ৫৭ হাজার ৫১৯ জন। এই নতুন ও নারী ভোটারদের অধিকাংশই ভোট দিয়েছেন। ২০১৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আইভীর সঙ্গে বিএনপির মেয়র প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান হয়েছিল প্রায় ৮০ হাজার। আইভী পেয়েছিলেন ১ লাখ ৭৫ হাজার ৬১১ ভোট আর বিএনপির সাখাওয়াত হোসেন খান পেয়েছিলেন ৯৬ হাজার।
নাসিক নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে নির্বাচন কমিশন স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তৎপরতা জোরদার করার নির্দেশ দেয়। নাসিক নির্বাচনের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রাখতে ভোটের আগের দিন থেকেই কঠোর নিরাপত্তাবলয়ে আনা হয় পুরো নির্বাচনী এলাকা। নাসিক নির্বাচনের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রাখতে ১৯২টি ভোটকেন্দ্র ও কেন্দ্রের বাইরে ছিল তিন স্তরের নিরাপত্তা। সার্বিক নিরাপত্তার জন্য সিটি কর্পোরেশন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৫ হাজারের বেশি সদস্য নিয়োজিত ছিল। প্রতিটি কেন্দ্রে ছিল ২৬ জন ফোর্স। এর বাইরে ছিল পুলিশ ও র্যাবের স্ট্রাইকিং ফোর্স। ২৭টি ওয়ার্ডে নির্বাহী ও জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের সমন্বয়ে ৩০টি মোবাইল কোর্ট কাজ করে। এছাড়া ১৪ প্লাটুন বিজিবি মাঠে কাজ করে। প্রতি ওয়ার্ডে একজন করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি করে টিম কাজ করেছে। ছিল র্যাবের একটি করে টিম। ২৭ কেন্দ্রে পুলিশ ছিল ৩ হাজারেরও বেশি। এছাড়াও পুলিশের মোবাইল টিম ছিল ৭৬টি, যার প্রতি টিমে সদস্য ছিল পাঁচজন করে। আর র্যাবের টিম ছিল ৬৫টি। এছাড়া ১৫ জানুয়ারি সকাল থেকেই নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রতিটি অলিগলি ও রাজপথের মোড়ে বিপুলসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভ্রাম্যমাণ টিমগুলোও সারাশহরে মহড়া দেয়।
নাসিক নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছে ৯ সংস্থার ৪২ পর্যবেক্ষক। সংস্থাগুলো হলোÑ জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদ (জানিপপ), সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন, আইন সহায়তা কেন্দ্র (আসক) ফাউন্ডেশন, সমাজ উন্নয়ন প্রয়াস, তৃণমূল উন্নয়ন সংস্থা, তালতলা যুব উন্নয়ন সংগঠন, রিহাব ফাউন্ডেশন, বিবি আছিয়া ফাউন্ডেশন এবং মানবাধিকার ও সমাজ উন্নয়ন সংস্থা (মওসুস)। নির্বাচন পর্যবেক্ষকরাও বলেছেন, নাসিক নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে।
২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন হিসেবে যাত্রা শুরুর পর এবার ছিল তৃতীয় নির্বাচন। গত বছর ৩০ নভেম্বর নাসিক নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। সব কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট হওয়ার আগে ১৪ জানুয়ারি কেন্দ্রে কেন্দ্রে ইভিএমে ভোটের মহড়া হয়। এর আগে ২০১৬ সালের ২২ ডিসেম্বর দ্বিতীয় নাসিক নির্বাচনে সব কেন্দ্রে ভোট হয় ব্যালট পেপারে। আর ২০১১ সালে প্রথম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ৯টি ওয়ার্ডে ভোট হয় ইভিএমে, আর অন্যান্য কেন্দ্রে ভোট হয় ব্যালট পেপারে।
ইতোমধ্যে অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন (নাসিক) নির্বাচন দেশ-বিদেশে ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করেছে।