Monday, October 2, 2023
বাড়িSliderবিদ্রোহে জর্জরিত মিয়ানমার

বিদ্রোহে জর্জরিত মিয়ানমার

বিশ্লেষকরা মনে করেন, জান্তাবিরোধী আন্দোলন বিভিন্ন পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ার কারণে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ব্যাপক চাপের মুখে পড়ছে সামরিক বাহিনী। নানা দিক থেকে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা চাপে পড়লেও এখনই তাদের উৎখাত করা যাবে- পরিস্থিতি এমন নয়।

সাইদ আহমেদ বাবু: সুদূর প্রাচীনকাল থেকে রাষ্ট্র-কাঠামোর উপস্থিতি ছিল বার্মাতে (বর্তমান মিয়ানমার)। শত শত বছরের সভ্যতার অগ্রগতিতে মানুষের নিরাপত্তার ধারণার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে ছিল সামরিক বাহিনী। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতীয় ও নেপালি গোর্খাদের দ্বারা বার্মা জয় করে ব্রিটিশরা। উপনিবেশ রক্ষা আর নিরাপত্তার জন্য গঠন করা হয় ব্রিটিশ বার্মা আর্মি। সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও ব্রিটিশ বার্মা আর্মিতে প্রতিনিধিত্ব ছিল না বার্মাদের। সেনাবাহিনী গঠিত হয় কারেন, কাচিন আর চিন নৃগোষ্ঠীর সেনাদের নিয়ে। ১৩৫টি স্বীকৃত নৃগোষ্ঠীর মধ্যে মিয়ানমারে সংখ্যাগরিষ্ঠ নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী বার্মিজরা, মোট জনসংখ্যার যারা ৬৮ শতাংশ। কারেনরা ৭ শতাংশ, শানরা ৯ শতাংশ। আছে রোহিঙ্গারা, আছে মনরা। এর বাইরে কয়েক মিলিয়ন ভারতীয় বংশোদ্ভূত আছে সেখানে, আছে চীনা বংশোদ্ভূত।
১৯৮৮ সালের ১২ মার্চ ছাত্ররা রেঙ্গুনে (বর্তমান ইয়াঙ্গুন) নে উইনের সামরিক শাসনবিরোধী বিক্ষোভ হয়। সর্বগ্রাসী শাসন এবং তার বার্মা সোশ্যালিস্ট প্রোগ্রাম পার্টি (বিএসপিপি)-এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করে। বিক্ষোভ দ্রুত সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিএসপিপি সরকারকে বহুদলীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চাপ দেওয়া হয়। ১৯৮৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর একটি সামরিক অভ্যুত্থানে ৫ হাজার মানুষের রক্তের ওপর দিয়ে ক্ষমতায় আসে নতুন স্বৈরশাসক। বিএসপিপি সরকার উৎখাত হয়। সামরিক বাহিনী তখন স্টেট ল’ অ্যান্ড অর্ডার রিস্টোরেশন কাউন্সিল (এসএলওআরসি) প্রতিষ্ঠা করে এবং প্রতিবাদকারীদের ওপর সহিংসভাবে দমন-পীড়ন শুরু করে। ১৯৮৮ সালের ২১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সমস্ত বিক্ষোভের লাগাম টেনে ধরে। ১৯৮৮ সালের বিদ্রোহে সহিংস দমন সত্ত্বেও নতুন সামরিক জান্তা বিক্ষোভ বন্ধ হওয়ার পরে কিছু বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সাথে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সম্মত হয়।
অং সান সু চি ১৯৮৮ সালের বিদ্রোহ থেকে মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থি আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনি দেশের বৃহত্তম বিরোধী দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)-এর নেতৃত্ব দেন। সামরিক জান্তা ১৯৯০ সালে একটি সংসদীয় সাংবিধানিক কমিটির সদস্যদের নির্বাচন করতে একটি সাধারণ নির্বাচন ব্যবস্থা করে, যার মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণীত হবে। এনএলডি আসনগুলোর একটি বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা জিতে। কিন্তু সামরিক জান্তা ফলাফলে বিস্মিত হয়ে ফলাফলগুলো স্বীকার করতে অস্বীকার করে এবং অং সান সু চি’কে গৃহবন্দি করে। নব্বইয়ের দশকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালিয়ে তাদের মারাত্মকভাবে দুর্বল করে বেশিরভাগ ঘাঁটি এবং দুর্গ ধ্বংস করে।
২০০৬ সালে মিয়ানমার কাচিন-এর সশস্ত্র শাখা কারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (কেএনএলএ)-এর বিরুদ্ধে একটি বড় আকারের সামরিক আক্রমণ শুরু করে। সংঘর্ষের ফলে ঐ রাজ্যের কয়েক লাখ বেসামরিক লোক বাস্তুচ্যুত হয়। অনুমান অনুসারে সরকারি বাহিনী এবং কেএনএলএ-এর মধ্যে লড়াইয়ের কারণে এবং সরকার কর্তৃক জোরপূর্বক গ্রাম স্থানান্তরের কারণে প্রায় অর্ধনিযুত লোক বাস্তুচ্যুত হয়।
২০০৭ সালে কয়েক হাজার ভিক্ষু সামরিক জান্তার শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে এবং অবাধ নির্বাচন, সংখ্যালঘু অধিকার এবং রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির আহ্বান জানায়, যা এখন ‘জাফরান বিপ্লব’ নামে পরিচিত। সিএনজি প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য সরকার কর্তৃক ভর্তুকি অপসারণের প্রতিক্রিয়ায় প্রতিবাদটি মূলত শুরু হয়।
২০০৯ সালে জান্তা বাহিনী কোকাং আক্রমণ করে। যার ফলে এমএনডিএএ এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং প্রায় ৩০ হাজার শরণার্থী প্রতিবেশী চীনের ইউনানে পালিয়ে যায়।
২০১০ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ডিকেবিএ-৫ এর সাথে সহিংস সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এতে প্রায় ১০ হাজার শরণার্থী হিংসাত্মক সংঘাত থেকে বাঁচতে থাইল্যান্ডে পালিয়ে যায়।
২০১২ সালে কেআইএ ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের ফলে প্রায় ২ হাজার ৫০০ বেসামরিক এবং সামরিক মানুষ নিহত হন। যাদের মধ্যে মাত্র ২১১ জন সরকারি সৈন্য ছিল। সহিংসতায় প্রায় ১ লাখ বেসামরিক লোক বাস্তুচ্যুত হয় এবং ৩৬৪টি গ্রাম সম্পূর্ণ বা আংশিক পরিত্যক্ত হয়।
২০১৩ সালে মিয়ানমারের বিভিন্ন শহরে বড় ধরনের মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। সহিংসতা সায়াদাউ ইউ উইরাথুর নেতৃত্বে বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উত্থানের সাথে মিলে যায়।
২০১৪ সালের নভেম্বরে এনএলডি সংবিধানে সংশোধনী আনার চেষ্টা করে। এ ধারার প্রতিক্রিয়ায় অং সান সু চি’কে মিয়ানমারের রাষ্ট্রপতি হওয়ার অযোগ্য করে তোলে, যদি তার দল নির্বাচনে জয়ী হয়। যদিও এ সংশোধনীগুলো প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল।
সরকার ২০০৮ সালে একটি নতুন সংবিধান প্রবর্তন করে এবং ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক সংস্কারের সময়কালের আশ্বাস দেয়। অং সান সু চি-সহ হাজার হাজার রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়। ২০০৮ সালের সংবিধান ৬টি জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর জন্য ৫টি স্বায়ত্তশাসিত স্ব-শাসিত অঞ্চল এবং একটি স্ব-শাসিত বিভাগ তৈরি করে।
২০১৫ সালে রাজনৈতিক সংস্কারের সমাপ্তির পর সরকার সংঘাতের অবসানের আশায় বেশ কয়েকটি শান্তি সম্মেলনের আয়োজন শুরু করে। এ প্রচেষ্টাগুলো যুদ্ধবিরত গোষ্ঠীগুলোর দ্বারা আনা প্রধান প্রস্তাবগুলোকে সুরাহা না করার জন্য এবং দেশের বৃহত্তম বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে বাদ দেওয়ার জন্য সমালোচিত হয় সরকারের সমালোচকরা যুক্তি দিয়েছেন যে মিয়ানমারের বর্তমান সংবিধান সামরিক বাহিনীকে অত্যধিক ক্ষমতা প্রদান করে এবং যা দেশটির শান্তি ও গণতান্ত্রিক সংস্কার অর্জনে বাধা। সেনাবাহিনীর ভূমিকা বিরোধিতার কারণে সূ চি সরকারের অনেক রাজনীতিবিদ ও কর্মীকে হত্যা করা হয়।
৯ অক্টোবর ২০১৬ সালে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে বার্মিজ সীমান্ত চৌকিতে প্রথম আক্রমণ শুরু করে। এতে ৯ জন সীমান্ত অফিসার নিহত হন। এটি মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে উত্তর রাখাইন রাজ্যে ব্যাপক ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ শুরু করতে অনুপ্রাণিত করে।
২০১৬ সালের নভেম্বরের শেষের দিকে ৪টি বিদ্রোহী গোষ্ঠী নিয়ে গঠিত হয় উত্তর জোট। এগুলো হচ্ছে- আরাকান আর্মি (এএ), কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি (কেআইএ), মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ) এবং তায়াং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ)। উত্তর শান রাজ্যের মিউজ টাউনশিপে চীন-মিয়ানমার সীমান্ত বরাবর শহর ও সীমান্ত চৌকিতে হামলা করে। বিদ্রোহীরা ২৫ নভেম্বর ২০১৬ সালে মং কো শহর দখল করে এবং মিয়ানমারের বিমান বাহিনীর বিমান হামলায় বেসামরিক হতাহতের ঘটনা এড়াতে ৪ ডিসেম্বর ২০১৬-তে শহর থেকে সরে না যাওয়া পর্যন্ত এর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে।
১৫ আগস্ট ২০১৯ সালে উত্তর জোট বিদ্রোহীরা নাওংঘকিও টাউনশিপের একটি সামরিক কলেজে হামলায় ১৫ জন হত্যা করে। পরের দিনগুলোতে আরও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। মিয়ানমারের সামরিক সতর্কতা করে যে উত্তর জোট তাদের আক্রমণ বন্ধ না করলে শান রাজ্যে একটি ‘পূর্ণ মাত্রার যুদ্ধ’ হতে পারে।
পরে এ অবস্থা বদলাতে শুরু করে, বিশেষত পশ্চিমা দেশগুলোর চাপে। ২০১৫ সালে কিছু আশা জেগেছিল। তখন অং সান সু চি গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি এবং নির্বাচনে লড়ার অনুমতি পান। নোবেল পুরস্কারজয়ী আউং সান সু চি নির্বাচনে দাঁড়িয়ে বিপুল ভোটে জয়লাভ করলেন, মিলিটারি জুন্টার শাসনের অবসান হলো মিয়ানমারে। সে-সময় সু চি-ই মিয়ানমারের সাংবিধানিক রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু আদতে সু চি’র কোনো ক্ষমতা ছিল না মিয়ানমারে। মিলিটারিই সেখানে ছড়ি ঘোরায়।
অভ্যুত্থানের পৌনে দুই বছর পরও দেশটির নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ সেনাবাহিনীর হাতে আসেনি। অভ্যুত্থানের পর থেকে মোট ৭টি অঞ্চলে- কাচিন, কাইয়া, কাইয়িন, সিন, রাখাইন এবং দেশের মধ্যাঞ্চলের কয়েকটি রাজ্য যেমন- ম্যাগুই এবং জাগাই অঞ্চলে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ হচ্ছে। বিরোধীদের দমন করতে ব্যাপক শক্তি ব্যবহার করছে সেনাবাহিনী। এখন মিয়ানমারের কোনো কোনো অঞ্চলে একাধিক বাহিনীর সঙ্গে লড়তে হচ্ছে সামরিক জান্তাকে। অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভকারীরা নিজেদের গুলতি, মোলোটভ ককটেল এবং অস্থায়ী ঢাল দিয়ে সজ্জিত করে প্রতিবাদ করতে থাকে। ২০২১ সালের মার্চের শেষের দিকে জানা গেছে, কয়েক ডজন বিক্ষোভকারী দেশটির অনেক বিদ্রোহী গোষ্ঠীর একটির অধীনে প্রশিক্ষণ নিতে মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকায় ভ্রমণ করেছিল, যা দেশব্যাপী গৃহযুদ্ধের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। নির্বাসিত বেসামরিক সরকার পাইডাংসু হুলুটাও (সিআরপিএইচ) প্রতিনিধিত্বকারী কমিটি সামরিক বাহিনীকে মোকাবিলা করার জন্য একটি ‘ফেডারেল সশস্ত্র বাহিনী’ গঠনের প্রস্তাব করে।
প্রতিবাদকারীদের সশস্ত্র প্রতিরোধের প্রথম দৃষ্টান্তগুলোর মধ্যে একটি সাগাইং অঞ্চলের কালে শহরে এবং এর আশপাশে ঘটে। ২০২১ সালের ২৮ মার্চ মিয়ানমার সেনাবাহিনী কালেতে একটি প্রতিবাদশিবিরে অভিযান চালানোর পর প্রতিবাদকারীরা পশু শিকারের রাইফেল এবং ঘরোয়া প্রস্তুতকৃত আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে লড়াই করে। বেশ কিছু বিদ্রোহী গোষ্ঠী বিশেষ করে কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি এবং কারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মিও অভ্যুত্থানের প্রতিক্রিয়ায় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের আক্রমণ পুনরায় শুরু করে। চিন রাজ্যের মিন্দাত এবং হাখায় চিনল্যান্ড প্রতিরক্ষা বাহিনী ২০২১ সালের ২৬ এপ্রিল একটি সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু করে।
২০২১ সালের ৫ মে জাতীয় ঐক্য সরকার একটি সশস্ত্র শাখা, পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) সামরিক জান্তা আক্রমণ থেকে নিজ অনুসারীদের রক্ষার জন্য এবং একটি ফেডারেল ইউনিয়ন সেনাবাহিনীর দিকে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ঘোষণা করে। এটি ২৩ মে মিউজ শহরে সেনাবহিনীর সাথে সংঘর্ষে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর কমপক্ষে ১৩ সদস্য নিহত হন। কায়াহ রাজ্যের কারেনি পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের (কেপিডিএফ) সদস্যরাও রাজ্যের রাজধানী লোইকাওর কাছে সেনাবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
মিয়ানমারের কমিউনিস্ট পার্টি নিজেকে পুনরায় সজ্জিত করেছে এবং ২০২১ সালের শেষদিকে তাদের নতুন সশস্ত্র শাখা পিপলস লিবারেশন আর্মি গঠনের ঘোষণা দেয়। এসিএলইডি অনুমান করেছে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১১ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে।
কাচিন জনগণ মিয়ানমারের একটি প্রধান জাতিগত সংখ্যালঘু যারা প্রধানত কাচিন রাজ্যের কাচিন পাহাড়ের পার্বত্য উত্তরাঞ্চলে বসবাস করে। কাচিন নিয়মিত সৈন্যরা পূর্বে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল।
দুর্নীতি এবং নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগে সু চি’কে সশ্রম কারাদ- দেওয়া হয়েছে। জুলাই মাসে চারজন গণতন্ত্রপন্থি আন্দোলনকারীর মৃত্যুদ- কার্যকর করে সেনাবাহিনী। নিপীড়নের মুখে লাখ লাখ মানুষ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে ঢুকে পড়ে বাংলাদেশ ও ভারতে। এনএলডি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কর্মকা- যেভাবে দমন করা হয়েছে, তাতে এখন প্রকাশ্যে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। এনএলডি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো যারা গণতন্ত্রের জন্য রাস্তায় আন্দোলন করছিল, সেই রাস্তার আন্দোলন পুরোপুরিভাবে সেনাবাহিনী দমন করেছে। প্রচুর লোক নিহত হয়েছে, নিষ্ঠুরতার সাথে যেভাবে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সামরিক জান্তা দমন করেছে, তাতে বর্মীয় জনগোষ্ঠী, যারা দেশের মূল জনগোষ্ঠী, যাদের মধ্যে এতদিন অস্ত্র ধরার প্রবণতা ছিল না, সেই জনগোষ্ঠী এখন অস্ত্র ধরছে। এখন কেবল এনএলডি নয়, তার পাশাপাশি অন্যান্য রাজনৈতিক দল এবং এর মধ্যে উপজাতীয় বিভিন্ন গোষ্ঠী ইতোমধ্যে যারা সংগ্রামে শামিল হয়েছিল, তারা সবাই মিলে একটা সমান্তরাল সরকার গঠন করেছে, যা ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট নামে পরিচিত। এই ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য প্রচারণা চালাতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে তাদের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে প্রকাশ্যে দেখা করেছেন আসিয়ান ও মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
বিবিসির বার্মিজ সার্ভিসের অ তু সান বলছেন, সমান্তরাল সরকারের পাশাপাশি মিয়ানমারের তরুণ প্রজন্মের বহু মানুষ এখন সশস্ত্র গোষ্ঠীতে যোগ দিচ্ছে এবং সামরিক প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। তাদের একটি বড় অংশ গণতন্ত্রপন্থি আন্দোলনের নেতাকর্মী এবং সামরিক বাহিনীর দমন-পীড়নের শিকার। অভ্যুত্থানের পর দেশটিতে নতুন প্রায় ১০০টির মতো সশস্ত্র গোষ্ঠী আত্মপ্রকাশ করেছে এবং তাদের বেশিরভাগই দুর্গম এলাকাভিত্তিক। আর গোষ্ঠীগুলো সারাদেশের গণতন্ত্রপন্থিদের সংগঠিত করে একটি বাহিনী গঠন করেছে, যার নাম দেওয়া হয়েছে পিপলস ডিফেন্স ফোর্স-পিডিএফ। এই বাহিনী এখন সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন শহর এবং গ্রামে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, জান্তাবিরোধী আন্দোলন বিভিন্ন পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ার কারণে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ব্যাপক চাপের মুখে পড়ছে সামরিক বাহিনী। নানা দিক থেকে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা চাপে পড়লেও এখনই তাদের উৎখাত করা যাবে- পরিস্থিতি এমন নয়। কিন্তু যেভাবে সহিংসতা নানা মাত্রায় ছড়িয়ে পড়ছে, প্রাণহানি ও অস্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে, তাতে এটুকু আন্দাজ করা যায় যে এই সংঘাত হয়তো চলবে আরও অনেকদিন এবং তার ফলে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী সব দেশেরই আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তা হুমকিতে পড়ছে।
সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে গৃহবন্দি থাকা মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থি নেত্রী অং সান সু চি’কে আরও তিন বছরের কারাদ- দেওয়া হয়েছে। গত ২৯ সেপ্টেম্বর সামরিক শাসিত মিয়ানমারের একটি আদালত সু চি’কে এই কারাদ- দেন। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক বাহিনী মিয়ামারের ক্ষমতা দখলে নেওয়ার পর দেশটির ৫ কোটি ৪০ লাখ মানুষের পরিস্থিতি খারাপ থেকে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে- এমন মন্তব্য করে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন মিয়ানমারের মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত টম অ্যান্ড্রুজ।

লেখক : সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, উত্তরণ

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য