Monday, December 4, 2023
বাড়িSliderবিএনপি গঠনতন্ত্র সংশোধন : বেড়ায় যদি খেত খায়

বিএনপি গঠনতন্ত্র সংশোধন : বেড়ায় যদি খেত খায়

সাদিকুর রহমান পরাগ: 

‘বেড়ায় যদি খেত খায়, সেই খেত কি আর রক্ষা পায়?’ বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদ। যার অর্থ খেতের ফসলকে রক্ষার জন্য বেড়া দেওয়া হয়েছে। এখন সেই বেড়া-ই যদি খেত খেয়ে ফেলে, তাহলে খেতকে কে আর রক্ষা করবে। আমাদের জীবনের বহুক্ষেত্রে আমরা এ-ধরনের ঘটনা দেখতে পাই। প্রবাদ তো আর এমনি এমনি তৈরি হয় না। সমাজে ঘটে যাওয়া ঘটনার অভিজ্ঞতা থেকে প্রবাদ তৈরি হয়। এত কথা বলার উদ্দেশ্য কি প্রবাদ নিয়ে আলোচনা করা? আসলে তা নয়। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশের একটি রাজনৈতিক দলের কর্মকা- দেখে বেড়ার খেত খাওয়ার প্রবাদটির কথা মনে হয়েছে।

একটি রাজনৈতিক দল সাধারণত তার জনগণের কল্যাণের জন্য কাজ করার ঘোষণা দেয়। তার এই সামগ্রিক কর্মকা- সুশৃঙ্খল এবং সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা ও নির্বাহ করার জন্য ঘোষণাপত্র এবং গঠনতন্ত্র তৈরি করে। সেই অনুযায়ী তারা কর্মসূচি দেয়, মানুষের কাছে যায়, মানুষের ম্যান্ডেট চায়। সাধারণত এমনটি হয়ে থাকে। তবে যেহেতু সমাজ একটি চলমান প্রক্রিয়া, যুগও প্রবাহমান, তাই যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দলের নেতা-কর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে দলকে সংশোধন ও পরিবর্তন করে যুগোপযোগী করে ঢেলে সাজানো হয়। এটি করা হয় দলকে আরও বেশি গণমুখী করার জন্য। অর্থাৎ দলের আদর্শের মধ্যে যেন জনমতের প্রতিফলন ঘটে। তবে সংশোধনের নামে এমন কিছু করা যায় না, যা দলের মূল স্পিরিট কিংবা নৈতিক অবস্থানকে অস্বীকার করে।

আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোও সেই চর্চা করে আসছে। তবে কারটা কতটুকু গ্রহণযোগ্য হচ্ছে সেই আলোচনায় যাচ্ছি না। সেটি বিচারের ভার চূড়ান্ত অর্থে জনগণের। বিএনপি তার গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন এনেছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি সেটি আনতেই পারে। বিএনপির নেতাকর্মীরা যদি মনে করে তারা সংশোধন আনবেÑ আনবে, তাতে কারও বাধা দেওয়ার কিছু নেই। নেই, আবার আছেও। সংশোধনের নামে এমন কিছু করা যাবে না, যেটি মানবতার বিরুদ্ধে, নীতি ও নৈতিকতার বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়ায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মানুষের সবকিছু করার অধিকার আছে, তবে আবার সবকিছু নয়। যেমন- মানুষ খুন করা কারও অধিকার হতে পারে না, দুর্নীতি করা কারও অধিকার হতে পারে না, সংখ্যালঘু নির্যাতন কারও অধিকার হতে পারে না, বর্ণবাদ কারও অধিকার হতে পারে না কিংবা নারী ও শিশু নির্যাতন করা কারও অধিকার হতে পারে না। ব্যক্তির ক্ষেত্রে এটি যেমনভাবে প্রযোজ্য, দলের ক্ষেত্রে এটি আরও বেশিভাবে প্রযোজ্য।

জাতীয় সংসদ নির্বাচন তো দূরের কথা, বিএনপির গঠনতন্ত্রের ৭ ধারা অনুযায়ী বিএনপির চেয়ারপারসন সাজাপ্রাপ্ত আসামি খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন বিদেশে পলাতক আসামি তারেক রহমান বিএনপির কোনো পদে থাকতে পারবে না।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, বিএনপি গঠনতন্ত্র সংশোধন নিয়ে কথা উঠছে কেন? কথা উঠছে এ-কারণে যে বিএনপি তার গঠনতন্ত্র সংশোধন করতে গিয়ে নৈতিক জায়গাটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বিএনপি গঠনতন্ত্রে ‘কমিটির সদস্য পদের অযোগ্যতা’ শিরোনামে ৭ ধারায় বলা আছে, “নিম্নোক্ত ব্যক্তিগণ জাতীয় কাউন্সিল, জাতীয় নির্বাহী কমিটি, জাতীয় স্থায়ী কমিটি বা যে কোনো পর্যায়ে যে কোনো নির্বাহী কমিটির সদস্য পদের কিংবা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থী পদের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন-
(ক) ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশ নম্বর ৮-এর বলে দ-িত ব্যক্তি;
(খ) দেউলিয়া;
(গ) উন্মাদ বলে প্রমাণিত ব্যক্তি;
(ঘ) সমাজে দুর্নীতিপরায়ণ বা কুখ্যাত বলে পরিচিত ব্যক্তি।”
এখন বিপত্তিটা বেধেছে এই ৭ ধারা নিয়ে। ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিশেষ কাউন্সিলের মাধ্যমে ধারা ৭ বাতিল করে বিএনপির গঠনতন্ত্র সংশোধন করা হয়। কিন্তু ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর বিএনপির সদস্য মো. মোজাম্মেল হোসেন বিএনপির সংশোধিত এই গঠনতন্ত্র গ্রহণ না করার আবেদন জানিয়ে আদালতের কাছে রিট করেন এবং নির্বাচন কমিশনের কাছে আবেদন জানান। তারই প্রেক্ষিতে রিট আবেদনটির নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সংশোধিত গঠনতন্ত্রটি গ্রহণ না করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ প্রদান করেন বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ। এই নির্দেশনার প্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ১২ নভেম্বর নির্বাচন কমিশন আদালতের নির্দেশের প্রেক্ষিতে বিএনপির গঠনতন্ত্রের এই সংশোধন গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করে।
এগুলো তো আইনি আলাপ। মূল আলোচনায় ফিরে আসি। দুর্নীতিবাজ দ-িত ব্যক্তি বিএনপি করতে পারবে না, এ-রকম একটি নৈতিক অবস্থান থেকে বিএনপি কেন সরে এলো? তবে কি বিএনপি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে চায় না? দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিএনপির কোনো অবস্থান নেই? চায় কি চায় না, আছে কি নেইÑ তাতে বিএনপির কিছু আসে-যায় না। কারণ, এখন বিএনপির বেড়া-ই খেত খেয়ে ফেলতে চাচ্ছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, বিএনপি বেড়া কেন খেত খেয়ে ফেলতে চায়? তাহলে ঝেড়েই কাশি, জাতীয় সংসদ নির্বাচন তো দূরের কথা, বিএনপির গঠনতন্ত্রের ৭ ধারা অনুযায়ী বিএনপির চেয়ারপারসন সাজাপ্রাপ্ত আসামি খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন বিদেশে পলাতক আসামি তারেক রহমান বিএনপির কোনো পদে থাকতে পারবে না। কারণ, অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ক্ষমতার অপব্যবহার করে এতিমের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। আর বিদেশে পলাতক তারেক রহমান ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় একজন দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি। ফলে গঠনতন্ত্র অনুসারে জিয়া পরিবারের হাতে বিএনপির নেতৃত্ব শুধু নয়, বিএনপি করারই সুযোগ থাকছে না। সেই বিপদ টের পেয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার রায় ঘোষণার আগেই তড়িঘড়ি করে ২৮ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশনের কাছে গঠনতন্ত্রের সংশোধিত কপি জমা দেয় বিএনপি।
এ-ধরনের একটি গর্হিত ও নৈতিকতা-বিবর্জিত কাজ বিএনপি কীভাবে করতে পারল? পারল, কারণ জন্মলগ্ন থেকেই দলটির আদর্শ হচ্ছে যেনতেনভাবে ক্ষমতা দখল, অবাধ লুটপাট ও দুর্নীতি এবং সন্ত্রাসের বিস্তার ঘটানো। ফলে যে কোনোরকম অনৈতিক পন্থায় হাঁটতে তারা বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। এখনও তারা সেই পথে হাঁটছে। দলীয় গঠনতন্ত্র থেকে ৭ ধারা বাতিলের অপতৎপরতা তার আরেকটি প্রমাণ।
যদিও সুশীল সমাজের অনেকে গঠনতন্ত্র সংশোধনের এই অপতৎপরতা নিয়ে সমালোচনা করেছে; কিন্তু তাতে বিএনপির কিছু যায়-আসে না। কারণ, তারা মানুষের মতামতকে থোড়াই কেয়ার করে। নেতৃত্ব ধরে রাখতে বিএনপি গঠনতন্ত্রে ওই সংশোধনী এনেছে মন্তব্য করে ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের (ইডব্লিউজি) পরিচালক আবদুল আলীম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম’কে বলেছিলেন, “বিএনপির একটা ভয় ছিল; যদি দুর্নীতির দায়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের শাস্তি হয়, তাহলে তার সদস্যপদও থাকবে না; নির্বাচনও করতে পারবেন না।” আর এই সংশোধনীকে সাংঘর্ষিক আখ্যা দিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছিলেন, “এর মাধ্যমে তাদের দলীয় নেতৃত্বের সংকট ও সাংগঠনিক দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে দলের যে অবস্থান তার সঙ্গে গঠনতন্ত্রের এ পরিবর্তন সাংঘর্ষিক।”
সুতরাং, বিএনপি যে নীতি-বিবর্জিত ও রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া একটি দল সে-ব্যাপারে কোনো সন্দেহই আর থাকতে পারে না। ৭ ধারা বাতিলের ঘটনায় মানুষের মনে অনেকগুলো প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, যে প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পাওয়া আমাদের জন্য খুব জরুরি। চলুন, সবাই মিলে প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজিÑ
১. জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় বেগম খালেদা জিয়ার সম্পৃক্ততা ও দ-প্রাপ্ত হওয়ার ব্যাপারে বিএনপি কি তবে আগেই নিশ্চিত ছিল?
২. দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান সাজাপ্রাপ্ত হলে দল থেকে বহিষ্কৃত হতে হবেÑ এটি আঁচ করতে পেরেই কি তারা গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করতে চেয়েছিল?
৩. এ ঘটনাই কি প্রমাণ করে না যে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া একটি দল এবং তাদের কোনো নৈতিক আদর্শিক ভিত্তি নেই?
৪. দুর্নীতিবাজদের দল করার সুযোগ দিয়ে বিএনপি আবার কোন মুখে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার কথা বলবে?
৫. বিএনপি দুর্নীতিকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করে কীভাবে তার তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের চরিত্রবান ও সৎ হতে বলবে?
৬. বিএনপি কর্মীরা কি এই অনিয়ম ও অনৈতিকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে, না-কি খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের মতো দুর্নীতিকে তাদের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করবে?

লেখক : সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, উত্তরণ

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য