ভাষা-আন্দোলন ও বাঙালির আত্মপরিচয়ের ঠিকানার কথা বলতে গেলে আমাদের আলোকপাত করতে হয় স্বাধিকার-সংগ্রাম এবং স্বাধীনতা অর্জনের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এক্ষেত্রে অবদান প্রসঙ্গে।
ড. এম আবদুল আলীম: বাঙালির আত্মপরিচয়ের ঠিকানা খুঁজতে আমাদের প্রথমেই স্মরণ করতে হয় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র সেই অমোঘ বাণী- “আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশী সত্য আমরা বাঙ্গালী। এটি কোন আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব সত্য। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালীত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে, মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার জো-টি নেই (শহীদুল্লাহ্, ১৯৪৯)।” এ-কথাটি তিনি যখন বলেন তখন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দিয়ে আরবি হরফে বাংলা প্রচলনের উদ্যোগ-আয়োজন করে বাঙালির আত্মপরিচয় মুছে দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টায় লিপ্ত হয়। প্রবল প্রতিকূলতা এবং জুলুম-নির্যাতনের মুখেও এ অঞ্চলের মানুষ তা মেনে নেয়নি। তাই সদ্য-স্বাধীন পাকিস্তানে তারা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে এবং অসাম্প্রদায়িক পাকিস্তানি ভাবধারার বিপরীতে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটায়। বায়ান্নর ফেব্রুয়ারিতে তারা ভাষাশহিদদের রক্তের শপথে বলিয়ান হয়ে ইস্পাতকঠিন ঐক্য গড়ে তোলে। এরপর চুয়ান্নর নির্বাচন, বাষট্টির ছাত্র-আন্দোলন, ছেষট্টির ৬-দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে খুঁজে নেয় আপন ঠিকানা;Ñ অর্থাৎ স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।
দুই
ভাষা-আন্দোলন কীভাবে বাঙালিকে আত্মপরিচয়ের সন্ধান দিয়েছিল, সে-প্রসঙ্গে আলোকপাত করতে গেলে আমাদের ইতিহাসের ঝরোকায় চোখ মেলে তাকাতে হয়। এই যে, বাঙালি বা বাঙালি জাতির কথা আমরা বলি কিংবা বাঙালিত্বের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করি; এর যাত্রাবিন্দু কোথায়? অর্থাৎ- বাঙালির জাতির উৎপত্তি হয়েছে কীভাবে? এর উত্তর খুঁজতে শরণাপন্ন হওয়া যাক ড. সুকুমার সেনের কাছে। ‘বঙ্গভূমিকা’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন- “ভাষা নিয়ে জাতি, জাতি নিয়ে দেশ। বাংলা ভাষার উৎপত্তির সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি জাতির ইতিহাসের শুরু (সেন, ১৯৭৪ : ৩)।” পুরনো বইপুস্তক, যেমন- ‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণ’, ‘রামায়ণ-মহাভারত’, ‘বোধায়ন ধর্মশাস্ত্র’, ‘কালিদাসের রঘুব্শং’, ‘পতঞ্জলির মহাভাষ্য’ প্রভৃতিতে বঙ্গের উল্লেখ রয়েছে। খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর প্রত্নলিপিতে ‘বঙ্গের’ উল্লেখ রয়েছে; আর ‘বঙ্গাল’ তথা বাঙালির উল্লেখ স্পষ্টভাবে পাওয়া যায় একাদশ শতাব্দী থেকে। দেশবাচক ‘বাংলা’ শব্দটির সঙ্গে কার্পাস-চাষ বা বস্ত্রশিল্পের প্রসঙ্গটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই ‘বঙ্গাল’ মানে প্রচুর বঙ্গ বা তুলা উৎপাদনকারী ভূমিকে বুঝায়। এখান থেকেই এসেছে ‘বঙ্গাল’ ও ‘বাঙ্গালী’ শব্দ দুটি। আল বেরুনির লেখায় বঙ্গাল-প্রণীত শকুন-বিদ্যাবিষয়ক পুস্তকের সন্ধান পাওয়া যায়। সেটা এগারো শতকের মধ্যভাগের কথা। এ শতকের বিখ্যাত বাঙালি অতীশ দীপঙ্করের পাণ্ডিত্যের বিশ্বজোড়া খ্যাতির কথা আমরা সকলেই জানি। বারো শতকে ‘বঙ্গাল’ ছদ্মনামের একজন কবির পরিচয় পাওয়া যায়। সদুক্তিকর্ণামৃতের শ্লোকে রসময় বাংলা ভাষাকে গঙ্গার সঙ্গে তুলনা করে উভয়কে প্রগাঢ় রসময়, গভীর ও সুন্দর গতিভঙ্গময় বলে অভিহিত করা হয়েছে; যাতে অবগাহন করলে কবিদের পুণ্য হয়। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন ‘চর্যাপদে’ বঙ্গ, বঙ্গাল এবং বঙ্গালীর উল্লেখ রয়েছে। চৌদ্দ শতকে সুলতান শামসউদ্দীন ইলিয়াস শাহ শাহ্-ই-বাঙ্গালা, সুলতান-ই-বাঙ্গালাহ্ প্রভৃতি উপাধি লাভ করেছিলেন। পনেরো শতকে বাংলার প্রসিদ্ধ সাধক নূর কুতুব আলম সর্বসাধারণের কাছে ‘শেখ নূর বাঙালি’ নামে পরিচিত ছিলেন। আঠারো শতকে ‘লালা বাঙালি’ এবং উনিশ শতকে ‘ইনামউদ্দীন বাঙালি’ নামক দুজন বিখ্যাত ব্যক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। এভাবে কালপরিক্রমায় বঙ্গ থেকে বাংলা এবং তার অধিবাসীরা বাঙালি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
সাহিত্যের কথা যদি বলি তাহলে দেখা যায়, ষোলো শতকের মধ্যেই বাংলা সাহিত্যে বাংলার অধিবাসী এবং বাংলাভাষী উভয়ই ‘বাঙালি’ নামে পরিচিতি লাভ করতে থাকে। একইসঙ্গে বাংলা ভাষার মর্যাদার প্রশ্নে বাঙালি কবিদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে উঠতে থাকে। অন্যদিকে ব্রাহ্মণ্যবাদী চেতনা এবং মুসলিম শাসক তথা পীর-দরবেশদের আনুকূল্যে সংস্কৃত ও আরবি-ফারসি ভাষা পবিত্র ভাষার মর্যাদা পেতে শুরু করে, বিপরীতে বাংলা ভাষা প্রাকৃতজনের ভাষারূপে হীন বলে গণ্য হতে থাকে (আনিসুজ্জামান, ২০১৫ : ১৪-১৫)। এ চেতনা এমন পর্যায়ে গড়ায় যে, পনেরো শতকের কবি কৃত্তিবাস এবং সতেরো শতকের কবি কাশীরাম দাসকে ‘রামায়ণ-মহাভারত’ অনুবাদের জন্য তাদের ‘সর্বনেশে’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। এসব উপেক্ষা করেও মধ্যযুগের কবিগণ বাংলা ভাষার চর্চা অব্যাহত রেখেছেন এবং এ ভাষার উৎকর্ষ সাধনের পাশাপাশি এর গৌরব উচ্চে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। লোকে দোষ ধরবে জেনেও শাহ মুগম্মদ সগির বাংলা ভাষায় প্রেমরসে ধর্মবাণী শুনিয়েছেন। কবি মুজাম্মিল লোকের কথার ভয় উপেক্ষা করে বাংলা পয়ার রচনা করেছেন। কবি হাজী মুহম্মদ তো হিন্দুয়ানি অক্ষরকে হেলা আর দেশি ভাষাকে ঘৃণা করতে নিষেধ করেছেন। সৈয়দ সুলতান স্ব-স্ব মাতৃভাষার শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরে লিখেছেন : “যারে যেই ভাষে প্রভু করিছে সৃজন/সেই ভাষ তাহার অমূল্য সেই ধন (শরীফ, ১৯৭৮ : ৮০)।” এভাবে শেখ মোত্তালেব, আবদুন নবি, আবদুল হাকিম প্রমুখের লেখায় বাংলা ভাষা ও বাঙালিত্বের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শিত হয়েছে। আবদুল হাকিম বাংলা ভাষার অবজ্ঞাকারী এবং এ ভাষার প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারীদের কঠোর সমালোচনা করে লিখেছেন : “যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।/সেসব কাহার জন্ম নির্ণএ ন জানি ॥/দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়াএ।/নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশে ন যাএ ॥” পরবর্তীকালে মীর মশাররফ হোসেনও প্রায় একই সুর বলেন, “মাতৃভাষায় যাহার আস্থা নাই, সে মানুষ নহে।” এসব উক্তি থেকে বুঝা যায়, মধ্য যুগ থেকেই বাংলা ভাষার প্রতি এক শ্রেণির মানুষের অবজ্ঞা এবং বিরোধ যেমন ছিল, তেমনি অন্য শ্রেণি এ ভাষার প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করে তার মধ্যে নিজেদের আত্মপরিচয়ের ঠিকানা খুঁজেছে। তবে কাজটি সহজ ছিল না, এজন্যে তাদের অনেক প্রতিকূলতা অতিক্রম করতে হয়েছে, করতে হয়েছে কঠোর সংগ্রাম এবং স্বীকার করতে হয়েছে সীমাহীন ত্যাগ।
তিন
সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক-সামাজিক নানা উত্থান-পতন ঘটেছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভাষা-সংস্কৃতির মধ্যেও ঘটেছে গ্রহণ-বর্জন, রূপান্তর এবং সমন্বয়। মুসলিম রাজত্বের অবসানে রাজদরবার থেকে যেমন আরবি-ফারসি ভাষা বিতাড়িত হয়েছে, তেমনি ইংরেজ শাসন জেঁকে বসায় ইংরেজি ভাষার প্রসার ঘটেছে। কিন্তু তাতে বাঙালিত্বের যে মহিমা তা এতটুকু ম্লান হয়নি। যুগের পরিক্রমায় নানান দেশ ও জাতির সংস্কৃতি বাঙালিত্বে লীন হয়ে এর গৌরব এবং ঐশ্বর্য বৃদ্ধি পেয়েছে। কংগ্রেস-মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা, এ অঞ্চলের মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতা এবং জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ও জাগরণে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটিও সামনে চলে এসেছে। রাজনৈতিক টানাপড়েনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে হিন্দু-মুসলিম বিরোধ। ‘ভাগ কর, শাসন কর’ নীতির কূটকৌশলে এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে বহুমাত্রিক বিরোধ উসকে দিয়ে শেষ পর্যন্ত তা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে ব্রিটিশ শাসকেরা ভারতবর্ষ ছেড়েছে। বঙ্গভঙ্গ, বেঙ্গল প্যাক্ট, সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, লাহোর প্রস্তাব, ভারত ছাড়ো আন্দোলন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে, স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে দেশভাগ প্রভৃতি ঘটনাপ্রবাহে বাংলার মানুষ যেমন উজ্জীবিত হয়েছে, সংকট-দ্বিধায় পড়েছে; তেমনি সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পেও বিপন্ন বোধ করেছে। রাষ্ট্রীয় ও সম্প্রদায়গত বাস্তবতায় ভারতবর্ষের হিন্দুদের কাছে হিন্দি এবং মুসলমানদের কাছে উর্দুর সমাদর বেড়েছে। শুধু তাই নয়, এক সম্প্রদায় হিন্দিকে, অপর সম্প্রদায় উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তুলেছে। মাঝখানে পিষ্ট হয়েছে বাংলা ভাষা এবং বাঙালি সংস্কৃতি তথা বাঙালিত্ব। এর ভেতর থেকেও হিন্দু-মুসলমানদের বৃহৎ একটা অংশ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মধ্যে নিজেদের আত্মপরিচয়ের ঠিকানা খুঁজেছে। দেশভাগের অনেক আগে থেকেই তারা বাংলা ভাষার প্রতি ক্রমাগত ভালোবাসা প্রদর্শনের পাশাপাশি সর্বত্র এ ভাষার যথাযোগ্য মর্যাদা প্রতিষ্ঠায়ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছে।
দেশভাগের আগেই ভারতের রাষ্ট্রভাষা যে হিন্দি হবে তা পুরোপুরি নিশ্চিত করেছিলেন কংগ্রেস নেতৃবৃন্দসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের নীতি-নির্ধারকরা, তাতে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা বিরোধিতা করেনি। মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের সকল অঞ্চলের মানুষকে চাঁদ-তারার পতাকাতলে সমবেত করতে গিয়ে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগ নেন। এ কাজ করতে গিয়ে তারা চরম বিপাকে পড়েন। কেবল বিপাকে নয়, পূর্ববঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে প্রবল বাধার সম্মুখীন হন। ইসলামের ধুয়া তুলে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ ও তাদের তল্পিবাহক বুদ্ধিজীবীগণ উঠেপড়ে লাগেন উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে। বস্তুত, ইসলাম ও জাতীয় সংহতির নামে পাকিস্তানের অবাঙালি শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের ওপর রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করতে, তাদের অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করতে এবং এবং তাদের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয় (আহ্মদ, ২০১৭ : ৭৬)। বিপরীতে পূর্ববঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, যাদের মাতৃভাষা বাংলা তাদের হয়ে প্রথমে মসিযুদ্ধে অবতীর্ণ হন বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের একাংশ। তারপর ছাত্রসমাজ এবং সবশেষে সর্বস্তরের মানুষ রাজপথে নেমে প্রবল প্রতিবাদ এবং আত্মাহুতি দানের মাধ্যমে মুসলিম লীগ সরকারের বাঙালিত্ব বিনাশী সকল তৎপরতা রুখে দেন। প্রথমে পত্র-পত্রিকার লেখা, সভা-সমিতিতে আলোচনার মাধ্যমে এর সূত্রপাত ঘটে। প্রকাশ্য রাজপথে আন্দোলন শুরু হয় পূর্ববঙ্গের কংগ্রেস দলীয় সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কর্তৃক পাকিস্তান গণপরিষদে উত্থাপিত ভাষাবিষয়ক সংশোধনী প্রস্তাব নাকচ হওয়ার পর। সেটা ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসের কথা। রাজপথের এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে গ্রেফতার হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কাজী গোলাম মাহবুব, শওকত আলী, অলি আহাদ, শামসুল হকসহ অনেক নেতাকর্মী। কিন্তু তাতেও আন্দোলন থামাতে ব্যর্থ হয়ে পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ছাত্রদের সঙ্গে আট-দফা সমঝোতা চুক্তি সই করে আন্দোলন স্তিমিত করেন। কিন্তু পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ববঙ্গ সফরে এসে প্রথমে রেসকোর্স ময়দানের সংবর্ধনা-সভায় এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে ছাত্রদের প্রকাশ্য প্রতিবাদের মুখে পড়েন। এরপর সরকারি দমন-পীড়নে প্রথম পর্বের ভাষা-আন্দোলন শেষ হলেও ১৯৫২ সালে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন কর্তৃক জিন্নাহর সুরে সুর মিলিয়ে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণার প্রতিবাদে পূর্ববঙ্গের ছাত্র-জনতা রাজপথে নেমে আসেন। গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরষদ। এরপর আসে একুশে ফেব্রুয়ারি, আসে ইতিহাসের সেই চূড়ান্ত মুহূর্ত। রাষ্ট্রভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে জীবন দেন বাংলার দামাল সন্তানেরা। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর, অহিউল্লাহ, আউয়ালসহ অনেকের রক্তের শপথে জাতি জেগে ওঠে। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত পূর্ববঙ্গে। দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়া এ আন্দোলন মুহূর্তেই সকল বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করে। ভাষাকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলের মানুষের যে ইস্পাতকঠিন ঐক্য, তা জন্ম দেয় নতুন এক বোধের, যা অসাম্প্রদায়িক চেতনায় দীপ্ত বাঙালি জাতীয়তাবাদ নামে পরিচিতি লাভ করে। সাম্প্রদায়িক ভাবধারার সংকীর্ণ পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে এ এমন এক উদ্দীপনা সৃষ্টি করে, যার মধ্যে বাঙালি নবরূপে খুঁজে পায় তার আত্মপরিচয়। এই পরিচয় তাদের এমন শক্তি ও আত্মবিশ্বাস দান করে যে- তারা ধর্ম, বর্ণ, সাম্প্রদায়িকতা সবকিছু ভুলে বাঙালি পরিচয়কেই উচ্চে তুলে ধরে। বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং চিরায়ত বাংলার সকল ঐতিহ্যকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে পথচলা শুরু করে। ভাষা-আন্দোলন থেকে উৎসারিত এই চেতনায় বলিয়ান হয়ে তারা চুয়ান্নর নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটিয়ে বাঙালিত্বের বিজয়-নিশান ওড়ায়। এই নির্বাচনে একুশের চেতনার স্মারক হিসেবে যুক্তফ্রন্ট প্রণয়ন করে একুশ-দফা কর্মসূচি। তবে বাঙালির এই বিজয়ের আনন্দ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। যুক্তফ্রন্টকে ক্ষমতাচ্যুত প্রথমে কেন্দ্রের এবং ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন চালু করে পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থবাদী মহল। বাঙালিকে স্তব্ধ করে দিতে সর্বদা তৎপর ছিল উর্দিপরা আইয়ুব খান। কিন্তু ভাষা-আন্দোলন তাদের চেতনায় যে স্ফুলিঙ্গ প্রজ্বলিত করে, তা দাবানলে রূপ নিতে বেশি সময় লাগেনি। ১৯৬২ সালের ছাত্র-আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে ৬-দফা আন্দোলনের পথ ধরেই আসে ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থান। এ সময় গগনবিদারী স্লোগান ওঠে ‘জাগো জাগো, বাঙ্গালী জাগো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘পিণ্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’। এসব স্লোগানে বুঝা যায় বাঙালি পদ্মা-যমুনা প্রবাহিত জনপদ অর্থাৎ ঢাকাকে কেন্দ্র করে তাদের আত্মপরিচয়ের ঠিকানা খুঁজছে। সেনাশাসক আইয়ুব খানের মসনদ থেকে বিদায়ের পর আরেক সেনাশাসক ইয়াহিয়া খান ক্ষমতার দৃশ্যপটে আবির্ভূত হন। গণ-অভ্যুত্থান বাঙালির যে জাগরণ ও ঐক্য সৃষ্টি করে, তাতে উর্দিপরা শাসকের বুঝতে বাকি থাকে না যে একটি সাধারণ নির্বাচন দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আমেজ শুরু হলে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ-বছর জানুয়ারি মাসে পূর্ব পাকিস্তানের নাম যে ‘বাংলাদেশ’ হবে, তা স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন। এরপর থেকে মুক্তিকামী বাঙালির কণ্ঠে স্লোগান ওঠে- ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘তোমার দেশ, আমার দেশ/বাংলাদেশ, বাংলাদেশ।’ সত্তরের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের সময় পত্রিকাগুলোতে যে শিরোনাম করা হয়, তাতেও বাঙালি পরিচয়টিই মুখ্য রূপে তুলে ধরে লেখা হয়- ‘কাঁদো, বাঙালি, কাঁদো।’ সত্তরের নির্বাচনে পূর্ববঙ্গের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে ভূমিধস বিজয় অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করলে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ অন্দোলনের ডাক দেন। তার সাতই মার্চের ভাষণের পর সেøাগান ওঠে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ (খান, ২০২২ : ৭৮-৭৯)। বাঙালির এই কণ্ঠকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য পাকিস্তানি সামরিক জান্তা পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করে। গোপনে গোপনে নামে সৈন্য সমাবেশ করে অপারেশন সার্চলাইটের নামে তারা ১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। গ্রেফতার করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। গ্রেফতারের প্রাক্কালে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন এবং বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। এরপর রক্ষক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি অর্জন করে স্বাধীন বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশ অর্জনে সঞ্জিবনীসুধার কাজ করে ভাষা-আন্দোলন তথা একুশের চেতনা, যা বাঙালিকে দেয় আত্মপরিচয়ের সন্ধান।
চার
ভাষা-আন্দোলন এ অঞ্চলের মানুষকে যে আত্মপরিচয়ের সন্ধান দিল এবং স্বাধীন আবাসভূমি খুঁজে নেওয়ার শক্তি-সামর্থ্য দান করল, সে-পথ মসৃণ ছিল না। দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ, সংগ্রাম, ত্যাগ আর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার পর এ অঞ্চলের মানুষ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান তথা ফাঁকিস্থান নামক যে রাষ্ট্রের নাগরিক হয়েছিল, সে-রাষ্ট্র তাদের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক মুক্তির সন্ধান তো মিললোই না; বরং নতুনমাত্রায় শুরু হয় শোষণ-বঞ্চনা। এছাড়া ক্ষুধা, দারিদ্র্য তো ছিলই, জেল-জুলুম-নির্যাতনও হয় নিত্যসঙ্গী। এমন ক্ষোভ আর হতাশাপূর্ণ রাষ্ট্রীয় বাস্তবতায় আসে মাতৃভাষা তথা চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতির ওপর আঘাত। অবশ্য পাকিস্তান জন্মের অব্যবহিত পূর্বেই কলকাতায় বসবাসরত পূর্ববঙ্গের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও যুবকরা হবু রাষ্ট্র পাকিস্তানে নিজেদের রাজনৈতিক কর্মপন্থা ঠিক করে ফেলে। মুসলিম লীগের কোটারী, সাম্প্রদায়িক এবং গণবিচ্ছিন্ন রাজনীতির বিপরীতে নতুন ধারার গণমুখী ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাধারার রাজনীতি করতে তারা নতুন সংগঠন গড়ে তোলার কাজ শুরু করে। মুসলিম লীগ সরকারের দমন-পীড়ন এবং পরিবর্তিত রাষ্ট্রিক বাস্তবতায় কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ফেডারেশন, কংগ্রেস, ছাত্র কংগ্রেস, ফরোয়ার্ড ব্লক প্রভৃতি রাজনৈতিক ও ছাত্র-সংগঠনের অস্তিত্ব প্রায় বিপন্ন হয়। এসব সংগঠনের নেতাকর্মীরা কেউ দেশ ত্যাগ করেন, কেউ চলে যান আত্মগোপনে। পাকিস্তান জন্মের অল্প কিছুদিন আগেই প্রগতিশীল নেতাকর্মীরা অসাম্প্রদায়িক ভাবধারার সংগঠন গণ-আজাদী লীগের গোড়াপত্তন ঘটান। এরপর একে একে জন্মলাভ করে পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রভৃতি রাজনৈতিক দল, ছাত্র ও যুবসংগঠন। সংগঠনগুলোর নীতিগত অবস্থান ছিল মুসলিম লীগের বিপরীতে। একই সময়ে গড়ে উঠেছিল ইসলামি ভাবধারাপুষ্ট ও পাকিস্তানি তমদ্দুনের ঝাণ্ডাবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিস ও ইসলামি ভ্রাতৃসংঘ। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী উদুর্কে রাষ্ট্রভাষা করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দাপ্তরিক কাজে এবং শিক্ষাক্ষেত্র থেকে ক্রমে বাংলা ভাষাকে বাদ দেওয়া শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় মুসলিম লীগের নীতি-নির্ধারকরা উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে তার প্রতিবাদে রাজপথে আন্দোলন শুরু হয়। নতুন রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে স্বস্তিতে জীবনযাপন দূরে থাক, বাঙালি হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই তাদের দুরূহ হয়ে ওঠে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বাঙালির অস্তিত্ব-বিপন্নকারী কর্মকাণ্ড রুখে দিতে এসব সংগঠনের নেতাকর্মীরা প্রত্যক্ষভাবে মাঠে নামেন। পাকিস্তানি দুঃশাসন এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে এতটাই হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছিল যে, ইসলামি ভাবধারাপুষ্ট সংগঠন হলেও তমুদ্দন মজলিস এবং ইসলামি ভ্রাতৃসংঘের নেতাকর্মীরা পর্যন্ত প্রতিবাদে রাজপথে নামেন। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন, আন্দোলনের কর্মসূচি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে এসব সংগঠনের নেতাকর্মীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করেন এবং অনেকেই জেল-জুলুম-নির্যাতনের শিকার হন। অনেকের জীবনই বিপন্ন হয়। তাদের এই সংগ্রাম ও ত্যাগই বাঙালিকে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি-সাহস দান করে এবং সহায়তা করে ভাষা-সংস্কৃতির বলে বলিয়ান হয়ে স্বকীয় সত্তায় ও আত্মপরিচয়ে জেগে উঠতে।
ভাষা-আন্দোলন থেকে উৎসারিত চেতনা হিমালয় থেকে নেমে আসা ঝরনাধারার মতো ক্রমে বেগবান হয় এবং খরস্রোতা নদীর মতো প্রবাহিত হয়ে স্বাধীনতার মোহনায় মিলিত হয়। এতে প্রধানভাবে শক্তি জোগায় ছাত্র-তরুণদের দুই বৃহৎ সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়ন। চিন্তা-আদর্শ এবং রাজনৈতিক কর্মসূচিতে মৌলিক পার্থক্য থাকলেও বাঙালিত্বের প্রশ্নে তারা একাট্টা ছিলেন। শুধু তাই নয়, ভাষা-আন্দোলন থেকে জন্ম নেওয়া বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও অসাম্প্রদায়িক ধ্যান-ধারণাকে পরিপুষ্ট ও বিকশিত করতে তারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছেন। স্বাধিকার-সংগ্রামের দিনগুলোতে একুশে ফেব্রুয়ারি এলেই তারা মিলিত হতেন শহিদ মিনারে। পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের রক্তচক্ষু এক্ষেত্রে তাদের দমাতে পারেনি। সাহিত্যিক এবং সংস্কৃতিকর্মীরাও বসে ছিলেন না। হাসান হাফিজুর রহমানের ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ (১৯৫৩) সংকলন এক্ষেত্রে ছিল এক বিরাট মাইলফলক। কবিতায়, উপন্যাসে, গল্পে, নাটকে, সংগীতে, সেøাগানে, আলপনায় নবজাগ্রত তরুণরা একুশের চেতনার বাণীকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে থাকল। সাংস্কৃতিক এসব কর্মকাণ্ডে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। ছাত্রলীগও পিছিয়ে ছিল না। ভাষা-আন্দোলন এই তরুণ ও যুবকদের রাজনৈতিক ও গণভিত্তি তৈরি করে দেয়। অনেক ছাত্রনেতা চুয়ান্নর নির্বাচনে মুসলিম লীগের ডাকসাইটে প্রার্থীদের পরাজিত করেন। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক খালেক নেওয়াজ খানের কাছে পরাজিত হন স্বয়ং পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীন। তাজউদ্দীন আহমদসহ অনেক যুবনেতা এমন জনপ্রিয়তা লাভ করেন। ১৯৬৬ সালের ‘বাংলা প্রচলন সপ্তাহ’ পালন এবং ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘বর্ণতরু’ কর্মসূচি পালনে ছাত্র ইউনিয়ন এবং ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বাংলা ভাষা এবং বাঙালি সংস্কৃতির ঝাণ্ডা উচ্চে তুলে ধরেন। এরাই একুশের চেতনায় জাগ্রত হয়ে স্বাধিকার সংগ্রাম থেকে স্বাধীনতার পথে জাতিকে অগ্রসর করতে থাকেন।
পাঁচ
ভাষা-আন্দোলন ও বাঙালির আত্মপরিচয়ের ঠিকানার কথা বলতে গেলে আমাদের আলোকপাত করতে হয় স্বাধিকার-সংগ্রাম এবং স্বাধীনতা অর্জনের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এক্ষেত্রে অবদান প্রসঙ্গে। অল্প বয়সেই বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি গভীর প্রীতিবোধ ও ভালোবাসা জন্ম হয়। রবীন্দ্র-নজরুল-জীবনানন্দের সাহিত্য তাকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। পরবর্তীকালে বক্তৃতা এবং ভাষণে প্রায়ই উদ্ধৃত করতেন তাদের কবিতার বিভিন্ন পঙ্ক্তি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গান তার এতই প্রিয় ছিল যে, এটিকে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত করেন। শুধু তাই নয়, অল্প বয়সেই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, রাজনীতি এবং সংস্কৃতি একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। তাই তার রাজনৈতিক জনসভাগুলোতে ঝাঁঝালো বক্তৃতার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা থাকত। তার বয়স যখন বিশ বছর তখন ফরিদপুর জেলা মুসলিম লীগের এক আলোচনা-সভায় অতিথি করে এনেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম এবং হুমায়ুন কবিরের মতো সাহিত্যিককে (খান, ২০১৮ : ২০)। ভাষা-আন্দোলনে তিনি প্রত্যক্ষভাবে নেতৃত্ব দেন এবং কারাভোগ করেন। বস্তুত, ১৯৪৮ সালের ভাষা-আন্দোলনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঢাকার ছাত্র-আন্দোলনে তার সরাসরি সম্পৃক্ততা ঘটে এবং স্বীয় সাংগঠনিক দক্ষতা ও নেতৃত্বদানের গুণাবলি দ্বারা নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের শক্ত ভিতও এর মাধ্যমেই নির্মাণ করেন (আলীম, ২০২১ : ১৪২)। বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনের সময় তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ছাত্রনেতাদের নির্দেশনা দেন (রহমান, ২০১২ : ১৯৬)। তিনি এবং মহিউদ্দিন আহমেদ অনশন শুরু করলে ভাষা-আন্দোলনে নতুন গতিবেগ সঞ্চারিত হয়। ভাষা-আন্দোলনের পর একুশের চেতনা বিস্তারেও তিনি ব্যাপকভাবে কাজ করেন। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি অর্জনে রাখেন বিশেষ অবদান। চীন শান্তি সম্মেলন এবং জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে তিনি এ ভাষাকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তুলে ধরেন। সর্বোপরি ভাষা-আন্দোলন ও একুশের চেতনায় জাগ্রত জাতিকে আত্মপরিচয়ের ঠিকানার সন্ধান দিয়ে তাদের পৌঁছে দেন স্বাধীনতার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে। সর্বোপরি তিনি পরিণত হন এ অঞ্চলের অবিসংবাদিত জাতীয়তাবাদী নেতায়। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর অবদানের কথা স্মরণ করেও বলা যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই এ ভূখণ্ডের মানুষকে জাতীয়তাবাদী চেতনায় জাগ্রত ও ঐক্যবদ্ধ করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন খাঁটি বাঙালি। নীতি-আদর্শ এবং বাঙালিত্বের প্রশ্নে আপোস করেননি কখনও। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখেই তিনি আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন, “আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান, একবার মরে দুইবার মরে না।” স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা ভাষাকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু এবং একুশে চেতনা সমুন্নত রাখতে তিনি অসামান্য অবদান রাখেন।
বাঙালির আত্মপরিচয়ের সূত্র-সন্ধান ও আত্মজাগরণে বঙ্গবন্ধু ছাড়াও উল্লেখ করতে হয় ধীন্দ্রেনাথ দত্ত, আবুল হাশিম, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, আতাউর রহমান খান, মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, খান সাহেব ওসমান আলী, আনোয়ারা খাতুন, খয়রাত হোসেন, শামসুল হক, অজিত গুহ, অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, জিল্লুর রহমান, শওকত আলী, হাসান হাফিজুর রহমান, শহীদুল্লা কায়সার, আবদুল মতিন, গাজীউল হক, খালেক নেওয়াজ খান, নাইমউদ্দীন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ, এম এ ওয়াদুদ, মমতাজ বেগম, হালিমা খাতুন, রওশন আরা বাচ্চুসহ অগণিত নেতাকর্মীর নাম। উল্লেখ করতে হয় জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ, মুহম্মদ এনামুল হক, প্রিন্সিপ্যাল আবুল কাসেম, মুনীর চৌধুরী, আবদুল হক, মাহবুব জামাল জাহেদীসহ অগণিত বুদ্ধিজীবীর কথা। সকলের সম্মিলিত প্রয়াস এবং পূর্ববঙ্গের সর্বস্তরের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ফলেই ভাষা-আন্দোলন সফল হয়েছে। আর এর মাধ্যমেই বাঙালি খুঁজে পেয়েছে তার আত্মপরিচয়ের ঠিকানা। পদ্মা-যমুনাসহ অসংখ্য নদ-নদীর তীরে তীরে, নদীমাতৃক বাংলার কুটিরে কুটিরে আবহমান কাল ধরে গড়ে ওঠা সাহিত্য, সংস্কৃতি; যার মূল সুর সমন্বয়, যার মর্মমূলে রয়েছে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, তার নবজাগরণ ঘটায় ভাষা-আন্দোলন। সেই জাগরণ তাদের এমনভাবে ঐক্যবদ্ধ করে যে, তা লালন ও বিকশিত করে তারা বাঙালিত্বের অসীম শক্তি সঞ্চয় করতে সক্ষম হয়। এবং সেই শক্তি দ্বারা পাকিস্তানি অসুরদের পরাজিত করে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনে। পাকিস্তানিদের ওই পরাজয়, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, নৈতিক; সকল দিক থেকেই সম্ভাবিত হয়। আর এসবের মূলে শক্তি-সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছে ভাষা-আন্দোলন ও একুশের চেতনা। একুশের চেতনার সেই অবিনাশী শক্তিই গত প্রায় পৌনে এক শতাব্দী বাঙালি-সংস্কৃতিকে রক্ষা করছে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার ভয়াল থাবা থেকে। আগামীতেও করবে। তাছাড়া বিশ্বায়নের নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্ত করে বাঙালিকে তথ্যপ্রযুক্তির হাত ধরে বিশ্ববাসীর সঙ্গে এগিয়ে যেতে সহায়তা করবে। বাঙালির আত্মপরিচয়ের স্মারক একুশের চেতনা বর্তমানে দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। কেবল বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতি নয়; সকল দেশের, সকল মানুষের ভাষার অস্তিত্বেরও রক্ষাকবচ হয়ে উঠেছে ভাষাশহিদদের আত্মত্যাগের চেতনায় ভাস্বর একুশে ফেব্রুয়ারি।
কাজেই এ-কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, বাঙালির আত্মপরিচয়ের মূল সূত্রটি নিহিত আছে বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য, বাঙালি সংস্কৃতি তথা বাঙালিত্বে। এটি হঠাৎ কুড়িয়ে পাওয়া কোনো বিষয় নয়, হাজার বছরের পথ-পরিক্রমায় অযুত-কোটি মানুষের কর্ম-সাধনায় অর্জিত ধন এই বাঙালিত্ব। বস্তুত, বাঙালি জাতিসত্তার মর্মমূল থেকে উৎসারিত চেতনাই এ অঞ্চলে জন্ম দিয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের। যার ভিত্তিভূমি পরিপুষ্ট করেছে ভাষা-আন্দোলন ও একুশের চেতনা। এই জাতীয়তাবাদ অসাম্প্রদায়িক চেতনার অগ্নিমন্ত্রে পরিশুদ্ধ করে এ অঞ্চলের মানুষের চেতনাকে ঋদ্ধ করেছে; যা ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীন আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে এদেশের মানুষের নাগরিকত্ব তাই ‘বাংলাদেশি’ হলেও জাতিসত্তাগত পরিচয় তাদের ‘বাঙালি’ (মামুদ, ২০১৫ : ১৬৮) পরিচয়ে গৌরবান্বিত।
সহায়কপঞ্জি
আলীম, এম আবদুল (২০২১)। ‘বঙ্গবন্ধু ও ভাষা-আন্দোলন’। প্রথম পুনর্মুদ্রণ। বাংলা একাডেমি, ঢাকা
খান, আবু সাঈদ (২০২২)। ‘স্লোগানে সেøাগানে রাজনীতি’। প্রথম বর্ধিত সংস্করণ। পাঠক সমাবেশ, ঢাকা
খান, শামসুজ্জামান (২০১৮)। ‘শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা’। কথাপ্রকাশ, ঢাকা
মামুদ, হায়াৎ (২০১৫)। ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্বরূপ’। ‘বাংলাদেশ : সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়’। চন্দ্রাবতী একাডেমি, ঢাকা
রহমান, শেখ মুজিবুর (২০১২)। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা
শহীদুল্লাহ্, মুহম্মদ (১০৪৯)। পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে অভিভাষণ। ‘দৈনিক আজাদ’। ১ জানুয়ারি, ঢাকা
শরীফ, আহমদ সম্পা. (১৯৭৮)। ‘সৈয়দ সুলতান বিরচিত রসুল চরিত’। ঢাকা
সালাহ্উদ্দীন, আহ্মদ (১৯১৭)। ‘বাঙালির সাধনা ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’। চতুর্থ মুদ্রণ। সাহিত্য প্রকাশ। ঢাকা
সেন, সুকুমার (১৯৭৪)। ‘বঙ্গভূমিকা’। কলকাতা
লেখক : ইতিহাস-ঐতিহ্যসন্ধানী গবেষক; সাবেক ডিন, কলা অনুষদ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়