সম্পাদকের কথা: বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা। শহিদানের আত্মদান ও অগণিত মানুষের লড়াই-সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা আমাদের ভাষার অধিকার ও আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হই। ভাষা-সংগ্রামের যৌক্তিক পরিণতি ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও আমাদের নিজস্ব জাতি-রাষ্ট্র স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। এ জন্য বিজয়ী জাতি হিসেবে আমাদের গর্ব ও গৌরবের অন্ত নেই। ভাষা-শহিদদের স্মরণে ২১ ফেব্রুয়ারিকে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতিদান বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষার মুকুটে আর একটি পালক পরিয়েছে। ২১ আমাদের চেতনার বাতিঘর, আমাদের জাতিসত্তা রক্ষার দুর্ভেদ্য প্রাচীর।
এতসব অর্জন সত্ত্বেও আমাদের মনস্তত্বে ঔপনিবেশিক হীনম্মন্যতার উত্তরাধিকার আমাদের মেরুদণ্ডে ঘুণপোকার সংক্রমণ ঠেকাতে পারছে না। আমাদের রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে এখনও শতভাগ বাংলা ভাষার প্রচলন হয়নি। বর্তমানে আমলাদের বড় অংশই বাংলা তো বটেই, ইংরেজিও শুদ্ধরূপে লিখতে, বলতে পারে না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা তিনটি ভাষার চাপে পঙ্গুত্বে আক্রান্ত। বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি মাধ্যম ও আরবি মাধ্যমে হাজার হাজার স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা। অথচ আমাদের ভাষা সংগ্রাম থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং আমাদের সংবিধান বলছে একমুখী শিক্ষার কথা। আমাদের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এখনও ইংরেজির প্রতাপ অব্যাহত। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকার জন্য ইংরেজি শেখার আবশ্যকতা অনস্বীকার্য। কিন্তু তাও কেবল সার্টিফিকেট দেওয়ার জন্য নয়। ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর মাতৃভাষাকে টিকিয়ে রাখা ও যুগোপযোগী করার জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে তা চালু করা বাঞ্ছনীয়।
আমাদের সামাজিক মনস্তত্বও অদ্ভুত। শতভাগ বাঙালি আমন্ত্রিত হলেও বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র, জন্মদিন, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীসহ যে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে ইংরেজিতে আমন্ত্রণপত্র লেখার সামাজিকতা জাঁকিয়ে বসেছে।
আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, কর্পোরেট হাউস সর্বত্র ইংরেজির রাজত্ব চলছে। এর থেকে নিষ্কৃতির উপায় কী? উপায় একটাই। আমাদের জাতীয়তাবোধকে শানিত করা এবং হীনম্মন্যতা ঝেড়ে ফেলা। বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম মাতৃভাষা বাংলা। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের ইংরেজি-প্রীতি। আমাদের মনোজগতে এখনও ঔপনিবেশিকতা কমে যাওয়া দূরের কথা, যতই দিন যাচ্ছে ততই এই দাস মনোবৃত্তি বাড়ছে।
আমাদের গর্ববোধ হয় যখন দেখি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়, ফরেইন ল্যাংগুয়েজ ইনস্টিটিউটে বাংলা ভাষায় পঠন-পাঠন চলছে। দাবি উঠেছে জাতিসংঘের অন্যতম অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা প্রচলনের। এ বিষয়ে ক্রমেই বিশ্ব জনমত গড়ে উঠছে। আমাদের প্রকাশনা শিল্পও আন্তর্জাতিক মান অর্জন করছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিপুল সংখ্যক বাঙালি স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেছে। এই প্রবাসী বাঙালিরা প্রতিবছর সাড়ম্বরে একুশে উদ্যাপন, সাহিত্য সম্মেলন এবং বইমেলার আয়োজন করছে।
কার্যত বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতি আন্তর্জাতিক ভাষা ও সংস্কৃতির মর্যাদা পাচ্ছে। এতসব ইতিবাচক অগ্রগতি সত্ত্বেও দেশের অভ্যন্তরে ব্যবহারিক প্রয়োগ দুঃখজনকভাবে কমে যাচ্ছে। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ইংরেজি ব্যবহারকে বিপুল সংখ্যক মানুষ তাদের মর্যাদার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করে। আমাদের ভাষার জন্য যথার্থ গৌরববোধ ও জাতীয়তাবোধ যদি শানিত হতো, তাহলে নিঃসন্দেহে দৃশ্যপট ভিন্ন হতো। এর জন্য রাজনৈতিক উদ্যোগের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে একটা নবজাগরণ সৃষ্টি করতে হবে। আমরা আশা করব, বাংলাদেশের ছাত্র-যুবসমাজ এবং দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীগণ এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবেন।
আমাদের অনুবাদ সাহিত্য খুবই দুর্বল। একদিকে যেমন ইংরেজির বাংলা প্রতিশব্দ কম, অন্যদিকে বাংলা ভাষার ইংরেজি প্রতিশব্দ কম। বাংলা একাডেমি ইংরেজির অনেক প্রতিশব্দ চালু করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এসব প্রতিশব্দ সহজ উচ্চরিত ও সহজবোধ্য নয়। কাজেই বেশির ভাগ প্রতিশব্দেরই কোনো ব্যবহার নেই। এদিকটার প্রতি লক্ষ রেখে প্রতিশব্দের প্রচলনে বাংলা একাডেমিকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। এ-জন্য গবেষণা ও ভাষার উৎকর্ষ সাধনে সরকারকে বাংলা একাডেমির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, বাংলা যেমন ইংরেজির দ্বারা, তেমনি হিন্দির দ্বারাও আক্রান্ত। জনমনে সচেতনতা সৃষ্টি এবং মাতৃভাষার জন্য গর্ববোধ জাগ্রত করতে হবে। এবারের একুশে, এটাই হোক আমাদের ঐকান্তিক কামনা।