মাসুদ পথিক : বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। প্রকৃতই, বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের অগ্রসৈনিক। সংগঠনটির ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিরিখ করার পূর্বে সম্প্রতি সময়ের কিছু ঘটনাপ্রবাহ পরখ করব। সম্প্রতি সময়গুলোতে কিছুটা নেতিবাচক নিউজের পাশ কাটিয়ে ছাত্রলীগ ইতিবাচক বিষয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। রিয়্যালি, মিডিয়া প্রপাগাণ্ডার বাইরে গিয়ে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কৃতিত্ব সম্প্রতি সময়ে অনেক। প্রি-পারসেপ্টশনের পাশ কাটিয়ে একটু খেয়াল করলেই দেখতে পাই বর্তমান সময়ে করোনার এই মহামারিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। দেশের মানুষের মঙ্গলের জন্য অকাতরে পরিশ্রম করে গেছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। করোনা পেন্ডামিকে নিপীড়িত মানুষকে সুরক্ষিত রাখার জন্য রাজধানী ঢাকাসহ দেশব্যাপী ছাত্রলীগ প্রায় ৪ লাখ ৬৮ হাজার বান্ডেল হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও ৬ লাখ ৪৭ হাজার মাস্ক বিতরণ করেছে। সারাদেশে নেতাকর্মীরা নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন জীবাণুনাশকসামগ্রী বিতরণ করেন।
তাছাড়া ভাসমান মানুষ, পথশিশুসহ প্রায় ৪ লাখ ৫৬ হাজার মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের জন্য খাদ্যসামগ্রী ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ঈদ উপহার হিসেবে বিতরণ করা হয়। বিভিন্ন স্থানে চালু করা হয় হ্যালো ছাত্রলীগ সেবা অ্যাপ। ‘হ্যালো ছাত্রলীগ’ সেবার মাধ্যমে দেশব্যাপী প্রায় ২ লাখ ৯২ হাজার মানুষ বিভিন্নভাবে সহায়তা পেয়েছে। মানবিক সহায়তা হিসেবে শিশুদের মাঝে শিশু খাদ্য বিতরণ করা হয়। পাশাপাশি সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মাঝে মৌসুমি ফল, খাবার, মাস্ক ও বোতলজাত হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণ করা হয়েছে। দেশব্যাপী প্রায় ১৮ হাজার ৫৫০ জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের মাঝে মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করে। প্রায় ২২ হাজার মানুষ টেলিমেডিসিন সেবা পেয়েছে এবং দেশব্যাপী প্রায় ৭৭ জনকে প্লাজমা দান করেছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। পাশাপাশি রক্তদান কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় ৫৬টি ডিজইনফেকশন চেম্বার ও ১২০টি বুথ স্থাপন করেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃতপ্রায় ৬০ জনকে দাফন করেছে।
ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত ২৫ জেলার বিভিন্ন এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ, রাস্তা, ব্রিজ-কালভার্ট মেরামতসহ প্রায় ৪ লক্ষাধিক মানুষকে ত্রাণ সহায়তা দিয়েছে ছাত্রলীগ। দেশব্যাপী কৃষকের প্রায় ৯৬ হাজার শতাংশ জমির ফসল কাটায় সহযোগিতা করে। সারাদেশে অসহায় কৃষকদের ১ লাখ ২৮ হাজার কেজি উন্নতমানের ফসলের বীজ বিতরণ করা হয়। শ্রমিক সংকট থাকা উপকূলীয় অঞ্চলের লবণ চাষি ও ভুট্টা চাষিদের পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে ছাত্রলীগ। করোনায় ছাত্রলীগের ফ্রি সবজি বাজার থেকে অসহায় মানুষ সম্পূর্ণ বিনামূল্যে তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহের উন্মুক্ত সুযোগ পেয়েছে। ফ্রি সবজি বাজার থেকে দেশব্যাপী প্রায় ৬২ হাজার মানুষ উপকৃত হয়েছে। সো, ছাত্রলীগ সব সময় শিক্ষা ও শান্তির লক্ষ্যে কাজ করে এসেছে। কাজ করে চলেছে। ছাত্রলীগ। শিক্ষা, শান্তি ও প্রগতির পতাকাবাহী সংগঠন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া ছাত্রলীগ, এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ ছাত্র-সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। প্রতিষ্ঠার ৭৩ বছর অতিক্রম করল।
হ্যাঁ, ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি সময়ের দাবিতেই বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রতিষ্ঠালগ্নে নাইমউদ্দিন আহম্মেদকে আহ্বায়ক করে ১৪ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। পরের বছর ৫ সেপ্টেম্বর আরমানিটোলায় ছাত্রলীগের প্রথম সম্মেলনে দবিরুল ইসলাম সভাপতি ও খালেক নেওয়াজ খান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
জন্মের প্রথম লগ্ন থেকেই ভাষার অধিকার, শিক্ষার অধিকার, বাঙালির স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা, দুঃশাসনের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান, সর্বোপরি স্বাধীনতা ও স্বাধিকার আন্দোলনের সাত দশকের সবচেয়ে সফল সাহসী সারথি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে আন্দোলন জোরালো করার ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
১৯৬২ সালে তৎকালীন আইয়ুব খান সরকার কর্তৃক গঠিত শরিফ কমিশন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর লক্ষ্য ও স্বার্থের অনুকূলে একটি গণবিরোধী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছিল। সেই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা গণ-আন্দোলন ও গণজাগরণ তৈরি করে। সেই ’৬২-র রক্তঝরা দিনগুলোতে রক্ত ঝরেছে অসংখ্য ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর।
১৯৬৬ সালে বাঙালির স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার সনদ ৬-দফা বাস্তবায়নে শেখ মুজিবুর রহমান আস্থা রেখেছিলেন তরুণ ছাত্রনেতাদের ওপর। ৬-দফা নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে বিভেদ ছিল। তিনি সে-সময়কার ছাত্র নেতাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, জেলায় জেলায় অবস্থান সুদৃঢ় করে ৬-দফার স্বপক্ষে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সারাবাংলার মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত ৬-দফা দাবির গুরুত্ব তুলে ধরেন। বঙ্গবন্ধুর ৬-দফার পক্ষে ছাত্রলীগের শক্ত অবস্থানের কারণে শেষ পর্যন্ত এ প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। ১৯৬৯ সালে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে বাংলার ছাত্র-সমাজ সারাদেশে দুর্বার গণ-আন্দোলন গড়ে তোলে, যা গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। তৎকালীন ছাত্রলীগ বাংলার ছাত্র-সমাজের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেন।
১৯৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বের সর্ববৃহৎ ছাত্র-সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। গৌরব, ঐতিহ্য, সংগ্রাম ও সাফল্যের দীর্ঘ পথচলায় ছাত্রলীগ হারিয়েছে তার সহস্র্রাধিক নেতাকর্মীকে। ১৯৭১ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের পর ছাত্রলীগের নেতৃত্বে সারাবাংলার ছাত্র-সমাজ সুসংগঠিত হতে থাকে। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন এবং পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি হলেন। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিল।
যখন বাঙালি জাতি, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছিল, ঠিক তখনই বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রটিকে নিভিয়ে দিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা বিরোধীচক্র আঘাত করে। ১৯৮১ সালে প্রত্যাবর্তন করলেন আমাদের প্রাণের নেত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনা। সেদিন প্রিয় নেত্রীর পাশে ভ্যানগার্ডের ভূমিকায় ছিল বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
সময়ের প্রয়োজনে সামরিক শাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ১৯৮৩ সালে শিক্ষা আন্দোলন ও সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের ১০-দফা তৈরিতে নেতৃত্ব দেয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। শিক্ষার অধিকার প্রসারে শামসুল হক ও অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর কমিশনের রিপোর্ট তৈরিতে ছাত্র-সমাজের পক্ষে জোরালো অবস্থান নেয় ছাত্রলীগ।
দেন ১৬ কোটি বাঙালির প্রাণের স্পন্দন, বিশ্বশান্তির অগ্রদূত, মাদার অব হিউম্যানিটি দেশরতœ শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার ক্ষতি মোকাবিলায় পালন করেছে অগ্রণী ভূমিকা। সে-সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে দিনে তিনবেলা নিজ হাতে রুটি তৈরি করেছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
সারারাত জেগে প্রস্তুত করেছেন খাবার স্যালাইন। সেগুলো পৌঁছে দেওয়া হয়েছে দুর্গম এলাকার মানুষের কাছে। ১৯৯৮ সালের বন্যাসহ সব প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ একই কার্যক্রম নিয়ে বিপর্যস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। ১৯৯৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র বেতন বৃদ্ধির প্রতিবাদে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল ছাত্রলীগ।
বিএনপি-জামাত (২০০১-০৬) জোট সরকারের আমলেও ছাত্রলীগের অগণিত নেতাকর্মীরা জেল-জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছে। বিশেষ করে ২০০২ সালের ২৩ জুলাই বিএনপির পেটোয়া পুলিশ বাহিনী ও ছাত্রদলের ক্যাডাররা গভীর রাতে শামসুন্নাহার হলে ঢুকে ছাত্রীদের শারীরিকভাবে নির্যাতন করে। ছাত্রলীগ সেদিন শামসুন্নাহার হলের ছাত্রীদের সম্ভ্রমহানির হাত থেকে রক্ষা করে ও দোষীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে।
২০০৭ সালের ১৬ জুলাই বিতর্কিত সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে আটক আমাদের প্রিয় নেত্রীর মুক্তি আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরে প্রতিবাদ মিছিল করেছিল। এবং সারাদেশে জনমত গঠন ও গড়ে তুলেছিল তীব্র প্রতিবাদ।
তো, বাঙালির নিকট আস্থা ভরসা ও ভালোবাসার প্রতীক বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। প্রতিষ্ঠার ৭৩ বছর ও ৭৪-এ পদার্পণ শুভ ও সুখকর হোক ছাত্রলীগের পথচলা। নতুন বছরে নতুন আঙ্গিকে বিনির্মাণ হোক বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। পূর্বের ন্যায় আগামীতেও দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যে সব সময় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অবদান হোক অভূতপূর্ব। দেশ ও জনগণের কল্যাণের লক্ষ্যে শিক্ষা, শান্তি, প্রগতি- এই স্লোগানে এগিয়ে যাক বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
তথাপি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ একটি দর্শনের নাম। ছাত্রলীগ ইতিহাসের নাম। ছাত্রলীগ স্বাধীনতার অগ্রসৈনিক। ছাত্রলীগ বাঙালির মনোজগতের কালপ্রবাহ। চৈতন্যের সারৎসার। মতাদর্শিক উদ্ভাস।
লেখক : সহ-সম্পাদক, উত্তরণ