“নচিকেতা, স্বাধীনতার নেশায় মত্ত তুমি হে অনিঃশেষ
তোমার ডাকেই মুক্তি তুমিই বাংলাদেশ।”
সম্পাদকের কথা: গভীর আবেগে, ভালোবাসায় ও শ্রদ্ধায় নানা বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের ভেতর দিয়ে পালিত হলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। একই সঙ্গে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতারও সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হলো পরম গৌরবে ও হৃদয়াবেগে।
সমস্ত জাতি তো বটেই, বিশেষ করে আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম, একটি জাতিসত্তার আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা এবং এক সাগর রক্তের বিনিময়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশগ্রহণ করার বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী।
জাতীয়তাবোধ বা জাতি-চেতনা, স্বাধীন রাষ্ট্র-চেতনা একটি আধুনিক ধারণা। তবে মধ্যযুগেও এক ধরনের জাতীয় চেতনার স্ফুরণ দেখা গেছে। এটা ছিল ভাষা ও এথনিসিটির স্বাতন্ত্র্যবোধ এবং গৌরববোধপ্রসূত। আবদুল হাকিমের বিস্ময়কর উচ্চারণ- “যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী, সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি। বাংলা ভাষার নিন্দুকদের প্রতি ঘৃণা ও ধিক্কার প্রকাশের সাথে সাথে প্রকাশ পেয়েছে মাতৃভাষা বাংলার প্রতি গভীর মমত্ববোধ। কিন্তু দেশ-ভাবনা, রাষ্ট্র-চেতনা তেমন সুস্পষ্টভাবে বিকশিত হয়নি। ১৭৫৭ সালে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয় এবং আমরা পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হই”Ñ বলে ধারণা চালু আছে, আধুনিক বিবেচনায় আদৌ তা সত্য নয়। প্রাচীন ও মধ্যযুগে কখনোই কোনো শাসক পরিবর্তনকে মানুষ স্বাধীনতা-পরাধীনতার মানদ-ে বিচার করেনি। বাংলায় কৈবর্ত্য বিদ্রোহকে আমরা মহিমান্বিত করি বটে, দিব্যকের শাসনামলকে গর্বের সাথে স্মরণ করি; কিন্তু এই পরিবর্তনকে কেউই স্বাধীনতার বা স্বতন্ত্র জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখে না। কেননা স্বাধীনতার নানা উপাদান থাকলেও ‘জাতি-রাষ্ট্র’ চেতনার স্ফুরণ তখনও হয়নি।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলেই ইউরোপীয় শিক্ষা-দীক্ষা ভারতীয় সভ্যতাকে ঢেলে সাজাতে সাহায্য করার পর এবং আধুনিক ধনতন্ত্র ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বিকাশের অনিবার্য ফল হিসেবে আধুনিক জাতীয়তাবাদী চেতনা এবং স্বাধীনতা ও রাষ্ট্র-চেতনা ভারতে নবজাগরণের সূচনা করে। এই নবজাগরণের তথা রেনেসাঁর সূচনা-ভূমি ছিল বাংলা। কাজেই বাংলায়ই ভাষার স্বাতন্ত্র্যবোধ, স্বদেশ-চেতনা এবং স্বাধীনতার চেতনা দেশপ্রেমের অনুষঙ্গ হিসেবে প্রকাশ পায়। কিন্তু, যে এলিট-শ্রেণি ও মধ্যবিত্ত স্বাধীনতা নিয়ে ভেবেছেন, তারা আচ্ছন্ন ছিলেন সর্বভারতীয় চেতনায়। জাতি-চেতনায় বাংলার জন্য গভীর মমত্ব প্রকাশ পেলেও তাদের মধ্যে বাঙালি স্বাতন্ত্র্যবোধ বা বাংলার স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের চেতনা ছিল না। ভারতীয়তা এবং ‘বন্দে মাতরম’ নিয়ে তাদের মতো সর্বভারতীয় জাতীয়তাবোধ ও স্বাধীনতার কথাই তাদের জীবনবেদ হয়ে দাঁড়ায়।
পক্ষান্তরে চল্লিশের দশকের বিভাজনের চিন্তা ও সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ, বাংলা ভাগ, পূর্ব বাংলায় ঔপনিবেশিক ধরনের শাসন, বাঙালির মনে নবতর জাতীয়তাবাদ ও রাষ্ট্রচিন্তার জন্ম দেয়।
বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে নতুন সেকুলার রাষ্ট্র-চেতনা। বাঙালির কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস এই প্রথম বাংলা ভাষাভাষীদের একটি স্বতন্ত্র জাতি-রাষ্ট্রের সুপ্ত আকাক্সক্ষাকে বাঙ্ময় করে তোলেন শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালি ইতিহাসের সকল সদর্থক ঐতিহ্যকে ধারণ করে শেখ মুজিব একটি নতুন জাতি-রাষ্ট্রের চিন্তাকে যেমন মানুষের মধ্যে রোপণ করেন এবং তিনিই এই চিন্তাধারাকে ‘বাংলাদেশ’ নামক জাতি-রাষ্ট্রের অবয়ব দান করেন। তিনি কেবল বঙ্গবন্ধু নন, তিনি জাতি-রাষ্ট্রের জনক মহামানব। তাই বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ একটি অভিন্ন চৈতন্য, একে অপরের পরিপূরক।
বাঙালি তাই যেমন সশ্রদ্ধচিত্তে প্রায় দেড় বছরব্যাপী বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করেছে। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ তাই অভিন্ন সত্তায় আমাদের চেতনায় ও আমাদের ইতিহাসে সতত বিরাজ করবে। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।