- সম্পাদকের কথা
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট শেখ মুজিব কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে তার সহকর্মীদের বলেছিলেন, “যে-পাকিস্তান গঠিত হয়েছে, তাতে ঔপনিবেশিকতার শেষ হয়নি; বরং পূর্ববঙ্গের মানুষ নতুন শৃঙ্খলে আবদ্ধ হতে চলেছে। এটা মানা যায় না। আমাদের নতুন করে সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে।” ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা এবং ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা বাঙালির জাতীয় জাগরণ এবং আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। বাঙালির একটি নিজস্ব জাতি-রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্য থেকেই বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর এই রাষ্ট্রচিন্তা আকস্মিক ছিল না। তেমনি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল গঠনের চিন্তাও আকস্মিক ছিল না।
পরবর্তীতে ভাষা সংগ্রামের পথ বেয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়Ñ আওয়ামী লীগের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গৌরবগাথা; বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। আওয়ামী লীগের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ তৎকালীন পূর্ব বাংলা তথা পাকিস্তানের রাজনীতির দৃশ্যপট বদলেরও সূচনালগ্ন হিসেবে চিহ্নিত। আওয়ামী লীগের জন্ম ছিল পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক ধরনের শাসন-শোষণ এবং মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক-স্বৈরতান্ত্রিক রাজনীতির অবসানের অনিবার্যতার ফল।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় কেবল নয়, একটি আত্মমর্যাদাশীল অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক এবং উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলাই ছিল আওয়ামী লীগের অঙ্গীকার। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং জাতীয় চার নেতাÑ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামান তাদের জীবন দিয়ে সেই অঙ্গীকারের মূল্য পরিশোধ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির প্রতিশোধ গ্রহণের সেই ষড়যন্ত্র ’৭৫-এর ট্র্যাজেডি সৃষ্টি করে। তা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু-কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতির পিতার অঙ্গীকার ও স্বপ্ন জয়ের পথে অকুতোভয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন মধ্য আয়ের দেশ। জাতির পিতার জন্মশতবর্ষে আওয়ামী লীগ ৭৩ বছরের গৌরব ও সাফল্যের জয়গানে মুখরিত হয়েছে। ২০২১ সালেই বিপুল আয়োজন-উদযাপনে পালিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। ইতিহাস প্রমাণ করেছে, আওয়ামী লীগের জন্ম এবং সংগ্রাম ও নেতৃত্ব ছাড়া ‘বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্রের অস্তিত্ব যেমন সম্ভব ছিল না, তেমনি এ অঞ্চলের মানুষের সুখী সুন্দর জীবনের স্বপ্নও কোনোদিন পূরণ হতো না। উন্নয়ন অগ্রগতিতে শিখরে ওঠা বদলে যাওয়া বাংলাদেশ কথা ভাবা যেত না।
দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মুখপত্র ‘উত্তরণ’-এর চলতি সংখ্যায় বেশ কয়েকটি তথ্যবহুল প্রবন্ধ সাজানো হয়েছে। গণতন্ত্র, ভাষা সংগ্রাম, স্বাধিকার আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়, মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর জাতীয় পুনর্গঠন, বঙ্গবন্ধু-কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়নের মহাসড়কে উত্তরণ, দারিদ্র্য বিমোচন, দেশকে মধ্যম আয়ের দেশ তথা উন্নয়নশীল দেশে পরিণত করা, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলা, নারীর ক্ষমতায়ন, সমুদ্র বিজয়, মহাকাশে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ, খাদ্যে আত্মনির্ভরশীলতা, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ২১ হাজার মেগাওয়াটের লক্ষ্য অর্জন, নিজস্ব অর্থে পদ্মাসেতু নির্মাণ, ঢাকা মেট্রোরেল, চট্টগ্রামে কর্ণফুলি নদীতে সুড়ঙ্গ পথ, পায়রা সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, ঈশ্বরদীতে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, সফলভাবে কোভিড মহামারি মোকাবিলা ও দ্রুত সময়ে টিকাদান সম্পন্ন এবং ক্রিকেটে আন্তর্জাতিক মান অর্জন প্রভৃতির উল্লেখ করলেও আওয়ামী লীগের অর্জনের কথা শেষ হবে না। বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা নেতৃবৃন্দের স্মৃতির প্রতি নিবেদন করছি নমিত শ্রদ্ধাঞ্জলি। এমন দিনে সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করি আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শামছুল হক-এর মহান স্মৃতি। ভাষা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লক্ষ শহিদের আত্মদানের কথা স্মরণ করার পাশাপাশি আমরা স্মরণ করি সেসব অকুতোভয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর কথাÑ যাদের আত্মদান, ত্যাগ, শ্রম ও মেধার বিনিময়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দেশের সর্ববৃহৎ ও চির তরুণ দল হিসেবে গড়ে উঠেছে।
অভিনন্দন জানাই, গভীর সংকটকালে, নেতৃত্বের শূন্যতার বৈরী পরিবেশে জীবনকে বাজি রেখে যে নেত্রী ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন এবং আওয়ামী লীগকে জনসমর্থনপুষ্ট অপ্রতিদ্বন্দ্বী বৃহৎ দলে পরিণত করেছেন, সেই বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনাকে। আওয়ামী লীগের ৭৩ বছর সময়কালের ৪১ বছরই জননেত্রী শেখ হাসিনা দলটির হাল ধরে থেকেছেন এবং আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃত্বে বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে বর্তমানে অনন্য মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। বঙ্গবন্ধু যেমন জাতি-রাষ্ট্রের নির্মাতা তেমনি তারই কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন রূপায়ণের লক্ষ্যে গড়ে তুলছেন উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।
এই জুন মাসে যেমন আওয়ামী লীগ আত্মপ্রকাশ করেছিল, তেমনি এই জুন মাসেই বাঙালির আত্মমর্যাদা ও শিখরস্পর্শী উন্নয়নের প্রতীক হিসেবে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন।
আজকের দিনে দেশবাসীর ঐকান্তিক কামনা- শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ও আওয়ামী লীগের জয়যাত্রা অব্যাহত থাকুক। আমরা শুধু একটি কথাই বলব, বঙ্গবন্ধু-কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সুখে-দুঃখে বিপদে-আপদে সর্বদা দেশবাসীর পাশে আছে এবং থাকবে। অপ্রতিরোধ্য আওয়ামী লীগ কেবল অতীত বর্তমান নয়, বাংলাদেশের ভবিষ্যতের নির্মাতা। আওয়ামী লীগ চিরজীবী হোক।