Sunday, September 24, 2023
বাড়িইতিহাসবাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৭১ বছরে অর্জন

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৭১ বছরে অর্জন

ড. এম আবদুল আলীম

এক
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এ বছর একাত্তর বছর পূর্ণ করল। একাত্তর সংখ্যাটি আওয়ামী লীগের জন্য খুবই গৌরব ও অহঙ্কারের। কারণ ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগ তথা এ রাজনৈতিক দলের সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার মানুষ সহস্র বছরের পরাধীনতার অভিশাপ থেকে মুক্তিলাভ করে এবং একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এদেশের অন্যতম পুরনো, ঐতিহ্যবাহী, সর্ববৃহৎ, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের নেতা-কর্মীদের কনভেনশনে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরুতে এ রাজনৈতিক দলের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। প্রতিষ্ঠালগ্নে এ রাজনৈতিক দলের ৪০ সদস্যবিশিষ্ট অর্গানাইজিং কমিটির মধ্যে যারা ছিলেন তাদের অন্যতম হলেনÑ মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সভাপতি; আতাউর রহমান খান অ্যাডভোকেট, সহ-সভাপতি; সাখাওয়াত হোসেন, প্রেসিডেন্ট, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স, সহ-সভাপতি; আলী আহমদ খান, এমএলএ, সহ-সভাপতি; আলী আমজাদ খান, অ্যাডভোকেট, সহ-সভাপতি; আবদুস সালাম খান, অ্যাডভোকেট, সহ-সভাপতি; শামসুল হক, সাধারণ সম্পাদক; শেখ মুজিবুর রহমান, যুগ্ম সম্পাদক; খন্দকার মোশতাক আহমদ, সহ-সম্পাদক; একেএম রফিকুল হোসেন, সহ-সম্পাদক; ইয়ার মোহাম্মদ খান, কোষাধ্যক্ষ। জন্মের পর থেকেই আওয়ামী লীগ এ অঞ্চলের জনগণের পক্ষে কাজ করে এবং ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে পালন করে ঐতিহাসিক ভূমিকা। বস্তুত, এ অঞ্চলের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের জন্ম ও উত্থান ‘একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক’। দলটি প্রথম থেকেই ‘সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা’র মূল্যবোধ লালন করেছে। ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে পূর্ববঙ্গের মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির তীব্র আকাক্সক্ষা থেকেই এ রাজনৈতিক দল জন্মলাভ করে এবং ক্রমে ব্যাপক জনপ্রিয় সংগঠনে পরিণত হয়। ভাষা-আন্দোলন, স্বাধিকার-সংগ্রাম এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ পালন করে ঐতিহাসিক ভূমিকা।

দুই
জন্মলগ্ন থেকে মুসলিম লীগ সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আন্দোলনে অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বদান করলেও ভাষা-আন্দোলনের মাধ্যমে এ রাজনৈতিক দল শক্ত জনভিত্তি গড়ে তোলে। প্রতিষ্ঠালগ্নে আওয়ামী মুসলিম লীগ তার ঘোষণাপত্রে মাতৃভাষা বাংলাকে শিক্ষার বাহন হিসেবে প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণের দাবি তোলে। ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলন প্রচ- রূপ ধারণ করলে এ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা তাতে অংশগ্রহণ করেন এবং সরকারি জুলুম-নির্যাতনের শিকার হন। ভাষা-আন্দোলন সমকালীন সরকারবিরোধী প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং এর নেতাকর্মীরা ভাষা-আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করলেও ছাত্ররা যখন ১৪৪ ধারা ভেঙে রাজপথে নামে তখন আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ তা সমর্থন করেন এবং আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কেবল ভাষা-আন্দোলন সফল করার ক্ষেত্রেই নয়; বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা এবং একুশের চেতনা লালন ও বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ পালন করেন অগ্রণী ভূমিকা।
ভাষা-আন্দোলনে আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সহ-সভাপতি আতাউর রহমান খান, সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক, যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান, কেন্দ্রীয় নেতা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, খয়রাত হোসেন, বেগম আনোয়ারা খাতুন, আলী আহমদ খান, আলমাস আলী, আবদুল আওয়ালসহ অনেক নেতা মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ধর্মঘট পালন করতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হন এবং কারাভোগ করেন। বস্তুত ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্বে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ’৫২-র ভাষা-আন্দোলনে কারাবন্দি অবস্থায় তিনি ছাত্রনেতাদের নির্দেশনা দেন। তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ এবং পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদনে এর সুনির্দিষ্ট বিবরণ পাওয়া যায়। একুশে ফেব্রুয়ারির মূল কর্মসূচিতে যেসব দাবি উত্থাপন করা হয়, তাতে সুনির্দিষ্টভাবে যুক্ত করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানের ‘আশুমুক্তির দাবি’। ভাষা-আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন শেখ মুজিবুর রহমান এবং মহিউদ্দিন আহমেদ কারাগারে অনশন শুরু করলে ভাষা-আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি হতাকা-ের প্রতিবাদে মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, শামসুদ্দীন আহমদসহ পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের অনেক সদস্য মুসলিম লীগ ত্যাগ করে গঠন করেন আওয়ামী মুসলিম লীগের পার্লামেন্টারি পার্টি। ’৫২-র ২৭ ফেব্রুয়ারি কারামুক্ত হয়ে শেখ মুজিবুর রহমান একুশে ফেব্রুয়ারি হত্যাকা-ের তীব্র নিন্দা জানান এবং শহিদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ৭ মার্চ পর্যন্ত ভাষা-আন্দোলনের অধিকাংশ নেতা গ্রেফতার হলে আওয়ামী মুসলিম লীগের সহ-সভাপতি আতাউর রহমান খানকে আহ্বায়ক করে পুনর্গঠন করা হয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। ২৭ এপ্রিল তার সভাপতিত্বে ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে জেলা ও মহকুমা প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে আয়োজন করা হয় ভাষা-সম্মেলন। এতে আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেকেই বক্তৃতা করেন। ১৯৫২ সালের মে-জুন মাসে শেখ মুজিব করাচি গিয়ে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে দেখা করে রাজবন্দিদের মুক্তি ও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি তুলে ধরে স্মারকলিপি প্রদান করেন। এরপর লাহোরে গিয়ে তিনি সাংবাদিক-সম্মেলন আয়োজন করে পশ্চিম পাকিস্তানিদের কাছে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। শুধু তাই নয়, তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার কাছ থেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে বিবৃতি আদায় করেন। এখানেই শেষ নয়, ১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে চীন শান্তি সম্মেলনে গিয়ে তিনি বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে এ ভাষাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেন। ভাষা-আন্দোলনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ১৯৫৩ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারি ‘শহিদ দিবস’ পালনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ। ঢাকার বাইরের ভাষা-আন্দোলনকে গণ-আন্দোলনে রূপদান করার ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন এ দলের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। এভাবে আওয়ামী মুসলিম লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার জয়ধ্বজা উচ্চে তুলে ধরে এবং পূর্ববঙ্গের মানুষের চেতনায় বপন করে স্বাধীনতার বীজমন্ত্র।

তিন
ভাষা-আন্দোলনের পথ ধরে আসা ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের নিরঙ্কুশ বিজয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে এবং সরকার গঠনে পালন করে সক্রিয় ভূমিকা। ’৫৪-র নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। এর আগে নির্বাচনে নিজেদের করণীয় ঠিক করতে এবং নতুন নেতৃত্ব গড়ে তুলতে ১৯৫৩ সালের ১৪ নভেম্বর ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত দলের কাউন্সিলে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি এবং শেখ মুজিবুর রহমান দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। নির্বাচন ঘনিয়ে এলে ১৯৫৩ সালের ১১ ডিসেম্বর ময়মনসিংহে আয়োজিত বিশেষ কাউন্সিলে এ রাজনৈতিক দল পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও গণতন্ত্রের দাবি সংবলিত ২১-দফা কর্মসূচি প্রণয়ন করে, যা যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইস্তাহার রূপে গৃহীত হয়। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখের নেতৃত্বে গঠিত নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে জনগণ ঐতিহাসিক রায় দেয়। এর ফলে পূর্ববঙ্গের মাটিতে মুসলিম লীগের কবর রচিত হয়। ১৯৫৪ সালের ২০ মার্চ অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে ৩০৯ আসনের প্রাদেশিক পরিষদে ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট লাভ করে ২২৩টি আসন। যুক্তফ্রন্টের প্রাপ্ত ২২৩টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ লাভ করে ১৪৩টি আসন। এ নির্বাচনে আওয়ামী মুসলিম লীগ পালন করে নিয়ামক ভূমিকা এবং পূর্ববঙ্গের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। দলের সেক্রেটারি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান যুক্তফ্রন্টের বিজয়ে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন এবং হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর পরেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে তিনি টুঙ্গিপাড়া এলাকা থেকে মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা ওয়াহিদুজ্জামানকে পরাজিত করে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার কনিষ্ঠতম সদস্য হিসেবে কৃষি ঋণ সমবায় ও পল্লি উন্নয়ন মন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তবে ১৯৫৪ সালের ৩০ মে ৯২(ক) ধারা জারি করে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়া হয় এবং শেখ মুজিসহ অনেক নেতাকে গ্রেফতার করে কারাবন্দি করা হয়।
যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়ার পর ষড়যন্ত্রের রাজনীতি ও দুঃশাসনের নতুন পথে এ অঞ্চলের মানুষের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৫৫ সালে বগুড়ার মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হয় এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আইনমন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন। সোহরাওয়ার্দীর এ সিদ্ধান্তে আওয়ামী লীগে চরম অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। এর মধ্যেই ১৯৫৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ঢাকার সদরঘাটের রূপমহল সিনেমা হলে আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। এবারও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি এবং শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এদিকে দ্বিতীয় গণপরিষদ নির্বাচনে পূর্ববঙ্গের ৩১টি মুসলিম আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ লাভ করে ১৩টি আসন। এ সময় চরম অন্তর্দলীয় কোন্দলে যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যায়। ১৯৫৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান এবার দায়িত্ব পান শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম ও দুর্নীতি দমন মন্ত্রীর। আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির আগ পর্যন্ত অর্থাৎ, ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত এ মন্ত্রিসভা বহাল ছিল। ১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে পাকিস্তানের কেন্দ্রে কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। তবে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কারণে এ মন্ত্রিসভা বেশিদিন দায়িত্ব পালন করতে পারেনি, ১৯৫৭ সালের ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত ছিল এর আয়ুষ্কাল। পাকিস্তান আমলে আওয়ামী লীগের এই শাসনামল স্বল্পকালের হলেও এ সময় সৃষ্টি হয়েছিল একটি উদার গণতান্ত্রিক পরিবেশ। একই সঙ্গে মন্ত্রী ও দলীয় পদে থাকার বিধান গঠনতন্ত্রে না থাকায় এই সময় শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করে শুধু দলীয় সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এটি একটি অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদাদান, ২১ ফেব্রুয়ারি ‘শহিদ দিবস’ ও সরকারি ছুটি ঘোষণা এবং শহিদ মিনার নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এছাড়া বাংলা একাডেমির আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু; এফডিসি, জুট মার্কেটিং কর্পোরেশন, ওয়াপদা গঠন, ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানা নির্মাণ, সাভার ডেয়ারি ফার্মের সূচনা, স্থায়ী শিল্প ট্রাইব্যুনাল গঠন, প্রথম প্ল্যানিং কমিশন গঠন, শিক্ষা সংস্কার কমিটি গঠন, লেবার রেজিস্ট্রেশন আইন পাস, ঢাকা-আরিচা জাতীয় সড়ক নির্মাণ, কক্সবাজার পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন, কৃষি ঋণের সার্টিফিকেট প্রথা বাতিল, রমনা পার্ক স্থাপন, উচ্চ ফলনশীল ধান উদ্ভাবন, পাওয়ার পাম্পে সেচ ব্যবস্থা চালু, ময়মনসিংহে পশু চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন এবং সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়।
১৯৫৭ সালের ৭ এবং ৮ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের কাগমারীতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের বিশেষ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এতে সোহরাওয়ার্দী এবং ভাসানীর অনুসারীদের নানা বিষয়ে মতপার্থক্য প্রকাশ্যে চলে আসে, যার পরিণামে মওলানা ভাসানী দল থেকে পদত্যাগ করেন। শুধু তাই নয়, তিনি ১৯৫৭ সালের ২৫ ও ২৬ জুলাই ঢাকায় একটি গণতান্ত্রিক কনভেনশন আয়োজন করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ভাসানী নতুন দল গঠন করায় মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নিযুক্ত হন।

চার
১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সামরিক শাসন জারি করে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা সংবিধান বাতিল, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা বাতিল, রাজনৈতিক দল ও তাদের কর্মকা- নিষিদ্ধ করেন। শুধু তাই নয়, তিনি এবডো, প্রোডো প্রভৃতি কালাকানুন জারি করে অনেক রাজনীতিবিদকে রাজনীতি ও নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করেন। গ্রেফতার করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানসহ অগণিত রাজনীতিবিদকে। এর অল্পদিনের মধ্যে অর্থাৎ, ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জাকে ক্ষমতাচ্যুত করে পাকিস্তানের মসনদে বসেন সেনাপ্রধান জেনারেল আইয়ুব খান। ক্ষমতায় বসেই আইয়ুব খান গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং আইনের শাসনের টুঁটি চেপে ধরেন। তিনি পূর্ববঙ্গের মানুষের ওপর চালান নির্যাতনের ভয়াবহ স্টিমরোলার। মুসলিম লীগের ধর্মীয় উন্মাদনার নীতি বিস্তার, পাকিস্তানের তথাকথিত এলিট-শ্রেণির স্বার্থ সংরক্ষণ এবং বাঙালির চিরায়ত সংস্কৃতি ও বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দেন। বাংলা ভাষা এবং বাঙালির সাহিত্য-সংস্কৃতির ওপর হন খড়গহস্ত। রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষ পালনে বিরোধিতা এবং রবীন্দ্রসংগীত প্রচারে আরোপ করেন নিষেধাজ্ঞা। এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশের মধ্যেই আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা সংগঠিত ও ছাত্র-সমাজের সঙ্গে একাত্ম্য হয়ে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে মাঠে নামেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ছাত্র নেতৃবৃন্দের সঙ্গে গোপনে দফায় দফায় বৈঠক করে কর্মপন্থা নির্ধারণ করেন। এ সময় ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন ঐক্যবদ্ধভাবে সামরিক শাসনের অবসান, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, রাজবন্দিদের মুক্তি, পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন, ছাত্রদের শিক্ষার অধিকার এবং কৃষক-শ্রমিকদের নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়। ঐ সময় পশ্চিম পাকিস্তানে রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করায় গ্রেফতার করা হয় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে। এর ফলে পূর্ববঙ্গের ছাত্র-সমাজের আন্দোলন কর্মসূচিতে নতুন গতি সঞ্চারিত হয়। ১৯৬২ সালের ১ মার্চ সামরিক ফরমান জারি করে আইয়ুব খান সংবিধান ঘোষণা করে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হন। তিনি ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নামে এক আজব গণতন্ত্র চালু করে গণভোট দেন এবং মৌলিক গণতন্ত্রীদের ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এরপর সামরিক শাসন প্রত্যাহার করলে রাজনৈতিক দলগুলোর পুনরুজ্জীবনের বাধা দূর হয়। ১৯৬২ সালের ২৪ জুন শেখ মুজিবসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ৯ নেতা এক যুক্ত বিবৃতি দেন, যা পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। ১৪ জুলাই আইয়ুব খান রাজনৈতিক দলবিধি ঘোষণা করেন, ১৯ আগস্ট সোহরাওয়ার্দী মুক্তিলাভ করেন। এর কিছুদিন পর তার উৎসাহে অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক দলগুলো ‘এনডিএফ’ নামে একটি ঐক্যবদ্ধ জোট গঠন করে। শুরু থেকেই আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ নেতা দেশের বিভিন্ন স্থানে গণসংযোগ ও জনসভা করে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলেন। ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আকস্মিক মৃত্যু হলে এনডিএফ-র কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় ১৯৬৪ সালের ২৫ এবং ২৬ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হয় এবং মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ও শেখ মুজিবুর রহমান দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পদে বহাল থাকেন। আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন বিরোধী নেতারা আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ প্রমুখের নেতৃত্বে এনডিএফ-এ রয়ে যান।
১৯৬৪ সালের ৬ এবং ৭ মার্চ ঢাকার হোটেল ইডেন প্রাঙ্গণে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় এবং মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ও শেখ মুজিবুর রহমান পুনরায় সভাপতি ও সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। এ বছর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আইয়ুব-বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সম্মিলিত বিরোধী দল গঠন করে। তারা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বোন মিস ফাতেমা জিন্নাহকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মনোনীত করে নির্বাচনে (নির্বাচন হয় ১৯৬৫ সালের ২ জানুয়ারি) অবতীর্ণ হলেও মৌলিক গণতন্ত্রী ব্যবস্থায় ভোটে তিনি পরাজিত হন। এ বছর ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা হয় এবং ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখে দাঁড়াও’ শিরোনামে দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির পক্ষ থেকে একটি লিফলেট প্রচার করা হয়। এ বছর ৬ সেপ্টেম্বর থেকে টানা ১৭ দিন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণ অরক্ষিত থাকে। এমন পরিবেশ-পারিপার্শ্বিকতায় শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের অপরাপর নেতৃবৃন্দ স্বাধিকারের প্রশ্নে দৃঢ়প্রত্যয়ী হন।

পাঁচ
আওয়ামী লীগের অর্জনের ইতিহাসে ১৯৬৬ সালটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সীমাহীন শোষণের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামরিক বৈষম্যের প্রতিকারে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান এ বছর ৬-দফা দাবি উত্থাপন করেন। ১৩ ফেব্রুয়ারি দলের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ৬-দফা অনুমোদন করে নিয়ে তার পক্ষে ব্যাপক প্রচারাভিযান চালান। পূর্ব বাংলার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে গিয়ে তিনি সর্বস্তরের জনগণের কাছে ৬-দফার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। ২০ মার্চ পল্টন ময়দানের জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান আবেগময়ী ভাষায় ৬-দফা কর্মসূচি ব্যাখ্যা করে বলেন : “বাঙালি জাতির অস্তিত্বের জন্যই আমরা ৬-দফা প্রণয়ন করেছি।… আপনাদের কাছে আকুল আবেদন, আপনারা ৬-দফার কথা ঘরে ঘরে পৌঁছে দিন।” এভাবে একে একে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৩২টির মতো বিশাল জনসভা করে জাতীয় জাগরণ সৃষ্টি করেন। আন্দোলন থামাতে ৮ মে গ্রেফতার করা হয় শেখ মুজিবসহ অগণিত নেতাকর্মীকে। এমতাবস্থায় ৭ জুন কঠোর হরতাল পালিত হয় এবং সমস্ত পূর্ববঙ্গ অচল হয়ে পড়ে। আন্দোলন থামাতে এবং পূর্ব বাংলার মানুষকে স্তব্ধ করে দিতে সরকার সর্বশক্তি নিয়োগ করে। পুলিশের গুলিতে ১০ জন শহিদ হন। ১৫ আগস্ট গ্রেফতার করা হয় ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে এবং ১৬ আগস্ট নিষিদ্ধ করা হয় ‘দৈনিক ইত্তেফাক’। এমতাবস্থায় ১৯ আগস্ট অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন, যাতে সর্বসম্মতিক্রমে ৬-দফার প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করা হয়। ১৯৬৬ সালের ২৭ আগস্ট এবং ১৯৬৮ সালের ১৯ ও ২০ অক্টোবর আরেকটি কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়, যা দলের সাংগঠনিক কাঠামো দৃঢ় করে এবং নেতা-কর্মীদের চাঙ্গা রাখতে ভূমিকা রাখে। সার্বিকভাবে ৬-দফা কর্মসূচি জনগণ গ্রহণ করে এবং শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করে।
১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে কারাগরের মূল ফটক থেকে আবারও গ্রেফতার করা হয়। তার নামে দায়ের করা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এবং বন্দী করে রাখা হয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। এ মামলায় মোট আসামি ছিলেন ৩৫ জন। শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দির মুক্তির দাবিতে ১৯৬৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জে বিশাল বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয় এবং চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে আয়োজন করা হয় জনসভা। একইভাবে দেশের সর্বত্র প্রতিবাদ-মিছিল ও জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। একদিকে সরকার বিচারের নামে করে প্রহসন, অন্যদিকে মুক্তিকামী মানুষ সারাবাংলায় সৃষ্টি করে গণবিস্ফোরণ। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে ৬-দফার ভিত্তিতে ছাত্ররা ঘোষণা করে ১১-দফা কর্মসূচি। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এবং জনগণের দাবির মুখে ২২ ফেব্রুয়ারি সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে এবং শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানের মহাসমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এরপর গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও তা ব্যর্থ হয়। ২৫ মার্চ স্বৈরাচার আইয়ুব খানের পতন ঘটে। বস্তুত, ৬-দফাকে কেন্দ্র করে ১১-দফার পক্ষে গড়ে ওঠা গণজোয়ার শেষ পর্যন্ত গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয় এবং তার উত্তাল তরঙ্গে আইয়ুব খানের মসনদ খড়কুটোর মতো ভেসে যায়। আইয়ুব খানের পতনের পর ক্ষমতায় বসে ইয়াহিয়া খান। তিনি সার্বজনীন ভোটাধিকারের দাবি মেনে নিয়ে ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করেন। ঐ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ লাভ করে ঐতিহাসিক বিজয়।

ছয়
আওয়ামী লীগের ৭১ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ও গুরুত্ববহ বছর ১৯৭১ সাল। ’৭০-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পরও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যখন ক্ষমতা হস্তান্তর না করে তালবাহানা শুরু করলে, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলার সকল প্রান্তে সেøাগান ওঠে ‘জয় বাংলা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘জাগো জাগো, বাঙালি জাগো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি’ প্রভৃতি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পাড়া-মহল্লায় সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলতে বলেন এবং পূর্ব বাংলার সর্বস্তরের মানুষকে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলে যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলার আহ্বান জানান। তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন : “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” এ সময় পাকিস্তানি সামরিক জান্তা আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে এবং গোপনে সৈন্য সমাবেশ করে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে নির্মম গণহত্যা শুরু করে। গ্রেফতার করা হয় বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। গ্রেফতারের পূর্বমুহূর্তে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এ ঘোষণা চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়। এরপর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ১০ এপ্রিল আওয়ামী নেতৃবৃন্দ গঠন করেন ‘মুজিবনগর সরকার’। এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী এবং এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান ও খন্দকার মোশতাক আহমেদকে নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন এই ‘মুজিবনগর সরকারে’র নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহিদ হন এবং ২ লাখ মা-বোন সম্ভ্রম হারান। অবশেষে আসে বিজয়ের আনন্দঘন মুহূর্তে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত বঙ্গবন্ধুর সরকার যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করে। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে মাটিতে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু সুদৃঢ়ভাবে স্বাধীন দেশের হাল ধরেন। তিনি রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে দেশকে অগ্রগতির পথে নিয়ে যান। পূর্ণাঙ্গ সরকার ব্যবস্থা গড়ে তোলার পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধান প্রণয়ন, অবকাঠামো নির্মাণ, কল-কারখানা স্থাপন, উদ্বাস্তু পুনর্বাসন, সশস্ত্র বাহিনী গঠন, শিল্প-ব্যাংক-বীমা জাতীয়করণ, খাজনা মওকুফ, শিক্ষা কমিশন গঠন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুসহ কূটনৈতিক ক্ষেত্রে অসামান্য সাফল্য অর্জন করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারীরা দেশের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করতে এবং ইতিহাসের চাকা উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে আওয়ামী লীগতে ক্ষমতাচ্যুত করে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে চিরতরে এদেশের মাটি থেকে নিশ্চিহ্ন করা এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত করতে ৩ নভেম্বর জেলের অভ্যন্তরে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ চার সহচর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামানকে। এরপর সামরিক স্বৈরাচারদের অপশাসনে দেশের বুকে নেমে আসে ঘোর অমানিশা।
বঙ্গবন্ধু ও তার সহচরদের হত্যাকা-ের ফলে দেশের ব্যাপক ক্ষতি এবং আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা অবর্ণনীয় অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হলেও ষড়যন্ত্রকারীদের আশা শেষ পর্যন্ত পূরণ হয়নি। আওয়ামী লীগ নতুনভাবে জেগে উঠে তাদের স্বপ্ন বানচাল করে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে এসে আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং জনগণের ভাত ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রামে রাজপথে নামেন। দীর্ঘ সংগ্রামের পর তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে ১৯৯৬ সালে। ওয়ান-ইলেভেনোত্তর সরকার তাকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করতে নানাভাবে জুলুম চালায়। কিন্তু অগণিত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও জনগণের জেগে ওঠার কারণে তাদের সে-অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় আসে এবং পরপর আরও দুবার নির্বাচনে জয়লাভ করে রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে দেশের উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতিতে পালন করছে অসামান্য দায়িত্ব। শেখ হাসিনার সরকার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধান, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, শিক্ষাক্ষেত্রে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ, নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার, নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, বিধবা নারী ও বয়স্কদের পুনর্বাসন, প্রতিবন্ধীসহ অনগ্রসর জনগোষ্ঠী কল্যাণ, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, জঙ্গি দমন ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিস্তার এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ও পদ্মাসেতু নির্মাণের মতো বৃহৎ প্রকল্প গ্রহণসহ নানা কর্মকা- পরিচালনা করে দেশকে উন্নতির পথে কয়েক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে। সর্বোপরি তার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগ দেশের মানুষের কল্যাণে ও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে নিরন্তর।
আওয়ামী লীগ যেহেতু বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনেছে এবং এ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো, ঐতিহ্যবাহী ও শক্তিশালী দল, সেহেতু এর প্রতি মানুষের প্রত্যাশা সীমাহীন। আমাদের বিশ্বাস আওয়ামী লীগ দেশবাসীর সকল প্রত্যাশা পূরণ করবে। এ রাজনৈতিক দল আরও শক্তিশালী হোক এবং দক্ষ ও সুশাসন দ্বারা বাংলাদেশকে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্র রূপে গড়ে তুলে এদেশের মানুষকে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার শক্তি-সাহস দান করুক। আওয়ামী লীগের ৭১ বর্ষপূর্তিতে এটাই প্রত্যাশা।

লেখক : ইতিহাস-ঐতিহ্যসন্ধানী গবেষক; সাবেক ডিন, কলা অনুষদ
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য