Wednesday, October 4, 2023
বাড়িনবম বর্ষ, দশম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর-২০১৯বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২১তম সম্মেলনকে ঘিরে প্রত্যাশা

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২১তম সম্মেলনকে ঘিরে প্রত্যাশা

২০২১ সালে দেশটি মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার কথা আছে। পদ্মাসেতুসহ শেষ হবে অনেক মেগা প্রকল্পের কাজ। চেষ্টা করা হোক এবারের কাউন্সিলে যারা দলের কাÐারি হিসেবে নির্বাচিত হবেন, তারা হবেন শেখ হাসিনার হাতে জন্ম নেওয়া নব আওয়ামী লীগের সেরা নির্বাহী কমিটি। তাদের হাত ধরেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে।

প্রফেসর আবদুল মান্নান:

২০ ও ২১ ডিসেম্বর দেশের বৃহত্তম ও অন্যতম ঐতিহাসিক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় কাউন্সিল। এই কাউন্সিলে আগামী তিন বছরের জন্য দলটির জাতীয় নির্বাহী কমিটি গঠন করা হবে। নানা কারণে এবারের কাউন্সিল ও কমিটি গঠন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর আগে দলটির বেশ কিছু অঙ্গসংগঠনের কমিটি গঠন করা হয়ে গেছে। এবারের কাউন্সিলকে ঘিরে দেশের মানুষের অনেক প্রত্যাশার মধ্যে আছে দলের নির্বাহী কমিটিতে যেন ক্লিন ইমেজের ও যাদের দলের প্রতি কমিটমেন্ট আছে তেমন ব্যক্তিদেরই জায়গা হওয়া উচিত। আওয়ামী লীগের ইতিহাস অনেক চড়াই-উৎরাইয়ের ইতিহাস, অনেক মানুষের ত্যাগ-তিতিক্ষার ইতিহাস। ১৯৪৯ সালে সময়ের বাঙালির স্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনে জন্ম নেওয়া দলটি এখন ৭০ বছর পার করছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একটি অমর কীর্তি হচ্ছে এই দলের নেতৃত্বেই বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে নিষিদ্ধ হয়েছে কয়েকবার, বিশেষ করে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সামরিক শাসকদের আমলে। ভাঙনের মুখে পড়েছে একাধিকবার। প্রথম বড় ভাঙনটি দেখা দেয় ১৯৫৭ সালে যখন দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী কাগমারি সম্মেলনে দল হতে বের হয়ে ন্যাপ গঠন করেন। ১৯৬৬ সালে তরুণ শেখ মুজিব বাঙালির মুক্তির সনদ ৬-দফা ঘোষণা করলে দলের তৎকালীন সভাপতি আবদুর রশিদ তর্কবাগিশ নিজের সমর্থক কয়েকজন সদস্যকে নিয়ে দল হতে বের হয়ে যান। এক সময় দলের এককালের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী দল হতে বের হয়ে নিজে একটি আওয়ামী লীগ গঠন করেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে না ফেরা পর্যন্ত দলটি অনেকটা ছত্রভঙ্গ অবস্থায় ছিল। আওয়ামী লীগের সেই দুর্দিনে দলের হাল ধরেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দীন। জিয়া ক্ষমতা দখল করে ১৯৭৭ সালে রাজনৈতিক দলের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে মহিউদ্দিন আহমেদ ও আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে পৃথক বাকশাল গঠন করে তারা আওয়ামী লীগ হতে বের হয়ে যান। ১৯৮১ সালে ছয় বছর নির্বাসনে থেকে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে শক্ত হাতে দলের হাল ধরলে তখন দলের অনেক নেতাই হতাশ হন। তাদের প্রত্যাশা ছিল শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি করা হলেও দলের আসল ক্ষমতা থাকবে তাদের হাতে। তাদের ধারণা ছিল আওয়ামী লীগের মতো এত বড় একটি রাজনৈতিক দল পরিচালনা করার মতো যেহেতু কোনো অভিজ্ঞতা শেখ হাসিনার নেই, সেহেতু দলের নিয়ন্ত্রক ভ‚মিকায় থাকবেন তারা। কিন্তু শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন তার অভিজ্ঞতা কম থাকতে পারে; কিন্তু জাতির পিতার কন্যা হিসেবে দলে পূর্ণ ক্ষমতা হাতে নেওয়ার মতো সাহস তার আছে।
শেখ হাসিনা সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি ঠিকই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে আবার পুনরুজ্জীবিতই করেন নি, দলকে দীর্ঘ ২১ বছর পর পুনরায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছেন, যা ছিল রাজনীতির ইতিহাসে এক বিস্ময়। এই মেয়াদসহ মোট চার মেয়াদে তিনি আওয়ামী লীগকে সরকার পরিচালনার দায়িত্বে রাখতে পেরেছেন। এই চার মেয়াদে তিনি বাংলাদেশকে নিয়ে গেছেন এক অন্য উচ্চতায়। এত দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা নিঃসন্দেহে আনন্দের ও কৃতিত্বের। তবে এ-মুহূর্তে দলের বা সরকারের সামনে কোনো প্রতিপক্ষ না থাকাতে দলকে আরও কার্যকর ও সক্রিয় করার এখনই সময়। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার বড় বিপদ হচ্ছে দলে বানে ভাসা খড়কুটার মতো অনেক আগাছা-পরগাছা ঢুকে পড়ে, যেমনটি বর্তমান সময়ের আওয়ামী লীগে পরিলক্ষিত হচ্ছে। এতে দল দুর্বল হতে বাধ্য আর একবার দল দুর্বল হয়ে গেলে তাকে আবার টেনে তোলা সহজ নয়। আর টেনে তুলবেন তেমন আর একজন শেখ হাসিনা তো দেখা যাচ্ছে না। একটি ক্রিয়াশীল ও দক্ষ দল না থাকলে সংগঠন তার অবস্থান ধরে রাখতে পারে না। এই সত্যটি বঙ্গবন্ধু বুঝতেন বলেই তিনি মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দলের সাধারণ সম্পাদক হওয়াটাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হলে দলের সভাপতির দায়িত্ব কামারুজ্জামানের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। সরকারে থাকা বা মন্ত্রিত্বে থাকার চেয়ে দলের হাল ধরা যে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তা বঙ্গবন্ধুর মতো অন্য কেউ বুঝেন নি। কিছুটা তার কন্যা বুঝেছেন কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এ-মুহূর্তে শেখ হাসিনা দল ও সরকারের জন্য এতটাই অপরিহার্য হয়ে উঠেছেন যে তাকে বাদ দিয়ে ভিন্ন কিছু চিন্তা করাও যায় না। ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর একটি বিষয় লক্ষণীয় যে বিগত ১০-১১ বছরে ভেসে আসা আগাছা-পরগাছারা দলে অনেক বেশি সমাদৃত, তৃণমূলের নেতাকর্মীদের অভিযোগ। পিতা পোড়খাওয়া আওয়ামী লীগের কর্মী হতে পারেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের জন্য জীবন বাজি রাখতে পারেন; কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে তার সন্তানরাও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন বা এই রাজনীতি সম্পর্কে তার কোনো ধারণা আছে। কারণ তাদের অনেকেই ‘আই হেইট পলিটিকস প্রজন্মের’ মানুষ। বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে বিশ্বাস করতেন। তার কন্যাও পিতার এই গুণাবলির উত্তরাধিকার। তারা সকলে বঙ্গবন্ধু-কন্যার এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছেন ও নিচ্ছেন। এক-এগারোর পর বঙ্গবন্ধু-কন্যা তখন কারাগারে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তার মুক্তি দাবি করে একটা বিবৃতি দেবেন। একজনের কাছে বিবৃতিটা নিয়ে গেলে তিনি সাফ জানিয়ে দিলেনÑ এটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের কাজ নয়। এরা হচ্ছেন দলের জন্য উইপোকা। যারা বঙ্গবন্ধু ও তার কন্যাকে ভালোবাসে, তারা প্রত্যাশা করেন এই কাউন্সিলে যারা দলের হাল ধরার জন্য মনোনীত বা নির্বাচিত হবেন, দলের প্রতি তাদের আনুগত্য নিরঙ্কুশ হবে এবং তারা পদ-পদবির জন্য কখনও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত হননি।
শেখ হাসিনা ইদানীং প্রায়শঃ বলে থাকেন তিনি অবসরে যাবেন। এই বয়সে এমনটা বলা স্বাভাবিক। যতই বলি শেখ হাসিনার বিকল্প তো দেখা যাচ্ছে না, কীভাবে অবসরে যাবেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে কোনো এক সময় তো তার বিকল্প খুঁজতে হবে এবং সেখানে আবেগের কোনো স্থান থাকবে না। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্থলাভিষিক্ত হতে পেরেছিলেন। কারণ জন্মলগ্ন থেকেই তিনি পিতাকে যত-না একজন পিতা হিসেবে দেখেছেন, তার চেয়ে বেশি দেখেছেন একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে। শেখ মুজিব হতে বঙ্গবন্ধু আর জাতির পিতা হয়ে ওঠার তিনি একজন সাক্ষী। বর্তমান কাউন্সিলের পর আর একটা কাউন্সিলের মাঝখানে হয়তো তিন বছরের ব্যবধান হবে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন করবে। ২০২১ সালে দেশটি মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার কথা আছে। পদ্মাসেতুসহ শেষ হবে অনেক মেগা প্রকল্পের কাজ। চেষ্টা করা হোক এবারের কাউন্সিলে যারা দলের কাÐারি হিসেবে নির্বাচিত হবেন, তারা হবেন শেখ হাসিনার হাতে জন্ম নেওয়া নব আওয়ামী লীগের সেরা নির্বাহী কমিটি। তাদের হাত ধরেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে। জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।

লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য