মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ পাঠান: মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ পাঠানের ‘বাংলাদেশের লোকসাহিত্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও মুক্তিযুদ্ধ’ গ্রন্থটি একটি ব্যতিক্রমী গবেষণা লব্ধ রচনা সংকলন। ১৭৬ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটি এখানে প্রকাশ সম্ভব নয়। আমরা বিষয়বস্তুর তাৎপর্য এবং লেখকের গবেষণার বিশেষত্ব পাঠকের কাছে তুলে ধরার জন্য এই গ্রন্থে লেখকের মুখবন্ধটুকু প্রকাশ করলাম। মুখবন্ধে বাংলাদেশের লোকসাহিত্যে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের যে চিত্র অঙ্কিত হয়েছে, তাতেই পুরো গবেষণা গ্রন্থটির পরিচয় মিলবে। Ñ সম্পাদক
পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির উদ্ভব না হলে বাংলাদেশের ইতিহাসের ধারা পরিক্রমণ ভিন্ন রকম হতো। ঐ রাষ্ট্রটির সঙ্গে পূর্ববঙ্গের অন্তর্ভুক্তি যুগপৎ আশীর্বাদ ও অভিশাপ। আশীর্বাদ এজন্য যে, পাকিস্তানের পর্যায়ক্রমিক দুঃশাসনে অতিষ্ঠ পূর্ববঙ্গবাসী নানা আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে অনিবার্য করে তোলে। আর অভিশাপ এজন্য যে, একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশে যে গণহত্যা ঘটিয়েছিল তা পৃথিবীর ইতিহাসে ভয়ঙ্কর জঘন্যতম পৈশাচিক বর্বরতার তুলনাহীন দৃষ্টান্ত।
১৯৪৭ সালে ১২০০ মাইল দূরবর্তী দুটি ভূখ- নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের পত্তন হয়েছিল। ভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও ইসলাম ধর্মের দোহাই দিয়ে দুটি অঞ্চলকে একই ঘেরাটোপে আবদ্ধ করে উদ্ভট এই রাষ্ট্রটি গঠিত হয়েছিল। ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতাকে পুঁজি করে মুসলমানদের চিরস্থায়ী আবাসভূমি গড়ে উঠেছে এরূপ প্রগল্ভ আস্ফালনে নেতৃবৃন্দ আকাশে রঙিন ফানুস উড়িয়েছিল। কিন্তু অতি আবেগে গড়া নড়বড়ে ভিত্তির সেই সৌধ দুই যুগেই ধূলিসাৎ হয়ে গেল। ইংরেজ শাসনাধীন অখ- ভারতবর্ষ যখন ভারত ও পাকিস্তান নামে দ্বিধাবিভক্ত হলো তখন পূর্ববঙ্গবাসী আনন্দে আত্মহারাÑ তারা ইংরেজের পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত স্বাধীন দেশের অধিবাসী। কিন্তু অচিরেই পাকিস্তানের সেই রঙিন সুখস্বপ্ন উবে গেল। লোক-অভিজ্ঞানে ব্যাপারটি এরূপ দাঁড়ালÑ
এক বউ ছাড়লাম আমি
চাল খাওয়ার ডরে,
আরেক বউ আইন্যা দেখি
ধানসুদ্ধ গিলে।
রাষ্ট্রটির সূচনাপর্বেই ইসলাম ধর্মের ধ্বজাধারী পাকিস্তানি শাসকদের কপট সাধুতার মুখোশ উন্মোচিত হয়ে পড়ল। ১৯৪৮ সালে জিন্নাহ ঢাকায় এসে বলেছিলেন, ‘উর্দুÑ একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ তখনই ছাত্র-জনতার জোর প্রতিবাদ উত্থিত হয়েছিল। সেদিন উপস্থিত ছাত্র-জনতা ৪ কোটি বাঙালির প্রতি পাকিস্তানি শাসকদের জঘন্যতম ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ সম্যক উপলদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছিল। এরপর এলো রক্তঝরা বায়ান্ন। বাংলা ভাষার জন্য আত্মাহুতি দিল রফিক, শফিক, সালাম, বরকত প্রমুখ। এ এক অনন্য ঘটনা।
কেননা ভাষার জন্য আত্মবলিদানের এমন মহত্তম দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে কুত্রাপি নেই। ’৫৪-তে ২১-দফা বাস্তবায়নের জন্য হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। তাদের ক্ষমতা বানচালেও চলে পাকিস্তানি ষড়যন্ত্র। কর্ণফুলী পেপার মিল ও আদমজী জুট মিলে বাঙালি-অবাঙালি দাঙ্গায় কয়েক হাজার লোক নিহত হয়। পাকিস্তান সরকার এ কে ফজলুল হকের মন্ত্রিসভা বাতিল করে দেয় এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী, ভারতের দালাল, কমিউনিস্ট দমনে ব্যর্থ ইত্যাদি অজুহাতে তাকে গৃহে অন্তরীণ করে রাখা হয়। তাকে ঈদের নামাজও পড়তে দেওয়া হয়নি। অতঃপর ’৬৬-তে ৬-দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও ’৬৯-এর গণ-আন্দোলন এবং ’৭০-এর নির্বাচন বাঙালির মুক্তির সম্মুখ অভিযাত্রায় এক একটি সফল উত্তরণ।
দ্বিজাতিতত্ত্বের নড়বড়ে খুঁটিতে ভর করে পাকিস্তানের জন্ম। পূর্ববঙ্গবাসীর কাছে অচিরেই রাষ্ট্রটির অন্তঃসারশূন্যতা প্রকটিত হয়ে ওঠেÑ
কায়েদে আজম বলেছিলেন গরীব দুঃখীর পাকিস্তান,
এখন দেখি ভাগ বসাইছে নন্দঘোষ আর নিধুরাম।
জনগণ তখন নিদারুণ শোষণ বঞ্চনার জাঁতাকলে পিষ্ট হতে থাকেÑ
সরওয়ার্দী বাংলাদেশের দুর্গতি দেখিয়া,
হক সাহেবকে সঙ্গে লয়ে উঠিল গর্জিয়া।
কি কাম করিলে মিস্টার জিন্নাহ মুসলমান হইয়া,
বাঙ্গালীরে দিলে তুমি পিছনে ফেলিয়া।
স্বাধীনতার সংগ্রাম মোরা করলাম একসাথে,
খালিকি মুক্তারি এখন সব তোমাদের হাতে।
বাংলার লোকে চাকরী পায় না বিএ পাশ করিয়া,
বিনা বিদ্যায় যাও তোমরা উজির নাজির হইয়া।
বাঙ্গালীরা দিবারাত্র মেহনত করিয়া,
দুইবেলা খাইতে পায় না তারা পেট ভরিয়া।
উৎপন্ন শস্য যত পশ্চিম দেশে নিয়া,
আটক করে রাখ গোলাজাত করিয়া।
তোমাদের দয়া হলে কিছু কিছু দেও,
কলকারখানার যত আয় পশ্চিম দেশে নেও।
এই প্রেক্ষিতে ‘বাংলার সিংহ পুরুষ’ শেখ মুজিবুর রহমান শোষিত-বঞ্চিত বাঙালির জাগ্রত করার ব্রত গ্রহণ করেনÑ
রয়েছ বাঙ্গালী ভাই কালঘুসে পড়ে,
পশ্চিমা মাওড়ায় ধন লয়ে গেল হরে।
এত শুনি বাঙ্গালী কিছু সাড়া দিল,
শেখ মজিবর ভাই সবার আগে গেল।
শেখ মজিবর বাংলার সিংহ পুরুষ ভাই,
সভা করে বুঝায় লোকে কত ঠাঁই ঠাঁই।
১৯৫৬ সালে জিঞ্জিরা থেকে ঢাকা আগত ভুখা মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণে চারজন নিহত হন। এই দুঃশাসনের অবসানকল্পে কবি চাষিদের চূড়ান্ত বিদ্রোহের আহ্বান জানানÑ
জাগরে যত হতভাগা পাকিস্তানের কৃষককুল,
ভেবে দেখ-না বুদ্ধির দোষে করেছিস কি মহাভুল!
নাইকি তোদের লজ্জাশরম নাইকি তোদের অভিমান।
বাঁচার মতো বাঁচতে চাইলে করতে হবে কঠিন প্রাণ।
এমন শক্তি নাই দুনিয়ায় চাষীর সঙ্গে লড়বেরে,
চাষীর হাঁকে পাহাড় চূড়ায় অসুর দানব ভাগবেরে।
যে মহাজন পেয়ে আসন কাঙাল করছে দেশটাকে,
যা ইচ্ছা তুই করতে পারিস রমাকান্তের মেষটাকে।
রাজনৈতিক ঘটনাসমূহের বিশ্লেষণে লোককবিগণ যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ কারাবন্দি হলে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আবদুল মোনায়েম খানের প্রতি কবির তীব্র ধিক্কারÑ
মোনেম তুই দেশের দেশী হইয়া,
বাঙ্গালীরে রাখলে তুইরে জেলখানায় ভরিয়া।
পাকিস্তানি হানাদারদের প্রতি চরম ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ‘স্বাধীন জয় বাংলার কবিতা’য়। ধুরন্ধর আইয়ুব খান কর্তৃক ইয়াহিয়া খানকে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি অনুধাবনে কবির তীক্ষè রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় পাওয়া যায়Ñ
আইয়ুব খানে মানে মানে পার হৈল এক ফালে (লাফে),
মুইত্যা গেল চালাক বান্দর ঘোড়ার কপালে।
’৭০-এর গণভোট ছিল বাংলাদেশের স্বাধিকার অর্জনের এক কঠিন লড়াই। অভূতপূর্ব উৎসাহ-উদ্দীপনায় অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভে পাকিস্তানি শাসকরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েÑ
দেখিতে দেখিতে আইল গণ নির্বাচন,
বাঙ্গালী শতেক লোক আনন্দিত মন।
ঈদগাতে চলিল যেমন কাতারে কাতার,
তেমনি চলিল কেন্দ্রে হাজারে হাজার।
বেলা শেষে ভোট হইল গণনা,
নৌকা মার্কার সাথে নাহিক তুলনা।
বাংলাদেশের সব কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ পাশ,
তা দেখিয়া মাওড়াদল পাইল তরাস।
ঢাকার রেসকোর্স মাঠে ’৭১-এর ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকণ্ঠ ভাষণ ছিল পশ্চিমা হায়েনাদের কবল থেকে বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের মহামন্ত্র। লোককবি সেই ভাষণের অবিকৃত প্রতিপাদ্য চমৎকার বাক্ভঙ্গিমায় তুলে ধরেছেনÑ
শুন ভাইয়েরা আমার হও হুঁশিয়ার দুঃখ আর কত সহিবে,
ঘরে ঘরে দুর্গ আজ গড়ে তুলতে হবে।
তোমাদের আছে যাহা নিয়ে তাহা আপন আপন হাতে,
তাই নিয়ে লড়তে হবে দুশমনের সাথে।
রক্তের বদলে এই দেশের আজাদী আসিবে, মুক্ত করবো স্বদেশ ইনশাল্লাহ বলছেন মুজিবে।
ঐ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় সত্ত্বেও শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতা অর্পণে পাকিস্তানিদের গভীর ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদাত্ত আহ্বানÑ
বঙ্গবন্ধুর ডাক পড়েছে শুনরে পাতি কান,
জয় বাংলা জয় বাংলা বলে উড়াও হে নিশান।
এরপর এলো ২৫শে মার্চের ঘোর অমানিশা। পাকিস্তানি হানাদাররা পৈশাচিক উন্মত্ততায় ব্যাপক গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, নারী নির্যাতন ও লুণ্ঠনে মেতে উঠল। বিজয় দিবসের পূর্ব পর্যন্ত অব্যাহত গতিতে সংঘটিত নারকীয় বীভৎসতায় বাংলাদেশ বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছিলÑ
ছাড়ে স্টেন কামান মেশিন গান উঠিল গর্জন,
হাজার হাজার মানুষ তাতে ঘটিল মরণ।
যত হানাদাররা অসুর তারা দয়ামায়া নাই,
লাইন করিয়া মানুষ মারে কেবা গুনে ভাই।
মুক্তিযোদ্ধাদের মরণপণ আক্রমণে
যখন পাকহানাদাররা পর্যুদস্ত তখন জগৎবাসী অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখছে বাঙালির মহান মুক্তিসংগ্রামÑ
মুক্তির লড়াই কী চমৎকার
জগৎবাসী হয় ধন্ধকার!
অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচ- আক্রমণে তখন হানাদারদের ত্রিশঙ্কু অবস্থাÑ
যত হানাদাররা পাগল তারা খাইয়া মুক্তির খাইর,
গুঁতার চোটে ফেলছে তাদের বত্রিশ দাঁতের পাইর।
আদত মুক্তিসেনা যায় না চিনা জিন কিবা পরী,
বিজলির মত গুল্লি ছাইড়া যায়গা তাড়াতাড়ি।
তারা বুট পরে না স্যুট পরে না নাইরে লোহার টুপি,
দেখলে মুক্তি যায় না চিনা আজব বহুরূপী।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয় অবধারিত। এই দৃঢ়প্রত্যয়ে বলীয়ান কবির উচ্চারণÑ
বাঙ্গালীর ভাই শেখ মুজিব ভাই আর তো কেই নাই,
ঝড়তুফানে তাহার ছায়ায় পাবো সবাই ঠাঁই।
সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর রক্ত দিবরে সবাই,
দেশ করবো স্বাধীন বাংলা কোন সন্দেহ নাইরে।
‘তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে’ অস্পৃশ্য গোপজাতির সংগ্রামী নেতা শ্রীকৃষ্ণ সংঘবদ্ধ ব্রাত্যজনদের নিয়ে অত্যাচারী মথুরারাজ কংসকে ধনুর্বাণে বধ করেছিলেন তেমনি মুক্তিসেনাদের অসমসাহসিক আক্রমণে স্বৈরশাসক ইয়াহিয়ার ধরাশায়ী পতন ঘটল। অত্যাচারীর পতন অবশ্যম্ভাবী, পাকসেনাদের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্যে এই চিরসত্যেরই পুনরাবর্তন ঘটেছিলÑ
বাংলাদেশে যত ছিল খান সেনাদল,
বিক্রম টুটিয়া গেল কমি হইল বল।
হাজার হাজার মাওড়া সৈন্য লইয়া চলিল,
কী অপরূপ তামসা পয়দা খোদায় করিল।
বাংলাদেশের শিশুগণ রাস্তায় আসিয়া,
খাসি মুরগি দেখায় খাইবার লাগিয়া।
বদরবাহিনী আর রাজাকারগণ,
বাপ চাচার দশা দেখে জুড়িল কান্দন।
আমাদের থুইয়া তোমরা কোথায় যাও চাচা।
খানসেনারা বলে বেটা আপন জান বাঁচা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম অভিন্ন সূত্রে গ্রথিত। স্বাধীনতার জন্য উৎসর্গিত প্রাণÑ মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদনে কবি বলেনÑ
দারু মিয়া বলে মুজিব তুমি গুণÑসিন্ধু,
তাই ত বাঙ্গালী তোমায় ডাকে বঙ্গবন্ধু।
ধন্য ধন্য বঙ্গবন্ধু তোমার জীবন,
বিলায়ে দিয়েছ প্রাণ দেশের কারণ।
দেশের তরে জীবন নাহি কাঁদিল যাহার,
এ ভব সংসারে বৃথা জনম তার।
অনেক রক্ত ঝরার পর এলো বহুকাক্সিক্ষত বিজয় দিবস ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১। দুঃখের অথৈ সাগর পাড়ি দিয়ে তরী ভিড়ল সোনালি তটেÑ আকাশে উড্ডীন রক্তিম পতাকাÑ মুক্তির মহানন্দে কোটি কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে মুখরিত হলো বাংলার আকাশ-বাতাসÑ
বঙ্গবাসী যত ছিল হইল এত খুশি,
হাত বাড়াইয়া পাইল যেন আসমানের শশী।
তবু ত বাঙ্গালীর মুখে ফুটিলেক হাসি,
বঙ্গ-বিষাদ ভুলে স্বাধীন বাংলা ভালবাসি।
কবি যেন তার অন্তর্দৃষ্টিতে ’৭৫-এর ১৫ই আগস্টে সংঘটিত জাতির পিতার পৈশাচিক হত্যাকা-ের পূর্বাভাস উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন। ‘১৯৭১Ñ শেখ মুজিব ভাই স্মরণে’ শীর্ষক গানে তার সতর্ক উচ্চারণÑ
শেখ মুজিবুর ভাই সাবধান হাল ধরিও
বিপদের সীমা নাই,
সামনে আছে বাউল বাতাস দেখিবারে পাই।
মুজিব ভাইও মাঝিমাল্লা যতই দেখো
কাল ভুজঙ্গ মনে রাখোও
এক ছোবলে করবে বিনাশ জীবনের কামাই।
পাকিস্তানের জন্ম, পূর্ববঙ্গবাসীর প্রতি পাকিস্তানি দুঃশাসনের চালচিত্র, ভাষা আন্দোলন, ২১-দফা ও যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, আইয়ুব খানের সামরিক শাসন, ’৬৬-র ৬-দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও ’৬৯-এর গণ-আন্দোলন, ’৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়, শেখ মুজিবকে ক্ষমতা অর্পণে পাকিস্তানের দুরভিসন্ধি, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ, অসহযোগ আন্দোলন, ২৫শে মার্চের পৈশাচিক গণহত্যা, শেখ মুজিবের গ্রেফতার, ভারতে শরণার্থীদের আশ্রয় গ্রহণ, মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীবাহিনীর ঢাকা আক্রমণ, পাকসেনাদের আত্মসমর্পণ, বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং স্বাধীনতার পরে পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তিলাভ ও স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, সপরিবারে জাতির জনকের নৃশংস হত্যাকা- এবং শেখ হাসিনার দেশে আগমন পর্যন্ত সময়ে (১৯৪৮-১৯৮১) সংঘটিত ঘটনাবলিকে উপজীব্য করে লোক ও চারণ কবিগণ রচিত পুথি, কবিতা ও গান অবলম্বনে এ গ্রন্থটি প্রস্তুত করা হয়েছে।
দেশ ও সমাজের নানা ঘটনা-দুর্ঘটনায় লোককবিগণের সংবেদনশীল হৃদয় প্রবলভাবে আলোড়িত হয়। তারই বাঙ্ময় প্রতিচ্ছবি তাদের সৃষ্টিতে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ জনপদে লোক ও চারণ কবিগণ স্বরচিত পুথি, কবিতা ও গান গেয়ে জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের পাকহানাদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে দারুণ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। বিদগ্ধ প-িত সমাজের কাছে এগুলোর গ্রহণযোগ্যতা না থাকলেও লোককবিদের এসব রচনা মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য-উপকরণ হিসেবে নিঃসন্দেহে মূল্যবান। অবিলম্বে সারাদেশ থেকে এ-জাতীয় রচনা সংগৃহীত হয়ে গ্রন্থবদ্ধ করা প্রয়োজন, নচেৎ বিলম্ব হলে এসব চিরতরে হারিয়ে যাবে।
লোককবিগণের অধিকাংশ রচনায় ত্রিপদী ও পয়ার ছন্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়া চতুষ্পদী, পঞ্চপদী, মালতী ছন্দযুক্ত কবিতাও লিখেছেন। আধুনিক কবিগণ যেভাবে জটিল জীবনানুভূতিকে মূর্ত করেনÑ সে তুলনায় গ্রামীণ পরিম-লে বর্ধিত লোককবিদের মনোজগৎ ততটা প্রসারিত নয়। তারা পুরাণ, চিরচেনা সমাজ, সমাজের মানুষ ও তার পরিপার্শ্ব থেকে কাব্যরচনার উপাদান আহরণ করেছেন। তারা সরল ভঙ্গিমায়, যথাযথ শব্দ যোজনায়, লোকপ্রবাদের ব্যবহারে, ছন্দ প্রকরণে এবং বিভিন্ন অলঙ্কার প্রয়োগের মাধ্যমে কাব্যের অঙ্গসৌষ্ঠব বৃদ্ধির প্রয়াস পেয়েছেন। নিচে অলঙ্কার প্রয়োগের কয়েকটি উদাহরণÑ
অনুপ্রাস :
রাজাকার হয় নছু তছু কেরু চাচা বুইধ্যা হাছু,
আর আমি বলব কিছু কিছু তাদের বিবরণ।
হাইছ্যা ফুইট্যা দুই ভাই, ঘরের চালে ছাউনি নাই,
আর কিছু বলে যাই তাদের বিবরণ।
পোটকিমরা টুইন্যা ভাইয়া, দিন কাটাইত আটা খাইয়া,
রাজাকারের চাকরী পাইয়া বেটা হয় একজন।
Ñ ইদ্রিছ আলী
বক্রোক্তি :
গুরু হইলেন লাট বাহাদুর শিষ্য পাইলেন মাতবরী,
সঙ্গীরা সব বেতাল ভট্ট রাবণ রাজার জাঁকজুরী।
Ñ মফিজউদ্দিন
উপমা :
সে যে বঙ্গ শার্দূল নাই সমতুল সারা বিশ্বে আর,
কোথায় গেল চীন মার্কিনের দেওয়া বিপুল হাতিয়ার।
Ñ ইদ্রিছ আলী
রূপক :
কুমিল্লায় মুক্তিযোদ্ধায় যতেক লড়িল,
কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধে তাহা না ঘটিল।
Ñ দারোগ আলী
উৎপ্রেক্ষা :
মণিহারা ফণী যেন বেড়ায় ঘুরিয়া,
তেনমতে ছিনু মোরা তোমায় হারাইয়া।
অগো বাংলার নয়নমণি শেখ মুজিব ভাই,
তোমারে হেরিয়া আজি পরান জুড়াই।
Ñ দারোগ আলী
সন্দেহ :
আদত মুক্তি যায় না চিনা জিন কিবা পরী,
বিজলির মত গুল্লি ছাইড়া যায়গা তাড়াতাড়ি।
ব্যাজস্তুতি :
ধন্য মওলানা সাব এইমত পাপ কোন হাদিছে ধরে
লুইট্যা খাইতে পাইছো তোমরা কোন মাদ্রাসায় পড়ে!
Ñ ইদ্রিছ আলী
লোককবিদের রচনাসমূহ কোনো ফরমায়েশি নয়Ñ অন্তরের অনিবার্য আকুলতা থেকে স্বতঃউৎসারিত। সারস্বতসমাজে অপাঙ্ক্তেয় ব্রাত্য অভাজন এসব ভাট ও চারণকবিদের রচনাসম্ভার প্রেম, দ্রোহ, সৃষ্টি, ঘৃণা, সহানুভূতি, আনন্দ-বেদনার সত্যসন্ধ ব্যঞ্জনায় দ্যুতিময় ও ঐশ্বর্যম-িত।
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরে, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মননশীল পাঠকদের উপযোগী সহস্র গ্রন্থ প্রকাশিত হলেও ব্রাত্যসমাজের কবি গায়কদের রচনা নিয়ে কোনো আলোচনা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে বলে জানা নেই। এক্ষেত্রে আমার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা ‘বাংলাদেশের লোকসাহিত্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও মুক্তিযুদ্ধ’ পাঠক সমক্ষে অর্পিত হলো। বইটি পাঠকের কাছে সমাদৃত হবে এরূপ প্রত্যাশা রইল।