Sunday, September 24, 2023
বাড়িদশম বর্ষ,নবম সংখ্যা,আগস্ট-২০২০বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর

বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর

“… এই বাড়িতে সময় এসে হঠাৎ কেমন থমকে আছে/এই বাড়িটি স্বাধীনতা, এই বাড়িটি বাংলাদেশ/এই বাড়িটি ধলেশ্বরী, এই বাড়িটি পদ্মাতীর/এই বাড়িটি শেখ মুজিবের/এই বাড়িটি বাঙ্গালির!” [মহাদেব সাহার কবিতা ‘তোমার বাড়ি’]

আমিরুজ্জামান পলাশ: ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের এই ঐতিহাসিক বাড়িটি বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে স্মৃতি সংরক্ষণ করে চলেছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর; সংক্ষেপে ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর’ হিসেবে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবন।
বাঙালি জাতির হাজার বছরের কাক্সিক্ষত স্বপ্ন ছিল আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীনতা। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য বাঙালির রয়েছে দীর্ঘ লড়াই, সংগ্রাম ও যুদ্ধ-বিদ্রোহের ইতিহাস। বাঙালি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও জাতীয় ঐক্য গঠনের যে সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় এসেছিল ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ৬-দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন, ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং চূড়ান্ত বিজয়।
ইতিহাসের এ সকল আন্দোলনকে উৎস থেকে মহীরুহে পরিণত করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। আর তাই জনমানুষের এই প্রিয় নেতা শেখ মুজিব থেকে হয়ে যান তিনি বঙ্গবন্ধু মুজিব। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে জাতিসত্ত্বায় রূপান্তরিত করে জাতিগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন, সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে তিনি ইতিহাসের মহানায়কে পরিণত হন। সংগত কারণেই তাকে ‘জাতির জনকের’ আসনে অধিষ্ঠিত করা হয় ১৯৭১ সালে মার্চের উত্তাল দিনগুলোর শুরুতে। জাতির জনক মুজিবই বাঙালি জাতিকে এনে দেন একটি স্বাধীন ভূ-খ-, পতাকা, মানচিত্র এবং শাসনতন্ত্র। বাঙালির হাজার বছরের কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়েই তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়ে যান। ইতিহাসের এই মহানায়কের স্মৃতিচিহ্ন বিজড়িত নিদর্শনসামগ্রী সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের জন্য বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা অর্জন সময়কালের সকল দিক-নির্দেশনা এই বাড়ি থেকেই পাওয়া গিয়েছিল।
১৯৫৪ সালে প্রথমবারের মতো বেগম মুজিব তিন সন্তান নিয়ে সন্তানদের পিতার কাছাকাছি থাকার জন্য ঢাকায় গে-ারিয়ার রজনী চৌধুরী লেনে বাসা ভাড়া নিলেন। (ইব্রাহীম, ২০১০ : ৩৪)। যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভায় শেখ মুজিব বন ও কৃষি দপ্তরের মন্ত্রিত্ব লাভ করেন। শেখ মুজিব ৩ নম্বর মিন্টো রোডে মন্ত্রীর বরাদ্দ বাড়িতে সপরিবারে বসবাস শুরু করেন। কিন্তু মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই মন্ত্রিসভা বাতিল হলো, ১৪ দিনের সরকারি নোটিসে বাড়ি ছেড়ে দিতে হয়। নাজিরা বাজারের এক ভাড়াবাড়িতে উঠতে হলো। এখানেই শেখ রেহানার জন্ম হয়। শেখ মুজিব যথারীতি কারাগারে, সব দায়িত্ব বেগম মুজিবকেই সামলাতে হয়। (ইব্রাহীম, ২০১০ : ৩৪)।
১৯৫৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য হন। ১৬ সেপ্টেম্বর তিনি কোয়ালিশন সরকারের শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ও ভিলেজ এইড দফতরের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৫ নম্বর আবদুল গণি রোডের সরকারি বাসায় সপরিবারে বসবাস শুরু করেন। এবার শেখ মুজিবুর রহমান দলীয় স্বার্থে মন্ত্রিত্ব থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করায় ছাড়তে হলো সরকারি বাড়ি। বেগম মুজিবের ঘর গুছানো হতে না হতেই আবার বাড়ি খোঁজার পালা। এবার বাড়ি নেয়া হলো সেগুন বাগিচায়। (ইব্রাহীম, ২০১০ : ৩৬)। এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯৫৫ সালের ২৫ আগস্ট গণপরিষদে শেখ মুজিবুর রহমান এ ভূ-খ-ের নাম পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে বাংলা রাখার প্রস্তাব করেন। (ইব্রাহীম, ২০১০ : ৩৬)। তিনি গণপরিষদে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি উত্থাপন করেন। ১৯৫৫ সালের ২১ অক্টোবর আওয়ামী মুসলিম লীগের বিশেষ কাউন্সিলে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি তুলে দিয়ে অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। (সুফী, ২০১২ : ১৮৫-১৮৬)।
১৯৫৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান এমপি থাকাকালে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কে একটি প্লট বরাদ্দ পান। (মওদুদ, ২০১০ : ৫৫)। বঙ্গবন্ধু টি বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকাকালে কিছুদিন সরকারি বাসভবনে সপরিবারে বসবাস করেন। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর মার্শাল ল’ জারি হলে শেখ মুজিব কারারুদ্ধ হন এবং পরদিনই তিন দিনের মধ্যে সরকারি বাসভবন ছাড়ার জন্য নোটিস হাতে নিয়ে বেগম মুজিবকে আবার বাড়ি খুঁজতে হয়। অবশেষে সেগুনবাগিচায় একটি নির্মীয়মান বাড়িতে পানি ও ইলেকট্রিসিটিবিহীন দুটি কামরা ভাড়া পান তিনি বসবাসের জন্য। এখানে কিছুদিন চরম কষ্টে থাকার পর বেগম মুজিব ৭৬, সেগুনবাগিচা তিনশত টাকা ভাড়ায় দোতলা ফ্ল্যাটে বসবাস করতে থাকেন। (ইব্রাহীম, ২০১০ : ৩৭)।
বঙ্গবন্ধুকে অধিকাংশ সময়ই কারার অন্তরালে কাটাতে হতো। ১৯৬১ সালে শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আলফা ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে চাকুরি গ্রহণ করেন। (ইব্রাহীম, ২০১০ : ৩৭)। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ইন্সুরেন্স কোম্পানীতে চাকুরির সুবাদে অর্জিত অর্থ, বেগম মুজিবের বিন্দু বিন্দু জমানো অর্থ এবং হাউজ বিল্ডিংয়ের ঋণের টাকা দিয়ে ধানমন্ডি ৩২ সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়িটি নির্মিত হয়। কাজেই বেগম মুজিবকে অত্যন্ত কষ্ট করেই এই বাড়িটি তৈরি করতে হয়েছে।

ইতিহাস ও ঐতিহ্যে বঙ্গবন্ধু ভবন
১৯৬১ সালে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের এই বাড়িটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। কোনোমতে তিনটা কামরা করে একতলা নির্মাণকাজ শেষে ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর সপরিবারে বঙ্গবন্ধু বসবাস শুরু করেন এই ভবনে। এরপর একটা একটা কামরা বাড়াতে থাকেন বেগম মুজিব। এভাবে ১৯৬৬ সালে ভবনের দোতলার নির্মাণকাজ শেষ হয়। (হাসিনা, ২০১৬ : ৬৪-৬৮)। তৎপরবর্তীতে তৃতীয়তলার তিনটি কক্ষের নির্মাণকাজ শেষ হয়। ১৯৬৪ সালের আগস্ট মাসে ধানমন্ডি ৩২ সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়িটি নির্মাণের জন্য বেগম ফজিলাতুন্নেছা গৃহনির্মাণ সংস্থা থেকে ৩২ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করেন এবং শেখ মুজিবুর রহমান গ্রান্টার হয়েছিলেন। (আহমেদ, ২০০১ : ৬৪২)। আর্থিক সংকটের কারণে বাড়িটি তৈরি করতে অনেকদিন সময় লেগেছিল। সেই ১৯৬১ সাল থেকে এ পর্যন্ত অনেক ঘটনা রয়েছে এই বাড়িটিকে ঘিরে। অবৈধ ও খুনি সামরিক শাসক কর্তৃক মাঝখানে ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৮১ সালের ১১ জুন পর্যন্ত বাড়িটি বন্ধ ছিল।
১৯৬২ সালে পূর্ববাংলার ছাত্র-সমাজ একটি সার্বজনীন গণমুখী শিক্ষানীতি প্রণয়নের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে। এটাই পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে সফল প্রথম গণ-আন্দোলন। (সুফী, ২০১২ : ১৯৬-১৯৭)। ১৯৬২-তে আইয়ুববিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রনেতা শেখ ফজলুল হক মণি এই বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধুর নিকট থেকে আন্দোলনের নির্দেশনা নিয়ে যেতেন এবং পরামর্শ করতেন। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের বহু নেতা এই বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনা ও নির্দেশনা নিতে আসতেন। বঙ্গবন্ধু এই বাড়ি থেকেই গ্রেফতার হন ১৯৬২-তে। (হাসিনা, ২০১৬ : ৬৪)। জেল থেকে মুক্ত হয়ে তিনি এ-বাড়িতেই ফিরে আসেন। ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পরলোকগমনের পর ব্যথিত মুজিব আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার জনগণের ন্যায়সংগত অধিকার সর্বতোভাবে আদায়ের দাবিকে অবলম্বন করে আওয়ামী লীগ এগিয়ে যেতে থাকে। ধারণা করা যায় এ-সময় থেকেই শেখ মুজিবের ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটি জনমুখী বাড়ির কেন্দ্রবিন্দুতে রূপ নিতে শুরু করে।
১৯৬৪ সালের অক্টোবর মাসে শেখ রাসেলের জন্ম হয় এ-বাড়িতে। তখনও বাড়ির দোতলা হয়নি, নিচতলাতে হয়েছে। উত্তর-পূর্ব কোণে শেখ হাসিনার থাকার ঘরেই রাসেলের জন্ম হয়। শেখ মুজিব তখন আইয়ুববিরোধী নির্বাচনী প্রচারকাজে ব্যস্ত। (হাসিনা, ২০১৬ : ৬৫)। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পূর্বে ১৯৬৪ সালে ঢাকায় হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা হয়। দাঙ্গা থামিয়ে শান্তি স্থাপনের জন্য নিজের জীবনের ওপর ঝুঁকি নিয়ে তিনি দাঙ্গায় আক্রান্ত বহু মানুষকে এই বাড়িত আশ্রয় দেন। (হাসিনা, ২০১৬ : ৬৬)।
১৯৬৬ সালের ৬-দফা আন্দোলনের সুতিকাগার ছিল শেখ মুজিবের ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটি। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ির সদস্য মুজিব-কন্যা শেখ হাসিনা কর্তৃক ১৯৬৬ সালের একদিনের ঘটনার স্মৃতিচারণ থেকেই উপলব্ধি করা যায় বাড়িটির তখন কত ইতিহাস, কত বেদনা আর কত ধারাবাহিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালির আশা-আকাক্সক্ষায় পরিণত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার স্মৃতিচারণটি অনেক বেশি প্রণিধানযোগ্য এবং নিম্নে হুবহু বিবৃত হলো :
… ১৯৬৬ সালের কথা মনে আছে। কয়েকদিন ধরে আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী কমিটির সভা চলছিল। আমার তখন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। প্রথম বর্ষের কয়েকটা বিষয়ের পরীক্ষা হবে, যার নম্বর দ্বিতীয় বর্ষে যোগ হবে। কিন্তু পড়ব কি! মিটিং চলছে বাড়িতে, মন পড়ে থাকে সেখানে। একবার পড়তে বসি আবার ছুটে এসে মিটিং শুনি। সবাইকে চা বানিয়ে দেই। যাক সেসব। বিকেলে নারায়ণগঞ্জে বিশাল জনসভা হয় ছয়-দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য। আব্বা ফিরতে বেশ রাত হল। আমরা অনেক রাত পর্যন্ত বারান্দায় বসে জনসভার গল্প শুনলাম। সেই জনসভায় আব্বাকে ছয়-দফার উপর একটা সোনার মেডেল উপহার দেয়া হয়েছিল। রাত বারোটায় আব্বা শুতে বিছানায় গেলেন। আমি পড়তে বসলাম। ঐ বছরেই বাড়ির দোতলার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কাজেই দোতলার পেছনের উত্তর-পূর্ব দিকের ঘরটা আমার। দক্ষিণের বড় জানালা। আমি খুর জোরে পড়তাম ঘুম তাড়ানোর জন্য। এর মধ্যে নিচ থেকে মামার চিৎকার শুনি ‘পুলিশ এসেছে’। বাড়িতে ঢুকতে চায়। গেটের তালা খুলতে বলে। আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। নিচে মামা দাঁড়িয়ে। আমি পুলিশ অফিসারকে বললাম, ‘আব্বা অনেক রাতে ঘুমিয়েছেন। এখন রাত দেড়টা বাজে, এখন কি করে ডাকব? তাছাড়া সকালের আগে কি করে বন্দি করবেন? আপনারা অপেক্ষা করুন।’ আমি তাদের গেটের বাইরে চেয়ার দিতে বললাম। আর এখন কিছুতেই ডাকতে পারবো না বলে জানালাম। আমি বারান্দা থেকে ঘর পেরিয়ে মাঝের বসার ঘরে এসেছি। শুনি টেলিফোন বাজছে। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। মাঝের ঘরের ছোট জানালা খোলা, আব্বা কথা বলছেন টেলিফোনে। ওপার থেকে কি বলছেন শুনছি না, তবে শুনলাম আব্বা বললেন, ‘তোমাকে নিতে এসেছে তবে তো আমাকেও নিতে আসবে।’

আমি জানালার পাশ থেকে বললাম, ‘নিতে আসবে না আব্বা, এসে গেছে অনেক আগে।’ আব্বা উঠে দরজা খুললেন। ততক্ষণে বাড়ির সবাই জেগে আছে। রাসেল খুবই ছোট। শুধু ও ঘুমিয়ে আছে।… চোখে পানি বাঁধ মানে না। মাও চোখের পানি চেপে রাখার চেষ্টা করছেন আর আব্বার কাপড়-চোপড় গুছিয়ে দিলেন, অনেকগুলি এরিনমোর তামাকের কৌটা দিলেনÑ পরে পাঠাতে অসুবিধা হয় বলে, লেখার জন্য কাগজ, কলম, খাতা সাথে নেন। কিছু বইপত্র এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী মা সব গুচিয়ে দিলেন। আব্বাকে ওরা নিয়ে গেল। ছোট্ট রাসেল অবুঝ, অঘোরে ঘুমুচ্ছে।… মনে হল বাড়িটা বড় শূন্য, ফাঁকা। (হাসিনা, ২০১৬ : ৬৬-৬৭)।
ছয়-দফা আন্দোলনের সময় বত্রিশ নম্বর বাড়িতে শেখ মুজিবের অবর্তমানেও আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হতো। বেগম মুজিব নিজের হাতে কাপড় কিনে সেলাই করে চাদর বিছিয়ে সভার ব্যবস্থা করতেন এবং নিজের হতে চা-নাশতা বানিয়ে ও রান্নাবান্না করে সবাইকে খাওয়াতেন। শেখ মুজিবের অবর্তমানে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলতেন। (মওদুদ, বেবী; ২০১০ : ৫৬)।
বত্রিশ নম্বর বাড়িতে আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সভা প্রসঙ্গে শেখ মুজিবের ‘কারাগারের রোজনামচা’র ৩রা মে-২৩ মে ১৯৬৭ থেকে বঙ্গবন্ধুর বয়ানেই জানা যায়, “১৯ তারিখে ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিত সভা। জেলা ও মহাকুমার প্রেসিডেন্ট ও সম্পাদকদেরও ডাকা হয়েছে। সভা আমার বাড়িতেই করতে হবে বলে একটিং সভাপতি ও একটিং সম্পাদক রেণুকে অনুরোধ করেছে। আমি বলেছি সকলে যদি রাজি হয় তাহা হইলে করিও। আমার আপত্তি নাই।” (রহমান, ২০১৭ : ২৪১)।
প্রসঙ্গত বঙ্গবন্ধুর জীবনের অধিককাল কারাগারের অন্তরালে কাটাতে হয়েছে গণমানুষের অধিকার আদায় আর স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন-সংগ্রাম করার অপরাধে রাজবন্দি হয়ে। ফলে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠ তার বাড়িতে পরিণত হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে শেখ মুজিবের ‘কারাগারের রোজনামচা’র ১৫ জুন ১৯৬৬ থেকে বঙ্গবন্ধুর বয়ানে জেনে নিতে পারি, “১৮ মাসের রাসেল জেল অফিসে এসে একটুও হাসে না Ñ যে পর্যন্ত আমাকে না দেখে। দেখলাম দূর থেকে পূর্বের মতোই ‘আব্বা আব্বা’ বলে চিৎকার করছে। জেল গেট দিয়ে একটা মাল বোঝাই ট্রাক ঢুকছিল। আমি তাই জানালায় দাঁড়াইয়া ওকে আদর করলাম। একটু পরেই ভিতরে যেতেই রাসেল আমার গলা ধরে হেসে দিল। ওরা বলল আমি না আসা পর্যন্ত শুধু জানালার দিকে চেয়ে থাকে, বলে ‘আব্বার বাড়ি’। এখন ওর ধারণা হয়েছে এটা ওর আব্বার বাড়ি।” (রহমান, ২০১৭ : ২৪১)।
১৯৬১ সাল থেকে জীবনের শেষ ক্ষণটি পর্যন্ত এই বাড়িটিতেই ছিলেন বঙ্গবন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের শেষ পদচিহ্ন। তিনি বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা অর্জন সময়কালের সকল দিক-নির্দেশনা এই বাড়ি থেকেই দিতেন। স্বাধীনতা অর্জনের পরও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী থেকে তিনি জীর্ণ-শীর্ণ স্বল্প পরিসরের নিজ বাড়িতেই বসবাস করতেন।
তিনি ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬-দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুথান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের (গ্রেফতারের পূর্ব পর্যন্ত) বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি সিদ্ধান্ত এই বাড়ি থেকেই দিতেন। ১৯৬১ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এই বাড়ি থেকেই তিনি বারবার গ্রেফতার হন।
১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন সময় সকল জাতীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং ছাত্র-জনতা, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকÑ সকলের পদচারণা ছিল বঙ্গবন্ধু ভবনকে ঘিরেই। এই বাড়ি থেকেই বেরিয়ে বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণটি প্রদান করেন।
২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু ভবনের গেটে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এভাবেই ক্রমান্বয়ে তিনি স্বাধীনতার চূড়ান্ত মুহূর্তের জন্য জাতিকে প্রস্তুত করেন। অতঃপর ২৬ মার্চ রাত্রে অর্থাৎ ২৫ মার্চ দিবাগত মধ্যরাতে পাকহানাদার বাহিনী কর্তৃক গ্রেফতারের পূর্বমুহূর্তে বঙ্গবন্ধু ভবনের নিচতলার পাঠকক্ষে বসে তিনি স্বাধীনতার চূড়ান্ত ডাক দেন এবং এই বাড়ি থেকেই তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের মিওনয়ালি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে আসার পর জাতির পিতা এই ভবনে বসবাস করতেন।
বঙ্গবন্ধু তার ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকেই গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার পরিচালনার জন্য রাষ্ট্রীয় কার্যালয়ে যেতেন। তিনি রাষ্ট্রীয় বাসভবনে বসবাস করতেন না। এই ভবনে এসেছেন অনেক আন্তর্জাতিক নেতা ও রাষ্ট্রপ্রধান।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশদ্রোহী ঘাতকের বুলেটে সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর এই বাড়িতে। বঙ্গবন্ধুর শরীরের বেদনাদায়ক রক্তবিন্দু আজও ৩২ নম্বরের সিঁড়ি বহন করে চলছে। আজও কালের সাক্ষী হয়ে এই ৩২ নম্বরের বাড়িটি বহন করেছে বাঙালির শতাব্দীর কণ্ঠেস্বরের স্মৃতি; বহন করে চলেছে বাঙালির বিজয়ের ইতিহাস, সংগ্রামের ঐতিহ্য আর এক বুক বেদনা-হাহাকার।
১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকারী হিসেবে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বাড়িটি ফিরে পান বুলেটবিদ্ধ ল-ভ- এবং রক্তের দাগে চিহ্নিত অবস্থায়।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট গঠন : বঙ্গবন্ধু-কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বেগম ফজিলাতুন্নেছার দুই জীবিত উত্তরাধিকারী। তাদের ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার সড়ক নং-৩২, বাড়ি নং-৬৭৭ (পুরাতন), বর্তমান বাড়ি নং-১০, সড়ক নং-১১ বাড়ির স্বত্ব বিগত ১১ এপ্রিল ১৯৯৪ইং তারিখে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট দলিল ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৪ইং তারিখে যথারীতি সম্পাদন ও রেজিস্ট্রি করে উক্ত বাড়ি ট্রাস্টের হাতে অর্পণ করেন।
১৪ই আগস্ট, ১৯৯৪ইং, ৩০শে শ্রাবণ, ১৪০১ বাংলা সালে বিদেশি কূটনীতিকবৃন্দ এবং দেশি-বিদেশি সম্মানিত বুদ্ধিজীবীদের এক বিরাট সমাবেশে এক ভাবগম্ভীর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরের শুভ উদ্বোধন করেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা।
এতদ্ব্যতীত ট্রাস্টের ৭ মে ১৯৯৫ইং তারিখের সভায় শহিদ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের নামে একটি হাসপাতাল, মাতৃসদন এবং শিশু চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। (সূত্র : ট্রাস্টের গঠনতন্ত্র)।
মেমোরিয়াল ট্রাস্টের উদ্দেশ্য : ট্রাস্ট দলিলের চতুর্থ অনুচ্ছেদে লিপিবদ্ধ তথ্য অনুযায়ী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি উদ্দেশ্য নিম্নরূপ (সূত্র : ট্রাস্টের গঠনতন্ত্র) :
(ক) জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও কর্মধারার পরিচয় সম্বলিত একটি স্মৃতি সংগ্রহালয় (জাদুঘর) গঠন, সংরক্ষণ ও পরিচালনা করা;
(খ) বঙ্গবন্ধুর সম্মানে জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা;
(গ) ঢাকার ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার ৩২নং সড়কে বঙ্গবন্ধুর বাড়িটির রক্ষণাবেক্ষণ এবং বাড়িটিকে জাতীয় ঐতিহাসিক ‘শেখ মুজিব মেমোরিয়াল’ ইমারত হিসেবে ঘোষণা ও সেইরূপে ও চালনা করিবার জন্য সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা;
(ঘ) বঙ্গবন্ধু, তাঁহার ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোগী এবং তাঁহার পরিবারের সদস্যদের বিশেষ করিয়া যাঁহারা স্বগৃহে ও কারাগারে নিষ্ঠুরভাবে নিহত হইয়াছেন, তাঁহাদের সকল বক্তৃতা, আলোকচিত্র ও চলচ্চিত্র সংগ্রহ করা;
(ঙ) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও কর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়বস্তু ও রচনা প্রভৃতি সংগ্রহ করা এবং প্রয়াত নেতার নামে একটি অধ্যয়ন কেন্দ্রে সংরক্ষণ করা;
(চ) বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মকা- গবেষণা ও অধ্যয়ন বিশেষ করিয়া যে রাজনৈতিক সংগ্রাম ও নেতৃত্ব মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে পরিণতি লাভ করে, তাহার পরিচয় ফুটিয়া ওঠে এ সম্পর্কিত প্রামাণিক দলিলপত্র ও সংকলন সংগ্রহের উদ্যোগ গ্রহণ করা;
(ছ) গণ-আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর অবদান ও তাঁহার বিশ্বাস এবং রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে তাঁহার নেতৃত্ব সম্পর্কে অধ্যয়ন ও গবেষণার উদ্যোগ গ্রহণ করা;
(জ) বঙ্গবন্ধুর উপর একটি গ্রন্থাগার স্থাপন ও চালনা করা এবং এই গ্রন্থাগারকে সমৃদ্ধ করার জন্য নির্বাচিত তথ্যগ্রন্থ ও আলোকচিত্র সংগ্রহ করা;
(ঝ) বাংলাদেশের ইতিহাস, দর্শন ও বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি এবং শান্তি, স্বাধীনতার জন্য জাতীয় আশা-আকাক্সক্ষা সম্পর্কিত তথ্য ও জ্ঞানের প্রসার ঘটায় এমন গ্রন্থ, পুস্তিকা, পত্রিকা ও সাময়িকী প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করা;
(ঞ) যে সকল রাজনৈতিক কর্মী জনসাধারণের স্বার্থরক্ষার জন্য নির্যাতিত এবং তাঁহাদের মৌলিক অধিকার, নাগরিক অধিকার, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য নির্যাতন ভোগ ও ত্যাগ শিকার করিয়াছেন, যাঁহারা কারাগারের যন্ত্রণা ভোগ করিয়াছেন, রাজনৈতিক সংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতি মুক্তিযুদ্ধে যাহারা জীবন দিয়াছেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে হইতে তাঁহাদের নাম সংগ্রহ করিয়া তালিকাভুক্ত করা এবং তাঁহাদের পরিবারের অভাবগ্রস্ত সদস্যদের সাহায্য করা;
(ট) ট্রাস্টের সামর্থ্য অনুযায়ী হাসপাতাল, চিকিৎসা কেন্দ্র, ক্লিনিক ও এতিমখানা সংগঠন ও স্থাপন করা, নিরক্ষরতা দূরীকরণে প্রকল্প ও আন্দোলনে পৃষ্ঠপোষকতা ও সহায়তা দান করা এবং সাক্ষরতার জন্য স্কুলগুলোতে সাহায্য করা;
(ঠ) দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্রদের মধ্যে বৃত্তি বা অন্য কোনো সাহায্য দেওয়া;
(ড) বাংলাদেশের যে কোনো অংশে যে কোনো স্কুল, কলেজ, বিশ^বিদ্যালয় বা অন্য ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য অনুদান দেওয়া।

বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাবিষয়ক কথন : বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের ঐতিহাসিক বাড়িটি আজও তার স্মৃতি সংরক্ষণ করে চলেছে। ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর’ হিসেবে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধু ভবনটিকে স্মৃতি জাদুঘরে রূপান্তর করে ট্রাস্টের সভাপতি বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট এই বাড়িটিকে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর হিসেবে উদ্বোধন করেন।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট দলিলের চতুর্থ অনুচ্ছেদের ধারা ‘ক’ ও ‘গ’ মোতাবেক বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। ট্রাস্ট দলিলের চতুর্থ অনুচ্ছেদের ধারা হলোÑ (ক) জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও কর্মধারার পরিচয় সংবলিত একটি স্মৃতি সংগ্রহালয় (জাদুঘর) গঠন, রক্ষণ ও পরিচালনা করা; এবং (গ) ঢাকার ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার ৩২নং সড়কের প্রয়াত নেতার (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) বাড়িটির রক্ষণাবেক্ষণ এবং বাড়িটিকে জাতীয় ‘ঐতিহাসিক শেখ মুজিব মেমোরিয়াল ইমরাত’ হিসেবে ঘোষণা ও সেরূপে সংরক্ষণ ও চালনা করিবার জন্য সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা (জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের গঠনতন্ত্র)।
ট্রাস্ট দলিল অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের সভাপতি বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার উদ্যোগে এই বঙ্গবন্ধু ভবনকে স্মৃতি জাদুঘরে রূপান্তরের কাজ শুরু হয়। এ জন্য অধ্যাপক আ ফ ম সালাউদ্দিন আহমেদকে সভাপতি করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্যান্য সদস্য হলেনÑ অ্যাডভোকেট গাজীউল হক, স্থপতি মাযহারুল ইসলাম, শিল্পী হাশেম খান, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, কবি রবিউল হুসাইন এবং সদস্য সচিব সিদ্দিকুর রহমান প্রমুখ। অতঃপর ১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট দেশি-বিদেশি সম্মানিত বুদ্ধিজীবী, বিদেশি কূটনৈতিক এবং বঙ্গবন্ধু আদর্শের অনুসারীদের একটি বিরাট সমাবেশে ভাবগম্ভীর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ভবনে এই জাদুঘরের শুভ উদ্বোধন হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরের উদ্বোধন করেন বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা।
জাদুঘর রূপান্তরের সময় বড়িটি মহান নেতার জীবদ্দশায় যেরূপে ঠিল সেরূপে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে সাধ্যমতো। পর্যায়ক্রমিকভাবে এই জাদুঘরের পূর্ণতা পাবে। প্রথমত; বঙ্গবন্ধু ভবনের নিচতলার দুটি কক্ষ ও দোতলায় ৪টি কক্ষ দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০০৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ভবনের তৃতীয়তলা দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয় এবং শেষ পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু ভবনের পিছনের ৬৮৬নং প্লটে সম্প্রসারিত জাদুঘরের জন্য ছয়তলা বিশিষ্ট একটি বর্ধিত ভবন নির্মিত হয়েছে। নবনির্মিত ভবনটিতে বঙ্গবন্ধুর কর্মময় জীবনের স্মৃতি নিদর্শন, আলোকচিত্র, সংবাদচিত্র ও ডকুমেন্ট সম্বলিত সম্প্রসারিত স্মৃতি জাদুঘর ২০১১ সালের ২০ আগস্ট শনিবার সকাল ১১টায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা এবং বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ রেহানা উদ্বোধন করেন।
ভূমিনকশা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু ভবন (বঙ্গবন্ধুর মূল বাসভবন) পরিদর্শন শেষ করে দর্শক পুরাতন ভবন থেকে জাদুঘরের নবনির্মিত অংশের চতুর্থতলায় প্রবেশ করবে। দর্শক লিফটযোগে বা সিঁড়ি দিয়ে সরাসরি চতুর্থতলায় উঠে গিয়ে প্রদর্শনী পরিক্রমা শুরু করতে পারবেন। সম্প্রসারিত স্মৃতি জাদুঘরে প্রদর্শনী পরিকল্পনায় স্থায়ী প্রদর্শনীর পাশাপাশি গ্যালারি, লাইব্রেরি, অডিও ভিজ্যুয়াল গ্যালারি, সেমিনার হল, স্বল্পকালীন প্রদর্শনী গ্যালারি প্রভৃতি সন্নিবেশিত হয়েছে।
সম্প্রসারিত ষষ্ঠতলা ভবনে ২৬টি পর্বে বঙ্গবন্ধুর তথ্য ও সচিত্র ঘটনাবলি তুলে ধরা হয়েছে। পঞ্চমতলায় একটি লাইব্রেরি রয়েছে। জাতির পিতার শৈশব থেকে ১৯৭০-এর নির্বাচন পর্যন্ত চতুর্থতলায় তুলে ধরা হয়েছে। তৃতীয়তলায় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে ১৯৭৩ সালের দেশ পুনর্গঠন পর্যন্ত সচিত্র তথ্য সংযোজন করা হয়েছে। পারিবারিক জীবন থেকে জীবনাবসানের মর্মান্তিক ঘটনাবলি দ্বিতীয়তলায় সন্নিবেশিত হয়েছে। চতুর্থতলা থেকে শুরু করে ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে নামতে পারেন। ভবনের নিচতলায় সভা-সেমিনারের জন্য অডিটরিয়াম রয়েছে।
দর্শক সম্প্রসারিত জাদুঘর পরিদর্শন করে মূল ভবনের জাদুঘর পরিদর্শন করতে পারেন।
বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে ১৯৯৮ সালে জনাব আনোয়ারুল হক লিখেছিলেন, “এই জাদুঘরটি দিয়ে এই শতাব্দী জাদুঘর পরিক্রমায় গর্বিত ইতি টানা হলো বলে মন্তব্য করা যায়। বাংলাদেশের জাদুঘর পরিক্রমার অবশ্যই এটি এই শতাব্দী ইতিবাচক পরিসমাপ্তি।” (হক, ১৯৯৮ : ১৯)।
১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পঠিত বক্তব্যে অধ্যাপক মুতাসীর মামুন বলেন, “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এক সময় আর দল বা পরিবারের ছিলেন না, হয়ে গিয়েছিলে বাঙালির, বাংলাদেশের। এ-কথা মনে রেখেই বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং মেমোরিয়াল ট্রাস্টের ট্রাস্টিরা এ বাড়িটিকে দান করেছেন বাঙালির জন্য। এজন্য আমরা তাঁদের কাছে বিশেষ করে ট্রাস্টের সভাপতি বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার কাছে কৃতজ্ঞ। আমাদের জাতীয় বীরদের স্মৃতি সংরক্ষণ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে করা জরুরি। তাহলে তাঁদের অবমাননার বিরুদ্ধে লড়াইটা জোরদার হয়। মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের মিথ্যা প্রচার রোখা যায়। আসুন নিরস্ত্র মানুষের বিজয়ের প্রতীক এ জাদুঘরটি দল-মত-নির্বিশেষ গড়ে তুলি। (মামুন, ১৯৯৯ : ১৫৯-১৬০)।
বঙ্গবন্ধু ভবনকে জাদুঘরে রূপান্তর প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার বক্তব্য, “এই বাড়িকে ঘিরে সবসময় আমাদের একটা চিন্তা ছিল যে, এমন একটা কিছু করব যা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকবে। একমাত্র আমরা দুই বোন। থাকার মতো জায়গাও ছিল না, তারপরও বাড়িটি জাদুঘরের জন্য দিয়ে দিয়েছি। ১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পর নানা প্রতিবন্ধকতার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে ফেরার পর আমাদের কেউ বাড়ি ভাড়া দিত না। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আমাদের দেশে ফিরতে দেয়া হয়নি। দেশে ফেরার পরও আমাদের ধানমন্ডির বাড়িতে ঢুকতে দেয়া হয়নি। একরাত ছোট ফুপুর বাড়িতে, একদিন মেঝো ফুপুর বাড়িতে এইভাবে আমাকে থাকতে হতো। তারপরও আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল আমরা এটাকে স্মৃতি জাদুঘর করব এবং আমরা সেটা করেছি।” (টজখ-১)।
বাঙালি জাতীয়তাবাদকে জাতিসত্তায় রূপান্তরিত করে একটি জাতি রাষ্ট্র নির্মাণ এবং এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য একটি নিয়মতান্ত্রিক, ধারাবাহিক দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার স্মৃতি বিজড়িত নিদর্শনাদি সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের জন্য এই জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
সামাজিক অবক্ষয়, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীদের রাষ্ট্রীয় মসনদ দখলের ষড়যন্ত্র, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প আর ইতিহাস বিকৃতির ইন্দ্রজালে পতিত প্রজন্মকে ইতিহাসের মুখোমুখি দাঁড়াবার শক্তি, সাহস, শিক্ষা ও চেতনা যোগানদাতা হিসেবে দিগভ্রষ্ট জাতিকে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পারে সঠিক পথ দেখাতে।

তথ্যসূত্র
১. আহমেদ, সিরাজ উদ্দিন; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ভাস্কর প্রকাশনী, ২০০১
২. ইব্রাহীম, নীলিমা; বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, জাগৃতি প্রকাশনী, ২০১০
৩. হাসিনা, শেখ; শেখ মুজিব আমার পিতা (স্মৃতি বড় মধুর, স্মৃতি বড় বেদনার), আগামী প্রকাশনী, ২০১৬
৪. হক, আনোয়ারুল; ঐতিহ্য-১৯৯৮
৫. রহমান, শেখ মুজিবুর; কারাগারের রোজনামচা, বাংলা একাডেমি, ২০১৭
৬. সুফী, মোতাহার হোসেন; ইতিহাসের মহানায়ক জাতির জনক, অনন্যা প্রকাশনী, ২০১২
৭. মওদুদ, বেবী; মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন্নেসা, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা মুজিব স্মারক গ্রন্থ (সম্পাদিত), বৈশাখী প্রকাশনী, ২০১০
৮. মামুন, মুনতাসীর; বাংলাদেশে ফেরা, মজিবরের বাড়ি, ১৯৯৯
৯. জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের গঠনতন্ত্র
১০. URL-1: https://bangabandhumuseum.org.bd/en/page/8/Building-History.

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য