Monday, October 2, 2023
বাড়িSliderবঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জীবনগল্প

বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জীবনগল্প

ড. জেবউননেছা: কবি মহাদেব সাহা তার ‘তোমার বাড়ি’ শিরোনামে কবিতায় লিখেছেন, “এই বাড়িতে সময় এসে হঠাৎ কেমন থমকে গেছে/এই বাড়িটি স্বাধীনতা, এই বাড়িটি বাংলাদেশ/এই বাড়িটি ধলেশ্বরীর, এই বাড়িটি শেখ মুজিবের/এই বাড়িটি বাঙ্গালির।” ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, বাংলা ১৩৮২ সালের ২৯ শ্রাবণ, আরবি ১৩৯৫ হিজরির ৮ শাবানের ছুটির দিনে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ঐতিহাসিক এই বাড়িতেই থমকে গিয়েছিল বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের প্রাণ। যিনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির পাশে ছায়ার মতো থেকে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। এই মহিয়সী নারী ৮ আগস্ট ১৯৩০ সালে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তার পিতার নাম শেখ মোহাম্মদ জহুরুল হক এবং মায়ের নাম হোসনে আরা বেগম। বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমান এবং মাতা সায়েরা খাতুন তাকে স্নেহে আগলে রাখেন। স্থানীয় মিশনারি স্কুলে তিনি লেখাপড়া করেন। বঙ্গবন্ধু এন্ট্রান্স উত্তীর্ণ হওয়ার পর ১৯৪২ সালে তাদের সংসার-জীবন শুরু হয়। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে নিয়ে লিখতে গেলে একটি প্রবন্ধই যথেষ্ট নয়। তবুও ক্ষুদ্র পরিসরে বঙ্গমাতাকে নিয়ে স্মৃতিচারণের ক্ষুদ্র প্রয়াস।

বঙ্গবন্ধু রচিত গ্রন্থ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গমাতা
উক্ত গ্রন্থে বেশ কয়েকবার বঙ্গবন্ধু বঙ্গমাতা সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করেছেন। “আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, ‘বসেই তো আছো, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী : ২)। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র সাত পৃষ্ঠায় বেগম মুজিবের আগমন একজন বধূ হিসেবে, যার নাম রেণু। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “একটা ঘটনা লেখা দরকার, নিশ্চয়ই অনেকে আশ্চর্য হবেন। আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বার বা তের বছর হতে পারে। রেণুর বাবা মারা যাবার পরে ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন, ‘তোমার বড় ছেলের সাথে আমার এক নাতনীর বিবাহ দিতে হবে। কারণ, আমি সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাব।’ রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরব্বীর হুকুম মানার জন্যই রেণুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হলো। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধ হয় তিন বছর হবে। রেণুর যখন পাঁচ বছর বয়স, তখন তার মা মারা যান। একমাত্র রইল তার দাদা। দাদাও রেণুর সাত বছর বয়সে মারা যান। তারপর সে আমার মা’র কাছে চলে আসে। আমার ভাইবোনদের সাথেই রেণু বড় হয়। রেণুর বড় বোনের ও আমার আর এক চাচাতো ভাইয়ের সাথে বিবাহ হয়। রেণু আমার শ্বশুরবাড়িতে থাকল, কারণ আমার ও রেণুর বাড়ির দরকার নেই। রেণুদের ঘর আমাদের ঘর পাশাপাশি ছিল, মধ্যে মাত্র দুই হাত ব্যবধান। অন্যান্য ঘটনা আমার জীবনের ঘটনার মধ্যেই পাওয়া যাবে।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী : ৭-৮)। এই হলো রেণুর জীবন। অপর আর এক স্মৃতিকথায় দেখা যায়, “রেণু কয়েকদিন আমাকে খুব সেবা করল। যদিও আমাদের বিবাহ হয়েছে ছোটবেলায়। ১৯৪২ সালে আমাদের ফুলশয্যা হয়।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী : ২১)। বঙ্গবন্ধু যখন কলেজে ভর্তি হলেন তখন থেকেই ফজিলাতুন্নেছা মানসিক সাহায্য প্রদান করেছেন। “আব্বা, মা, ভাইবোনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রেণুর ঘরে এলাম বিদায় নিতে। দেখি কিছু টাকা হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে। ‘অমঙ্গল অশ্রুজল’ বোধ হয় অনেক কষ্টে বন্ধ করে রেখেছে। বলল, ‘একবার কলকাতা দেখলে আর আসতে চাও না। এবার কলেজ ছুটি হলেই বাড়ি এসো’।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী : ৬১)। বঙ্গবন্ধু ইসলামিয়া কলেজে যখন পড়তে গেলেন। কলেজ প্রিন্সিপাল ডেকে বললেন, তুমি কলকাতা শহরে থাকতে পারবে না। অতঃপর তিনি শহরের বাইরে উল্টোডাঙ্গাতে তার বোনের বাড়িতে থাকলেন। বঙ্গবন্ধু যেন নিরবচ্ছিন্নভাবে লেখাপড়া করতে পারেন এজন্য তাকে উৎসাহ দেবার লক্ষ্যে তিনি উল্টোডাঙ্গা গিয়েছেন। এই স্মৃতিকথাটিতে তারই প্রমাণ পাওয়া যায়, “কিছুদিন পর রেণুও কলকাতায় এসে হাজির। রেণুর ধারণা, পরীক্ষার সময় আমার কাছে থাকলে আমি নিশ্চয়ই পাস করব। বিএ পরীক্ষা দিয়ে পাস করলাম।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী : ৭২)। “টাকা পয়সা নাও থাকতে পারে। টাকার দরকার হলে লিখতে বলেছিল।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী : ১১৮)। নীরবে নিভৃতে বঙ্গবন্ধুর পাশে তিনি সৌভাগ্যের প্রতীক হয়ে ছিলেন। মাঝে মাঝে তাঁর অভিমানের বাঁধ ভেঙ্গে যেতো। কিন্তু কিছুই প্রকাশ করতেন না। “রেণু বলল, ‘এভাবে তোমার কতকাল চলবে।’ আমি বুঝতে পারলাম, যখন আমি ওর কাছে এলাম। রেণু আড়াল থেকে সব কথা শুনছিল। রেণু খুব কষ্ট করত, কিন্তু কিছুই বলত না। নিজে কষ্ট করে আমার জন্যে টাকা পয়সা জোগাড় করে রাখত যাতে আমার কষ্ট না হয়।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী : ১২৬)। “লাহোর থেকে রেণুকে চিঠি দিয়েছিলাম, বোধ হয় পেয়ে থাকবে।” “লাহোর থেকে ফিরে নিশ্চয়ই একবার বাড়িতে আসব। রেণু তো নিশ্চয়ই পথ চেয়ে বসে আছে। সে তো নীরবে সকল কষ্ট সহ্য করে, কিন্তু কিছু বলে না। কিছু বলে না বা বলতে চায় না, সেই জন্য আমার আরও বেশী ব্যথা লাগে।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী : ১৪৫-১৪৬)। “গোপালগঞ্জ গিয়ে দেখি থানার ঘাটে আমাদের নৌকা। আব্বা; মা, রেণু, হাচিনা ও কামালকে নিয়ে হাজির। ঘাটেই দেখা হয়ে গেল (অসমাপ্ত আত্মজীবনী : ১৮৩)। ধৈর্যশীল রেণু বাচ্চাগুলোকে নিয়ে একাই দিনাতিপাত করেছেন। অপেক্ষা করেছেন কখন বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকে ফিরবেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার ভালোবাসা ছিল শান্ত নদীর মতো বয়ে যাওয়া স্রোত, মাঝে মাঝে সেই স্রোত খরস্রোতা হয়ে যেতো। এই স্মৃতিকথাটুকু তাই প্রমাণ করে। “রেণু আমাকে যখন একাকী পেল, বলল, ‘জেলে থাকো আপত্তি নেই, তবে স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখ। তোমাকে দেখে আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেছে। তোমার বোঝা উচিত আমার দুনিয়ায় কেউ নাই। ছোটবেলায় বাবা-মা মারা গেছেন, আমার কেউই নাই। তোমার কিছু হলে বাঁচব কি করে?’ কেঁদেই ফেলল। আমি রেণুকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, তাতে ফল হয় উল্টা। আরও কাঁদতে শুরু করল।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী : ১৯১)। রেণু মাঝে মাঝে রাগতস্বরে অভিমান নিয়ে কথা বলতেন। “কেন তুমি অনশন করতে গিয়েছিলে? এদের কি দয়া মায়া আছে? আমাদের কারও কথাও তোমার মনে ছিল না? কিছু একটা হলে কি উপায় হত? আমি এই দুইটা দুধের বাচ্চা নিয়ে কি করে বাঁচতাম? হাচিনা, কামালের অবস্থা কি হত? তুমি বলবা, খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট তো হত না? মানুষ কি শুধু খাওয়া-পরা নিয়েই বেঁচে থাকতে চায়? আর মরে গেলে দেশের কাজই বা কিভাবে করতা?” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী : ২০৭)। কতটুকু দেশপ্রেমিক হলে এমন প্রশ্নবানে জর্জরিত করতে পারেন বঙ্গবন্ধুকে। একসময় রেণু চিরচেনা গ্রাম ছেড়ে সন্তানদের নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। ভাড়া থাকেন ঢাকার বিভিন্ন স্থানে। এই স্মৃতিকথা থেকে তাই জানা যায়, “রেণু ঢাকায় এসেও শান্তিতে বাস করতে পারেননি। আমি সন্ধ্যার দিকে ঢাকায় ফিরে এলাম। বাসায় যেয়ে দেখি রেণু ছেলেমেয়ে নিয়ে গতকাল ঢাকায় এসেছে। সে এখন ঢাকায়ই থাকবে।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী : ২৬২)।

বঙ্গবন্ধু রচিত গ্রন্থ ‘কারাগারের রোজনামচা’য় বঙ্গমাতা
বঙ্গবন্ধু রচিত ‘কারাগারের রোজনামচা’য় বঙ্গমাতা সম্পর্কে স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেছেন, “সরকার হুকুম দিয়েছে ১৪ দিনের মধ্যে বাড়ি ছাড়তে। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে মহাবিপদেই পড়ল আমার স্ত্রী।” (কারাগারের রোজনামচা : ১২০)। “তাও হাল ছেড়ে দেননি রেণু। একসময় রেণু বড় মেয়ের বিয়ের জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। রেণু দেখা করতে এসেছিল। রেহানার জ্বর, আসে নাই। রাসেল জ্বর নিয়ে এসেছিল। হাচিনার বিবাহের প্রস্তাব এসছে। রেণু ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।” (কারাগারের রোজনামচা : ১৯৪)। “১৪ তারিখে রেণু বিশেষ অনুমতি নিয়ে দেখা করতে এসেছে। ঈদের জন্য এই অনুমতি দিয়েছে।” (কারাগারের রোজনামচা : ২০৩)। কারাগারে বঙ্গবন্ধুর জন্য নিয়মিত খাবার পাঠাতেন রেণু। “যথারীতি রবিবার সকাল থেকে খিচুড়ি পাকের জোগাড়ে আত্মনিয়োগ করা হলো। রেণু কিছু ডিমও পাঠাইয়াছে।” (কারাগারের রোজনামচা : ২৩৫)।

লেখকের স্মৃতিতে বঙ্গমাতা
বঙ্গমাতাকে নিয়ে বিশিষ্ট লেখক এবং অধ্যাপক ড. নীলিমা ইব্রাহীম তার স্মৃতিচারণের একপর্যায়ে লিখেছেন, “রেণুর আরেকটি পোষ্য ছিল একটি খাটি বঙ্গ সন্তান অর্থাৎ দেশী কুকুর নাম তার টমি। ২৫ মার্চের টমির বত্রিশ নম্বরেই ছিল। তারপর কেমন করে কেউ জানে না ১৮ নম্বর বাড়িতে এসে হাজির। টমি থাবা দিয়ে গেটে ধাক্কা দিতো, সেন্ট্রি দরজা খুলে দিতো। রেণু খুব উপভোগ করত এ দৃশ্যÑ বলতো, ‘তোরা আমাকে দরজা খুলে না দিলেও, রোজ দু’বেলা আমার কুকুরকে তো গেট খুলে দিস।’ এতেই বুঝা যায়, তিনি কতটা সংবেদনশীল নারী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ব্যবহৃত পাইপে তামাক পুরে দেওয়া থেকে শুরু করে, পায়জামার ডুরি পর্যন্ত লাগিয়ে দিতেন তিনি। রাজনৈতিক কর্মীদের আপ্যায়নের জন্য তার সংগ্রহে ছিল শ’পাঁচেক কাচের প্লেট, কাপ। যা পরবর্তীতে ১৯৭১-এ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।” অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত বঙ্গমাতা অধ্যাপক ড. নীলিমা ইব্রাহীমকে কথার এক ফাঁকে বলেছিলেন, “একদিন খুব গম্ভীরমুখে রেণু বললÑ আপা, আমি আপনাদের উপর খুব রাগ করেছি। শান্ত হয়ে বললাম বেশ? কি করছি আমরা? বললেন নিজের ভাইকে বানিয়েছেন ‘বঙ্গবন্ধু’ আর আমাকে ‘বঙ্গমাতা’, বেশ আমি বুঝি বঙ্গবান্ধবী হতে পারি না? এতোই কি বুুড়ো হয়েছি। আমরা সবাই হেসেই অস্থির।” এই হলো বঙ্গমাতার সহজ সরল কথোপকথন।

বড় তনয়া শেখ হাসিনার স্মৃতিতে বঙ্গমাতা
বঙ্গমাতার বড় তনয়া গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, “ত্যাগের মধ্য দিয়ে একটা সংসারকে সুন্দর করা যায়, একটি প্রতিষ্ঠানকে সুন্দর করা যায়, একটা দেশকে সুন্দর করা যায়। চাওয়া পাওয়ার ঊর্ধ্বে উঠে নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার চেয়ে বড় আর কিছু না। আমার মা সেই দৃষ্টান্ত দেখিয়ে গেছেন। আমার মা গণভবনে বা সরকারী বাসভবনে থাকেননি। কারণটা হচ্ছে তিনি বলতেনÑ ‘আমার ছেলেমেয়েকে নিয়ে সরকারি বাসভবন বা শান-শওকতে থাকব না। তারা বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত হউক সেটা আমি চাই না। বিলাসিতায় আমরা যেন গা না ভাসাই সেটার ব্যাপারে তিনি যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। আমার মা নিজ হাতে রান্না করতেন। আমার মা আমাদের মানুষ করার পাশাপাশি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ প্রতিটি সংগঠনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল। নির্দেশনা দেয়া, বাইরের অবস্থা জেলখানায় থাকা আব্বাকে (বঙ্গবন্ধু) জানানো, বাবার নির্দেশনা নিয়ে সেগুলো পৌঁছে দেয়া এই কাজগুলো বঙ্গমাতা খুব দক্ষতার সাথে করতেন।” ‘কারাগারের রোজনামচা’র উপক্রমনিকায় শেখ হাসিনা লিখেন, “আমার মা আমাকে বললেন, ‘একবার যেতে পারলে আর কিছু না হোক তোর আব্বার লেখা খাতাগুলো যেভাবে পারিস নিয়ে আসিস।’ খাতাগুলো মা’র ঘরে কোথায় রাখা আছে তাও বলে দিলেন। আব্বার লেখা এই খাতা উদ্ধার আমার মায়ের প্রেরণা ও অনুরোধের ফসল। আমার আব্বা যতবার জেলে যেতেন মা খাতা-কলম দিতেন লেখার জন্য। বারবার তাগাদা দিতেন। আমার আব্বা যখন জেল থেকে মুক্তি পেতেন, মা সোজা জেল গেটে যেতেন, আব্বাকে আনতে আর আব্বার লেখাগুলো যেন আসে তা নিশ্চিত করতেন। সেগুলি অতি যতেœ সংরক্ষণ করতেন।” (কারাগারের রোজনামচা : ৮-৯)।

ছোট তনয়া শেখ রেহানার স্মৃতিতে বঙ্গমাতা
বঙ্গমাতার ছোট তনয়া শেখ রেহানা বলেন, “মাত্র ৪৪ বছর বয়সে তো তিনি আমাদের ছেড়ে চলেই গেলেন। কত অল্প বয়সে এতগুলো ছেলেমেয়ে নিয়ে জীবন সংগ্রামে নেমে পড়তে হয়েছে। আব্বা আগের দিন মন্ত্রী, পরের দিন জেলখানায়, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সরকারি বাসা ছেড়ে দিতে হয়েছে, কিন্তু কেউ বাসা ভাড়া দিচ্ছে না। আমার মায়ের কাছ থেকে আমাদের যে জিনিসটি সবার আগে শেখা উচিত, তা হলো ধৈর্য আর সাহস। সবাইকে এক করে রাখা। ”

কবির কাব্যে বঙ্গমাতা
বেশ কিছু কবি বঙ্গমাতাকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন, তার মধ্যে কবি ও নাট্যকার মু. জালাল উদ্দিন নলুয়া লিখেছেন। “পুতুল খেলার বয়সে হলে তুমি ঘরনী/তোমাকে ধন্য ধন্য করে আজ এই ধরনী। শান্তির ঘরে কারাগার দেখেছো বারবার/দিশারী অগ্নিতেজে দুর্বার রাহবার। অমানিশার কালিমা নাশি সত্যের খোঁজে/শোষকের পতন চাহি মুক্ত ভাষা বুঝে। সংগ্রামী মহা সারথীর দুর্জয়ে অগ্নিশপথে/সাহস যোগাও সতত ছোট আলোর রথে। কত ঈদ, কত পার্বণ, কতোনা শুভদিন/মুক্তি কামনায় সারথী কারাগারে অন্তরীণ। ঘরের চেয়ে মাতৃভূমি প্রিয়, অনেক বড়ো/বঞ্চিত জনতার কান্না হৃদয়ে আছে জড়ো। শিকল ভাঙ্গার গানে দিশারী অহরহ জাগে/ফুল ফোটায় ঘরনী তাঁর সংসার বাগে। ডানা মেলে মুক্ত বলাকা/রক্তে ভিজে পতাকা/অমøান তুমি বঙ্গমাতা/আছো হৃদয়ে আঁকা।”

রাজনৈতিক দূরদর্শী বঙ্গমাতা
বঙ্গমাতা দেশের জন্য কতটা অন্তঃপ্রাণ ছিলেন, তার অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। তিনি একজন রাজনৈতিক সচেতন নারী ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতকালে ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ বেগম মুজিবের কাছে পরামর্শ নিতেন এবং নেতৃবৃন্দদের তিনি বুদ্ধি পরামর্শ প্রদান করতেন এবং অনেক সময় নেতাদের ডাকতেন দলের সমস্যা শোনার জন্য। দলের সংকটকালে অর্থ সাহায্য প্রদান করতেন। একটি ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়, ১৯৬৯ সালে লাহোরে আইয়ুব খান গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেন। তখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারাবন্দি শেখ মুজিবকে গোলটেবিলে অংশগ্রহণ করার জন্য প্যারোলে মুক্তির প্রস্তুতিকালে বেগম মুজিব প্যারোলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। কারণ বঙ্গমাতা বুঝতে পেরেছিলেন, আইয়ুব খানের পতন আসন্ন। আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ বেগম মুজিবকে রাজি করানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বেগম মুজিব মুক্তি না নেওয়ার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুকে অনুপ্রাণিত করেছেন। তার এই বিস্ময়কর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে বেগবান করে। শুধু কি তাই, ১৯৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যের বিষয়ে বঙ্গবন্ধুকে তিনি একটি কথাই বলেছিলেন, “তোমার যেটি মনে আসে তুমি সেটিই বলবে।” বঙ্গবন্ধু সেদিন তাই করেছিলেন।
বেগম মুজিব গান শুনতেন। গ্রামোফোনে তিনি গান শুনতেন। গ্রামে ছিল তার একটি কলের গান। তিনি জগণ¥য় মিত্র, শচীন দেব বর্মন, সন্ধ্যা-লতা, সুরাইয়া আর আব্বাসউদ্দিনের নজরুল সংগীত শুনতেন। অর্থাভাবে এবং রাজনৈতিক কাজে ঘরের জিনিসপত্র এবং নিজের গহনা বিক্রি করে দিলেও তার সংগ্রহে থাকা বাদ্যযন্ত্র বিক্রি করেননি। বই পড়তে ভালোবাসতেন। বেগম মুজিব বার্ট্র্রান্ড রাসেলের জীবনী পড়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে পরবর্তীকালে তার পুত্রসন্তানের নাম রেখেছিলেন রাসেল। সাদাসিধে সহজ-সরল জীবন ছিল বেগম মুজিবের। সেটির প্রমাণ পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধুর আসবাবপত্র এবং ডাইনিং টেবিলে রাখা তৈজসপত্রের মাধ্যমে এবং তার পরিধানকৃত শাড়ি কাপড়ে। ফার্স্টলেডি হওয়া সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রীয় সফরে তাকে দেখা যেত না। ছেলেমেয়েদের কাপড় নিজে সেলাই করতেন। এমনকি ছেলেমেয়েদের ঈদের কাপড়ও তিনি সেলাই করতেন। পরবর্তীকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মায়ের কাছ থেকে সেলাই শিখেন। তিনি সুতি শাড়ি পরিধান করতেন। তিনি ভালো পান সাজাতে পারতেন। তার নিরাভরণ জীবনের শেষ উদাহরণ, মৃত্যুর সময় তার পায়ে ছিল বাথরুম সিøপার।
গ্রামে কোনো মেয়ে এসএসসি উত্তীর্ণ হলে তাকে ঢাকায় কোনো কলেজে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার পরামর্শ, সন্তানদের মৌলভি রেখে কোরআন শরিফ শিক্ষা, নাচ শিখানো, সেতার শিখানো, বেহালা শিখানোর সিদ্ধান্ত ছিল তারই। অথচ নিজের দিকে কোনোদিন তাকাননি কোনোদিন। স্বামীর কাছ থেকে ফিতা-চুড়ি-শাড়ির আবদার করেননি। বঙ্গবন্ধু লুকিয়ে মেয়েদের টাকা দিতেন বেগম মুজিবের জন্য শাড়ি আনতে।
বেগম মুজিব দশগুণে গুণান্বিতা যেন দশভূজা নারী, তার মধ্যে যে দশটি গুণ দেখা যায়, তা হলোÑ তিনি একাধারে আদর্শ মাতা, বুদ্ধিমতী স্ত্রী, ধৈর্যশীল, দায়িত্বশীল, বিচক্ষণ, রন্ধন পটিয়সী, সংগীতপিয়াসী, স্নেহময়ী, দূরদর্শী এবং ধীশক্তিসম্পন্ন সাহসিকা। এমন একজন গুণসম্পন্ন নারীর উৎসাহ প্রেরণায় বঙ্গবন্ধু রাজনীতিতে নিশ্চিন্তে নিজেকে নিবেদিত করেছেন। তিনি মানসিকভাবে অসহযোগিতা করলে বঙ্গবন্ধু হয়তো এতটা পথ এগুতে পারতেন না। ১৭ মার্চ ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর শেষ জন্মদিনের ফুলের মালা বেগম মুজিবের গলায় পরিয়ে দিয়েছিলেন। এটাই প্রাপ্তি এবং স্বীকৃতি বেগম মুজিবের। জাতির পিতা বঙ্গমাতাকে সম্বোধন করতেন রেণু নামে। ‘রেণু’ শব্দের অর্থ উদার। বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকার সময়গুলো একাকী যন্ত্রণা সয়ে বঙ্গবন্ধুকে সাহস জুগিয়েছেন, মানসিকভাবে সমর্থন দিয়েছেন। শত বিপদে কোনোদিন টলে যাননি। পাহাড়ের মতো অবিচল থেকেছেন। শত দুঃখ সয়ে যাওয়া এই নারী আমাদের বাঙালির বঙ্গমাতা। বেগম মুজিবের মাঝে নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাওয়া যায়। বেগম রোকেয়া স্বপ্ন দেখেছিলেন বৈষম্যমুক্ত সমাজের। বেগম মুজিব স্বপ্ন দেখেছিলেন বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্রের। তিনি ‘বঙ্গমাতা’ হয়ে বেঁচে থাকবেন ইতিহাসের পাতায়। বনানী গোরস্তানে ১৫ আগস্টের শহিদদের সাথে বঙ্গবন্ধুর রেণু বাঙালির বঙ্গমাতা বেগম মুজিব বুকের সব কষ্ট চাপা দিয়ে নীরবে শায়িত আছেন। আগস্টের এই শোকে বঙ্গমাতাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। প্রার্থনা করছি বাঙালির প্রতি ঘরে বঙ্গমাতার মতো তনয়া জন্মগ্রহণ করুক। তবে তার শেখানো সাধারণ জীবনযাপনের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তারই দুই তনয়া সেই আদর্শ বহন করে চলছেন। একবারে সহজ-সরল সাদামাটা জীবনের জ্বলন্ত উদাহরণ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আর এক কন্যা শেখ রেহানা। বেগম মুজিবকে ছাড়া বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িটি মানায় না। তাও ইট-পাথরের মাঝে রয়ে গেছে তার স্মৃতিচিহ্ন। বাড়িটিতে এখন আর বেগম মুজিব রোববার ছুটির দিনে লুচি ভাজেন না। মোড়ায় বসে থাকেন না বঙ্গবন্ধু। অথবা সেই বাড়ির ছাদে বেগম মুজিবের প্রিয় গান, তার ছেলে শেখ কামাল গান গায় না, শেষ করব বেগম মুজিবের কন্যা শেখ রেহানার স্মৃতিচারণ দিয়ে। “কামাল ভাই সেতার বাজাচ্ছেন। আমাকে বললেন, তুই একটা গান ধর। মায়ের পছন্দ জগণ¥য় মিত্র। ‘যত লিখে যাই, চিঠি না ফুরায় কথা তো হয় না শেষ… তুমি আজ কত দূরে।’ কিংবা শচীন দেবের গানÑ

‘নদী যদি হয়রে ভরাট কানায় কানায়
হয়ে গেলে শূন্য হঠাৎ
তাকে কি মানায়।’

আমাদের ভর ভরন্ত একটা পৃথিবী ছিল। হঠাৎ করে একদিন সব শূন্য হয়ে গেল।”

লেখক : অধ্যাপক ও প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান, লোকপ্রশাসন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য