১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের সদস্যবৃন্দ, আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও শেখ ফজলুল হক মণির পরিবারের সদস্যবৃন্দ এবং সেনা কর্মকর্তা কর্নেল জামিলসহ যাদের হত্যা করা হয়েছিল, ২১ বছর পর প্রচলিত ফৌজদারি আইনে হত্যাকা-ে জড়িতদের বিচার হয়েছে। ১৯৭৫-এর নভেম্বরে খুনি মোশতাক তার সহযোগীদের নির্দেশে কারারুদ্ধ জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানকে জেলখানার অভ্যন্তরে খুনিদের বিচারের জন্যও জাতিকে প্রায় তিন দশক অপেক্ষা করতে হয়েছে। একইভাবে ফৌজদারি আইনে এই হত্যাকা-ের বিচার হয়েছে।
খুনি খন্দকার মোশতাকের এই নৃশংস হত্যাকা-ের বিচার হওয়ায় জাতি নিঃসন্দেহে বেশ কিছুটা কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। কিন্তু সত্য হলোÑ এই হত্যাকা-ে যে ষড়যন্ত্রমূলক রাষ্ট্রদ্রোহ, তার বিচার হয়নি। এটা একটা রহস্যময় ও বিস্ময়কর ঘটনা।
রাষ্ট্রপক্ষ প্রচলিত ফৌজদারি আইনে যথাযথ তদন্ত সম্পন্ন করে অভিযুক্তদের বিচারের জন্য নিম্ন আদালতে মামলা দায়ের করেছে। নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে অপরাধীরা প্রথমে হাইকোর্টে আপিল আবেদন করেছে। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছে। সুপ্রিম কোর্টের রুলিংয়ের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন দিয়েছে। দীর্ঘ এই আইনি প্রক্রিয়া শেষে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনাও করার সুযোগ নিয়েছে। তাদের আবেদন খারিজ হওয়ার পর এই হত্যাকা-ের বিচারের রায় কার্যকর করা হয়েছে। তাই এই হত্যাকা-ের বিচার নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারেনি।
জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার এজন্য দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছেন। পক্ষান্তরে সমাজের অগ্রগণ্য বুদ্ধিজীবী এবং রাজনীতিবিদ/রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, নানা পেশার মানুষসহ দেশবাসীর একটি অংশ হত্যাকা-ের বিচারের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিলেও তারা রাষ্ট্রদ্রোহ ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা না নেওয়াকে দুর্বোধ্য বলে মনে করেন। অত্যাশ্চর্য হলেও সত্য, ১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের সেনাবাহিনীর একটি অংশ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যা করে। কিন্তু সেই হত্যাকা-ের বিচার না করে তৎকালীন বিএনপি সরকার মিউটিনির বিচার করে। ফলে মিউটিনির বিচার হলেও জিয়া হত্যার বিচার আজও হয়নি। চট্টগ্রামের আদালতে একটি মামলা দায়ের করলেও, তা আর আগায়নি। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পন্ন হলেও ষড়যন্ত্র ও রাষ্ট্রদ্রোহের বিচার অসম্পন্ন রয়ে গেছে।
প্রশ্ন হলো যে, ষড়যন্ত্র ও রাষ্ট্রদ্রোহের বিচার হলো না কেন? বাংলাদেশের কা-জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ বিশ্বাস করে বঙ্গবন্ধু হত্যার কুশীলবদের একজন প্রধান পা-া তাহের উদ্দিন ঠাকুর ও শাহ মোয়াজ্জেমের মতো দুর্বৃত্তরা হত্যা মামলায় বেকসুর খালাস পেলেও ষড়যন্ত্র ও রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় খালাস পেত না। আওয়ামীপন্থি কোনো কোনো আইনজীবী মনে করেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার এই রহস্যের কিছু কিছু উপাদান রয়েছে, যা আইনজীবী অথবা বিচারকদের দৃষ্টিতে গোচর হয়নি অথবা তারা উপেক্ষা করেছেন। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফসুলজ, ’৭৫-এ বাংলাদেশে নিয়োজিত রাষ্ট্রদূত বোস্টার প্রমুখ, ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর সাবেক প্রধান, কাও, প্রয়াত সাংবাদিক মিজানুর রহমান সংগৃহীত অবমুক্ত মার্কিন দলিলপত্র এবং সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাথে লিফসুলজের সাক্ষাৎকারে, আরও গবেষণায় ষড়যন্ত্র ও রাষ্ট্রদ্রোহের আলামত তুলে ধরেছেন, যা বিবেচনায় নিলে রাষ্ট্রদ্রোহিতার সঙ্গে যুক্ত এবং ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে এখনও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। ষড়যন্ত্র ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার সাথে জড়িতদের বিচার না হলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের বিচারও অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। জাতীয় শোকের মাসে জনগণের এটাই প্রত্যাশা। তবে ভরসার কথা এই যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি এক আলোচনা সভায় মন্তব্য করেছেন যে, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনের ষড়যন্ত্র একদিন উদ্ঘাটন হবেই।’ প্রধানমন্ত্রীর এই ধারণা যে কেবল কথার কথা থাকবে না; বরং জননেত্রী শেখ হাসিনা যে মন্তব্য করেছেন তা একদিন বাস্তবায়িত হবে। আমাদের কেবল কিছুদিন ধৈর্য ধারণ করতে হবে।