কাজী নাবিল আহমেদ: বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পরিবার ও আওয়ামী লীগের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজে একজন ভালো ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন। খেলতেন ভলিবল, হকিও। বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমানেরও খেলাধুলার প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল। তিনি গোপালগঞ্জ অফিসার্স ক্লাব ফুটবল দলের অধিনায়ক ছিলেন। ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে তিনি ক্লাবটির সেক্রেটারির দায়িত্বও পালন করেন।
বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন, “আমার আব্বাও ভালো খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি অফিসার্স ক্লাবের সেক্রেটারি ছিলেন। আর আমি মিশন স্কুলের ক্যাপ্টেন ছিলাম। আব্বার টিম ও আমার টিম যখন খেলা হতো তখন জনসাধারণ খুব উপভোগ করতো। আমাদের স্কুল টিম খুব ভালো ছিল। মহকুমায় যারা ভালো খেলোয়াড় ছিল, তাদের এনে ভর্তি করতাম এবং বেতন ফ্রি করে দিতাম।”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্কুল ফুটবল দলের অধিনায়ক ছিলেন। তার উদ্যোগেই ১৯৩৭ সালে গোপালগঞ্জে মিশন স্কুলে গড়ে উঠেছিল ফুটবল ও ভলিবল দল। এক সময় তিনি প্রাদেশিক পর্যায়ের ফুটবল দলেও জায়গা করে নেন। ১৯৪০ সালের শুরুতে তিনি রাজধানী ঢাকায় ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। নিয়মিত খেলার সুযোগ না থাকলেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪১ সাল থেকে আমৃত্যু ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সঙ্গে নানাভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৪৩-৪৪ মৌসুমে বগুড়ায় একটি গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হয়েছিল। এই টুর্নামেন্টে তার নেতৃত্বে ওয়ান্ডারার্স ক্লাব অংশ নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে বাস্কেটবলও খেলেছেন। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তীকালে দেশ পরিচালনার বিশাল দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে কখনও কখনও তিনি প্রাণের টানে চলে যেতেন ক্লাব প্রাঙ্গণে। ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের অফিস কক্ষটি এখনও তার সাক্ষ্য দেয়, সেখানে টানানো রয়েছে ফুটবলার শেখ মুজিবের এক হাস্যোজ্জ্বল ছবি।
আওয়ামী লীগ ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত হয় গণমানুষের সংগঠন হিসেবে। তৎকালীন মুসলিম লীগের খাজা নাজিমুদ্দীন সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে পূর্ব বাংলার মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে রোজ গার্ডেনে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়েই তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব পান।
পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাস হচ্ছে বাঙালির বঞ্চনার ইতিহাস। সুদীর্ঘ ২৩ বছর রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ক্রীড়াসহ সকল বিষয়েই বাঙালির অধিকার নিষ্পেষিত করে রাখা হয়।
১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে পাকিস্তানের জাতীয় ক্রীড়াঙ্গনে বাঙালিদের অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল খুবই সীমিত। পূর্ব বাংলার টাকা দিয়ে দল গঠন করা হলেও বাঙালি ফুটবল, ক্রিকেট ও হকি খেলোয়াড়রা জাতীয় দলে সুযোগ পেতেন না। যদিও অবিভক্ত ভারতবর্ষে বাংলার রাজধানী কলকাতা ছিল ফুটবলের তীর্থস্থান। ‘কলিকাতা মহামেডান’, ‘মোহনবাগান’, ‘ইস্টবেঙ্গল’-এর মতো ক্লাব ছিল সকলের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। তবে সেই সময়ে অনেকাংশে একই খেলোয়াড় ও সংগঠকদের নিয়ে ঢাকাতেও ক্লাব ফুটবল যাত্রা শুরু করলেও ইচ্ছেকৃতভাবে স্থানীয় খেলোয়াড়দের কোণঠাসা করে রাখা হতো।
পাকিস্তান আমলে জাতীয় দলে হাতেগোনা খেলোয়াড়রা সুযোগ পেতেন। ষাটের দশকে ফুটবলের জাতীয় দলে সুযোগ পান নবী চৌধুরী, জাকারিয়া পিন্টু, গোলাম সারওয়ার টিপু, মেজর হাফিজউদ্দীন, প্রতাপ শঙ্কর হাজরা প্রমুখ খেলোয়াড়রা। ক্রিকেটের জাতীয় দলে রকিবুল হাসান, আশরাফুল হক, তানভীর মাযহার তান্নাসহ অনেকে ডাক পেলেও তাদের স্থান দেওয়া হতো না। কেবল রকিবুল হাসান জাতীয় দলের পক্ষে একবার ডাক পেয়েছিলেন। কিন্তু গণ-আন্দোলনের কারণে সেই খেলায় অংশ নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি।
বাংলাদেশের ভূখ-ের ক্রীড়াঙ্গনে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হচ্ছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে যখন বাংলার ছাত্র, শ্রমিক, জনতা, সেনাবাহিনী, ইপিআর মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন একদল তরুণ সংগঠক ও খেলোয়াড় গঠন করেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। পৃথিবীর ইতিহাসে যুদ্ধকালীন প্রথম ফুটবল দল এটি। বর্তমানে ফিলিস্তিন ফুটবল দল এ ধরনের তহবিল সংগ্রহ ও জনমত গঠন করছে। ১৯৭১ সালের জুন মাসে দলটি গঠিত হয়। প্রথম দিকে কয়েকজনকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিতে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের কথা উল্লেখ করে মুজিবনগর গিয়ে তাতে যোগ দিতে বলা হয়। এ সময় মুজিবনগরে প্রথমে গিয়ে উপস্থিত হন প্রতাপ শঙ্কর হাজরা, সাইদুর রহমান প্যাটেল, শেখ আশরাফ আলীসহ আলী ইমাম এবং অন্যরা। এরপর সেখান থেকে আকাশবাণীতে (কলকাতা রেডিও) ঘোষণা দেওয়া হলো বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থানরত খেলোয়াড়দের মুজিবনগরে রিপোর্ট করার জন্য। ঘোষণার পরে ৪০ জন খেলোয়াড় মুজিবনগর ক্যাম্পে যোগ দেন। ৩৪ জন খেলোয়াড়, সাথে ম্যানেজার এবং কোচসহ সর্বমোট ৩৬ জন নিয়ে গড়া ফুটবল দলের অধিনায়ক ছিলেন জাকারিয়া পিন্টু। সহ-অধিনায়ক ছিলেন প্রতাপ শঙ্কর হাজরা। ব্যবস্থাপক ছিলেন তানভীর মাজহারুল ইসলাম তান্না (পরবর্তীকালে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের কর্মকর্তা) এবং প্রশিক্ষক ছিলেন ননী বসাক।
কলকাতার থিয়েটার রোডে অবস্থিত প্রবাসী সরকারের নির্দেশনায় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের জাকারিয়া পিন্টু, প্রতাপ শংকর হাজরা, মোহাম্মদ কায়কোবাদ, অমলেশ সেন, আইনুল হক, শেখ আশরাফ আলী, আলী ইমাম, কাজী সালাউদ্দীন প্রমুখ খেলোয়াড়রা বিভিন্ন ম্যাচে অংশগ্রহণ করে স্বাধীনতা সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যান। সেই সময় তরুণ শেখ কামাল ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এমএজি ওসমানীর এডিসি। সেই দায়িত্বে থেকেই তিনি তৎকালীন স্বাধীন বাংলার খেলোয়াড়দের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশে ক্রীড়াঙ্গনের নতুন স্বপ্ন দেখতেন। বিভিন্ন এলাকায় মোট ১৬টি ম্যাচ খেলে স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার পাশাপাশি ফান্ড সংগ্রহ করা হয়। ম্যাচগুলো থেকে আয়কৃত ৫ লাখ টাকা মুক্তিযুদ্ধের ফান্ডে জমা দেওয়া হয়। সর্বশেষ খেলাটি অনুষ্ঠিত হয় মুম্বাইতে, যেখানে মহারাষ্ট্র ফুটবল দলের নেতৃত্ব দেন ভারতের খ্যাতনামা সাবেক ক্রিকেট অধিনায়ক নবাব মনসুর আলি খান পতৌদি। ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের পর দেশে ফেরেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্যরা। যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের ফুটবলকে চাঙ্গা করতে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল কাজ করে।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্লাবে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ সাংগঠনিক দায়িত্বে ছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ আইন প্রণয়ন করেন। তার উদ্যোগেই বাংলাদেশের ক্রীড়া ফেডারেশনগুলো আন্তর্জাতিক ক্রীড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর স্বীকৃতি ও অনুমোদন লাভ করে। তৎকালীন মোহামেডান ক্লাবে অ্যাডভোকেট জহীরুদ্দীন সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন, তিনি আওয়ামী লীগেরও একজন দায়িত্বশীল নেতা ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল ছিলেন একজন অতুলনীয় ক্রীড়া সংগঠক ও ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব। তিনি তার সতীর্থ ও বন্ধু হারুনুর রশীদ, ফারুক আহমেদ বাচ্চু, সালমান এফ রহমান, সাহাবুদ্দীন সেন্টু, কেএম মোজাম্মেল, জিএম ইকবাল ও জিএম ফারুকসহ আরও অনেককে নিয়ে ১৯৭২ সালে আবাহনী ক্রীড়া চক্র প্রতিষ্ঠা করেন। আবাহনী ক্লাবের প্রতিষ্ঠাকালে অন্যতম সদস্য ছিলেন তার বড় বোন বর্তমানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি এখনও ক্লাবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
ক্রীড়াঙ্গনে নতুন বার্তা আবাহন করে এই ক্লাবের যাত্রা শুরু হয়। সূচনালগ্নে ফুটবলে গোলাম সারওয়ার টিপু, আবদুস সাদেক, অমলেশ সেন, কেএন নওশেরুজ্জামান, কাজী সালাউদ্দীনসহ অনেক তারকা খেলোয়াড় ছিলেন। ক্রিকেটে ছিলেন আলিউল ইসলাম ও কালিচরণ এবং হকিতে আবদুস সাদেক, সাব্বির ইউসুফ, মহসীন, ইব্রাহীম সাবের প্রমুখ। ফুটবল, ক্রিকেট, হকিসহ বিভিন্ন খেলায় আবাহনী পারদর্শিতার স্বাক্ষর রাখে। তৎকালীন আবাহনী দলে আইরিশ কোচ বিল হার্টকে নিয়ে আসা হয়। তিনি বদলে দেন বাংলাদেশে প্রচলিত ফুটবল খেলার ধরন; বিশ্ব ফুটবলে সে-সময়ে ডাচ্ ফুটবল দলের ‘টাচ অ্যান্ড পাস’ কৌশলকে আবাহনীর মাঠে প্রচলন ঘটান এক শৈল্পিক আধুনিকতার। এ কারণে আবাহনীকে আজও বাংলাদেশে আধুনিক ফুটবলের পথপ্রদর্শক হিসেবে গণ্য করা হয়।
শুধু ফুটবল নয়, ক্রীড়াপাগল বঙ্গবন্ধুর সার্থক উত্তরসূরি ছিলেন ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব শেখ কামাল। একইসঙ্গে বাস্কেটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন ও অ্যাথলেটে পারদর্শী ছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালে ঢাকা ক্রিকেট লিগে চ্যাম্পিয়ন হয় আবাহনী ক্রীড়া চক্র, একই সালে বাস্কেটবল লিগ চ্যাম্পিয়ন হয় ঢাকা ওয়ান্ডারার্স। মজার বিষয় হচ্ছে উভয় দলেরই খেলোয়াড় ছিলেন শেখ কামাল। একই বছর সলিমুল্লাহ হলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় হয়েছিলেন দ্রুততম মানব। শেখ কামাল আবাহনী ক্রীড়া চক্রের হয়ে ফুটবল এবং ক্রিকেট খেললেও বাস্কেটবল খেলেছেন বাবার প্রিয় ক্লাব ওয়ান্ডারার্সের হয়ে। তার নেতৃত্বে ওয়ান্ডারার্স ক্লাব ১৯৭৩ ও ১৯৭৫ সালে বাস্কেটবল লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়। শেখ কামাল রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম নেওয়ার পরও খেলাধুলাই তার কাছে বেশি প্রাধান্য পেয়েছিল। হয়তো জাতির সামনে আরও অনেক কিছুই প্রকাশ করার ছিল তার। কিন্তু, সে-সুযোগ আর পাননি তিনি। ঘাতকদের নির্মম বুলেটে ওই বছরই বাবা আর পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে নির্মমভাবে শহিদ হয়ে যান তিনি।
বঙ্গবন্ধুর পুত্রবধূ অর্থাৎ শেখ কামালের সহধর্মিণী সুলতানা কামাল খুকিও ছিলেন ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব। ১৯৭৩ সালে ভারতের নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা। সেই দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন সুলতানা কামাল খুকি। ওই আসরে যাওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু সুলতানা কামালকে বললেন, ‘বাঙালির মান রাখতে পারবি তো?’ খুকির সাহসী উত্তর ছিল ‘পারবো।’ খুকি ওই আসরে লংজাম্প ইভেন্টে দ্বিতীয় হন। এটাই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের হয়ে প্রথম কোনো পদক জয়। তিনি দেশে ফেরার পর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খুকিকে বাহবা দিয়েছিলেন। খুকি তখনও বঙ্গবন্ধুর পুত্রবধূ হননি। মৃত্যুর কিছুদিন আগে ১৯৭৫ সালেও হার্ডলসে স্বর্ণপদক জিতেছিলেন খুকি।
তিনি শুধু একজন ভালো অ্যাথলেটই ছিলেন না, ছিলেন দক্ষ সংগঠকও। মেয়েরা যেন খেলাধুলায় মন ঢেলে দেয়, সে-জন্য রীতিমতো কাউন্সেলিং করতেন। ১৯৬৬ সালে জাতীয় অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপের লংজাম্পে রেকর্ড গড়ে স্বর্ণপদক জেতেন স্কুল-পড়–য়া খুকি। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান অলিম্পিক গেমসে লংজাম্পে নতুন রেকর্ড গড়ে চ্যাম্পিয়ন হন। ১৯৭০ সালে অল পাকিস্তান উইমেন্স অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে মেয়েদের মধ্যে সেরা হন। ১৯৭৩ সালে ১০০ মিটার হার্ডলসেও জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাথলেটিক্সে প্রথম নারী ‘ব্লু’ সুলতানা কামাল খুকি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও পাকিস্তান প্রাদেশিক গেমসেও রেকর্ড গড়ে স্বর্ণপদক জয়ের কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন তিনি।
বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় পুত্র শেখ জামালও ছিলেন খেলোয়াড়। ফুটবল ও ক্রিকেটের প্রতি তার ছিল বিশেষ ঝোঁক। তিনি প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগে আবাহনী ক্রীড়া চক্র ও আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবে খেলেছেন। শেখ জামাল আবাহনী ক্রীড়া চক্রে ক্রিকেট দলেও খেলতেন।
যে কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় যাওয়ার আগে বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের বঙ্গভবনে ডেকে নিতেন বঙ্গবন্ধু। তাদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন, উৎসাহ দিতেন। ১৯৭৩ ও ১৯৭৫ সালে মালয়েশিয়ার মারদেকা টুর্নামেন্টে যাওয়ার আগে জাতীয় ফুটবল দলকে তার কার্যালয়ে ডেকে নিয়েছিলেন।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। বিদেশে থাকায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। কিন্তু আবাহনী হারায় সেই রাতে শেখ কামালকে। তার মৃত্যুতে তখনই ক্লাবটির বিলীন হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তৎকালীন অনেক কর্মকর্তার নেতৃত্বে ও খেলোয়াড়দের ঐকান্তিক চেষ্টায় ক্লাবটি টিকে যায়। হারুনুর রশীদ, কেএন হক, সোহেল রহমান, ফারুক আহমেদ বাচ্চু, সালমান এফ রহমান, মোমেনউদ্দীন আহমেদসহ অনেক কর্মকর্তাই আদর্শিক কারণে ক্লাবটিকে টিকে থাকতে সহযোগিতা করেন। খেলোয়াড় নান্নু, সালাউদ্দীন, চুন্নু, অমলেশ, আশরাফ, টুটুল, আনোয়ার, হেলালসহ আরও অনেকে আদর্শিক কারণে আবাহনীতে খেলেন।
১৯৭৫-পরবর্তী ভয়াবহ সেনাশাসনের সময় ক্লবের ওপর বারবার হামলা হয়। জিয়াউর রহমান এবং এরশাদ আমলে অনেকবার আবাহনী ক্লাব ধ্বংসের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু হারুনুর রশীদ, কাজী শাহেদ আহমেদ, মোমেনউদ্দীন আহমেদ, আবদুস সাদেকসহ অনেক সংগঠক ঢাল হয়ে ক্লাবটিকে টিকিয়ে রাখেন। আশির দশকের শেষ দিকে আবাহনী ক্লাবকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য ক্রীড়া সংগঠন থেকে লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত করা হয়। সেখানে প্রথম চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান এবং ডিরেক্টর ইনচার্জ ছিলেন কাজী শাহেদ আহমেদ। এছাড়া অন্যতম উদ্যোক্তা হিসেবে ছিলেন আ হ ম মোস্তফা কামাল, সাবের হোসেন চৌধুরী, আফজালুর রহমান সিনহা, অঞ্জন চৌধুরী পিন্টুসহ আরও কয়েকজন।
১৯৭৫ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের অনেক নেতা দীর্ঘ সময়ের জন্য কারাবরণ করেন। অনেক নেতা প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কর্মকা- করতে বাধাগ্রস্ত হতেন। সে-সময় আবাহনী ক্লাব সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। যেমন খুলনায় মোস্তফা রশিদী সুজার নেতৃত্বে এই ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রামে আবাহনী প্রতিষ্ঠিত করেন দিদারুল ইসলাম, হাজী রফিকুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন নেতা। ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রাম আবাহনী ক্লাবও অনেক বছর ধরে ফুটবলে স্বতন্ত্র দল হয়ে খেলছে।
পিতার মতো বঙ্গবন্ধুও ছিলেন দক্ষ খেলোয়াড় ও ক্রীড়া পৃষ্ঠপোষক, তার ছেলেরাও ছিলেন তেমনই। তবে তাদের অবর্তমানে সেই মশাল উঁচিয়ে ধরে পুরো বাংলাদেশকে পথ দেখিয়ে চলছেন বঙ্গবন্ধুরই সুযোগ্য কন্যা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ক্রীড়াবান্ধব শেখ হাসিনার রাষ্ট্র পরিচালনাকালেই বাংলাদেশও স্পর্শ করেছে ক্রীড়াঙ্গনের বড় অর্জনগুলো।
আইসিসি চ্যাম্পিয়ন হওয়া থেকে ওয়ানডে ও টেস্ট মর্যাদা কিংবা ফুটবলে সাফের স্বর্ণ বিজয়ের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম জড়িয়ে রয়েছে। জড়িয়ে আছে বিশ্বকাপ ক্রিকেট, টোয়েন্টি২০ বিশ্বকাপ ক্রিকেট, এসএ গেমস ও বাংলাদেশ গেমস আয়োজনের মতো ঘটনার সঙ্গে। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেন এবং আবারও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার ক্রীড়াঙ্গনকে অগ্রাধিকার দেয়। এই সময়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ দল ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ক্রিকেট বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে পরাজিত করে তাক লাগিয়ে দেয়।
খেলায় জয়লাভের পাশাপাশি সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যোগাযোগ আর ক্রীড়া কূটনীতিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্রীড়া কূটনীতিতেও সমান উজ্জ্বল। আর তাই ক্রিকেট বিশ্বকাপে প্রথমবার অংশ নেওয়ার মাত্র এক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ অর্জন করে টেস্ট খেলার যোগ্যতা। ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল যেন বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে এক ঘোরলাগা সময়। এই সময়ে জাতীয় ক্রিকেট দলের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোসহ দেশ ও দেশের বাইরে ক্রিকেটকে তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে কা-ারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হন তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুধু ক্রিকেট নয়, বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনই যেন নতুন করে জেগে ওঠে এ-সময়কালে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ফেডারেশনে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনকে সরব রাখেন। এ-সময়ই অনেক নেতার ঐকান্তিক চেষ্টায় তৈরি করা হয় শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিনা কারণে ঘাতকের বুলেটের আঘাতে প্রাণ দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর আদরের ছোট্ট ভাইটির নামে গড়ে ওঠে এই সংগঠন। আর এর মাধ্যমে আবাহনীর পরে আরেকটি ক্লাবের মাধ্যমে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক বার্তা পৌঁছে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার আবারও দায়িত্বে আসার পর বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন ফের চাঙ্গা হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় সব সময়ে সচেষ্ট। আমরা দেখতে পাই, শেখ হাসিনার সরকার বিভিন্ন পর্যায়ে সমতার নীতিতে ও পিছিয়ে থাকা নারীদের এগিয়ে নিতে তাদের জন্য খেলা চালু করে। নারীদের ফুটবল, ক্রিকেট দল তৈরিসহ বিভিন্ন বয়সভিত্তিক খেলায় নারীদের দল গঠন করা হয়।
প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগেই সারাদেশে অনূর্ধ্ব-১২ ও ১৪ বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা কাপ চালু করা হয়েছে। যার ফলে সারাদেশেই খেলার এক নবজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কেবল জাতীয় দল, ক্লাব দলই নয়, বিভিন্ন বয়সভিত্তিক পুরুষ ও মহিলা দলকেও কাছে টেনে নেন, পিতার মতোই তাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে এসব দলের খেলোয়াড়দের উৎসাহিত করেন। তিনি তাদের বিভিন্ন পুরস্কার ও আর্থিক অনুদান দেন। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সান্নিধ্য পাওয়া সকল জাতীয় খেলোয়াড় ও উঠতি খেলোয়াড়দের জন্য সব সময়ই একটি বাড়তি প্রেরণা। খেলার আগে ও পরে ব্যক্তিগতভাবে সরাসরি ফোনে কথা বলে সাহস, উৎসাহ এবং সাধুবাদ দেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী এতটাই ক্রীড়াপাগল যে ঢাকা স্টেডিয়ামে বেশিরভাগ ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনালে তাকে প্রধান অতিথি হিসেবে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা থাকলে সুযোগ পেলেই স্টেডিয়ামে সশরীরে হাজির হন এবং খেলোয়াড়দের উৎসাহ দেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের খেলাধুলার উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন। তার উৎসাহ ও প্রত্যক্ষ উদ্যোগে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম, মিরপুর শের-ই-বাংলা জাতীয় স্টেডিয়াম, চট্টগ্রাম জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামসহ অনেক স্টেডিয়াম পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। কক্সবাজারে ‘শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম’ নির্মাণ করা হয়েছে। দেশের প্রায় সকল স্টেডিয়াম, সুইমিংপুল, জিমনেসিয়াম ও ক্রীড়া কমপ্লেক্সের সংস্কার ও উন্নয়নে তিনি সব সময় হাসিমুখে বরাদ্দ দিয়েছেন। সারাদেশে নতুন নতুন স্টেডিয়াম নির্মাণ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশ কোয়ার্টার ফাইনাল, এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলেছে, অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জয় করেছে। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পাকিস্তান, ভারত, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সিরিজ জয় করেছে। নারীদের অনূর্ধ্ব-১৫ ফুটবল দল সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়ন এবং এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ ফুটবলে আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। নারী ক্রিকেট দল জায়গা করে নিয়েছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে।
আওয়ামী লীগ একটি ঐতিহ্যবাহী দল এবং এ-কারণে বাঙালির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক মুক্তি ও প্রগতির জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছে। ক্রীড়াঙ্গনে আওয়ামী লীগের ও বঙ্গবন্ধু-পরিবারের অবদান অপরিসীম। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনকে আধুনিক রূপ দিতে বঙ্গবন্ধু-কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সময় তার মেধা, সময় ও সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগ নিয়ে এসেছে বাঙালির স্বাধীনতা এবং সারা পৃথিবীতে ক্রীড়ার মাধ্যমে বাংলাদেশকে পরিচিত করতে কাজ করে যাচ্ছে নিরলসভাবে।
লেখক : সংসদ সদস্য ও ক্রীড়া সংগঠক