Monday, October 2, 2023
বাড়িদশম বর্ষ,ষষ্ঠ সংখ্যা,মে-২০২০বঙ্গবন্ধু ও সংবাদপত্র ছয় দফা থেকে গণ-অভ্যুত্থান

বঙ্গবন্ধু ও সংবাদপত্র ছয় দফা থেকে গণ-অভ্যুত্থান

দুনিয়া বোধ হয় হাসে আমাদের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দেখে। যে দেশে মানুষের মতামত বলার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে, সে দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকবে কেমন করে?
Ñ কারাগারের রোজনামচা : শেখ মুজিবুর রহমান

সোহরাব হাসান: আমরা যে বইটি নিয়ে আজ এখানে আলোচনা করছি তার শিরোনাম ‘বঙ্গবন্ধু ও সংবাদপত্র : ছয় দফা থেকে গণ-অভ্যুত্থান’। লেখক ড. কামরুল হক। তিনি গবেষক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ। বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। বইয়ের শিরোনামেই স্পষ্ট এর ভেতরে কী আছে। আলোচ্য সময় ১৯৬৬-৬৯।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৬-দফা কর্মসূচি পেশ করেছিলেন। তিন বছরের মাথায় ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ঘটে গণ-অভ্যুত্থান; ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুসহ সব রাজনৈতিক বন্দীকে কারাগার থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। ঊনসত্তরের ২৫ মার্চ আইয়ুব সেনাবাহিনী প্রধান ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে দৃশ্যপট থেকে সরে যান। এর দুবছর পর একাত্তরের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়।
গেল শতকের ষাটের দশকে জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশের প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু যে ৬-দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন, এদেশের মানুষ তার ভেতরেই তাদের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন দেখতে পায়। এ-কারণে ডান ও বাম রাজনৈতিক দলগুলো সে-সময় যত বিরূপ ও নিস্পৃহ প্রতিক্রিয়া দেখাক না কেন, সাধারণ মানুষ এটিকে তাদের নিজস্ব কর্মসূচি হিসেবে নিয়েছিল। ৬-দফা কর্মসূচি প্রণয়ন ও উত্থাপনে বেশ নাটকীয়তা ছিল। সাধারণত দলীয় ফোরামে কোনো সিদ্ধান্ত হওয়ার পর নেতৃত্ব সেটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু ৬-দফার ক্ষেত্রে ঘটল বিপরীত। আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান তার বিশ্বস্ত কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে এটি প্রণয়ন করেন লাহোরে আহূত বিরোধী দলের সম্মেলনে উপস্থাপনের জন্য। এই বিশ্বস্ত সহকর্মীদের একজন ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। দলের অন্য কাউকে তারা জানতে দেননি। ৫-৬ ফেব্রুয়ারি এ সম্মেলন হয়। বিষয় নির্ধারণী সভায় পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা ৬-দফা আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করতে রাজি না হওয়ায় বঙ্গবন্ধু সম্মেলন বর্জন করেন এবং লাহোরেই সংবাদ সম্মেলন ডেকে ৬-দফা কর্মসূচির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ব্যাখ্যা করেন।
কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক দাবি করেন, ৬-দফায় নতুন কিছু নেই; প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের কথা ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ২১-দফায় ও ১৯৫০ সালে সংবিধান প্রণয়ন-সংক্রান্ত সর্বদলীয় সভায় উত্থাপিত প্রস্তাবেও ছিল। কিন্তু তারা ভুলে যান যে পূর্ববর্তী প্রস্তাবের সঙ্গে ৬-দফার মৌলিক পার্থক্য হলো এতে পূর্ববঙ্গের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটি পুরোপুরি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার কথা আছে। আছে এমন একটি কেন্দ্রীয় সরকারের কথা যেটি সম্পূর্ণ প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক সরকারের ওপর নির্ভরশীল। ফলে ৬-দফা আর দাবি আদায়ের কর্মসূচি থাকেনি, হয়ে উঠেছে স্বশাসন তথা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দলিল।
অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলাম ও রেহমান সোবহানের লেখা থেকে আমরা এও জানতে পারি যে পূর্ব ও পশ্চিমাংশের অর্থনৈতিক বৈষম্য নিয়ে বঙ্গবন্ধু তাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন আলোচনা করেছেন, পরামর্শ নিয়েছেন। পরামর্শ নিয়েছেন বাঙালি আমলাদেরও। কিন্তু কর্মসূচিটি প্রণয়ন করেছেন তিনি নিজেই। এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ষাটের দশকের শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক রেহমান সোবহান ‘এক দেশ দুই অর্থনীতি’ তত্ত্ব হাজির করে পাকিস্তানিদের ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন। ৬-দফা সেই ভয়টি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতৃত্ব ৬-দফার তাৎপর্য অনুধাবনে ব্যর্থ হলেও পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থবাদী চক্র ও ডানপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো ঠিকই বুঝেছিল। এ-কারণে আইয়ুব খান অস্ত্রের ভাষায় এর জবাব দেওয়ার কথা বলেছিলেন। মোনায়েম খান হুমকি দিয়েছিলেন ‘আমি যত দিন গভর্নর আছি, শেখ মুজিবকে জেলেই থাকতে হবে।’ তারা ৬-দফার মধ্যে যে বিচ্ছিন্নতাবাদের আলামত দেখেছিল, সেটি পুরোপুরি অসত্য ছিল না।
কামরুল হক ৬-দফা কর্মসূচির প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘তাসখন্দ চুক্তির মাধ্যমে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের অবসানের পর পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের চরম অবহেলা ও ঔদাসীন্যের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোচ্চার হয়েছিলেন। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যকার বৈষম্য এবং পূর্ব বাংলায় পশ্চিম পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের লক্ষ্যে ১৯৬৬ সালে তিনি ৬-দফা কর্মসূচি তৈরি করেন।’
৫টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত ‘বঙ্গবন্ধু ও সংবাদপত্র : ছয় দফা থেকে গণ-অভ্যুত্থান’ বইয়ের লেখক বিভিন্ন সংবাদপত্রের খবর ও মতামতের ভিত্তিতে এর রসদ সংগ্রহ করেছেন। ৬-দফা কর্মসূচির খবর পরিবেশনে কোন পত্রিকা কতটা পক্ষপাত করেছে, কোন পত্রিকা কতটা বিরূপতা দেখিয়েছে, সেসবও উঠে এসেছে তার গবেষণায়। আলোচ্য সময়ে পূর্ববঙ্গের প্রধান পত্রিকা ছিল ইত্তেফাক, সংবাদ, দৈনিক আজাদ, দৈনিক পাকিস্তান, পয়গাম, পাকিস্তান অবজারভার, মর্নিং নিউজ ইত্যাদি। তবে লেখক সূত্র হিসেবে বেশি ব্যবহার করেছেন উল্লিখিত ৪টি বাংলা পত্রিকা। পাকিস্তান অবজারভার কিংবা মর্নিং নিউজ কদাচিৎ ব্যবহৃত হয়েছে।
লেখক বইটিতে নিজে মন্তব্য কমই করেছেন। প্রধানত সেই সময়ের পত্র-পত্রিকার মন্তব্য-প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেছেন। ৬-দফার আন্দোলনের সময় জনপ্রিয় পত্রিকা ছিল ‘ইত্তেফাক’ ও ‘দৈনিক আজাদ’। আর বামপন্থিদের মুখপত্র ছিল ‘সংবাদ’। এই তিন পত্রিকার রাজনৈতিক মত ও সাংস্কৃতিক ভাবনা এক ছিল না। ষাটের দশকের শুরুতে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন বিষয়ে ‘সংবাদ’ ও ‘ইত্তেফাক’-এর বিপরীতে ‘আজাদ’-এর অবস্থান ছিল। দিনের পর দিন দুই পক্ষের মধ্যে বিতর্ক হয়েছে। তারপরও অস্বীকার করা যাবে না যে পূর্ব বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ে এই ৩টি পত্রিকা বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। অবশ্য মূলধারার সংবাদপত্রের বাইরে ‘সান্ধ্যদৈনিক আওয়াজ’, ‘সাপ্তাহিক জনতা’সহ আরও কিছু পত্রিকা জাতীয়তাবাদের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিল।

দুই
বঙ্গবন্ধু লাহোর থেকে ফিরে এসে ঢাকা বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনায় বলেছেন, ‘পাক-ভারতের মধ্যকার ১৭ দিনের যুদ্ধে যে অভিজ্ঞতা হইয়াছে, তাহাতে প্রশাসনিক দিক দিয়ে জনসাধারণের বৃহত্তর কর্তব্য সাধনের কথা বিবেচনা করিয়া দেশের প্রশাসনিক কাঠামো সম্পর্কে নতুনভাবে চিন্তা করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।’
২০ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে ৬-দফা কর্মসূচি অনুমোদন পায়। এরপর ১৮ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন, যাতে বঙ্গবন্ধু সভাপতি ও তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপরই আওয়ামী লীগ ৬-দফার পক্ষে সারাদেশে প্রচারাভিযান চালায়। বঙ্গবন্ধু যেখানে জনসভা করেন, সেখানেই বিপুল জনসমাগম ঘটে। সরকার ভয় পেয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা-বিবৃতিকে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর আখ্যায়িত করে তার প্রতি সরকার একের পর এক গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। কোনো আদালত থেকে তিনি জামিন নিলেন তো পুলিশ আরেকটি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। সর্বশেষ ৮ মে নারায়ণগঞ্জে জনসভা করে বঙ্গবন্ধু ঢাকায় ফিরে আসার পর ওই দিন রাতে ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে গ্রেফতার হন। এর কিছুদিনের মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রথম সারির প্রায় সব নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। এ অবস্থায় দ্বিতীয় সারির নেতারা আন্দোলনকে এগিয়ে নেন; যার কম-বেশি বিবরণ কামরুল হকের বইয়ে আছে।
উল্লেখ করা প্রয়োজন যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের বাইরে মূলধারার কোনো দলই ৬-দফা কর্মসূচিকে সমর্থন দেয়নি। বরং পশ্চিম পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের বাইরে কিছু সংগঠন সমর্থন জানিয়েছে। ১৯৬৬ সালের ২০ মার্চ দৈনিক আজাদের খবর থেকে আমরা জানতে পারি ‘পাকিস্তান জাতীয় সম্মেলন কনভেনিং কমিটির সেক্রেটারি জেনারেল মালিক হামিদ সরফরাজ ৬-দফার প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন।’ নবগঠিত পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা ও আইয়ুব খানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ৬-দফা নিয়ে জনসভায় প্রকাশ্য বাগ্-যুদ্ধের আহ্বান জানিয়ে পরে পিছু হটেন।
আমরা যদি সেই সময়ের পত্রিকার খবর ও ভাষ্যগুলো পর্যালোচনা করি দেখতে পাব, ইত্তেফাক ৬-দফার সমর্থনে দৃঢ় সমর্থন দিয়েছিল। সংবাদ ও আজাদ ৬-দফাকে সরাসরি সমর্থন না দিলেও সরকারের চ-নীতির বিরোধিতা করেছে। আওয়ামী লীগের বাইরে যারা জোরালো কণ্ঠে ৬-দফার সমর্থন জানিয়েছিল তাদের মধ্যে ছাত্র, শ্রমিক ও আইনজীবীরাই প্রধান। আইনজীবীরা বিবৃতি দিয়ে, সমাবেশ করে সরকারের দমন-পীড়নের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। আদমজীসহ বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকেরা প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন।
১৯৬৭ সালের ১৩ জুন আওয়ামী লীগ যে প্রতিবাদ দিবস পালন করে, তার খবর ১৪ মে ইত্তেফাক পরিবেশন করে এভাবে :
নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন স্তব্ধ করার অপচেষ্টা হইতে বিরত থাকিয়া অবিলম্বে জাতীয় নেতৃবৃন্দকে মুক্তি দাও। প্রতিবাদ দিবসে দিকে দিকে বিক্ষুব্ধ মানুষের ক্ষুব্ধ গর্জন।
এই ভাষা সংবাদপত্রের পেশাদারি ভাষা নয়। তার চেয়ে বেশি কিছু। জাতীয় জীবনে এমন সময় আসে, যখন সংবাদপত্রকে পেশাগত দায়িত্বের বাইরে গিয়েও কিছু করতে হয়। ৬-দফা কর্মসূচি পেশের পর ইত্তেফাক সেটি করেছে। সংবাদ, আজাদ ইত্তেফাক-সহ আরও কিছু পত্রিকা ঊনসত্তরেও একই ভূমিকা নেয়।

তিন
সংবাদ পরিবেশনের ধরন দেখে সব সময় পত্রিকার রাজনৈতিক মত জানা যায় না। কিন্তু সম্পাদকীয় কিংবা উপ-সম্পাদকীয় কলামে সেটি পরিষ্কার হয়ে যায়।
গবেষক কামরুল হক তার বইয়ে যে কটি সম্পাদকীয় ও উপ-সম্পাদকীয় তুলে ধরেছেন, তাতে সেই সময়ের রাজনীতির পক্ষ-বিপক্ষ স্পষ্ট হয়েছে। ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষায় ৬-দফার পক্ষে যেসব যুক্তি তুলে ধরেছেন, তা পাঠককে ব্যাপকভাবে আন্দোলিত করেছে। ১৯৬৬ সালের ৪ মার্চ তিনি লিখলেন, বাস্তবতার আলোকে ৬-দফা কর্মসূচি। লেখাটি শুরু ছিল এ-রকম :
‘৬-দফা কর্মসূচি দেখে আঁতকে ওঠার বা ভীতসন্ত্রস্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই। আসুন, আমরা ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার মন নিয়ে প্রকৃত অবস্থা বিচার করি। সংশ্লিষ্ট সকলে পরস্পর পরস্পরের বক্তব্য ও মতামত বোঝার ও সম্যক উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন। প্রত্যেক ব্যাপারে যারা আমাদের সন্দেহ করেন, তাদের কাছে আমি একটি প্রশ্ন করতে চাই : পূর্ব পাকিস্তানের বদলে পশ্চিম পাকিস্তান যদি আজকের এই পর্বতপ্রমাণ বৈষম্যের শিকার হতো, তাহলে তাদের প্রতিক্রিয়া কি হতো?’
২৩ মার্চ ইত্তেফাক-এ লাহোর প্রস্তাবের আলোকে শিরোনামে প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে বলা হয় : লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী ফেডারেল ও পূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র-কাঠামোর মধ্যে আত্মমর্যাদা, স্বায়ত্তশাসনাধিকারসহ পূর্ব পাকিস্তানিদের বসবাসের আকাক্সক্ষাকে বিচ্ছিন্নতাবাদ বলিয়া আখ্যা দেওয়া হইতেছে। এবার তেইশে মার্চে তাই লাহোর প্রস্তাবের আলোকেই দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি ও পরিবর্তিত রাজনীতি বিচার বিশ্লেষিত হওয়া প্রয়োজন।… পূর্ব পাকিস্তানে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনাধিকারের ৬-দফা দাবিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে লাহোর প্রস্তাবেরই সম্প্রসারণ ও পরিবর্ধন বলা যাইতে পারে। স্বাধীনতায় ঐতিহাসিক সনদের মূল কাঠামো অক্ষুণœ রাখিয়া স্বাধীনতা-উত্তর ১৮ বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে এই ৬-দফা প্রণীত হইয়াছে বলিয়া মনে হয়।
৩০ মার্চ রাজনৈতিক মঞ্চ কলামে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া লিখেন, ‘৬-দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে সকলে মিলিয়া দুর্বার জনমত গঠন করিতে পারিলে এই দাবি কাহারো পক্ষে প্রতিহত করা সম্ভব হইবে না। তাই, আমরা মনে করি, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের সমর্থক বিভিন্ন দল অস্পষ্টভাবে ও বিভিন্ন সুরে কথা না বলিয়া ৬-দফার ভিত্তিতে দাবি উত্থাপন করিতে পারিলে লক্ষ্যে পৌঁছা সহজ হইবে।’
তবে বাস্তবতা হলো আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের সমর্থক বিভিন্ন দল শেষ পর্যন্ত এক সুরে কথা বলতে পারেনি। ছাত্র-তরুণ ও বিভিন্ন পেশাজীবী পেরেছে।
অন্যদিকে সরকার সমর্থক ‘দৈনিক পাকিস্তান’ ও মোনায়েম খানের মালিকানাধীন ‘পয়গাম’ সরাসরি ৬-দফার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ১৮ মার্চ দৈনিক পাকিস্তান ‘দফায় দফায়’ শিরোনাম সম্পাদকীয়তে লিখেছে :
দফা ওয়ারী দাবি-দাওয়ার সংখ্যায় যথাসম্ভব বৈচিত্র্য সাধন করিয়া পাকিস্তানের কতিপয় ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতিক আসর মাত করিবার চেষ্টায় আবার মাঠে নামিয়া পড়িয়াছেন। গত কয়েক বৎসরের রাজনীতির ভানুমতীর খেলায় এ কথাটা অত্যন্ত স্পষ্ট হইয়া গিয়াছে যে জনসাধারণের নেতৃত্বের দাবিদার রাজনীতিকেরা আর যাই কিছু করেন, এদেশের সাধারণ মানুষের অভাব অভিযোগ ও দুর্দশা মোচন অন্তত তাহাদের আন্তরিক অভিপ্রায় হইতে পারে না।
৩১ মার্চ দৈনিক পায়গাম সম্পাদকীয়তে লিখেছে : আওয়ামী লীগ নেতাদের ৬-দফা ও অন্যান্য বিরোধী দলের পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র, স্বায়ত্তশাসন প্রভৃতি বড় বড় বুলি যে লোক ভুলানো ছলাকলা মাত্র তা বুদ্ধিমান লোকের বুঝিয়া উঠা কঠিন নয়।
কামরুল হুদা তার বইয়ে ৬-দফা সম্পর্কে সংবাদ, আজাদ, পাকিস্তান অবজারভার বা অন্য কোনো পত্রিকার সম্পাদকীয়/উপ-সম্পাদকীয় উদ্ধৃতি করেননি। ফলে ওসব পত্রিকার মতামত জানা সম্ভব হয়নি।
লেখক উপসংহারে লিখেছেন, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অনেক রাজনৈতিক দল ৬-দফার প্রতি সমর্থন জানায়। কিন্তু তিনি পত্রিকা উদ্ধৃত করে যেসব তথ্য-উপাত্ত হাজির করেছেন তা এই বক্তব্য সমর্থন করে না। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের বাইরে কোনো দল ৬-দফার প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থন করেছে বলে আমাদের জানা নেই। যত দূর জানা যায়, নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টি তার অনুসারী ছাত্র ইউনিয়নকে ৭ জুনের কর্মসূচিতে শরিক হতে বলেছিল। পিকেটিং করতে গিয়ে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমসহ কয়েকজন ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী গ্রেফতারও হন। কিন্তু আন্দোলনটি পরিচালিত হয়েছিল এককভাবে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতৃত্বেই। তখনও পর্যন্ত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ ভাগ হয়নি। তবে দলে মস্কো-পিকিং বিরোধ স্পষ্ট। ভাগ হওয়ার পর ন্যাপের মস্কোপন্থি অংশ সীমিত সমর্থনের নীতি নেয় বলে নেতারা পরবর্তীকালে দাবি করেছেন। আর পিকিংপন্থি অংশ সরাসরি বিরোধিতা করে। কেউ কেউ ৬-দফাকে সিআইএ’র দলিল বলেও আখ্যায়িত করেছিলেন। সে-সময়ে ছাত্র ইউনিয়ন পিকিংপন্থি অংশের নেতৃত্বে ছিলেন এ-রকম একজন রাজনৈতিক কর্মী, পরবর্তীকালে যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন, ব্যক্তিগত আলাপে বলেছেন, তারা ভাসানী ন্যাপের তৎকালীন নেতৃত্বের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ৬-দফার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বক্তব্য কি? নেতারা কোনো যুক্তি না দিয়ে ৬-দফা নিয়ে জামায়াতে ইসলামী যে পুস্তিকা বের করেছিল সেটাই তাদের পড়তে দেন। এটি আমাদের বাম রাজনৈতিক নেতৃত্বের দেউলিয়াত্বের উদাহরণই বটে।
কামরুল হক লিখেছেন, ৬-দফার সমর্থনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে সারাদেশে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলো নানা কর্মসূচি পালন করে এবং সে-খবর পত্রিকাগুলোও গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছে। তার মন্তব্যের মধ্যে অতিশয়োক্তি নেই। পাকিস্তানি শাসকের চোখে আওয়ামী লীগ ও ইত্তেফাক উভয়ই শত্রু। এক পর্যায়ে সরকার ইত্তেফাক বন্ধ করে দিলে সংবাদ ও আজাদ সীমিত আকারে হলেও সেই দায়িত্ব পালন করে।
অন্যান্য রাজনৈতিক দল ৬-দফা সমর্থন না করলেও এই কর্মসূচির কারণে সরকার যে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন চালায়, তার প্রতিবাদ করেছে। তবে তা পত্রিকায় বিবৃতি কিংবা পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে জনপ্রতিনিধিদের বক্তৃতার মধ্যেই সীমিত ছিল। কামরুল হকের বইয়ে উদ্ধৃত বিভিন্ন পত্রিকার খবরে দেখা যায়, পূর্ববঙ্গের বিশিষ্ট রাজনীতিকদের মধ্যে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের নেতা আতাউর রহমান খান, জাতীয় পরিষদের বিরোধীদলীয় নেতা নুরুল আমিন, নেজামে ইসলামের ফরিদ আহমদ, ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আলতাফ হোসেন, প্রবীণ রাজনীতিক আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, এমনকি পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা আবদুর রহিম বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার ও হয়রানির প্রতিবাদ জানিয়েছেন। মতাদর্শিক ভিন্নতা সত্ত্বেও এই রাজনৈতিক সহমর্মিতা সে-সময়ের রাজনীতিকদের মধ্যে ছিল। এখন আছে সে-কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না।

চার
১৯৬৮ সালের অক্টোবরে আইয়ুব উন্নয়ন দশক পালন করেন। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো একে অভিহিত করেছিল কালো দশক। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হয় ওই বছরের শুরুতে। তখনও দেশে চলছিল জরুরি অবস্থা। সংবাদপত্রের ওপর জারি ছিল নানা বিধিনিষেধ। আইয়ুব-মোনায়েম ভেবেছিলেন, এ-রকম একটি মামলায় শেখ মুজিবকে জড়িয়ে রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়া যাবে। কিন্তু এই মামলাই তাদের পতন ত্বরান্বিত করেন। সরকারের ওপর মানুষ এমনিতেই ক্ষুব্ধ ছিল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সেই ক্ষোভকে আরও বাড়িয়ে দেয়। পাকিস্তানি শাসকচক্র যাকে দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছিল, তিনিই জনগণের কাছে আবির্ভূত হলেন নন্দিত বীর হিসেবে।
আর ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি ৪টি রাজনৈতিক সংগঠন যথাক্রমে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) এবং জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের (এনএসএফ) একাংশ ১১-দফা কর্মসূচি ঘোষণা করলে আন্দোলনের চরিত্রই পাল্টে যায়। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলেও ছাত্র নেতৃত্বের মধ্যে দ্বিধা ছিল না। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঘোষিত ১১-দফা দাবির ১০টিই ছিল রাজনৈতিক এবং তাতে বঙ্গবন্ধুর ৬-দফার মূল দাবিও অন্তর্ভুক্ত হয়। ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের পর ৮টি রাজনৈতিক দল মিলে গঠন করে ডাক বা ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি। এই জোটে বামপন্থি ন্যাপ (মোজাফফর) জাতীয়তাবাদী আওয়ামী লীগ এবং ধর্মবাদী জামায়াতে ইসলামীও ছিল। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপ ডাক-এ যোগ না দিলেও আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে।
সেই সময়ের সংবাদপত্র সম্পর্কে লেখকের বিশ্লেষণ হলো : ইত্তেফাক শুরু থেকে ৬-দফার মধ্যে জনমত গঠনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন শাখা যেসব কর্মসূচি পালন করেছে, নেতারা বক্তৃতা বিবৃতি দিয়েছেন তা বিশদভাবে প্রকাশ করেছে। সেই সঙ্গে সম্পাদকীয়/উপ-সম্পাদকীয় লিখেও সমর্থন জানিয়েছে। দৈনিক সংবাদ ও আজাদ-এর ভূমিকাও ছিল ইতিবাচক।
তবে সব পত্রিকা যে ইতিবাচক ভূমিকা নেয়নি, তার প্রমাণ ২৪ মার্চ গণ-অভ্যুত্থানের তুঙ্গ মুহূর্তে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা দৈনিক পাকিস্তান মর্নিং নিউজ অফিস জ্বালিয়ে দেয়।
কামরুল হক লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে সংবাদপত্র। কিন্তু সংবাদপত্র কতটা জড়িয়ে ছিল সেই বিষয়ে পুরোপুরি সন্দেহ যুক্ত হওয়া যায় না।
পত্রিকার রিপোর্ট থেকে আমরা জানতে পাই যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পরিচালনায় মুজিব ফান্ড নামে একটি তহবিল গঠন করা হয়েছিল। এই তহবিলে কত টাকা আদায় হয়েছে, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ছিল এর মাধ্যমে জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়ানো। তহবিল গড়ে তুলেছিলেন যুক্তরাজ্যের প্রবাসী বাঙালিরাও। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আইনি লড়াই চালাতে লন্ডন থেকে প্রখ্যাত আইনজীবী টমাস উইলিয়ামকে আনা হয়েছিল।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচার শুরু হওয়ার আগেই সরকার ইত্তেফাক বন্ধ করে দেয়। পত্রিকা পুনরায় প্রকাশিত হয় ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময়। এই সময়ে সংবাদ ও আজাদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মামলার বিচার শুরু হয় ১৯ জুন। বিচারটি ছিল প্রকাশ্য। সম্পাদক ও অভিযুক্তদের আত্মীয়-স্বজনেরা পাস নিয়ে আদালত কক্ষে প্রবেশ করতে পারতেন। ২০ জুনে সংবাদ-এর রিপোর্ট ছিল এ-রকম : গতকাল বিশেষ ট্রাইব্যুনালের অধিবেশন কক্ষে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। অধিকাংশ অভিযুক্তের আত্মীয়-পরিজন বিচারকক্ষে উপস্থিত ছিলেন এবং বিচার কাজের শুরুতে এবং পরে তাহারা খোলাখুলিভাবেই মেলামেশা করেন। উপস্থিতগণের মধ্যে শেখ মুজিবের বৃদ্ধ পিতা অন্যতম। পাকিস্তানি সাংবাদিক ছাড়াও রয়টার, এএফপি ও বাল্টিমোর সান-এর প্রতিনিধি প্রমুখ বিদেশি সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। অভিযুক্তদের উপস্থিত করার সময় বিচার কক্ষে বিরাজ করেছিল নীরবতা।
সেনানিবাসে স্থাপিত বিশেষ আদালতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শুনানিতে বিভিন্ন পত্রিকার সাংবাদিকেরা উপস্থিত থাকতেন। তখন আজাদ-এর প্রধান প্রতিবেদক ছিলেন ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’ খ্যাত ফয়েজ আহমদ। তিনি বিচারের শুনানির রিপোর্টের পাশাপাশি ‘ট্রাইব্যুনাল কক্ষে’ নামে একটি বিশেষ রিপোর্ট করতেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার রিপোর্টের কারণে আজাদ জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠেছিল। পরবর্তীকালে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময়ও পত্রিকাটি অগ্নিঝরা ভাষায় রিপোর্ট করে।
ফয়েজ আহমদ-এর রিপোর্ট থেকেই আমরা জানতে পাই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার এক নম্বর আসামি শেখ মুজিবুর রহমান সংবাদপত্রের মাধ্যমে বাইরে খবরাখবর পাঠাতেন, আবার বাইরের খবরাখবর জেনে নিতেন। ফয়েজ আহমদ আদালত কক্ষের একদিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন :
আমি এবং অন্য সমস্ত রিপোর্টারই ফাঁসির আসামি এক নম্বর অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সারাজীবনই মুজিব ভাই বলতাম। ফলে সবার মনেই একদিকে যেমন তার সম্পর্কে জানার উৎকণ্ঠা, অপরদিকে তার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানার জন্য নানা প্রশ্ন জাগছিল। এমনকি এত সতর্কতার মধ্যেও কথা বলা যায় কি না সেই ফাঁক আমরা স্ব-স্ব পদ্ধতিতে ভাবছিলাম। কিন্তু যমের মতো জাঁদরেল কালো গাউন পরিহিত তিনজন বিচারপতি এবং সতর্কতাদানকারী বহু সংখ্যক ডিএফআই এবং আইবি’র লোক ক্ষুদ্র কক্ষটিতে শ্যেনদৃষ্টিতে শেখ সাহেবের দিকে চেয়ে আছেন। ভাবলাম, মাথা ডান দিকে বাঁকা করলেই গর্দান যাবে। এমন সময় আকস্মিক ডাক, ‘ফয়েজ, ফয়েজ, এই ফয়েজ।’ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পাথরের মূর্তির মতো বিচারকদের দিকে চেয়ে রইলাম। একটু পরেই আমার ডান উরুতে শেখ সাহেব হাত বাড়িয়ে কিছু একটা দিয়ে খুঁচিয়ে দিলেন। দেখলাম তার সেই বিখ্যাত পাইপের আঘাত। আমি দুই পক্ষের কৌঁসুলিদের সামান্য তর্ক-বিতর্কের ফাঁকে পূর্বের ন্যায় প্রস্তর মূর্তির মতো অন্যদিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বললাম, ‘মুজিব ভাই, কথা বলা মানা। মাথা ঘোরাতে পারছি না। বের করে দেবে।’ তক্ষুনি উত্তর আসল যথেষ্ট উচ্চকণ্ঠে, ‘ফয়েজ, বাংলাদেশে থাকতে হলে শেখ মুজিবের সাথে কথা বলতে হবে।’ তার এই কথা ছিল রাজনৈতিক ও প্রতীকধর্মী। স্তম্ভিত কোর্ট, সমস্ত আইনজীবী, সরকারি অফিসারেরা তার এই সুস্পষ্টভাবে উচ্চারিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন। (সূত্র : আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, শেখ মুজিব ও বাংলার বিদ্রোহ)

পাঁচ
৬-দফা কর্মসূচি ঘোষণার সময় পত্রিকাগুলোর মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকলেও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময়ে পত্রিকাগুলো সাহসী ভূমিকা রেখেছে, তা কামরুল হকের বয়ানে জানতে পারি। একজন গবেষক-রাজনীতিক লিখেছেন, মাসের পর মাস প্রায় প্রতিদিন সংবাদপত্রে এই ষড়যন্ত্র মামলার ধারাবিবরণী প্রকাশিত হয়। মামলার আরজি এবং সাক্ষীদের সওয়াল জবাব পাঠকেরা প্রতিদিন আগ্রহসহকারে পাঠ করতে থাকেন। তারা জানতে পারেন পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ থেকে মুক্তির জন্য কাজ করেছেন। ফলে পাকিস্তানিরা যাদের ভিলেন বানাতে চেয়েছিলেন তারা জনগণের কাছে নন্দিত নেতা হিসেবে জনগণের হৃদয়ে স্থান করে নেন। (মওদুদ আহমদ, বাংলাদেশ : স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা)
কামরুল হকের পর্যবেক্ষণ হলো ১৯৬৬ সালের ৬-দফা কর্মসূচি ঘোষণা থেকে শুরু করে ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান পর্যন্ত সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনা ধারাবাহিকভাবে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। আলোচ্য সময়ে পূর্ববঙ্গের রাজনীতি আবর্তিত হয়েছে ৬-দফাকে কেন্দ্র করেই। ঊনসত্তরে ছাত্র-সমাজের ১১-দফা ছিল সেই ৬-দফারই সম্প্রসারণ ও পরিপূরক। ফলে সেদিন ৬-দফা ও ১১-দফার আন্দোলন একাকার হয়ে গিয়েছিল; যদিও রাজনৈতিক নেতারা একমত হতে পারেননি।
স্বাধীনতা পূর্বকালে সংবাদ জানার মাধ্যম ছিল সীমিত। বেতার টেলিভিশন পুরোপুরি সরকার নিয়ন্ত্রিত। এখনকার মতো তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সামাজিক যোগযোগমাধ্যম ছিল না। ফলে রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ জানার জন্য সংবাদপত্রই ছিল একমাত্র ভরসা। স্বাধীনতা-পূর্ব সেই অস্থির সময়ে কোন পত্রিকা কী ভূমিকা রেখেছে কামরুল হকের বইয়ে তার একটি চিত্র পাওয়া যায়; যদিও তা অসম্পূর্ণ। একটি বইয়ে তা হয়তো সম্ভবও নয়। পুরো চিত্রটি পেতে হলে আমাদের আরও গবেষণা করতে হবে। আশা করি ভবিষ্যতে কেউ করবেন।
‘বঙ্গবন্ধু ও সংবাদপত্র : ছয় দফা থেকে গণ-অভ্যুত্থান’-এর লেখক কামরুল হককে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
আপনাদের সবাইকে শুভেচ্ছা।

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য