আনিস আহামেদ
অসমাপ্ত আত্মজীবনী
১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চকে ‘বাংলা ভাষা দাবি’ দিবস ঘোষণা করা হল। জেলায় জেলায় আমরা বের হয়ে পড়লাম। আমি ফরিদপুর, যশোর হয়ে দৌলতপুর, খুলনা ও বরিশালে ছাত্রসভা করে ঐ তারিখের তিন দিন পূর্বে ঢাকায় ফিরে এলাম। দৌলতপুরে মুসলিম লীগ সমর্থক ছাত্ররা আমার সভায় গোলমাল করার চেষ্টা করলে খুব মারপিট হয়, কয়েকজন জখমও হয়। এরা সভা ভাঙতে পারে নাই, আমি শেষ পর্যন্ত বক্তৃতা করলাম। এ সময় জনাব আবদুস সবুর খান আমাদের সমর্থন করছিলেন। বরিশালের জনাব মহিউদ্দিন আহমদ তখন নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সদস্য, মুসলিম লীগ ও সরকারের পুরা সমর্থক। কাজী বাহাউদ্দিন আহমদ আমাদের দলের নেতা ছিলেন। আমি কলেজেই সভা করেছিলাম। মহিউদ্দিন সাহেব বাধা দিতে চেষ্টা করেন নাই। ঢাকায় ফিরে এলাম। রাতে কাজ ভাগ হলÑ কে কোথায় থাকব এবং কে কোথায় পিকেটিং করার ভার নেব। সামান্য কিছু সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাড়া শতকরা নব্বই ভাগ ছাত্র এই আন্দোলনে যোগদান করল। জগন্নাথ কলেজ, মিটফোর্ড, মেডিকেল স্কুল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বিশেষ করে সক্রিয় অংশগ্রহণ করল। মুসলিম লীগ ভাড়াটিয়া গুণ্ডা লেলিয়ে দিল আমাদের উপর। অধিকাংশ লোককে আমাদের বিরুদ্ধে করে ফেলল। পুরান ঢাকার কয়েক জায়গায় ছাত্রদের মারপিটও করল। আর আমরা পাকিস্তান ধ্বংস করতে চাই এই কথা বুঝাবার চেষ্টা করল।
১১ই মার্চ ভোরবেলা শত শত ছাত্রকর্মী ইডেন বিল্ডিং, জেনারেল পোস্ট অফিস ও অন্যান্য জায়গায় পিকেটিং শুরু করল। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে কোনো পিকেটিংয়ের দরকার হয় নাই। সমস্ত ঢাকা শহর পোস্টারে ভরে ফেলা হল। অনেক দোকানপাট বন্ধ ছিল, কিছু খোলাও ছিল। পুরান ঢাকা শহরে পুরাপুরি হরতাল পালন করে নাই। সকাল আটটায় জেনারেল পোস্ট অফিসের সামনে ছাত্রদের উপর ভীষণভাবে লাঠিচার্জ হল। একদল মার খেয়ে স্থান ত্যাগ করার পর আরেকদল হাজির হতে লাগল। ফজলুল হক হলে আমাদের রিজার্ভ কর্মী ছিল। এইভাবে গোলমাল, মারপিট চলল অনেকক্ষণ। নয়টায় ইডেন বিল্ডিংয়ের সামনের দরজায় লাঠিচার্জ হল। খালেক নেওয়াজ খান, বখতিয়ার (এখন নওগাঁর অ্যাডভোকেট), শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এমএ ওয়াদুদ গুরুতররূপে আহত হল। তোপখানা রোডে কাজী গোলাম মাহাবুব, শওকত মিয়া ও আরও অনেক ছাত্র আহত হল। আবদুল গনি রোডের দরজায় তখন আর ছাত্ররা অত্যাচার ও লাঠির আঘাত সহ্য করতে পারছে না। অনেক কর্মী আহত হয়ে গেছে এবং সরে পড়ছে। আমি জেনারেল পোস্ট অফিসের দিক থেকে নতুন কর্মী নিয়ে ইডেন বিল্ডিংয়ের দিকে ছুটেছি, এর মধ্যে শামসুল হক সাহেবকে ইডেন বিন্ডিংয়ের সামনে পুলিশ ঘিরে ফেলেছে। গেট খালি হয়ে গেছে। তখন আমার কাছে সাইকেল। আমাকে গ্রেফতার করার জন্য সিটি এসপি জিপ নিয়ে বারবার তাড়া করছে, ধরতে পারছে না। এবার দেখলাম উপায় নাই। একজন সহকর্মী দাঁড়ান ছিল তার কাছে সাইকেল দিয়ে চার-পাঁচজন ছাত্র নিয়ে আবার ইডেন বিল্ডিংয়ের দরজায় আমরা বসে পড়লাম এবং সাইকেল যাকে দিলাম তাকে বললাম, শীঘ্রই আরও কিছু ছাত্র পাঠাতে। আমরা খুব অল্প, টিকতে পারব না। আমাদের দেখাদেখি আরও কিছু ছাত্র ছুটে এসে আমাদের পাশে বসে পড়ল। আমাদের উপর কিছু উত্তম মধ্যম পড়ল এবং ধরে নিয়ে জিপে তুলল। হক সাহেবকে পূর্বেই জিপে তুলে ফেলেছে। বহু ছাত্র গ্রেফতার ও জখম হল। কিছু সংখ্যক ছাত্রকে গাড়ি করে ত্রিশ-চল্লিশ মাইল দূরে জঙ্গলের মধ্যে ফেলে আসল। কয়েকজন ছাত্রীও মার খেয়েছিল। অলি আহাদও গ্রেফতার হয়ে গেছে। তাজউদ্দীন, তোয়াহা ও অনেককে গ্রেফতার করতে পারে নাই। আমাদের প্রায় সত্তর-পঁচাত্তরজনকে বেঁধে নিয়ে জেলে পাঠিয়ে দিল সন্ধ্যার সময়। ফলে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠল। ঢাকার জনগণের সমর্থনও আমরা পেলাম।
সূত্র : অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান
তাজউদ্দীনের ডায়েরি
১১ মার্চ ’৪৮, বৃহস্পতিবার
সকাল ৬টায় ঘুম থেকে উঠেছি, আজ পড়াশোনা হলো না।
সকাল ৭টায় সাধারণ ধর্মঘটের পক্ষে কাজ করতে বেরিয়ে প্রথমে গেলাম এফএইচএম হলে। তোয়াহা সাহেব এবং আমি একসঙ্গে কাজ করছি। রমনা পোস্ট অফিসের কাছে তোয়াহা সাহেব ও অন্য কয়েকজন পুলিশ কর্তৃক আটক হলেন। আমি গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হলাম। একটু পরে তোয়াহা সাহেবকে পুলিশ ছেড়ে দিল।
১২টায় পিকেটিং বন্ধ হলে ১টায় নাইমউদ্দিন সাহেবের সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সভা হলো।
বেলা ২টায় সচিবালয় অভিমুখে মিছিল শুরু হলে পুলিশ হাইকোর্ট গেটের কাছে বাধা দিল। আমরা উত্তর গেটের দিকে রওনা হলাম। তখনই পুলিশ লাঠিচার্জ করল। তোয়াহা সাহেবকে মারাত্মক মারধর করল, অন্যরাও মার খেল। কোথাও যেতে পারলাম না। সাড়ে ৩টায় সভার পর সবাই চলে গেল।
মুজিব, শামসুল হক, মাহবুব, অলি আহাদ, শওকত, আনসার ও অন্যান্য ৬৯ জনকে আটক করে জেলহাজতে রাখা হয়েছে। ১৪ জন আহত হয়ে হাসপাতালে। সেন্ট্রাল জেল, কোতোয়ালি ও সূত্রাপুর থানা এবং হাসপাতালে তাদের সঙ্গে দেখা করলাম। ৮টায় হলে এলাম। সাড়ে ৮টায় মেসে ফিরলাম।
১০টায় ঘুমাতে গেলাম।
আবহাওয়া স্বাভাবিক।
বি. দ্র. পুলিশের নির্যাতন ও ভাড়াটে গুণ্ডাদের গুণ্ডামি সত্ত্বেও আজকের ধর্মঘট চমৎকার সফল হলো।
সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি, প্রথম খণ্ড
গবেষণা ও গ্রন্থনা : আনিস আহামেদ, বার্তা সম্পাদক, উত্তরণ