ড. এ কে আব্দুল মোমেন: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কেবল একটি নাম নয়, একটি প্রত্যয়; একটি আদর্শ, একটি দর্শন, একটি দীর্ঘ সংগ্রাম, নির্যাতিতের আলো, মানুষের ভালোবাসা, বাংলার সবুজ জমিনে এক সাগর রক্ত, একটি সফল বিপ্লব, অতঃপর- একটি দেশ গড়ে তোলার সংগ্রাম। বহু সংগ্রামের পর ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা চলে যেতে বাধ্য হলো, পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে স্বীকৃতি পেল বাংলাদেশ। তবে তাতে স্বস্তির চেয়ে যন্ত্রণা বাড়ল বাংলাদেশের। অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি, রাষ্ট্রব্যবস্থাসহ সবক্ষেত্রেই শুরু হলো শোষণ আর বঞ্চনা। এরপর বঙ্গবন্ধুর প্রগাঢ় নেতৃত্বে রাজনৈতিক নানা ঘটনার বাক-পরিক্রমায় একাত্তরে বাংলাদেশ পেল লাল-সবুজের নতুন পতাকা, বিশ্ব অভ্যুদয়ে নতুন পরিচিতি এলো স্বাধীন বাংলাদেশের। নতুন বাংলাদেশ গঠনের শুরুতেই সবার সঙ্গে সুসম্পর্ককে প্রাধান্য দিলেন জাতির পিতা প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধু যুদ্ধের ভয়াবহতা ও নির্মমতা প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করেন। আর পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের প্রতি জুলুম নির্যাতন প্রতিরোধের আন্দোলনে তিনি তো সম্মুখ যোদ্ধা। এমন অভিজ্ঞতা থেকে বঙ্গবন্ধু সব সময় শান্তিপূর্ণ আইনানুগ সমাধানের নীতি গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু সারাজীবনই ছিলেন অহিংস, মানবপ্রেমী, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আর শান্তিপ্রিয়। তিনি চেয়েছিলেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতির কোনো জোট নয়, বাংলাদেশ হবে শান্তিপূর্ণ দেশ, হবে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড। সকলের সঙ্গে আন্তরিক হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে স্বাধীন জোটনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ, অন্য রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, সমতা, ভৌগোলিক অখ-তা, অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি নিয়ে বঙ্গবন্ধু পররাষ্ট্রনীতি ঘোষণা করলেন। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে প্রতিবেশী ভারত সর্বোতভাবে সাহায্য করে। ভারতের বন্ধু সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের জন্য বারবার ভেটো দিয়েছে। অপরপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র সরকার আমাদের বিরোধিতা করে পাকিস্তানকে অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ দিয়ে গণহত্যায় সাহায্য করে। সে-সময়ে যুক্তরাষ্ট্র-সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল না। এমন অবস্থায় বঙ্গবন্ধু কোনো ব্লকের অনুসারী না হয়ে ‘জোটনিরপেক্ষ’ জোটে সদস্যপদ অর্জন এবং ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’- এমন পররাষ্ট্রনীতি ঘোষণা করলেন। যা আজও বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রনীতির মূল চালিকাশক্তি ও মূলমন্ত্র।
বাংলাদেশের সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির নির্দেশনা রয়েছে। এই নির্দেশনাসমূহ সংবিধানের ২৫নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছেÑ
(ক) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগ পরিহার এবং সাধারণ ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য চেষ্টা করিবেন;
(খ) প্রত্যেক জাতির স্বাধীন অভিপ্রায় অনুযায়ী পথ ও পন্থার মাধ্যমে অবাধে নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও গঠনের অধিকার সমর্থন করিবেন; এবং
(গ) সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ বা বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সংগত সংগ্রামকে সমর্থন করিবেন।
ভারসাম্যের উৎকৃষ্ট উদাহরণ
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পক্ষে প্রত্যাশিত সহযোগিতা মেলেনি চীনের কাছ থেকে। তবে সময়ের পরিক্রমায় বাংলাদেশের অন্যতম বন্ধুপ্রতীম দেশ এখন চীন। এর অর্থ হচ্ছে দেশের স্বার্থে কূটনৈতিক পাড়ায় কোনো রাষ্ট্র চিরকালীন বন্ধু বা শত্রু নয়। এ যাবতকালে বাংলাদেশের বড় উন্নয়ন সহযোগীদের তালিকাতেও জায়গা করে নিয়েছে চীন। আবার, মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করে ভারত। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান, শরণার্থীদের আশ্রয়দানসহ সম্মুখ সমরে ভারতের অনেক সৈন্যও প্রাণ হারায়, অর্থাৎ নানাভাবেই ভারতের সহযোগিতা সব সময় মনে রাখবে বাংলাদেশ। এমন কী স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েও পুনর্গঠনে ভারতের কাছ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা পেয়েছিল বাংলাদেশ। এদিকে ভারত ও চীনের বৈরী সম্পর্কের কথাও কারও অজানা নয়। তা সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশ দুটির সঙ্গে সমানতালে চমৎকার সম্পর্ক বজায় রেখে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। এটি সম্ভব হয়েছে দেশরত্ন শেখ হাসিনার ভারসাম্য ও বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির জন্যই।
সব সময়ের বন্ধু ভারত : মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানের প্রতি বরাবরই শ্রদ্ধাশীল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ‘তবে তাঁর পরিকল্পনা ছিল সমৃদ্ধ ও আত্মমর্যাদাশীল বাংলাদেশ বিনির্মাণ।’ ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি লন্ডন থেকে দিল্লিতে ফিরে বঙ্গবন্ধু কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন ভারতের শক্তিশালী অবদানের কথা। বলেন, “বাংলাদেশ ও ভারতের ভ্রাতৃত্ববন্ধন চিরকাল অটুট থাকবে।” ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নীতির মিল প্রসঙ্গে বলেন, “এটা হচ্ছে আদর্শ, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধের মিল।” তবে এর মানে এই নয় যে, তিনি অন্ধভাবে ভারতের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন। তা বোঝা যায় লন্ডন থেকে বাংলাদেশে তার প্রথম যাত্রা দিয়েই। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে তিনি লন্ডন হয়ে দিল্লিতে আসেন। এ যাত্রায় তিনি বিনয়ের সাথে ভারতীয় বিমান ব্যবহারের আমন্ত্রণ গ্রহণ না করে ব্রিটিশ বিমান ব্যবহার করেন।
বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি কেবল উদারই নয়, তা স্বাধীন ও বলিষ্ঠও বটে। তার প্রমাণ মেলে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাসখানেক পরেই। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় বঙ্গবন্ধু প্রথম সরকারি সফরে যান। ৬ ফেব্রুয়ারি তার সম্মানে দেওয়া এক নাগরিক সংবর্ধনায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সুস্পষ্ট প্রশ্ন করে জিজ্ঞাসা করে বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতীয় যেসব সৈন্য বাংলাদেশের প্রয়োজনে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল, তারা কবে বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহৃত হবে।” এর প্রত্যুত্তরে সমালোচকরা আশা করেছিল, ভারত হয়তো বাংলাদেশের ওপর নাখোশ হবে, সৈন্যদের অবস্থান দীর্ঘায়িত করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে আধিপত্য বিস্তার করতে চাইবে ভারত। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী স্বভাবসুলভ চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যেই বঙ্গবন্ধুর এমন আহ্বানকে স্বাগত জানান। পরবর্তীতে ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের আগেই ভারতীয় সেনাদের বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহৃত করা হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কম দেশই আছে যেখানে এত স্বল্প সময়ের মধ্যে বিদেশি বিজিত সৈন্য বিদায় নেয় এবং এটি সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্বের জন্য। আর ইন্দিরা গান্ধী ১৭-১৯ মার্চ বাংলাদেশ সফর করেন। ১৯ মার্চ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ঐতিহাসিক মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, সহমর্মিতা আর সার্বভৌমত্ব অটুট রাখার বিষয়ে দু-দেশের একমত হওয়ার ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশের বড় সাফল্য। এতে বলা হয়, এক দেশ আরেক দেশের স্বাধীনতা আর আঞ্চলিক অখ-তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে। কোনো দেশ অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকবে। কোনো দেশই কারও প্রতি আক্রমণ বা এ-ধরনের অভিযান পরিচালনা করবে না। নিরাপত্তার প্রতি হুমকি বা সামরিক কোনো অভিযান পরিচালনার মতো পদক্ষেপ থেকে দেশগুলো বিরত থাকবে। চুক্তিভুক্ত দেশগুলো আক্রান্ত হলে বা এসব দেশের ওপর আক্রমণের শঙ্কা তৈরি হলে পারস্পরিক মতামত ও সমঝোতার ভিত্তিতে শান্তি ও নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ক্ষেত্রে উভয় দেশ তাদের নীতি ও সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দেবে। স্বাধীনতা পাওয়ার মাত্র তিন মাসের মাথায় এমন সাফল্য সে-সময়েই ইঙ্গিত করে যে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কেবল সৌহার্দ্যপূর্ণ আর সংযমীই নয়; বরং তা একে অপরের প্রতি আস্থা, বিশ্বাস ও সমসম্মানের পরিচায়ক।
শুভেচ্ছা সফরে সোভিয়েত ইউনিয়নে : ভারত সফরের পরই বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ২ থেকে ৬ মার্চ সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেন। বিমানে ওঠার আগে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ আর জনগণের জন্য বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের শুভেচ্ছা নিয়ে যাচ্ছি।” সে-সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই সফরের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা বাংলাদেশের উদীয়মান পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে অপরিসীম প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। অত্যন্ত সফল এই সফরকে ‘বঙ্গবন্ধুর শুভেচ্ছা সফর’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে ঐতিহাসিক রাজকীয় সম্মাননা প্রদান করা হয়। সে-দেশের বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান পরিদর্শনের সময় রাস্তার দু-ধারে হাজার হাজার শিক্ষার্থী, জনগণ ফুল হাতে বঙ্গবন্ধুকে শুভেচ্ছা জানান। এ যেন ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ কোনো মহানায়কের অভিবাদন। আজকের জাতীয় স্মৃতিসৌধ বলতে গেলে সেই রাশিয়া সফরের প্রাপ্তি। লেনিন গ্রাদের স্বাধীনতা স্তম্ভগুলো দেখার পর বঙ্গবন্ধুর মনে ভাবনা জাগে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে এমন অবকাঠামো তৈরি করা উচিত। তারই ফলশ্রুতিতে পরে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ গড়ে তোলা হয়। এই সফরে রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের বড় ধরনের কয়েকটি বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর হয়। বঙ্গবন্ধুর এই সফরের সুদূরপ্রসারী প্রভাব ছিল। ১৯৭৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের নিজের জন্য সংগ্রহ করা খাদ্যসামগ্রী থেকে বাংলাদেশকে ২ লাখ টন খাদ্যসামগ্রী সহযোগিতা প্রদান করে। ১৯৭৩ সালের জুনে কয়েকটি মিগ-২১ জঙ্গি বিমান, পরিবহন বিমান ও হেলিকপ্টার পাওয়া যায় দেশটির কাছ থেকে। রাষ্ট্রীয়, নৈতিক ও পররাষ্ট্রনীতির দিক থেকে সব সময়ই বাংলাদেশের পাশে পাওয়া গেছে সোভিয়েত ইউনিয়নকে।
তবে, সহযোগিতা গ্রহণ কিংবা পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও সংযমী ছিলেন বঙ্গবন্ধু, গাম্ভীর্য্যপূর্ণ ছিল তার পররাষ্ট্রনীতি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সারাদেশে অনেক মাইন পোঁতা ছিল। বিশেষ করে বন্দর, বাসস্ট্যান্ড ও রেলস্টেশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন বঙ্গবন্ধুকে প্রস্তাব দেয়, চালনা ও চট্টগ্রাম বন্দরের মাইনমুক্ত করতে দেশটি সহযোগিতা করতে চায়। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় এসে রুশ নৌসেনারা টহল দেবে, বিষয়টি সংযতভাবেই দেখেন বঙ্গবন্ধু। তিনি তাদের কেবল চট্টগ্রাম বন্দর মুক্ত করার দায়িত্ব দেন। আর চালনা বন্দরের দায়িত্ব পায় জাতিসংঘ। আসলে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ক্ষমতার বলীয়ান বলেই সে-সময় তিনি বিচক্ষণতার সাথে এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
বরফ গলতে শুরু করে চীনের সঙ্গে
স্বাধীন হওয়ার পরও বাংলাদেশের প্রতি চীনের বিদ্বেষীনীতি কার্যকর থাকে। ১৯৭২ সালের ৮ আগস্ট জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের জন্য আবেদন করে বাংলাদেশ। কিন্তু চীনের বিরোধিতায় ১০ আগস্ট তা নাকচ হয়ে যায়। এ নিয়ে ক্ষোভও ঝরে পড়ে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক অধিবেশনে ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ভাষণে বলেন, “… যখন চীনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে ভেটো দেওয়া হতো তখন এই বাংলার মানুষই বিক্ষোভ করতো। আমি নিজে ওই ভেটোর বিরুদ্ধে বহুবার কথা বলেছি। যে ভেটোর জন্য চীন ২৫ বৎসর জাতিসংঘে যেতে পারে নাই, দুঃখের বিষয়, সেই চীন ভেটো ‘পাওয়ার’ পেয়ে প্রথম ভেটো দিলো আমার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। তবুও আমি কামনা করি তাদের বন্ধুত্ব। অনেক বড় দেশ। দুশমনি করতে চাই না। বন্ধুত্ব কামনা করি। কারণ আমি সকলের বন্ধুত্ব চাই। কিন্তু জানি না, আমার এই কামনায়, আমার এই প্রার্থনায় তাঁরা সাড়া দিবেন কি না। যদি না দেন কিছু আসে যায় না। ভুলে গেলে চলবে না যে, আমরা এত ছোট দেশ নই। বাংলাদেশ এতটুকু নয়। পপুলেশনের ভিত্তিতে বাংলাদেশ দুনিয়ার অষ্টম বৃহত্তম রাষ্ট্র।” এর মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনচেতা পররাষ্ট্রনীতি ফুটে ওঠে। পরে অবশ্য চীন তাদের অবস্থান পাল্টায়। ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে চীনা রেডক্রসের একটি দল সফর করে বাংলাদেশের বন্যার্ত অঞ্চল। তাদের কাছ থেকে পাওয়া যায় ১ মিলিয়ন ডলারের সহযোগিতা। আর পঁচাত্তরের মে মাসে দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ। এখানে সে-সময়ের একটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। ১৯৭৪ সালে আমি সে-সময়কার বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজীর একান্ত সচিব হিসেবে কাজ করি। কয়লা, লবণসহ দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় উপাদানের বেশিরভাগই আমরা সে-সময় ভারত থেকে আমদানি করতাম। সেবার কয়লা ও লবণ কেলেঙ্কারি হলো। এর ফলে ভারত থেকে কয়লা আমদানি অনিশ্চিত হয়ে পড়ল। যথাসময়ে জ্বালানি সরবরাহের লক্ষ্যে আমরা কয়লা সরবরাহে আন্তর্জাতিক একটা টেন্ডার আহ্বান করি। এতে চীনও অংশ নেয়। যদিও চীন তখনও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। চীন বলল, গুণগত মানের কয়লা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই তারা সরবরাহ করতে পারবে। কিন্তু বেঁকে বসল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তাদের যুক্তি, পরিবহন খরচ বেশি হবে। বিষয়টির সুরাহার জন্য আমরা বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলাম। বঙ্গবন্ধু দাম বেশি হওয়া সত্ত্বেও চীন থেকে কয়লা আমদানির বিষয়টি অনুমোদন করে দিয়ে বললেন, “ব্যবসা হলে সম্পর্কও হবে।” এর কিছুদিন পরে ভারতের নয়াদিল্লিতে ঊঝঈঅচ সম্মেলন হয় এবং ওই সম্মেলনের সময়ে চীনের মন্ত্রী ও আমাদের মন্ত্রীর বৈঠক হয়। যা মন্ত্রী পর্যায়ে চীনের সাথে প্রথম আলোচনা। এর ফলে বরফ গলতে থাকে। ১৯৭৪ সালের জুনে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের সময় সরাসরি বিরোধিতা থেকে বিরত থাকে চীন, ভেটো প্রদান থেকে বিরত থাকে।
আমেরিকার লুকোচুরি
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমেরিকার ভূমিকা আমাদের স্বপক্ষে ছিল না। যদিও সে-দেশের বহু হৃদয়বান ব্যক্তিত্ব অনেক আইন-প্রণেতা ও বুদ্ধিজীবী বাংলাদেশের যুদ্ধের পক্ষে জনমত সংগ্রহ করেছেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের মানুষের জন্য ফান্ড সংগ্রহ করেছেন। আমেরিকান কবি এলেন গিন্সবার্গ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেই তো লিখে ফেললেন বিখ্যাত ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতাটি। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সেই মার্কিন মুল্লুকের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে জোর দিলেন। স্বাধীনতার দু-তিন বছর পর্যন্ত আমেরিকার মন গলাতে বেগ পোহাতে হয় বাংলাদেশকে। ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে আমেরিকা সফরে যান বঙ্গবন্ধু, প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড আর ফোর্ডের সঙ্গে ১ অক্টোবর হোয়াইট হাউসে মিটিং করেন। এই বৈঠকে বেশ উদার ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ফোর্ড বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানালেও খানিকটা রক্ষণশীল ভঙ্গিতে বলেন, “আপনাদের স্বাধীনতা লাভ ও জাতিসংঘের সদস্যপদ অর্জনের জন্য আমি আপনাকে অভিনন্দন জানাই।” বঙ্গবন্ধু বললেন, “আমরা একটি দরিদ্র দেশ কিন্তু আমরা আপনাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক চাই।” এই সফর থেকে ১ লাখ টন খাদ্য সহায়তা মেলে। তবে দীর্ঘমেয়াদে সুসম্পর্কের বীজ যে রোপিত হয়, তা বলাই বাহুল্য।
মুসলিম দেশসমূহের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন
স্বাধীনতা লাভের মাত্র তিন বছরের মাথায় বাংলাদেশ ১২৬টা দেশের স্বীকৃতি অর্জন করে। এত অল্প সময়ে এতগুলো দেশের স্বীকৃতি পাওয়া মোটেও চাট্টিখানি কথা নয়। স্বীকৃতির মানে হলো ওইসব দেশ বাংলাদেশকে পূর্ণ সার্বভৌম দেশ হিসেবে পরিগণিত করে। শুরুর দিকে বাংলাদেশকে নিয়ে আরব ও মুসলিম দেশগুলো খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। কারণ, পাকিস্তানের মতো বড় মুসলিম দেশ থেকে বের হয়ে গিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করা ভৌগোলিক আয়তনের ছোট্ট এই দেশটির ভবিষ্যৎ কিইবা হতে পারেÑ এমন দোলাচল ছিল তাদের। তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ও অল্প সময়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক যোগাযোগ তাদের আশ্বস্ত করতে সক্ষম হয়। এদিক থেকে ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সের জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলন উল্লেখ করার মতো। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই সম্মেলনে ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ মতামত তুলে ধরেন, যা তাকে সম্ভাব্য বিশ্ব মুসলিম নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। একই সাথে আরবদের সমর্থন করায় বাংলাদেশের প্রতি আরব দেশগুলোর অগাধ আস্থা তৈরি হয়। ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় আরবদের প্রতি শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে একটি মেডিকেল টিম পাঠানো হয়। প্রায় কাছাকাছি সময়ে যুদ্ধরত মিসরীয় সেনাবাহিনীর জন্য ১ লাখ পাউন্ড চা-ও পাঠানো হয়। উদ্দেশ্য ছিল, বাংলাদেশের প্রতি আরব দেশগুলোর দৃষ্টি ফেরানো। বাংলাদেশ তাতে সফলও হয়। ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর দেশবাসীর উদ্দেশ্যে দেওয়া এক বেতার ও টেলিভিশন ভাষণে বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেন, “আমরা আজ গর্বিত যে, মধ্যপ্রাচ্যে আমরা আরব ভাইদের এবং প্যালেস্টাইনবাসীদের পাশে রয়েছি। ইসরায়েলিরা তাদের ন্যায্য অধিকারে হস্তক্ষেপ করেছে। ইসরায়েলিরা জাতিসংঘের প্রস্তাব মানে নাই। তারা দখল করে বসে আছে আরবদের জমি। আমি আরব ভাইদের এ-কথা বলে দেবার চাই এবং তারা প্রমাণ পেয়েছে যে, বাংলার মানুষ তাদের পেছনে রয়েছে। আরব ভাইদের ন্যায্য দাবির পক্ষে রয়েছে। আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে তাদের সাহায্য করবো।”
১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ৩২তম দেশ হিসেবে ইসলামি সম্মেলন সংস্থা-ওআইসি’র সদস্যপদ লাভ করার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি পরিণত মর্যাদা লাভ করে। এই সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে অংশগ্রহণ করে। এটি ছিল ওআইসি’র দ্বিতীয় সম্মেলন। এ সম্মেলনটি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির জন্য উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা। কেননা বঙ্গবন্ধু দৃঢ়ভাবে ঘোষণা দেন যে, পাকিস্তান আগে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি না দিলে বাংলাদেশ এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করবে না। এর ফলে প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর ওপর ওআইসিভুক্ত দেশগুলো থেকে প্রচ- চাপ পড়ে। পাকিস্তান রাজি হলেও বাধা হয়ে দাঁড়ায় ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দির বিচার প্রক্রিয়া। এবং কয়েক হাজার পাকিস্তানে আটকেপড়া বাংলাদেশি নাগরিকদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। পরে সোমালিয়ার মধ্যস্থতায় বিষয়টির সমাধান হয়। এছাড়া প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র ভারতও কোনোভাবেই চাচ্ছিল না যে, লাহোরের ওই সম্মেলনে বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করুক। এই ইস্যুতে কয়েকবার ভারতীয় হাইকমিশনার আমার মন্ত্রীর সঙ্গে এসে দেখা করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কাউকে কিছু না বলে নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নেন। এটি ছিল তার দৃঢ় ও স্বাধীনচেতা নেতৃত্বের বহিঃপ্রকাশ। ভুট্টো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে রাজি হওয়ার পর কয়েকজন ওআইসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় এসে সসম্মানে তাদের উড়োজাহাজে করে বঙ্গবন্ধুকে লাহোর নিয়ে যান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে লাহোর বিমানবন্দরে যথাযথ অভ্যর্থনা জানানো হয়, মর্যাদা ও গুরুত্ব দেওয়া হয়।
উদীয়মান বিশ্বনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত
শান্তি ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করায় অল্প সময়েই সদ্য স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিকমহলে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক দরবারে শান্তির মডেল হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকে। ১৯৭২ সালের অক্টোবরে চিলির রাজধানী সান্তিনিয়াগোতে বিশ্ব পরিষদের প্রেসিডেনসিয়াল কমিটির সভায় বাঙালি জাতির মুক্তি আন্দোলনে অনবদ্য ভূমিকা রাখায় বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ পদক দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পৃথিবীর ১৪০টি দেশের শান্তি পরিষদের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুকে এই পদকের জন্য প্রস্তাব গৃহীত হয়, যা পুরো বাঙালি জাতির জন্য গর্বের বিষয়। ১৯৭৩ সালের মে মাসে বিশ্ব শান্তি পরিষদ ঢাকায় দুদিনব্যাপী সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন ২৩ মে জাতীয় সংসদের উত্তর প্লাজায় বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ পদক পরিয়ে দেওয়া হয়। এ সময় বিশ্ব শান্তি পরিষদে যোগ দিতে আসা সারাবিশ্বের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। পদক পরিয়ে দেওয়ার সময় বিশ্ব শান্তি পরিষদের সে-সময়ের মহাসচিব রমেশ চন্দ বলেন, “শেখ মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধু নন, আজ থেকে তিনি বিশ্ব বন্ধুও বটে।” বঙ্গবন্ধুও তার ভাষণে বলেন, “বিশ্ব শান্তি আমার জীবনদর্শনের মূলনীতি। নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত, শান্তি ও স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী মানুষ, যে কোন স্থানেই হোক না কেন, তাঁদের সাথে আমি রয়েছি। আমরা চাই, বিশ্বের সর্বত্র শান্তি বজায় থাকুক, তাকে সুসংহত করা হোক।” বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতিতে ভর করে জাতিসংঘের ‘টঘ চবধপশববঢ়রহম’-এ বাংলাদেশ আজ একটি ব্র্যান্ড নেইম।
আলজেরিয়ায় ন্যাম সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু
১৯৭৩ সালের ৫ থেকে ৯ সেপ্টেম্বর আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত হয় জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) শীর্ষ সম্মেলন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অংশগ্রহণ করেন। এই সম্মেলনে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত পৃথিবী গড়তে বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। এই সম্মেলন শেষে ঘোষণাপত্রে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে জোটনিরপেক্ষ দেশগুলো তাদের সমর্থন দেয়।
সম্মেলনে ৮ সেপ্টেম্বর স্বাগত ভাষণে সারাবিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, “উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, বর্ণবাদবিরোধী মজলুম জনগণের ন্যায্য সংগ্রামের প্রতি বাংলাদেশের সমর্থনে ‘জোটনিরপেক্ষ নীতি’ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।”
সম্মেলনের ফাঁকে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী বিশ্বনেতার সঙ্গে দ্বি-পাক্ষিক বৈঠক করেন বঙ্গবন্ধু। এই সম্মেলনের সময় সৌদি আরবের বাদশাহ ফয়সাল, প্রেসিডেন্ট টিটো, মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, উগান্ডার প্রেসিডেন্ট ইদি আমিন, লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফিসহ অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে দ্বি-পাক্ষিক বৈঠক করেন।
পরদিন ৯ সেপ্টেম্বর বিদায়ী ভাষণেও বঙ্গবন্ধু বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা ও পারস্পরিক সহযোগিতার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, “একটি সমৃদ্ধ বিশ্বের জন্য আমাদের পরমাণু নিরস্ত্রি¿করণের ওপর জোর দিতে হবে।”
সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সদস্যপদ দিতে জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোর জোর সমর্থনের কথা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পরিচালিত কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এই সমর্থন আদায়ের পথে মূল চালিকাশক্তি ছিল।
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। ২০১৪ সালে ন্যামের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের এক সম্মেলনে আমি অংশগ্রহণ করি। আমি অভিভূত হই, সেখানকার সেই অডিটোরিয়ামের পাশের দেয়ালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ন্যাম সম্মেলনে উপস্থিতির ওপর বড়সড় সাইজের ছবিসহ বক্তব্য স্থাপন করা হয়েছে। কিউবার প্রতিনিধি (যিনি ১৯৭৩ সালের সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন) বললেন, আমি যে চেয়ারে বসে কথা বলছি, সেখানে বসেই বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে ন্যাম সম্মেলনে ভাষণ দিয়েছিলেন। আলজেরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, বহু রাষ্ট্রনায়ক এই সম্মেলনে যোগদান করেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এতই বড় মাপের নেতা ছিলেন যে, তার স্মৃতি ধারণ করে আমরা এই দেয়ালে তার প্রতিকৃতি তুলে ধরেছি। দুদিন পর আমাদের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী এই সম্মেলন কক্ষে এলে তাকে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি সংবলিত এই দেয়াল আমি দেখাই এবং গর্ববোধ করি।
এই সম্মেলনে ৭৮টি দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান এবং ২১টি পর্যবেক্ষক দেশের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। বিশেষ আমন্ত্রণে যোগ দেন জাতিসংঘসহ ১১টি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা। তবে সবাইকে ছাপিয়ে এই সম্মেলনের মধ্যমণি হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহানায়ক ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নেতৃত্বের প্রগাঢ় গুণাবলির পাশাপাশি মানবিক গুণবলিতেও অনন্য ছিলেন তিনি। দৃঢ়তা, সততা, বক্তব্যের জোরালো বাগ্মিতা, অসহায় ও নির্যাতিত জনপদের প্রতি আকুণ্ঠ সমর্থন ও ভালোবাসার জন্য বঙ্গবন্ধু সকলের পছন্দের ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। এই সম্মেলনে বক্তব্য দেওয়ার পর সম্মেলনের নেতারা বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করেন। তার বক্তব্য এতটাই যৌক্তিক আর বাস্তবধর্মী ছিল যে, এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাতিন আমেরিকার দেশগুলোর নির্যাতিত ও বঞ্চিত জনপদের শীর্ষনেতায় পরিণত হন বঙ্গবন্ধু।
জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু
১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসংঘের ১৩৬তম স্বাধীন দেশ হিসেবে সদস্যপদ লাভ করে পরিচিতি পায় বিশ্বজুড়ে। ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে প্রথমবারের মতো বক্তৃতা করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই ভাষণটি ছিল সারাবিশ্বের অধিকারহারা শোষিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার ভাষণ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার একটি বলিষ্ঠ উচ্চারণ ও সাহসী পদক্ষেপ। এ বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি বিশদ আকারে তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “একদিকে অতীতের অন্যায়-অবিচারের অবসান ঘটাইতে হইতেছে, অপরদিকে আমরা আগামী দিনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হইতেছি। আজিকার দিনে বিশ্বের জাতিসমূহ কোন পথ বাছিয়া নিবে তাহা লইয়া সংকটে পড়িয়াছে। এই পথ বাছিয়া নেওয়ার বিবেচনার উপর নির্ভর করিবে আমরা ধ্বংসের ভীতি এবং আণবিক যুদ্ধের হুমকি নিয়া এবং ক্ষুধা, বেকার ও দারিদ্র্যের কষাগাতে মানবিক দুর্গতিকে বিপুলভাবে বাড়াইয়া তুলিয়া আগাইয়া যাইব অথবা আমরা এমন এক বিশ্ব গড়িয়া তোলার পথে আগাইয়া যাইবÑ যে বিশ্বে মানুষের সৃজনশীলতা এবং আমাদের সময়ের বিজ্ঞান ও কারিগরি অগ্রগতি আণবিক যুদ্ধের হুমকিমুক্ত উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের রূপায়ণ সম্ভব করিয়া তুলিবে। এবং যে বিশ্ব কারিগরিবিদ্যা ও সম্পদে পারস্পরিক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে সুন্দর জীবন গড়িয়া তোলার অবস্থা সৃষ্টি করিবে।”
একটি দেশের পররাষ্ট্রনীতির প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন নির্ভর করে দেশটির নেতৃত্বের রাজনৈতিক দর্শন ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে ওই দেশের সম্পর্কের সমীকরণের ওপর। পররাষ্ট্রনীতির সফলতার জন্য শুধু শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করলেই চলবে না, এর সফল বাস্তবায়নের জন্য শক্তিশালী নেতৃত্ব থাকতে হবে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন শক্তিশালী ও বিচক্ষণ নেতৃত্বের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তার দিক নির্দেশনায় আজকে বিশ্বের প্রায় সকল রাষ্ট্রের সঙ্গে রয়েছে বাংলাদেশের অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।
বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থায় বঙ্গবন্ধুর পদচারণা
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু নিজের দেশের মানুষের কল্যাণের কথাই ভাবেন নি, তিনি হৃদয় দিয়ে অনুভব করতেন বিশ্বের নিঃস্ব মানুষের দুঃখ-দুর্দশা। তিনি প্রায়ই বলতেন, “বিশ্বটা দুই ভাগে বিভক্ত। একদিকে রয়েছে শোষক, অন্যভাগে শোষিত। আমি শোষিতদের দলে।” বিশ্বের যে কোনো প্রান্তের যে কোনো ধর্ম বা বর্ণের মানুষের ওপর শোষণ বা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে তিনি কখনও দ্বিধা করেন নি। মূলত বঙ্গবন্ধু ছিলেন এমন একজন বিশ্বনেতা যিনি সব সময়ই শোষিতদের পক্ষে কথা বলতেন। তাকে তুলনা করা হতো হিমালয়ের সঙ্গে। তিনি আফ্রিকার বর্র্ণবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন; অবসান চেয়েছেন এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় বিদেশি শাসনের। বঙ্গবন্ধু যেমন ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে একাত্মা প্রকাশ করেছেন, তেমনি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সাইপ্রাস সরকারকে উৎখাতের নিন্দাও করেছেন। ভিয়েতনামে আমেরিকার বোমাবাজি বন্ধের দাবিও জানায় বাংলাদেশ তার আমলেই। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে মর্মান্তিকভাবে নিহত হওয়ার আগের পুরোটা সময় তিনি উল্কার মতো ছুটে চলেছেন বিশ্বজুড়ে। নিজে যেমন বাংলাদেশের উন্নয়নের মিশন নিয়ে ভ্রমণ করেছেন বিভিন্ন দেশ, তেমনই বাংলাদেশেও এসেছে বিভিন্ন দেশের প্রেসিডেন্ট, সরকার প্রধানগণ।
শেষ হইয়াও যা হইলো না শেষ
জানুয়ারি ১৯৭২ থেকে জুলাই ১৯৭৫, মাত্র সাড়ে তিন বছরে যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ৫০টির মতো রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানের সফরসহ বিভিন্ন পর্যায়ের শতাধিক সফর অনুষ্ঠিত হয় বঙ্গবন্ধু সরকারের সফল কূটনৈতিক তৎপরতায়। ওই স্বল্প সময়ে বাংলাদেশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সহযোগিতার নানা বিষয়ে ৭০টির বেশি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। অনেক দেশ ও সংস্থা যেমনÑ সোভিয়েত ইউনিয়ন, সুইডেন, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, পোল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ডেনমার্ক, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, বুলগেরিয়া, বেলজিয়াম, আলজেরিয়া, নেদারল্যান্ডস, জাতিসংঘ, ইউনিসেফ, ডাব্লিউএফপি, আইডিএ, ইউএনএইচসিআর প্রভৃতি বাংলাদেশকে কোটি কোটি ডলারের বিভিন্ন ধরনের ঋণ, সাহায্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রদান করে এবং স্বীকৃতি প্রদান করে আরও বিভিন্নমুখী সহযোগিতার। এ সময় বাংলাদেশ এডিবি, আইসিএও, ইকাফ এবং ফাও-এর সদস্যপদ লাভ করে। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষার যে মিশন নিয়ে তিনি যাত্রা শুরু করেছিলেন, কয়েক বছরের মধ্যেই তার শতভাগ সুফল ভোগ করতে থাকে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকতেই সৌদি আরব, সুদান, ওমান ও চীন ছাড়া বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্রই বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে, দূরদর্শিতা ও বিশ্বনেতাদের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিল এসব অর্জনে। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের জনসভায় প্রদত্ত এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আমি দুনিয়ার প্রত্যেক রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব করতে চাই, কারো সঙ্গে দুশমনি করতে চাই না। সকলের সাথে বন্ধুত্ব করে আমরা শান্তি চাই।”
বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই বাংলাদেশ : বিশ্ব শান্তি ও উন্নয়ন প্রসঙ্গ
শেখ হাসিনার বৈশ্বিক নেতৃত্ব জাতিসংঘের নিরলস প্রয়াসের কারণেই আজ পৃথিবীতে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার কমেছে, প্রসূতি মায়েরা অধিক হারে সুস্থ সন্তানের জন্ম দিচ্ছে, লাখ লাখ শিশু স্কুলে যাচ্ছে এবং কোটি কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্য ও ক্ষুধার ভয়াল চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে। তবে এই অর্জন সম্ভব হতো না, যদি বৈশ্বিক নেতৃত্বের গতিশীলতা, দৃঢ় সংকল্প ও প্রয়াস না থাকতÑ যারা স্ব-স্ব দেশের জনগণের জীবনমান উন্নয়নে এবং দারিদ্র্য দূরীকরণে ইস্পাত কঠিন সংকল্প নিয়ে কাজ করেছেন এবং এখনও করে চলেছেন। তেমনি এক নেতৃত্ব বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিম-লেও আজ ন্যায় ও সুশাসন এবং উন্নয়নের প্রতীক বলে খোদ জাতিসংঘই বলছে বাংলাদেশ ও দেশটির নেতা শেখ হাসিনার কথা।
এতে সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই যে দেশ ও বিশ্ব পরিম-লে শেখ হাসিনা আজ গণতন্ত্র, উন্নয়ন, ন্যায়বিচার ও শান্তির প্রতীক। তারই নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতিসংঘে অনেকগুলো প্রস্তাব আনে, যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানবকল্যাণ, টেকসই উন্নয়ন এবং সকল জাতিসত্তার অব্যাহত উন্নয়ন ও মুক্তি। উদাহরণস্বরূপ, তারই নেতৃত্বে ও তারই আনীত প্রস্তাবের কারণে জাতিসংঘে আজ ‘উন্নয়নের অধিকার’ একটি মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাদেশের সভাপতিত্বে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ১৩২৫ নম্বর প্রস্তাবের কল্যাণে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা ও শান্তি বিনির্মাণের প্রতিটি পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে। বাংলাদেশের নেতা শেখ হাসিনার কল্যাণেই আজ জাতিসংঘে ‘শান্তির সংস্কৃতি’ বা ঈঁষঃঁৎব ড়ভ চবধপব চালু হয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী জোরালোভাবে অনুসূত হচ্ছে।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশ আজ সর্বোচ্চ সৈন্যদাতা রাষ্ট্র। যুদ্ধ আক্রান্ত রাষ্ট্র যাতে সাধারণ মানুষ এবং শান্তিরক্ষীরা সুরক্ষিত থাকে সে-বিষয়ে শেখ হাসিনা বদ্ধপরিকর। বিশ্বে তিনিই একমাত্র নেতা যিনি এমন কী বড়দিনের ছুটির মাঝেও জাতিসংঘ মহাসচিবের অনুরোধে মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে শান্তিরক্ষী প্রেরণের নির্দেশনা দিয়েছেন। শান্তিরক্ষী প্রেরণে তিনি কখনোই কার্পণ্য করেন নি। এটি কোনো বিস্ময়ের ব্যাপার নয় যে ১ লাখ ৩৮ হাজার শান্তিরক্ষী বাহিনীর সমন্বয়ে জাতিসংঘ সারা পৃথিবীতে শান্তি রক্ষা করতে সমর্থ হচ্ছে যেসব সৈন্যের, অনেকেই তাদের জীবনের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করেছেন। তারা প্রকৃত অর্থেই শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কারের দাবিদার।
শেখ হাসিনার সফল নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতিসংঘে দুটি যুগান্তকারী প্রস্তাব আনে ২০১২ সালে, যা সর্বসম্মতিক্রমে বিশ্বসভায় গৃহীত হয়। এর প্রথমটি ছিল অটিজম ও প্রতিবন্ধী শিশুদের অধিকার সংক্রান্ত, আর দ্বিতীয়টি জনগণের ক্ষমতায়ন সংক্রান্ত। তিনি বিশ্বাস করেন, সবারই অংশগ্রহণের সমান সুযোগ রয়েছে, কারোই বাদ পড়ার কথা নয়। মানবতা ও উন্নয়নে সবাই নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী অবদান রাখতে পারে। তাই অটিজমে আক্রান্ত এবং প্রতিবন্ধী শিশুদের জীবন যন্ত্রণা ও বঞ্চনার বিষয়টি যখন তার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ হোসেন উত্থাপন করেন, বাংলাদেশ দ্রুত এ বিষয়টি বিশ্বসভায় উত্থাপন করে এবং বিশ্বনেতৃত্বের দৃষ্টি আকর্ষণ ও সমর্থন আদায় করে।
অটিজম এবং প্রতিবন্ধিতা সংক্রান্ত অনেকগুলো বড় আহ্বান করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতিসংঘ এবং তার সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সামনে বিষয়টি উত্থাপিত হওয়ার পরপরই তা সাধারণ পরিষদে সেগুলো প্রস্তাবিত ও অনুমোদিত হয় এবং সদস্য রাষ্ট্রসহ সবক’টি জাতিসংঘ সংস্থার কর্মকা-ে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়। এক্ষেত্রে বৈশ্বিক নেতৃত্বটি অবশ্যই বাংলাদেশের এবং দেশটির নেতা শেখ হাসিনার।

বিগত ৪০ বছরের জাতীয় ও বৈদেশিক রাজনীতির অভিজ্ঞতা থেকে শেখ হাসিনা জানেন যে, সামনের দিনগুলোতে বিশ্বের প্রধানতম চ্যালেঞ্জগুলো হবে জলবায়ু পরিবর্তন, বেকারত্ব, আর্থিক সংকট, দীর্ঘস্থায়ী ক্ষুধা ও দারিদ্র্য এবং এগুলো থেকে উদ্ভূত হাজারও সমস্যা। তাই তিনি বিশ্বাস করেন এ চ্যালেঞ্জগুলো তখনই মানুষ অতিক্রম করতে সক্ষম হবে যখন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা যাবে। একেই তিনি বলছেন জনগণের ক্ষমতায়ন। এটি সম্ভব হলে সৃজনশীলতা, উদ্ভাবনী শক্তি, সক্ষমতা এবং কার্যকারিতার সাথে মানুষ কাজ করতে পারবে, ফলে সবাই সমভাবে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অবদান রাখতে পারবে। তাই জনগণের ক্ষমতায়নের প্রতি তিনি এতটা গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে জনগণকে ক্ষমতায়িত করা যাবে? বিষয়টিকে তিনি ৬টি আন্তঃসংযুক্ত চলকের দ্বারা বিশ্লেষণ করেছেন-
প্রথমত; মানুষের ক্ষমতায়ন হবে চরম দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্তি সম্ভব হলে,
দ্বিতীয়ত; তাদের ক্ষমতায়ন সম্ভব হবে প্রয়োজনীয় দক্ষতা, কারিগরি জ্ঞান ও মানসম্মত শিক্ষাদানের মাধ্যমে, যাতে করে তারা নিজেরাই কর্মসংস্থান বা উপর্যুক্ত চাকরির ব্যবস্থা করে স্বাবলম্বী হবে,
তৃতীয়ত; তাদের ক্ষমতায়ন সম্ভব হতে পারে বৈষম্য ও বঞ্চনার অবসানের মাধ্যমে,
চতুর্থত; সন্ত্রাস নির্মূল করে একটি নিরাপদ জীবন নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতায়ন করা যাবে,
পঞ্চমত; এতদিন যারা উন্নয়ন ও মূল জীবনধারার বাইরে ছিল, তাদের অন্তর্ভুক্ত করে ক্ষমতায়ন করা যাবে এবং সর্বোপরি, তাদের ক্ষমতায়ন সম্ভব হবে ভোটাধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে ও শাসন ব্যবস্থায় সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে।
শেখ হাসিনার ‘জনগণের ক্ষমতায়ন’ ধারণাটি জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনসহ সদস্য রাষ্ট্রসমূহের নেতৃবৃন্দের মধ্যেও অনুরণিত হয়েছে। ২০১২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত ‘রিও+২০ বিশ্ব সম্মেলন’ বিশ্ব নেতৃবৃন্দ ‘যেমন ভবিষ্যৎ চাই’ শীর্ষক দলিল গ্রহণ করেন, যার মধ্যে শেখ হাসিনা প্রণীত জনগণের ক্ষমতায়ন নীতিমালা এবং তার সাথে জড়িত আদর্শ অনুসৃত হয়। উক্ত সম্মেলনে দারিদ্র্য দূরীকরণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়, যার মূল ভিত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়েছে সবার অংশগ্রহণের ভিত্তিতে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত স্থিতিশীলতা অর্জন। সম্প্রতি জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত প্রস্তাব, যা নামে পরিচিত সেটির মূল ভিত্তিই ছিল ‘রিও+২০’তে অনুসৃত শেখ হাসিনার জনগণের ক্ষমতায়ন তত্ত্ব। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা জাতিসংঘে গ্রহণ করেন ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, যার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের যথার্থভাবেই শেখ হাসিনা প্রণীত প্রযুক্তি হস্তান্তর, দারিদ্র্য দূরীকরণ, জনগণের অংশগ্রহণ, আইনের শাসন, সুশাসন ইত্যাদি নির্ধারিত হয়।
তার গতিশীল নেতৃত্বে জাতিসংঘে বাংলাদেশ কর্তৃক উত্থাপিত প্রতিটি বিষষই এসডিজি’র ১৭টি লক্ষ্য এবং ১৬৯টি উদ্দেশ্যের মাঝে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে খাদ্য নিরাপত্তা, জ্বালানি নিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রযুক্তি হস্তান্তর, শিল্পায়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন, অভিবাসন ও উন্নয়ন, মানসম্মত শিক্ষা, জলসম্পদের আন্তঃদেশীয় ব্যবস্থাপনা, জীববৈচিত্র্য, নীল অর্থনীতি (সাগর ও মহাসাগর), বিশ্ব আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অধিকতর অংশগ্রহণের সুযোগ, শান্তি ও স্থিতিশীলতা, আইনের শাসন, পারস্পরিক সহযোগিতা, এলডিসি ইস্যু ইত্যাদি।
জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যে অবিস্মরণীয় অগ্রগতি, তা মূলত সম্ভব হয়েছে দেশটির নেতা শেখ হাসিনার উন্নয়ন চিন্তা এবং জনগণের মুক্তির লক্ষ্যে তার অবিচল প্রতিজ্ঞার কারণেই। সম্পদের ব্যাপক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কেবল নেতৃত্বের বিচক্ষতার, দৃঢ় এবং সঠিক দিক-নির্দেশনার কারণেই বাংলাদেশ এই লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয়েছে। এককালে যে দেশকে বলা হয়েছিল ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ (Bottomless Basket), যার সফল হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই বিশ্ব মোড়লেরা দেখেনি, সেই দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২০১৮-১৯-এ দাঁড়িয়েছে ৮.১৫ শতাংশ। চরম দারিদ্র্য ১৯৯১ সালে যেখানে ছিল ৫৭.৮ শতাংশ, ২০১৯ সালে তা কমে এসেছে ২০.৫ শতাংশের নিচে। করোনার কারণে বিশ্ব অর্থনীতি টালমাটাল হলেও বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫.২০ শতাংশ। একই সাথে ২০১৯ সালে নবজাতক শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ২৬ জনে কমিয়ে আনতে পেরেছে বাংলাদেশ।
বিশ্বের সর্বাধিক জন-অধ্যুষিত ও স্বল্প আয়তনের এক দেশের জন্য এই সাফল্য একেবারে কম নয়। আর এই অর্জন কেবল শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বের কারণেই। দেশের অভ্যন্তরে ব্যাপক বিরোধিতা এবং নানান প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও শেখ হাসিনা তার দৃঢ় ও আপসহীন সিদ্ধান্তের দ্বারা দেশকে উন্নয়নের পথে যেভাবে পরিচালিত করেছেন, তার কল্যাণেই বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে, অথচ পূর্বে দীর্ঘ সময় ধরে দেশটি ছিল খাদ্য ঘাটতির মধ্য।
এই ব্যাপক পরিবর্তনের জন্য শেখ হাসিনা এবং তার দেশবাসী বিশ্বসভায় সাধুবাদ পেতেই পারেন। আর তারই প্রমাণ আমরা দেখি যখন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন বলেন, “বাংলাদেশ হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়নের মডেল এবং নারীর ক্ষমতায়নের উজ্জ্বল নক্ষত্র।” আমেরিকার প্রভাবশালী ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের ভাষায় বাংলাদেশ হচ্ছে ‘দক্ষিণ এশিয়ার আলোকবর্তিকা’ আর গোল্ডম্যান শ্যাক্স তাদের গ্লোবাল অবস্থানে বাংলাদেশকে এন-১১-তে উন্নীত করেছে, যার অর্থ হচ্ছে ১১টি অগ্রসরমান অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ।
দুর্যোগের ঝুঁকি মোকাবিলার প্রস্তুতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম প্রধান দেশের সুনাম অর্জন করেছে। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ শেখ হাসিনার নেতৃত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে একাধিক পদকে ভূষিত করেছে, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সহস্রাব্দ উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য এমডিজি-৪ পুরস্কার (২০১০)। ‘সাউথ-সাউথ’ পুরস্কারে তিনি ভূষিত হন ২০১৩ সালে, দেশজুড়ে প্রায় ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং প্রায় সাড়ে ৫ হাজার ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে জনগণকে সফলভাবে ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তির সংযোগের আওতায় নিয়ে আসার স্বীকৃতিস্বরূপ।
২০১৪ সালে তাকে ‘সাউথ-সাউথ লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করা হয় বিশ্বের দক্ষিণের দেশগুলোতে নেতৃত্বের দূরদর্শিতার স্বাক্ষর হিসেবে। ২০১৫ সালে তিনি জাতিসংঘ কর্তৃক দুটি পুরস্কারে ভূষিত হন, এগুলো হচ্ছেÑ জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব মোকাবিলায় সফলতার জন্য ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ পুরস্কার এবং টেলিযোগাযোগ খাতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন সংস্থার পুরস্কার বা ‘আইটিইউ অ্যাওয়ার্ড’।
২০০০ সালে যখন জাতিসংঘে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) ঘোষণা প্রদান করা হয় তখন শেখ হাসিনা বাংলাদেশের নেতা হিসেবে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আবার ২০১৫ সালে যখন ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জনের লক্ষ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা (এসডিজি) হয় তখনও তিনি বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে জাতিসংঘে নেতৃত্বদান করেন। তিনি বিশ্বের একমাত্র নেতা যিনি জাতিসংঘের উন্নয়ন সংক্রান্ত এ দুই মাইলফলক ঘোষণার সময় নিজের দেশের নেতা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তার দেশ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা সক্ষম হবে মর্মে ২০০০ সালের সম্মেলনে তিনি ব্যক্তিগতভাবে প্রতিশ্রুতি দেন বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সামনে। সেই প্রতিশ্রুতি তিনি রক্ষা করেছেন। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম সেই যে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্র পূরণ করতে পেরেছে। ২০১৫ সালের সম্মেলনে আবার যখন বিশ্ব নেতৃবৃন্দ টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেন (যা ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জন করতে হবে) তখন শেখ হাসিনা বিশ্বসভায় এই প্রতিশ্রুতি দেন যে তার দেশ এই লক্ষ্যমাত্রা যথাসময়ে পূরণ করবে। শুধু সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকেন নি তিনি, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যআয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে রূপান্তরের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য এদেশগুলোর প্রতি বছর ৫ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করতে হবে। বর্তমানে বৈদেশিক সাহায্য স্কিমের আওতায় উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্রসমূহ বছরে ১৩৮ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়ে থাকে, যার মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে যায় মাত্র ৩৮ থেকে ৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য এই অর্থ পর্যাপ্ত নয়। সাউথ-সাউথ দেশগুলোর অমিত সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অগ্রগতি যথাযথভাবে তদারকি ও মূল্যায়নের জন্য বাংলাদেশ সাউথ-সাউথ দেশগুলোর অর্থ ও উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রীদের একটি ফোরাম গঠনের প্রস্তাব করেছে, যা আন্তর্জাতিকমহল কর্তৃক সমর্থিত হয়েছে। সম্প্রতি চীন সাউথ-সাউথ সহযোগিতার জন্য ১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অনুদানের ঘোষণা দিয়েছে। শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো কর্তৃক ২১ ফেব্রুয়ারি মহান ভাষা শহিদ দিবসকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সক্ষম হয়।
এ-কথা আজ সারাবিশ্ব জানে যে, ১৯৫২ সালে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বাংলাদেশের জনগণ তাদের বুকের রক্ত দিয়েছে। সেই আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘ পৃথিবীর সব জাতির মাতৃভাষা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার প্রয়াসে সেই দিনটিকে জাতিসংঘ সম্মানিত করেছে, যা আজ বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সব দেশে পালিত হচ্ছে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অনন্য নজির স্থাপন করেছে। দীর্ঘদিন ধরে বিরোধপূর্ণ সমুদ্রসীমা নিয়ে প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের সাথে যে দ্বন্দ্ব চলে আসছিল, সে-বিষয়ে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন সংক্রান্ত ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার যে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত তিনি গ্রহণ করেন, তারই ফল স্বরূপ বাংলাদেশ তার সমুদ্রসীমার ওপর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। অন্যদিকে প্রতিবেশী দুই রাষ্ট্র ভারত এবং মিয়ানমারও তাদের আইনগত ন্যায্য পাওনা পেয়েছে। কোনো সংঘাত বা যুদ্ধ ছাড়াই এহেন বিরোধ নিষ্পত্তির ঘটনা পৃথিবীতে বিরল।
শেখ হাসিনার শাসনের প্রথম মেয়াদে (১৯৯৬-২০০১) বাংলাদেশে কয়েকটি যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে। এর প্রথমটি ছিল ভারতের সাথে গুরুত্বপূর্ণ গঙ্গা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে সক্ষম হয় বাংলাদেশ। দ্বিতীয় যে ঐতিহাসিক ঘটনা সে-সময়ে ঘটে সেটি হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর। যে সমস্যার আবর্তে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের দোলাচলে সেই সময় পর্যন্ত ২৫ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল, রাষ্ট্রনায়কোচিত পদক্ষেপ নিয়ে শেখ হাসিনা সেই দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতের অবসান ঘটান। বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে। পৃথিবীর সাম্প্রতিক ইতিহাসে শান্তি প্রতিষ্ঠান এমন নজির বিরল। মার্কিন কংগ্রেস এবং বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এই সাহসী দুই চুক্তির জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী ও সাহসী নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেছে। সম্প্রতি কূটনৈতিক আলাপ-আলোচনা, রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও প্রশাসনিক কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে ভারতের সাথে অর্ধশতক ধরে ঝুলে থাকা ‘ছিটমহল সমস্যার’ সমাধান করেছেন ৭২ বছর আগে ‘সীমান্ত নির্ধারণ চুক্তি’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে। ফলে গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকার এবং ন্যায় বিচার পেয়েছে দীর্ঘদিন ভাগ্যবিড়ম্বিত থাকা উভয় দেশের ছিটমহলবাসী। প্রকৃত অর্থেই শেখ হাসিনা শান্তি ও স্থিতিশীলতার মূর্ত প্রতীকে পরিণত হয়েছেন দক্ষিণ এশিয়ার এ অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের জন্য। আশার আলোকবর্তিকা হয়ে তিনি আবির্ভূত হয়েছেন বিশ্বের শত-কোটি নিপীড়িত মানবতার জন্য।
আধুনিক বিশ্বে বাংলাদেশ আরও একটি কারণে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। তা হলো- একটি শক্ত, সৃজনশীল ও পরিশ্রমী অভিবাসী শ্রমিকদের দেশ হিসেবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ আজ বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটিরও বেশি প্রবাসী নাগরিক রয়েছেন। যারা কঠোর পরিশ্রম করে বাংলাদেশে বিভিন্ন বন্ধু-রাষ্ট্রসমূহের অবকাঠামো উন্নয়নে অবদান রাখছেন, তাদের অর্থনীতি সমৃদ্ধ করছেন। একই সাথে নিজেদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা স্বদেশে পাঠিয়ে তারা বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নে রাখছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তবে এসব প্রবাসী শ্রমিকদের জীবনে থাকে অজস্র দুঃখগাঁথা, বঞ্চনা আর প্রতারণার কাহিনি। এমন কী কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা নিজেদের ন্যায্য বেতনটুকু থেকেও বঞ্চিত হন। অথচ এই প্রবাসীরাই মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে কী অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছেন বিদেশের মাটিতে। আবার আজ তারা সেই বিদেশে থেকেও নিজের দেশকে সমৃদ্ধ ও উন্নয়নের শিখরে নিয়ে যেতে রাখছেন ব্যাপক অবদান। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে প্রবাসীরা আজ রেখেছেন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। দেশে বিনিয়োগ, বৈদেশিক মুদ্রার রির্জাভ বৃদ্ধিতেও তাদের অবদান অনেক। ১ কোটিরও বেশি প্রবাসীদের ওপর দেশের প্রায় ৩৩ শতাংশ মানুষ নির্ভর করে, যাদের সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখেরও বেশি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এই অভিবাসী শ্রমিক এবং বিদেশে অবস্থানরত দক্ষ বাংলাদেশি পেশাজীবীদের স্বীকৃতি প্রদান করেছে; তাদের সুরক্ষা এবং দেশে তাদের বিশেষ সম্মানের ব্যবস্থা করেছে এবং তাদের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য গ্রহণ করেছে নানামুখী পদক্ষেপ। প্রবাসে তাদের সমস্যা সমাধানে নিজের দেশের সরকারি প্রতিনিধি/কূটনীতিকদের যেমন তিনি নির্দেশনা দিচ্ছেন ঠিক তেমনি বিশ্বসভায় তিনি এই দাবি তুলেছেন যে, প্রবাসী শ্রমিকদের কল্যাণে হোস্টকান্ট্রি বা শ্রমিকদের অবস্থানকারী রাষ্ট্রের দায়িত্ব অনেক। তাদেরই এটি নিশ্চিত করা কর্তব্য যাতে তাদের দেশে প্রবাসী শ্রমিকদের কেউ শোষণ, নির্যাতন বা কোনোরকম বৈষম্য বা বঞ্চনার শিকার হতে না হয়। একই সাথে উন্নত দেশগুলোরও এ বিষয়ে যতœবান হওয়া উচিত, যাতে তাদের দেশে কর্মরত বিদেশি শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষিত হয় এবং সেসব সংগ্রামী শ্রমজীবী জনতা যেন কোনো প্রকার শোষণ, নির্যাতন বা প্রতারণার শিকার না হন। প্রবাসীদের দেশে অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
দেশে এবং বিদেশে বাংলাদেশি নাগরিকদের অধিকার আদায়ে এতটা সোচ্চার এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর কণ্ঠস্বর হতে পারে বলেই হয়তো, বস্তুত, এ সময়ের মধ্যে কোনো আন্তর্জাতিক নির্বাচনে বাংলাদেশ পরাজিত হয়নি; বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রসমূহ বাংলাদেশের কথা ভেবে, বাংলাদেশ নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখে ওইসব নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে নিজেদের প্রার্থিতা প্রত্যাহারও করে নিয়েছে। বাংলাদেশের নেতা শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রসমূহ তথা বিশ্ব নেতৃত্বের আস্থা এবং প্রগাঢ় ভরসারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে এসব আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নির্বাচনে জয়লাভের মাধ্যমে।
জাতিসংঘের সেকেন্ড কমিটির চেয়ার হিসেবে অধিকাংশ বিতর্কেই বাংলাদেশ সকল সদস্যকে মতৈক্যে নিয়ে আসতে পেরেছে। পিস বিল্ডিং কমিটি (পিবিসি) বা অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের (ইসিওএসওসি) চেয়ার হিসেবে বিশ্বব্যাংকে জাতিসংঘ কমিটিসমূহের সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করাতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ।
সাউথ-সাউথ কো-অপারেশনের চেয়ার হিসেবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে বাধাসমূহ ও করণীয় চিহ্নিতকরণে বাংলাদেশ নেতৃস্থানীয় ভূমিকা গ্রহণ করে। জাতিসংঘের ব্যুরো সদস্য এবং এলডিসি গ্রুপের চেয়ার হিসেবে ইস্তাম্বুল কর্মপরিকল্পনা (আইপিএও) প্রণয়নে বাংলাদেশ অগ্রণী ভূমিকা রাখে; শুধু তাই নয়, জাতিসংঘের বিভিন্ন ফান্ড যেমনÑ ইউনিসেফ, ইউএনডিপি, ইউএন উইমেন, জাতিসংঘ জনসংখ্যা কমিশন ইত্যাদির চেয়ার হিসেবে ওইসব অঙ্গ সংগঠনের কর্মপরিকল্পনায় ইস্তাম্বুল কর্মপরিকল্পনা অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অন্যতম ভূমিকা পালন করে।
সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ সংক্রান্ত জাতিসংঘ কমিটির ফ্যাসিলিটেটর হিসেবে ২০১০ সালে বাংলাদেশ উক্ত কমিটির প্রস্তাব সদস্য রাষ্ট্রসমূহের মতৈক্যের অর্জনে সফল হয়। ‘মানবপাচার প্রতিরোধ সংক্রান্ত জাতিসংঘের বন্ধু’ রাষ্ট্রসমূহের সদস্য হিসেবে জাতিসংঘের প্রস্তাব পাসের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। মানবপাচার প্রতিরোধ ও অবসানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত সাহসের সাথে উটের জকি ও দাস হিসেবে শিশুদের ব্যবহারের বিরুদ্ধে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মাঝে সোচ্চার জনমত গড়ে তোলেন এবং মধ্যপ্রাচ্যে পাচার হয়ে যাওয়া বাংলাদেশি শিশুদের উদ্ধারের নির্দেশ দেন ও তাদের উদ্ধার-পরবর্তী পুনর্বাসনের পদক্ষেপ সংক্রান্ত সার্ক সম্মেলনে ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতিসংঘের ‘ফ্রেন্ডস অব মিডিয়েশন’, ‘ফ্রেন্ডস অব ইন-অ্যালিনেবল রাইটস অব প্যালেস্টাইন’, ‘ফ্রেন্ডস অব নো ফুড ওয়েস্ট, নো ফুড লস’ ইত্যাদি ভূমিকায় মানবতার মর্যাদা রক্ষা এবং জাতিসংঘ সনদের লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
বস্তুতপক্ষে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতিসংঘে একটি অত্যন্ত সম্মানজনক সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে এবং বর্তমানে ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ হিসেবে জাতিসংঘ কর্তৃক বাংলাদেশকেই চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। কেবল সর্বোচ্চ সৈন্য প্রেরণকারী দেশ হিসেবেই নয়, সক্ষমতার সাথে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলাকারী দেশ হিসেবেও বাংলাদেশের সুনাম আজ জাতিসংঘে ব্যাপক। জাতিসংঘের ‘হি অ্যান্ড শী’ চ্যাম্পিয়ন হিসেবেও বাংলাদেশের নাম চলে আসে সবার আগে। জাতিসংঘ মহাসচিবের ‘শিক্ষাই সর্বাগ্র’ শীর্ষক প্রকল্পে এবং মহাসচিবের স্বাস্থ্যরক্ষা সংক্রান্ত উদ্যোগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে চ্যাম্পিয়ন হিসেবে গণ্য করা হয়। মহাসচিবের নেতৃত্বে শান্তিরক্ষী নিয়োগ সংক্রান্ত সিনিয়র পরামর্শক কমিটির সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ শান্তিরক্ষীদের নীল হেলমেট প্রদানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা সংক্রান্ত আঞ্চলিক রিভিউ কমিটির ঢাকা কনফারেন্সের আয়োজন করে বাংলাদেশ, ২০১৪ সালে এবং সদস্য রাষ্ট্রসমূহের শান্তিরক্ষীদের প্রশিক্ষণ দান করে। প্রতি ১০ শান্তিরক্ষীর মধ্যে একজন বাংলাদেশি শন্তিরক্ষী। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ নারী শান্তিরক্ষীদের জন্য নীল হেলমেট, বর্ম ও তলোয়ার চালানো এবং পুলিশের একটি ইউনিট বসানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার ক্ষেত্রে জাতিসংঘ অত্যন্ত সোচ্চার ভূমিকা পালন করছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অপূরণীয় ক্ষতি ও চ্যালেঞ্জকে বিশ্ববাসীর সামনে যথার্থভাবে তুলে ধরতে তিনি সদা সচেষ্ট থেকেছেন। তিনি একজন নেতা যিনি এ বিষয়টিকে বিশ্ববাসীর সামনে বারংবার তুলে ধরেছেন যে, পরিবেশ দূষণকারী না হয়েও স্বল্পোন্নত রাষ্ট্রসমূহ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সবচেয়ে বড় হুমকির মধ্যে রয়েছে। কেবল বাগাড়ম্বর বা উচ্চবাক্য না করে এ বিষয়টি তিনি কর্মপরিকল্পনার মধ্যে গ্রহণ করেছেন এবং বিষয়টি নিয়ে কীভাবে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগোনো যায় তা নিজে তদারক ও কাজ করে চলেছেন।
আজ সম্পদের স্বল্পতা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা সংক্রান্ত দুটি ফান্ড গঠন করেছে। তাই সংগত কারণেই জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি তাকে ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ পুরস্কারে ভূষিত করেছেন। কেননা পরিবেশ সুরক্ষার জন্য তিনি বিশ্বের সিংহভাগ জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর এবং পরিবেশ নীতিমালা গঠনের ক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা রেখেছেন। ‘জলবায়ু ঝুঁকি ফোরাম (সিভিএফ)’ এবং ‘জলবায়ু ঝুঁকি প্রবণতা তদারকি (সিভিএম)’ গঠন করেছেন তিনিই। তার প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়েই ‘জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিষয়ক দায়িত্ব বিষয়ক রাষ্ট্রদূত ফোরাম’ (Ambassadors with Responsibiliy to Climate Change-ARC) এবং ‘জলবায়ু পরিবর্তনের বন্ধু’ (Friends of climate change-FCC) গঠন করা হয়েছে, যারা জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে তার যুদ্ধ ঘোষণার পরই আমরা দেখতে পাই যে, অন্যান্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এই জটিল ইস্যুতে এগিয়ে আসছেন।
যুদ্ধ-বিগ্রহ, ভয়াল বন্যা, অনাবৃষ্টি, ক্ষরা, নদীভাঙন ইত্যাদি নানা কারণে সাম্প্রতিককালে দেশে দেশে যে হারে মানুষ বাস্ত্যুচ্যুত হচ্ছে বা নিজ দেশে কাজ হারিয়ে দেশান্তরী হয়ে পড়ছে জীবিকার তাগিদে, কিংবা শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় খুঁজছে বিভিন্ন দেশে তখন সেসব কঠিন সমস্যার কারণ খুঁজে আর কোনো মানুষ যেন শরণার্থী না হয়, বাস্তুচ্যুত না হয় তার ব্যবস্থা করার জন্য জোরালো দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ। সম্পদশালী দেশগুলো সম্পদের অপব্যবহারের মাধ্যমে আজ পৃথিবীর পরিবেশের এই দশা করেছে, যদিও তাদের অবিমৃষ্যকারিতার ফল পেতে হচ্ছে স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে, যারা হয়তো কোনোভাবেই এই ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা জলবায়ু’র কারণে উদ্বাস্তু হওয়ার জন্য দায়ী নয়। অথচ তাদেরই সবচেয়ে কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হবে। বাংলাদেশ মনে করে, এ অবস্থা হতে উত্তরণের দায় এবং দায়িত্ব উভয়ই উন্নত বিশ্বকে নিতে হবে। হয় তাদের এসব নানান প্রক্রিয়ায় করা পরিবেশ দূষণ বন্ধ করতে হবে; অথবা তাদের এমন কাজ করতে হবে যাতে যুদ্ধবিগ্রহ না বাধে বা মানুষ নিজের দেশ ছাড়তে বাধ্য না হয়।
শেখ হাসিনা কথা নয়, কাজে বিশ্বাসী। লক্ষ্য অর্জনে তিনি পিছপা নন এক কদমও। তার অক্লান্ত প্রয়াসের ফলে বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন বেড়েছে। বাংলাদেশে সরকারপ্রধান একজন নারী। জাতীয় সংসদের স্পিকার এবং সংসদের বিরোধীদলীয় নেতাও নারী- নারীর ক্ষমতায়নের এ এক অনবদ্য সংযোগ। শেখ হাসিনার বাংলাদেশ সেই গুটিকয়েক রাষ্ট্রের মধ্যে অন্যতম যেখানে বছরের শুরুতে দেশব্যাপী শিশুদের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩০০ মিলিয়ন বই বিতরণ করা হয় বিনামূল্যে। বাংলাদেশ সেই রাষ্ট্র যেখানে এনজিওরা উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সরকারের সাথে সমানতালে অংশগ্রহণ করে। তাই বাংলাদেশ আজ তার উদ্ভাবনী সুশাসন প্রক্রিয়া এবং যুক্তির নিরিখে চলার জন্য বিশ্ব দরবারে সম্মানিত। সামগ্রিক এই প্রক্রিয়ায়, সন্দেহ বা বিস্ময়ের কোনো অবকাশই নেই যে, সেই বাংলাদেশের নেতা শেখ হাসিনা, আজ জাতিসংঘ তথা বিশ্ব পরিম-লে শান্তি ও ন্যায্যতার এক মূর্ত প্রতীক হিসেবে নিজের দেশ ও জনগণকে তুলে ধরেছেন সবার ওপরে। জয়তু বিশ^নেতা শেখ হাসিনা।
জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদান
জনগণের ক্ষমতায়ন মডেল : অস্থিরতা, সহিংসতা, পরমত অসহিঞ্চুতা, বৈষম্য এবং ব্যাপক জন-অসন্তোষের ক্ষেত্রে এই মডেল বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
কালচার অব পিস : বিগত সময়ে সরকারের থাকাকালীন সময়ে বাংলাদেশ কর্তৃক জাতিসংঘে শান্তির সংস্কৃতির ধারণা প্রচলন করা হয়। জাতিসংঘের ভিতরে ও বাইরে এ ধারণা ব্যাপক সমর্থন লাভ করে; কেননা এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। বিষয়টি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, যা সমগ্র জাতিসংঘ ব্যবস্থার মাঝে অনুরণিত হয়।
শান্তিরক্ষা কার্যক্রম (পিস কিপিং) : শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমিকা সর্বজনবিদিত ও স্বীকৃত। জাতীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরিম-লে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বদ্ধপরিকর। তার গতিশীল নেতৃত্বে বিশ্বে আজ সর্বোচ্চ সংখ্যক শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে সমাদৃত বাংলাদেশ।
শান্তি বিনির্মাণ (পিস বিল্ডিং) : তার সুযোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ শান্তি বিনির্মাণের বিষয়টি বিশ্বব্যাপী গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেছে। স্বল্পদিন হলো এ-সংক্রান্ত কমিশন গঠিত হয়েছে, যা ‘ইউএন পিস বিল্ডিং কমিশন’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশ এর গুরুত্বপূর্ণ মিটিংসমূহে সভাপতিত্ব করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতার কারণে এ-সংক্রান্ত সব কার্যক্রমের আলোচনায় বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে।
বহুমাত্রিক নেতৃত্ব : নানামুখী জাতীয় ও বৈশ্বিক ইস্যুতে চ্যালেঞ্জ নিতে পিছপা নন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার অবিচল নেতৃত্বে বাংলাদেশে জাতিসংঘের বিভিন্ন কমিটি এবং অনেকগুলো আন্তর্জাতিক সংস্থায় সভাপতি এবং সদস্যপদে নির্বাচিত হয়েছে। বিগত ছয় বছরে বাংলাদেশে কোনো একটি নির্বাচনেও পরাজিত হয়নি। সকল দেশ ও তাদের নেতাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ ও তার নেতা শেখ হাসিনা।
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার মডেল বাংলাদেশ : জাতিসংঘ মহাসচিবের ভাষ্যমতে, বাংলাদেশ এমডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কেবল স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যেই নয়, অনেকগুলো উন্নত দেশের চেয়েও বাংলাদেশের এমডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সাফল্য ব্যাপক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে এর সফল বাস্তবায়ন তদারক ও মূল্যায়ন করে থাকেন। এবং প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা প্রদান করেন।
ঝুঁকিপূর্ণ দেশসমূহের সুরক্ষা ও নেতৃত্ব দান : বর্তমানে বাংলাদেশে ৪৮টি স্বল্পোন্নত দেশের নেতা ও মুখপাত্র। তাই জাতিসংঘ তথা আন্তর্জাতিক ফোরামে এসব দেশের স্বার্থ রক্ষা এবং তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ের নেতৃত্বও বাংলাদেশের। সর্বসম্মতভাবে বাংলাদেশ এই পদে নির্বাচিত হয়; বাংলাদেশের নেতা শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতাই বাংলাদেশকে এই পদে আসীন করেছে। এলডিসি রাষ্ট্রসমূহের স্বার্থরক্ষায় তিনি ব্যক্তিগতভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
ভিন্ন জীবনের মানুষের সমস্যাকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসা : বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণেই জাতিসংঘের সকল রাষ্ট্রের কাছে আজ অটিজমে আক্রান্ত শিশু ও অটিজম সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিবর্গের সমস্যাবলি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ-সংক্রান্ত বাংলাদেশের প্রস্তাব পৃথিবীর সবক’টি রাষ্ট্রের অকুণ্ঠ সমর্থন লাভ করেছে। বিষয়টির প্রবক্তা হিসেবে বাংলাদেশের নাম আজ সব দেশে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে।
জলবায়ুর ঝুঁকি আক্রান্তদের সমস্যায় নেতৃত্ব : জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সক্রিয়ভাবে কাজ করে দেখিয়েছেন যে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের দরিদ্র ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ঝুঁকি কতটা। এ-সমস্যার কারণ খুঁজে আর কোনো মানুষ যেন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শরণার্থী না হয়, বাস্তুচ্যুত না হয় তার ব্যবস্থা করার জন্য জোরালো দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ। সম্পদশালী দেশগুলো সম্পদের অপব্যবহারের মাধ্যমে আজ পৃথিবীর পরিবেশের এই দশা করেছে, যদিও তাদের অবিমৃষ্যকারিতার ফল পেতে হচ্ছে স্বল্পোন্নত দেশগুলো, যারা হয়তো কোনোভাবে এই ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্ব উষ্ণতায়ন’র কারণে উদ্বাস্তু হওয়ার জন্য দায়ী নয়। অথচ তাদেরই সবচেয়ে কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হবে। বাংলাদেশ মনে করে, এ অবস্থা হতে উত্তরণের দায় এবং দায়িত্ব উভয়ই উন্নত বিশ্বকে নিতে হবে। হয় তাদের এসব নানান প্রক্রিয়ায় করা পরিবেশ দূষণ বন্ধ করতে হবে, অথবা তাদের এমন কাজ করতে হবে যাতে যুদ্ধবিগ্রহ না বাধে বা মানুষ নিজের দেশ ছাড়তে বাধ্য না হয়। জলবায়ু ঝুঁকি ফোরাম (সিভিএফ) এবং জলবায়ু ঝুঁকিপ্রবণতা তাদরকি (সিভিএম) গঠন করেছে বাংলাদেশ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এর প্রতিষ্ঠা করেন জাতিসংঘের ৬৭তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে।
আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ আইনি সমাধান : শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অনন্য নিজের স্থাপন করেছে। দীর্ঘদিন ধরে বিরোধপূর্ণ সমুদ্রসীমা নিয়ে প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের সাথে যে দ্বন্দ্ব চলে আসছিল সে-বিষয়ে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন সংক্রান্ত ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার যে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত তিনি গ্রহণ করেন, তারই ফলস্বরূপ বাংলাদেশ তার সমুদ্রসীমার ওপর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। অন্যদিকে প্রতিবেশী দুই রাষ্ট্র ভারত এবং মিয়ানমারও তাদের আইনগত ন্যায্য পাওনা পেয়েছে। কোনো সংঘাত বা যুদ্ধ ছাড়াই এহেন বিরোধ নিষ্পত্তির ঘটনা পৃথিবীতে বিরল।
জাতিসংঘের মাধ্যমে অভিবাসীদের অধিকারের সুরক্ষা : অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষার জন্য নিরলস কাজ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ-সংক্রান্ত জাতিসংঘ কমিটিতে তিনি যথার্থভাবে তার বক্তব্য তুলে ধরেছেন। এবং তার পক্ষে সমর্থন আদায়ে সক্ষম হয়েছেন। অভিভাসী শ্রমিকের মানবাধিকার, কাজের পরিবেশ, বেতন ও নিরাপত্তাÑ এসব বিষয়ে নিশ্চিত করার জন্য সকল রাষ্ট্রের প্রতি তিনি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। ২০৩০ সালের মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় এ বিষয়টি গুরুত্বের সাথে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
সাউথ-সাউথ অ্যান্ড ট্রায়াঙ্গুলার কো-অপারেশনের কণ্ঠস্বর : সাউথ-সাউথ সংক্রান্ত জাতিসংঘের উচ্চ পর্যায়ের কমিটির সভাপতি বাংলাদেশ। আর সাউথ-সাউথের কণ্ঠস্বর হচ্ছেন শেখ হাসিনা। সম্প্রতি এই রাষ্ট্রসমূহের সাফল্য ব্যাপক, যার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দৃশ্যমান।
জাতিসংঘ সনদের মূল লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়ন
প্রথমত; সহিষ্ণুতার চর্চা এবং ভালো প্রতিবেশী হিসেবে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।
দ্বিতীয়ত; আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখার সাথে একতাবদ্ধ থাকা।
তৃতীয়ত; এই নীতির প্রতি অবিচল থাকা যে, শক্তি প্রয়োগ কোনোভাবে করা হবে না, একমাত্র সামষ্টিক স্বার্থ ছাড়া।
চতুর্থত; বিশ্বের সকল মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক শক্তিসমূহকে কাজে লাগানো।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সনদের এসব মূলনীতির আলোকে একটি সুন্দর, নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে কাজ করে চলেছেন। তার জয়যাত্রা, তার সফলতা অব্যাহত থাকুক। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক : পররাষ্ট্রমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার