Monday, December 4, 2023
বাড়িSliderবঙ্গবন্ধুচর্চা এবং বঙ্গবন্ধু-বিষয়ক কিছু আকরগ্রন্থ

বঙ্গবন্ধুচর্চা এবং বঙ্গবন্ধু-বিষয়ক কিছু আকরগ্রন্থ

বঙ্গদেশে অনেক কীর্তিমান রাজনীতিবিদের জন্ম হলেও এখানকার অধিবাসীদের জন্য একটি স্বাধীন আবাসভূমি প্রতিষ্ঠায় তার মতো অবদান আর কোনো নেতা রাখতে পারেননি। নেতৃত্বগুণেই এ অঞ্চলের গণমানুষ থেকে লেখক-চিন্তাবিদ সকলের চেতনায় তিনি স্থায়ী আসন লাভ করেছেন।

ড. এম আবদুল আলীম: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫) বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। সাংগঠনিক দক্ষতা, সাহস, ত্যাগ আর নেতৃত্বের সম্মোহনী শক্তির গুণে দীর্ঘকালের পরাধীন বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করে তিনি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এর ফলে ‘জাতির পিতা’, ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি’, ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’, ‘বাংলাদেশের স্থপতি’- এসব উপাধি তার নামের পাশে অনিবার্যভাবেই যুক্ত হয়েছে। বঙ্গদেশে অনেক কীর্তিমান রাজনীতিবিদের জন্ম হলেও এখানকার অধিবাসীদের জন্য একটি স্বাধীন আবাসভূমি প্রতিষ্ঠায় তার মতো অবদান আর কোনো নেতা রাখতে পারেননি। নেতৃত্বগুণেই এ অঞ্চলের গণমানুষ থেকে লেখক-চিন্তাবিদ সকলের চেতনায় তিনি স্থায়ী আসন লাভ করেছেন। ফলে নিরক্ষর লোককবিরা যেমন তাকে নিয়ে গান-কবিতা রচনা করেছেন; তেমনি শিক্ষিত-পরিশীলিত কবি, সাহিত্যিক, পণ্ডিত, গবেষকগণও রচনা করেছেন অনেক কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ এবং গবেষণাগ্রন্থ। এ পর্যন্ত তাকে নিয়ে রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থসংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। বাংলাদেশ ও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে উচ্চতর গবেষণাও হয়েছে এবং হচ্ছে। তার জীবন, রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং শাসনকাল নিয়ে পিএইচডি পর্যায়ে গবেষণা হয়েছে। এ ধরনের কয়েকটি পিএইচডি অভিসন্দর্ভের গ্রন্থরূপ হলো- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়ার ইমারজেন্স অব বাংলাদেশ এন্ড রোল অব আওয়ামী লীগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিজ্ঞাগের অধ্যাপক মো. নজরুল ইসলামের ফরেন পলিসি অব বাংলাদেশ : মুজিব ইরা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ সোলায়মানের লিডারশিপ অব শেখ মুজিবুর রহমান, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হাবিবুর রহমানের বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও শেখ মুজিব প্রভৃতি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত গ্রন্থগুলোতে তার জীবন ও কর্মের নির্মোহ এবং বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নের পাশাপাশি স্তুতি-বন্দনা যেমন করা হয়েছে, তেমনি করা হয়েছে বিষোদ্গারও। এসব গ্রন্থ-রচনায় ব্যক্তি উদ্যোগ থেকে প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়াস সবই লক্ষ করা যায়। বর্তমান প্রবন্ধে আমরা বঙ্গবন্ধু-বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ কিছু গ্রন্থ সম্পর্কে আলোকপাত করে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুচর্চার প্রধান প্রধান প্রবণতা সম্পর্কে পর্যালোচনার প্রয়াস চালাব।
বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুচর্চার শুরু বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশাতেই। ওই সময় যেসব বই রচিত হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কাজী আহমেদ কামালের ঝSheikh Mujibur Rahman and Birth of Bangladesh (1970), খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের মুজিববাদ (১৯৭২), কৃত্তিবাস ওঝার আমি মুজিব বলছি (১৯৭২), মযহারুল ইসলামের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব (১৯৭৪) প্রভৃতি। যতদূর জানা যায়, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত প্রথম বই কাজী আহমদ কামালের Sheikh Mujibur Rahman and Birth of Bangladesh গ্রন্থটি; ১৯৭০ সালে এটি যখন রচিত হয়, বঙ্গবন্ধু তখন পূর্ববঙ্গের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদে পরিণত হয়েছেন। বইয়ের লেখক ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনি খুব কাছে থেকে তাকে দেখেছেন। চল্লিশের দশকে কলকাতায় অবস্থানকালে তার সঙ্গে বেকার হোস্টেলে বসবাস করেছেন। ষাটের দশকে বারবার তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন। ফলে বইটি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত বইগুলোর মধ্যে আকরগ্রন্থের মর্যাদা লাভ করেছে। খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসও বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তিনি ব্যক্তি মুজিবের রাজনৈতিক আদর্শকে একটি তাত্ত্বিক কাঠামোর ওপর দাঁড় করে মুজিববাদ নামে গ্রন্থ রচনা করেছেন। মার্কসবাদের সঙ্গে তুলনা করে মুজিববাদকে তিনি জনগণের মুক্তির মূলমন্ত্র হিসেবে অভিহিত করেছেন। মযহারুল ইসলামের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বইটি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এ পর্যন্ত রচিত বইগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। বইটির বিশেষত্ব হলো, এতে সামগ্রিক দৃষ্টিতে ইতিহাসের ঘটনাপরম্পরা বিশ্লেষণ করে বঙ্গবন্ধুর জীবন, সংগ্রাম, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তার অবদান, তার শাসনকাল এবং রাজনৈতিক দর্শন; সবই তুলে ধরা হয়েছে। দশটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত প্রায় হাজার পৃষ্ঠার মহাকাব্যিক এ বইতে বঙ্গবন্ধুর মহাজীবনের পাশাপাশি বাঙালির অর্ধ-শতাব্দীর ইতিহাসের সালতামামি উঠে এসেছে। বইটি প্রথমে বাংলা একাডেমি এবং পরে আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়। যতদূর জানা যায়, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ‘প্রচ্ছদের জন্য : শেখ মুজিবুর রহমানকে’ এই শিরোনামে প্রথম কবিতা লেখেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। কবিতাটি দৈনিক সংবাদ-এ প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালের ১২ নভেম্বর। পল্লিকবি জসীম উদ্দীন ‘বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামে কবিতা রচনা করেন ১৯৭১ সালের ১৬ মার্চ, যেটি তার ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে কাব্যে স্থান পেয়েছে। কবিতাটিতে বঙ্গবন্ধুর তেজ, সংগ্রাম ও স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় অবদানের কথা বাক্সময় হয়ে উঠেছে। কবিতার শুরুতেই জসীম উদ্দীন লিখেছেনÑ ‘মুজিবুর রহমান।/ওই নাম যেন বিসুভিয়াসের অগ্নি-উগারী বান।’ একই বছর (১৯৭১) জুলাই মাসে অন্নদাশঙ্কর রায় তার গঙ্গা থেকে বুড়িগঙ্গা কাব্য সংকলনে স্থান দেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত তার বিখ্যাত পঙ্ক্তিমালা : ‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা/গৌরী মেঘনা বহমান/ততকাল রবে কীর্তি তোমার/শেখ মুজিবুর রহমান।’
বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় তার জীবন ও রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে পঠন-পাঠন ও চর্চা শুরু হলেও অপপ্রচারও কম হয়নি। স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের সঙ্গে এ কাজে পাল্লা দিয়ে নেমেছিল চীনপন্থি লেখক-সাংবাদিকরা। তাছাড়া জাসদ এবং এ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাজনীতিবিদ এবং তাত্ত্বিক বুদ্ধিজীবীরাও পিছিয়ে ছিলেন না। মূলত অপপ্রচারের মাধ্যমে তারা বঙ্গবন্ধুকে যেমন বিতর্কিত করার চেষ্টা করেছেন, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেও করেছেন ভূলুণ্ঠিত। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের পর এ ধারা আরও বেগবান হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের পাশাপাশি একাত্তরের পরাজিত শক্তি ও তাদের দোসররা তখন বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অপপ্রচারে মরিয়া হয়ে মাঠে নামে। উগ্র-বামপন্থি বুদ্ধিজীবীরাও বসে থাকেননি। বদরুদ্দীন উমর থেকে এনায়েতউল্লাহ খানেরা বঙ্গবন্ধু ও তার আদর্শের কঠোর সমালোচনা করেছেন বিভিন্ন লেখায়। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীও এক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিলেন না। এ ধারায় কিছু গ্রন্থও রচিত হয়। যেমন মেজর ডালিমের আমি মুজিবকে হত্যা করিনি, মুনির উদ্দীন আহমদ সম্পাদিত বাংলাদেশ বাহাত্তর থেকে পাঁচাত্তর, আ ক ম রুহুল আমিনের বিতর্কিত মুজিব প্রভৃতি। কিন্তু এই অপপ্রচারকারীরা সফল হয়নি। আঁধার কেটে ক্রমে প্রভাতের আলোর রেখা দেখা দিতে সময় লাগেনি। সকল অপপ্রচারের ছাইভস্ম থেকে ফিনিক্স পাখির মতো পাখা ঝাপটা দিয়ে জেগে ওঠে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ। জীবিত বঙ্গবন্ধুর চেয়ে মৃত বঙ্গবন্ধু যেন অধিক শক্তিশালী হয়ে নবজন্ম লাভ করেন। কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে, প্রবন্ধে, স্মৃতিচারণে, গবেষণায় তিনি নব নব রূপে ফিরে আসতে থাকেন। হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রহমান, শহীদ কাদরী, ওমর আলী, সৈয়দ শামসুল হক, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, হুমায়ুন আজাদ, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, নূহ-উল-আলম লেনিন, অসীম সাহা, কামাল চৌধুরী, নাসির আহমেদসহ অগণিত কবি-সাহিত্যিক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা রচনা করেছেন। মুজিববর্ষে কামাল চৌধুরীর সম্পাদনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিবেদিত কবিতা নামে যে গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তাতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ৩৬৩ জন কবির ৩৬৩টি কবিতা স্থান পেয়েছে। কেবল বাঙালি কবিরাই নন, বিভিন্ন দেশের কবি-লেখকরা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখনী ধারণ করেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়- মার্কিন লেখক রবার্ট পেইন, সালমান রুশদী, লোরী এ্যান ওয়ালস; জাপানি কবি মাৎসুও শুকাইয়া, গবেষক কাজুও আজুমা, প্রফেসর নারা; জার্মান কবি গিয়ার্ড লুইপকে, ব্রিটিশ কবি টেড হিউজ, বসনিয়ার কবি ইভিকা পিচেস্কি প্রমুখের নাম। লিখেছেন ভারতীয় ও পাকিস্তানি লেখকরাও। বিদেশিদের লেখা কয়েকটি গ্রন্থের নাম এক্ষেত্রে উল্লেখ করতে হয়; যেমন- থমাস মিররের মুজিবস রিভেঞ্জ ফর্ম দ্য গ্রেভ, রাও ফরমান আলীর ভুট্টো শেখ মুজিব বাংলাদেশ, আই এন তেওয়ারির ওয়ার অফ ইন্ডিপেনডেন্স ইন বাংলাদেশ স্টাইল অব শেখ মুজিবুর রহমান, আতিদ্রা ভাতনগরের মুজিব দি অর্কিটেক্ট অব বাংলাদেশ এ পলিটিক্যাল বায়োগ্রাফি প্রভৃতি।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ডের পর তাকে নিয়ে নির্মলেন্দু গুণ (‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’), নূহ-উল-আলম লেনিন (‘বঙ্গবন্ধু’), কামাল চৌধুরী (‘জাতীয়তাময় মৃত্যু’), মৃণাল সরকার প্রমুখ কবিতা রচনা করলেও; আলোড়ন সৃষ্টি করে কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতাটি। নির্মলেন্দু গুণ ১৯৭৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন। ১৯৮১ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত হয় এল খতিবের হু কিলড শেখ মুজিব বইটি, যার ভূমিকা লেখেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। এভাবে জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনের সেই বৈরী পরিবেশে অব্যাহত থাকে বঙ্গবন্ধুচর্চা। কেবল ঢাকা নগরীতে নয়, প্রত্যন্ত পল্লিতে বসেও অনেকে অব্যাহত রাখেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখালেখি। পাবনার ঈশ্বরদীর স্কুলশিক্ষক ও বহুমাত্রিক লেখক মুজিবুর রহমান বিশ্বাস (যিনি ‘ভবঘুরে’ নামে পরিচিত ছিলেন) লেখেন শেখ মুজিবই জাতির পিতা নামক গ্রন্থ। বইটি ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হয়। এভাবে আশির দশক পেরিয়ে নব্বই দশক হয়ে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুচর্চা ক্রমে বেগবান হয়েছে। আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, এ পর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজার গ্রন্থ রচিত হয়েছে। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, গান কত লেখা হয়েছে; তার হিসাব নেই। ড. মুহম্মদ এনামুল হক, কবীর চৌধুরী, অমর্ত্য সেন, খান সারওয়ার মুরশিদ, মযহারুল ইসলাম, শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, সৈয়দ শামসুল হক, বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, আবদুল খালেক, যতীন সরকার, আনিসুজ্জামান, আবদুল গাফফার চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মুনতাসীর মামুন, শেখ হাসিনা, নূহ-উল-আলম লেনিন, বেবী মওদুদ, এমএ ওয়াজেদ মিয়া, আবু সাইয়িদসহ অগণিত পণ্ডিত-গবেষক, কবি-সাহিত্যিক-রাজনীতিবিদ বঙ্গবন্ধুচর্চা করেছেন।
ইতিহাসবিদ আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুচর্চা ও বঙ্গবন্ধু-বিষয়ক গ্রন্থ রচনা ও সম্পাদনার ১৬টি প্রবণতার কথা উল্লেখ করেছেন। নূহ-উল-আলম লেনিন রচিত মৃত্যুঞ্জয়ী বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশের অভ্যুদয়, মূলধারা বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছর এবং সম্পাদিত গ্রন্থ ইতিহাসের মহানায়কসহ বেশ কিছু গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও সংগ্রামের কথা বিধৃত রয়েছে। এ বিষয়ে আগ্রহীরা দেখতে পারেন তার বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত গ্রন্থ বঙ্গবন্ধু-বিষয়ক গ্রন্থপঞ্জি (২০২১)। বঙ্গবন্ধুচর্চায় জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি বিশেষ অবদান রেখেছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে বাংলা একাডেমি থেকে আশির অধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, যেগুলো বঙ্গবন্ধুচর্চায় যুক্ত করেছে নতুন মাত্রা। এতে বঙ্গবন্ধু-বিষয়ক পুরনো গ্রন্থসমূহ যেমন পুনর্মুদ্রণ করা হয়েছে তেমনি রচিত হয়েছে বেশ কিছু গবেষণা ও সম্পাদনাগ্রন্থ। এ গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখ করা যায় শামসুজ্জামান খান সম্পাদিত বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ : বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ, মিনার মনসুর সম্পাদিত শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ, হারুন-অর-রশিদের বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব কী ও কেন, সুব্রত বড়ুয়ার বঙ্গবন্ধুর জীবন-কথা, অনুপম হায়াৎ-এর বঙ্গবন্ধু ও চলচ্চিত্র, জালাল ফিরোজের বঙ্গবন্ধু গণপরিষদ সংবিধান, সৈয়দ শামসুল হকের বঙ্গবন্ধুর বীরগাথা, নূহ-উল-আলম লেনিনের রাজনীতিতে হাতেখড়ি ও কলকাতায় শেখ মুজিব, আসাদ চৌধুরীর সংগ্রামী নায়ক বঙ্গবন্ধু, আনোয়ারা সৈয়দ হকের ছোটদের বঙ্গমাতা, সৌমিত্র শেখরের বঙ্গবন্ধু : আদর্শের সুবর্ণরেখা, স্বরোচিষ সরকারের বঙ্গবন্ধু ও বাংলা ভাষা, এম আবদুল আলীমের বঙ্গবন্ধু ও ভাষা-আন্দোলন, অজয় দাশগুপ্তের বঙ্গবন্ধুর আন্দোলন কৌশল ও হরতাল, সাজেদুল আওয়ালের বঙ্গবন্ধুর সংস্কৃতি-ভাবনা, সাইমন জাকারিয়ার সাধক কবিদের রচনায় বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতি, পিয়াস মজিদের মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও বাংলা একাডেমি প্রভৃতি।
বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুচর্চার সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের নির্মাতা তার কন্যা শেখ হাসিনা। তার প্রত্যক্ষ উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা, আমার দেখা নয়াচীন এবং Secret Documents of Intelligence Branch on Father of The Nation
Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman 1948-1971 (Vol 1-14),), জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : জন্মশতবর্ষ স্মারকগ্রন্থ কেবল বঙ্গবন্ধুর জীবন নয়, বাঙালির স্বাধিকার-সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেও অভিনব সংযোজন। এসব বই প্রকাশের ফলে বঙ্গবন্ধুর জীবনের অজানা নানা তথ্য যেমন সামনে এসেছে তেমনি ইতিহাসের অনেক বিভ্রান্তিও দূর হয়েছে। টুঙ্গিপাড়ার এক নিভৃত পল্লির ‘খোকা’ ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে নেতৃত্বের দক্ষতা, সংগ্রাম, ত্যাগ আর মানবিকতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে কীভাবে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হলেন, তা এসব বইয়ের পাতায় পাতায় বিধৃত হয়েছে। কেবল ব্যক্তি শেখ মুজিব নন, তার সমকালের অনেক রাজনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক ঘটনার বস্তুনিষ্ঠ বয়ান এসব বইতে পাওয়া যায়। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধুর জীবনকথা যেভাবে উঠে এসেছে আর কোনো বইতে তার সন্ধান মেলে না। কারাগারের রোজনামচা পাঠ করলে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য বঙ্গবন্ধু কতটা ত্যাগ শিকার করেছেন, সে-সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। আমার দেখা নয়াচীন গ্রন্থে স্থান পেয়েছে একজন উদীয়মান রাজনীতিবিদের দেখা নতুন পরাশক্তি হিসেবে চীনের উত্থানের বর্ণিল ইতিহাস। বইগুলো স্মৃতি আর ইতিহাসের মিশেলে আকরগ্রন্থের মর্যাদা লাভ করেছে। সিক্রেট ডকুমেন্টগুলোকে পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের বয়ানে বঙ্গবন্ধুর জীবন, সংগ্রাম ও ত্যাগের চিত্র মহীয়ান হয়ে উঠেছে। একজন রাজনীতিবিদ সরকারের রক্তচক্ষু ও শ্যেন দৃষ্টি উপেক্ষা করে কীভাবে জাতির মুক্তির অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছিলেন, এ প্রতিবেদনগুলো পাঠ না করলে তা বুঝা যাবে না। কী নেই এই প্রতিবেদনগুলোতে? শেখ হাসিনা সম্পাদিত বঙ্গবন্ধু-বিষয়ক আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : জন্মশতবর্ষ স্মারকগ্রন্থ। বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের বিচিত্র দিক মূল্যায়ন করে লেখা মোট ৫৭টি প্রবন্ধ ও স্মৃতিচারণমূলক লেখা এতে স্থান পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু বিষয়ে শেখ হাসিনার আরও একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ রয়েছে, যেটির নাম শেখ মুজিব আমার পিতা। এতে কন্যার চোখে পিতা মুজিব যেমন উঠে এসেছে, তেমনি একজন রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়কের চোখে আরেকজন রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়কের স্বরূপ উদ্ঘাটিত হয়েছে।
বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুচর্চায় একটি আকরগ্রন্থ মুজিবপিডিয়া (২০২২)। প্রকাশক হিস্ট্রি অ্যান্ড কালচারাল সার্কেল লিমিটেড। দু-খণ্ডে প্রকাশিত এ বইটির প্রধান সম্পাদক কামাল চৌধুরী, সম্পাদক ফরিদ কবির। বঙ্গবন্ধুর জীবনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সম্পর্কিত ৫৯১টি ভুক্তি এ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। দেশের ১০০ খ্যাতিমান রাজনীতিক, ইতিহাসবিদ, লেখক, বুদ্ধিজীবী ও গবেষক ভুক্তিগুলো লিখেছেন। এছাড়া সন্নিবেশিত হয়েছে ৭০০-র বেশি আলোকচিত্র। এত বিশাল ক্যানভাসে বঙ্গবন্ধুর জীবনকে এর আগে আর কোনো গ্রন্থে তুলে ধরা হয়নি। বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতি নিয়ে কয়েক খণ্ডে একটি পূর্ণাঙ্গ চরিত্রের গ্রন্থ লিখেছেন মুনতাসীর মামুন, যার প্রথম খণ্ডের নাম বঙ্গবন্ধুর জীবন : ছাত্র রাজনীতি থেকে জাতীয় রাজনীতি (১৯২০-১৯৪৯)।
মুজিববর্ষে বঙ্গবন্ধুচর্চায় নবজোয়ার সৃষ্টি হয়। বছরজুড়ে আলোচনা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম তো চলেই রচিত ও সম্পাদিত হয় বহু গ্রন্থ। সেসবের পরিচয় এই ক্ষুদ্রকলেবর প্রবন্ধে তুলে ধরা সম্ভব নয়। সবশেষে বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট থেকে প্রকাশিত মুজিববর্ষের স্মারক প্রকাশনা বঙ্গবন্ধু ও বিচার বিভাগ : জাতির পিতার জীবনে আইন, মামলা ও বিচার কার্যক্রম (২০২১) নামক অসাধারণ বইটির নাম উল্লেখ করেই বঙ্গবন্ধুচর্চার সংক্ষিপ্ত ভাষ্যের ইতি টানলাম।

লেখক : গবেষক-প্রাবন্ধিক; সাবেক ডিন, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধড. ইউনূসের সেই তেভাগা খামার এখন ধু-ধু মাঠ
পরবর্তী নিবন্ধকবিতা
আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য