Sunday, September 24, 2023
বাড়িএকাদশ বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, ডিসেম্বর-২০২০বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখার অম্লান স্মৃতি

বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখার অম্লান স্মৃতি

কা মা ল চৌ ধু রী : ১৯৬৯ সালের ২১ মার্চ আমার জীবনের এক অসাধারণ স্মৃতিময় দিন। সেদিনই আমি প্রথম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে কাছ থেকে দেখি। জনসভা মঞ্চে স্কুলপড়–য়া বালকের বঙ্গবন্ধুর কাছে যাওয়ার স্মৃতি- তার সস্নেহ স্পর্শের উত্তাপ আমার জীবন অভিজ্ঞতার সমুজ্জ্বল এক অংশ।
বঙ্গবন্ধু সেদিন আদমজীনগরে এসেছিলেন- আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে তিনি মুক্তি লাভ করেন ২২ ফেব্রুয়ারি। ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ছাত্র-জনতার সংবর্ধনা সমাবেশে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ১০ মার্চ বঙ্গবন্ধু রাওয়ালপিন্ডিতে আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করেন। ১৪ মার্চ তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। ঢাকায় ফিরে ঢাকার বাইরে তিনি প্রথম জনসভা করেন আদমজীনগরে।
১৯৪৯ সালে আওয়ামী (মুসলিম) লীগের প্রতিষ্ঠার পর বাঙালি এলিট-শ্রেণির পাশাপাশি কৃষক শ্রমিক ছাত্র জনতাকে আন্দোলন সংগ্রামে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন শেখ মুজিব। ৭ জুনের হরতালে আদমজী ও তেজগাঁওসহ সারাদেশের হাজার হাজার শ্রমিক স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আদমজী জুট মিলের শ্রমিকদের এক ধরনের স্বজন-সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। ১৯৫৪ সালের দাঙ্গার সময়েও আদমজীর শ্রমিকরা শান্তির দূত হিসেবে তরুণ নেতা শেখ মুজিবকে কাছে পেয়েছিল। শেখ মুজিব প্রথম মন্ত্রী হন ১৯৫৪ সালের ১৫ মে তারিখে। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভায় শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের সময় তারা জানতে পারেন আদমজীতে বাঙালি ও অবাঙালি শ্রমিকদের মধ্যে ভীষণ দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হয়েছে। এ কে ফজলুল হক, শেখ মুজিবসহ নেতৃবৃন্দ তৎক্ষণাৎ আদমজী জুট মিলে ছুটে যান। শেখ মুজিব সেখানে রাত ৯টা পর্যন্ত অবস্থান করে দাঙ্গায় আহতদের সেবা শুশ্রƒষা ও হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা নেন। পরদিনও বঙ্গবন্ধু আদমজী জুট মিলে গিয়ে শ্রমিক কর্মচারীদের পাশে দাঁড়ান। এভাবেই আদমজীর শ্রমিকরা শেখ মুজিবকে নিজেদের একজন হিসেবে পেয়েছিল। বঙ্গবন্ধুও প্রতিদান দিতে ভুল করেননি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি প্রথম ঢাকায় ফিরেই আদমজীতে জনসভা করার সিদ্ধান্ত নেন।
১৯৫০ সালে নারায়ণগঞ্জ (তখন মহকুমা) থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার সুমিলপাড়া ইউনিয়ন এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীতীরে ২৯৭ একর জায়গার ওপরে প্রতিষ্ঠিত হয় আদমজী জুট মিলস লি.। এটি ছিল পৃথিবীর বৃহত্তম পাটকল। একে ইংল্যান্ডের ড্যান্ডি শহরের সঙ্গে তুলনা করে বলা হতো প্রাচ্যের ড্যান্ডি। এর প্রতিষ্ঠা করেছিল পাকিস্তানের আদমজী গ্রুপ। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছিল পাটের জন্য বিখ্যাত। এখানে উৎপন্ন উন্নতমানের পাট ব্যবহার করে এই মিলের বিভিন্ন ইউনিটে পাটজাত দ্রব্য তৈরি করা হতো। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হতো এসব দ্রব্যÑ এ থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক আয় হতো। আদমজী জুট মিলস প্রতিষ্ঠার পর শীতলক্ষ্যা নদীর দুই পাড়ে সিদ্ধিরগঞ্জ, বন্দর, সোনারগাঁও-সহ সন্নিহিত এলাকায় বিশাল জনগোষ্ঠীর আবাস গড়ে ওঠে। আদমজীতে প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করত। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শ্রমিক ছাড়াও বিপুল সংখ্যক বিহারি শ্রমিকও কাজ করত মিলে। শ্রমিক-কর্মচারীদের পোষ্য মিলে লক্ষাধিক লোকের বসবাস ছিল আদমজী জুট মিলস এলাকায়। অস্থানীয় শ্রমিকরা বেশিরভাগ থাকত মিল এলাকার ভেতরে ঢাকাবাজুতে, বিহারির বিহারিপট্টিতে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকার প্রতিশ্রুতি মোতাবেক আদমজী জুট মিলস জাতীয়করণ করে। ২০০২ সালে বিএনপি সরকার আদমজী জুট মিলস বন্ধ ঘোষণা করে। এতে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক-কর্মচারী চাকরি হারায়। পরবর্তীকে এখানে আদমজী ইপিজেড স্থাপন করা হয়।
আমরা তখন থাকতাম আদমজী জুট মিলের জুনিয়র অফিসার্স কোয়ার্টার (জে ও কোয়ার্টার)-এর ২৮ নম্বর বাসায়। আমার পিতা প্রয়াত আহমদ হোসেন চৌধুরী ছিলেন আদমজী জুট মিলসের শ্রম ও কল্যাণ কর্মকর্তা। তিনি ছিলেন ভাষাসৈনিক, প্রবলভাবে রাজনীতি সচেতন- আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ সমর্থক। আদমজীতে চাকরিতে যোগদানের পূর্বে তিনি আইয়ুব খানের শাসনামলে সম্মিলিত বিরোধী দলের সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে মতিঝিল-টিএন্ডটি এলাকার বিডি মেম্বার (Basic Democracy Member) নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার পরিচয় ছিল। পরে পারিবারিক কারণে তিনি আদমজীতে চাকরি নেন। তবে বাঙালিদের স্বার্থের প্রশ্নে তিনি ছিলেন সোচ্চার। শ্রমিক নেতাদের সঙ্গেও তার ছিল সুসম্পর্ক। আমরা সপরিবারে আদমজী বসবাস শুরু করি ১৯৬৮ সালের প্রথম দিকে। আমার বড় ভাই মামুন চৌধুরী ও আমি আদমজী থেকে মাইল দুয়েক দূরে গোদনাইল হাই স্কুলে ভর্তি হই।
জনসভার স্থান নির্বাচন করা হয় মুন লাইট সিনেমা হলের পেছনে খালি জায়গায়। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য, কানায় কানায় পূর্ণ মাঠ- ঢাকা, ডেমরা থেকে শুরু করে আদমজী জুট মিলস, গোদনাইল, ১নং ঢাকেশ্বরী কটন মিল, চিত্তরঞ্জন কটন মিল, লক্ষ্মী নারায়ণ কটন মিলসহ নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, মাধবদি, ঘোড়াশাল ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সমবেত হয়েছিল লাখ লাখ মানুষ। পরদিন দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় শিরোনাম ছিল ‘আন্দোলন সংগ্রাম চলিবে দুইভাবেÑ জনগণের ভোট আর গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে : আদমজী নগরে তিন লক্ষাধিক লোকের জনসভায় শেখ মুজিব’। আদমজীনগরে আসার পথে জনতা বঙ্গবন্ধুকে অভূতপূর্ব সংবর্ধনা জানায়। ঢাকা থেকে জনসভায় আদমজীনগর যাওয়ার পথে পথে আপামর ছাত্র-জনতা, কৃষক-মজুর যে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানায়, নেতা-জনতার নৈকট্যবোধের ইতিহাসে তা ছিল নজিরবিহীন। সুদীর্ঘ কারাবাস থেকে মুক্তির পর এটি ছিল বঙ্গবন্ধুর ঢাকার বাইরে প্রথম জনসভা। তখন তিনি জাতির মহানায়কে রূপান্তরিত হয়েছেন। পরদিন প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকায় তাকে বাংলার মহানায়ক, দেশবরেণ্য গণনায়ক, বাংলার অগ্নিসন্তান ইত্যাদি বিশেষণে আখ্যায়িত করা হয়।
পরদিনের পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ বিবরণে দেখা যায়, ডেমরা থেকে আদমজীনগর, এই ৫ মাইল পথ অতিক্রমকালে হাজার হাজার মানুষ বঙ্গবন্ধুর মোটর শোভাযাত্রাটির সঙ্গে সঙ্গে ছুটে চলে। একদিকে ইতস্তত বিচ্ছিন্ন কল-কারখানা ও কর্মচারীদের বাসস্থান আর অন্যদিকে শ্যামল সবুজ প্রান্তরের মাঝে ফাঁকা ফাঁকা ঘরবাড়ি মাঝখানে পিচঢালা পথে নেতার আগমনে হাজার হাজার মানুষের মিছিল। সামনে পিছনে যতদূর চোখ যায়, শুধু মানুষ আর মানুষ। বঙ্গবন্ধু আদমজীনগরে পৌঁছলে সভাস্থলে অপেক্ষমাণ ৩ লক্ষাধিক জনতা গগনবিদারী সেøাগান এবং তুমুল করতালির মাধ্যমে তাকে স্বাগত জানায়। দূর-দূরান্ত থেকে আগত কিশোর, যুবক, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ মিলে সভাস্থলে ও তার আশপাশে জনসমুদ্রের সৃষ্টি হয়।
পূর্ব পাকিস্তান চটকল শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি সাইদুর রহমান আদমজী নগরের এই ঐতিহাসিক জনসমাবেশ সভাপতিত্ব করেন। সভায় সভার শুরুতে ৭২টি শ্রমিক, ছাত্র ও আওয়ামী লীগ শাখার পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বিপুলভাবে মাল্যভূষিত করা হয়। আদমজী মিল শ্রমিকদের পক্ষে মাল্যদান করেন মওলানা সাইদুর রহমান। জনসভায় সোনারগাঁও জি. আর. ইনস্টিটিউশনের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র ১০ বছর বয়স্ক মহিউদ্দিন শেখ মুজিবকে এক হাতে মাল্যভূষিত করে। গণ-আন্দোলনের সময় সোনারগাঁওয়ে কনভেনশন লীগ দলের চিফ হুইপের বাড়ির সামনে মহিউদ্দিন বাম বাহুতে গুলিবিদ্ধ হয়। শেখ মুজিব তাকে আদর করে নিজের গলা থেকে একটি মালা এবং আরও দুটি মালা তার গলায় পরিয়ে দেন। গোদনাইল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ৬-দফা প্রতীক একটি স্বর্ণ তারকা এবং সিদ্ধিরগঞ্জ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ৬-দফার আরও একটি স্বর্ণ তারকা উপহার দেওয়া হয়। সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার হাউসের পক্ষ থেকে মানপত্র প্রদান করা হয়। আদমজী জুট মিলস সংযুক্ত শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে কোরআন শরিফ ও একটি রুপার তলোয়ার উপহার দেওয়া হয়। আদমজী শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ৬-দফার প্রতীক ৬টি কপোত বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দেওয়া হয় এবং তিনি সেগুলোকে মুক্ত আকাশে উড়িয়ে দেন।
চট্টগ্রামের বিপ্লবী গায়ক শফিউদ্দিন উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশন করেন। তার গানের কথা ছিল- “তোরা সব জয়ধ্বনি কর, সরকারের আতঙ্ক মোদের বীর মুজিবর”। জনসভায় মোহাম্মদ খান ৬-দফার সংগীত পরিবেশন করেন। নারায়ণগঞ্জ মহকুমা আওয়ামী লীগের সদস্য কফিল উদ্দিন আহমেদ সভার মানপত্র পাঠ করেন। ঐতিহাসিক এই জনসভায় আরও বক্তৃতা করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ, সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী, ছাত্রলীগের সভাপতি আবদুর রউফ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি তোফায়েল আহমেদ, নারায়ণগঞ্জে মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান, চটকল শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান, নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল হক এমপি, গণসমাবেশের প্রস্তাবলী পাঠ করেন সিরাজুল আলম খান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যখন বক্তৃতার জন্য উঠে দাঁড়ান তখন পাঁচ মিনিটকাল বিপুল করতালি ও স্লোগানের মধ্যে নেতার ওপর চারদিক থেকে সমানে পুষ্প ও মাল্য বৃষ্টি হতে থাকে। বক্তৃতার শুরুতে বঙ্গবন্ধু সাম্প্রতিক গণ-আন্দোলনকালে যারা প্রাণ দিয়েছেন, গভীর শ্রদ্ধার সাথে তাদের স্মরণ করেন।
দেশবাসীকে ৬-দফা কর্মসূচি উপহার দেওয়ার পর নিজের ওপর যে জেল-জুলুম ও অত্যাচারের অভিশাপ নেমে আসে, তার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, “কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বসে যখন শুনলাম, ৬-দফা আন্দোলনে নেমে আমার মা, ভাই ও বোনেরা রাজপথে পুলিশ-মিলিটারির গুলিতে প্রাণ দিয়েছে, বিশ্বাস করুন ভাইসব, তখন এক মুহূর্তের জন্যও ঘুমাতে পারি নাই। অসহ্য বেদনায় বুক আমার ভারাক্রান্ত হয়েছে, এই জন্যই কি তবে পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করেছিলাম?” পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকের অভিজ্ঞতা ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু দুঃখ করে বলেন, “কোন কোন নেতার স্বার্থপরতার ও সংকীর্ণ চিন্তাধারার দরুন স্বায়ত্তশাসন ও এক ইউনিটের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত আমরা গ্রহণ করতে পারি নাই। কিন্তু এ অবস্থা আর বেশি দিন চলবে না। জনগণ নিজেদের শক্তিতে এই দুই প্রশ্নের সমাধান ছিনিয়ে আনবেই। এই দাবি দাবাইয়া রাখা কারও পক্ষে আর সম্ভব হবে না।”
ছাত্র-শ্রমিক মেহনতির মানুষের দাবি-দাওয়ার প্রশ্নে তিনি ঘোষণা করেন, “জনগণের দাবি-দাওয়া আদায় না হওয়া পর্যন্ত দিনের আরাম ও রাতের বিশ্রাম আমার জন্য হারাম। দেশবাসীকে আমি এই আশ্বাস দিচ্ছি যে, আমি এক কথার মানুষ, আমার দেশের ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-জনতার ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য আমার সংগ্রামী সহকর্মী ও ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-জনতার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমি সংগ্রাম চালিয়ে যাবো। সুস্পষ্টভাবে আমি দেশবাসীকে জানিয়ে দিতে চাই, আমাদের সংগ্রাম চলবে দুইভাবে- জনগণের ভোট আর গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে।”
অসুস্থবোধ করায় উপস্থিত শ্রোতৃম-লীকে সংগ্রামী সালাম জানিয়ে বক্তৃতা শেষ করে তিনি নিজেই মাইকে কয়েক দফা সেøাগান দেন, উপস্থিত জনতা প্রাণপ্রিয় নেতার কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে গগনবিদারী ধ্বনিতে ফেটে পড়ে। জনসভা শেষে ফেরার সময়ও তাকে পথে পথে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়।
এ জনসভায় আব্বা আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু মঞ্চে ওঠার পর তিনিও আমাদের নিয়ে মঞ্চে ওঠেন এবং বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে আমাদের দুই ভাইকে পরিচয় করিয়ে দেন। বঙ্গবন্ধু তার গলা থেকে মালা নিয়ে দুটো মালা আমাদের গলায় পরিয়ে দেন। আমাদের চুমু দিয়ে আদর করেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। তারপর তার সামনে থেকে অনেকগুলো মালা নিয়ে আমার হাতে দিয়ে বলেন ‘এগুলো সব তোমার।’ আমি আনন্দ, উত্তেজনা ও গভীর শ্রদ্ধায় মালাগুলো নিয়ে মঞ্চের একপাশে বসে পড়ি। কী যে আনন্দ আজ ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না! কিন্তু সবগুলো মালা আমি ধরে রাখতে পারিনি। মঞ্চে অনেকে ছিলেনÑ আমাকে একটা দাও- আমাকে একটা… এভাবে একেকজন একেকটা মালা নিয়ে যান। দুটো মালা আমি অনেক কষ্টে ধরে রাখি। জনসভা থেকে ফেরার পথে আরেকটি মালা যে কখন খোয়া যায়- আজ মনে নেই। বাসায় ফিরে দক্ষিণ দিকের কক্ষের পশ্চিম দিকের দেয়ালে সেই মালাটি আমি ঝুলিয়ে রাখি, আমার জীবনের অনন্য এক প্রাপ্তি হিসেবে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরুর পর থেকে আমরা উদ্বাস্তু হয়ে পড়ি। এক কাপড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলাম আমরা, বিজয়ের পূর্বে আদমজীতে ফিরতে পারিনি। দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর অধীনে চাকরিতে যোগদান না করায় আমার পিতাকে চাকরিচ্যুত করা হয়Ñ আমাদের ঘরের সবকিছু বিহারিরা লুট করে নিয়ে যায়। স্বাধীনতার পরে আমরা আদমজী ফিরে আসি। আব্বা চাকরি ফিরে পান এবং পরবর্তীতে মুক্তিযাদ্ধা কর্মকর্তা হিসেবে দুই বছরের ভূতাপেক্ষ জ্যেষ্ঠতা লাভ করেন।
দীর্ঘ ৯ মাস পর বাসায় ঢুকে দেখি লুটপাটের চিহ্ন সর্বত্র। ধুলো জমে আছে চতুর্দিকে। প্রথমেই আমি বঙ্গবন্ধুর দেওয়া মালাটা খোঁজ করি। আমি দেখলাম, কিছুই নেই- খাঁখাঁ শূন্য দেয়াল- ঘরে কিছুই নেইÑ আমার জীবনের অসাধারণ সঞ্চয়কেও তারা লুট করে নিয়ে গেছে।
বঙ্গবন্ধুকে এর পরে আরও দেখেছি। তবে এভাবে কাছে যাওয়ার সুযোগ আমার হয়নি। জনসমুদ্রে উপস্থিত থেকে তার অনেক ভাষণ শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ, ১০ জানুয়ারির ভাষণ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রলীগের সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণ সেসব সভায় উপস্থিত থেকে শুনেছি। ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে তিনি আবারও আদমজী জুট মিলসে গিয়েছিলেনÑ তখনও হাজার হাজার শ্রমিকের আবেগাপ্লুত সংবর্ধনায় তাকে দেখেছি।
কিন্তু ২১ মার্চের সেদিনের স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ক্ষণিকের জন্য হলেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্য পাওয়ার স্মৃতিÑ তার স্নেহ পাওয়ার স্মৃতি। মানুষের এক জীবনের সব প্রাপ্তি মূল্যবান নয়, কিছু কিছু প্রাপ্তি থাকে যা রোমন্থনের, গৌরবের ও আনন্দের। বঙ্গবন্ধুর স্নেহের অনন্য আলোকসম্পাতে আমার কিশোরবেলা গৌরবান্বিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্কুলপড়–য়া বালকের হাতে তুলে দিয়েছিলেন মালা। মালাটা হারিয়ে গেছেÑ কিন্তু সৌরভ হারায়নি আজও। আমার স্মৃতিতে চির অমøান সেই দিনÑ মনে হয় এখনও দাঁড়িয়ে আছি কৈশোরের সেই বিকেলবেলায়, আদমজীর জনসভায়- স্মৃতিকথা লিখছি হৃদয়েÑ লিখছি অবিরত।

স্মৃতিকথা লিখব বলে এখনও মিছিল আসছে
আদমজীর জনসভায়
না, এখনো শুকিয়ে যায়নি সেই ফুল
প্রতিদিন ফুল ফুটছে, হে পিতা
প্রতিদিন তোমার নামে
মালা গাঁথছে বাঙালি জীবন।

লেখক : কবি, প্রধান সমন্বয়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি ও প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য