বিশ্বকাপ বলে কথা। কেউ হাসবে তো কেউ কাঁদবে। কাতার বিশ্বকাপ এমন এক মঞ্চ তৈরি করে দিয়েছে যেখানে সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের শুধু হারই নয়, বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
আরিফ সোহেল: রেফারির বাঁশি নয়; চলছে প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বকাপ। গোল-ফাউল-পেনাল্টি; সন্দেহের কোনো ঘটনায় ব্যবহৃত হচ্ছে ‘ভিএআর’ প্রযুক্তি। এবারের বিশ্বকাপে দাপুটে নায়ক হিসেবে মাঠ মাতিয়েছে এই ভিএআর প্রযুক্তি। এর সাহায্যে যেমন গোল বাতিল হয়েছে, তেমনই পেনাল্টি হয়েছে। আর ভিএআরের সাহায্য নিয়ে লাল কার্ডও দেখিয়েছেন রেফারি। তবে প্রযুক্তির কারণে খেলার গতি স্লথ হয়নি।
২০ নভেম্বরে শুরু বিশ্বকাপ চলবে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত। বিশ্বকাপের গণ্ডি থেকে যোজন যোজন দূরে বাংলাদেশের ফুটবল। অথচ তা নিয়ে উচ্ছ্বাস-উন্মাদনায় মাতোয়ারা সারাদেশের ফুটবলভক্তরা। ঘুম হারাম করে খেলা দেখার পাশাপাশি চলছে পাল্লা দিয়ে পতাকা উড়ানোর হিড়িক। ভক্তরা বাড়ি-রাস্তা-দেয়াল রাঙিয়েছেন পতাকার রঙে রঙে। ছিল পাড়া-মহল্লা, মাঠে-রাস্তায় বড় পর্দায় খেলা দেখার আয়োজন চোখে পড়ার মতো। গভীর রাত অবধি গোল-ম্যাচের ফুটবলের শোরগোল চলেছে। বিশ্বকাপ ফুটবল এলেই যেন বাঙালিরা হয়ে ওঠেন ফুটবলের ফেরিওয়ালা।
৩২ দলের গ্রুপ পর্বের খেলা ২ ডিসেম্বর মধ্যরাতে শেষ হয়েছে। এবার শুরু হয়েছে নকআউট পর্ব। প্রথম পর্বে বেশ কয়েকটি অঘটন, নাটকীয়তা আর রোমাঞ্চ দেখেছে ফুটবলপ্রেমীরা। নকআউট পর্বের প্রতিটি ম্যাচই এখন একেকটি ফাইনাল। জিতলে পরের ধাপে, আর হারলে বিদায়। দ্বিতীয় রাউন্ডে প্রতিদিন দুটি করে ম্যাচ রাখা হয়েছে। প্রতিদিন রাত ৯টা এবং ১টায়। প্রথম পর্বের লড়াই শেষে বিশ্বকাপের প্রতিটি গ্রুপ থেকে দুটি করে দলে উঠেছে কোয়ার্টার ফাইনালে। প্রথম রাউন্ড থেকে ছিটকে পড়েছে জার্মানি, উরুগুয়ে ও বেলজিয়ামের মতো শক্তিশালী দল। বলতে দ্বিধা নেই, নকআউট পর্বে আসার লড়াইয়ে শেষ ম্যাচ পর্যন্ত রোমাঞ্চ-স্নায়ুযুদ্ধ অটুট-অব্যাহত ছিল। দক্ষিণ কোরিয়া যেমন হারিয়ে দিয়েছে পর্তুগালকে, অন্যদিকে ক্যামেরুনের কাছে লজ্জার হার ব্রাজিলের।
গ্রুপ এ-র শীর্ষে থেকে প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছে নেদারল্যান্ডস। দ্বিতীয় হয়ে শেষ ষোলোয় জায়গা করে নিয়েছে সেনেগাল। গ্রুপ বি থেকে প্রথম ও দ্বিতীয় হয়ে পরের রাউন্ডে এসেছে যথাক্রমে ইংল্যান্ড ও আমেরিকা। গ্রুপ সি-র শীর্ষে থেকে শেষ করেছে আর্জেন্টিনা। দ্বিতীয় স্থানে ছিল পোল্যান্ড। গ্রুপ ডি-র শীর্ষে থেকে প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছে ফ্রান্স। দ্বিতীয় হয়ে শেষ ষোলোয় জায়গা করে নিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। গ্রুপ ই থেকে প্রথম ও দ্বিতীয় হয়ে শেষ ষোলোয় উঠেছে যথাক্রমে জাপান ও স্পেন। গ্রুপ এফ থেকে প্রথম হয়ে পরের রাউন্ডে গিয়েছে মরক্কো। দ্বিতীয় স্থানে শেষ করেছে ক্রোয়েশিয়া। গ্রুপ জি থেকে ব্রাজিল ও সুইজারল্যান্ড উঠেছে শেষ ষোলোয়। আর গ্রুপ এইচ-এর শীর্ষে শেষ করেছে পর্তুগাল। দ্বিতীয় স্থানে শেষ করেছে দক্ষিণ কোরিয়া। বিশ্বকাপের সূচি অনুযায়ী নকআউট রাউন্ডে মুখোমুখি হওয়া দলগুলো হচ্ছে- নেদারল্যান্ডস-যুক্তরাষ্ট্র, আর্জেন্টিনা-অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স-পোল্যান্ড, ইংল্যান্ড-সেনেগাল, জাপান-ক্রোয়েশিয়া, ব্রাজিল-দক্ষিণ কোরিয়া, মরক্কো-স্পেন এবং পর্তুগাল-সুইজারল্যান্ড।
বিশ্বকাপ বলে কথা। কেউ হাসবে তো কেউ কাঁদবে। কাতার বিশ্বকাপ এমন এক মঞ্চ তৈরি করে দিয়েছে যেখানে সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের শুধু হারই নয়, বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তাতে বিশ্বকাপ জমে বরফ। ১৯৭৮ ও ১৯৮৬ বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা নিজেদের প্রথম ম্যাচেই সৌদি আরবের কাছে হেরেছে। স্কোরলাইন ছিল এ-রকম : আর্জেন্টিনা ১-২ সৌদি আরব। প্রথম পর্বের শেষ ম্যাচে খেলেছিল নন্দিত ব্রাজিল ও ক্যামেরুন। ম্যাচের যোগ করা সময়ে ক্যামেরুনের ভিনসেন্ট আবুবকরের গোলে স্তব্ধ হয়ে যায় পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। শুধু ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা নয়, প্রথম পর্বে সাবেক সব বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরাই হোঁচট খেয়েছে। ১৯৩০ ও ১৯৫০ বিশ্বকাপ জেতা উরুগুয়ে শেষ ষোলোতে উঠতেই পারেনি। তাদের পথের পথিক চারবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জার্মানি। থমাস মুলাররা জাপানের কাছে ২-১ গোলে হারের পর স্পেনের সঙ্গে ১-১ ড্র করে। সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের এই হোঁচটের মিছিলে কেবল ব্যতিক্রম ইংল্যান্ড। ১৯৬৬ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা তিন ম্যাচে দুই জয় ও একটি ড্র করেছে। অবশ্য এবারের বিশ্বকাপে হারেনি নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাষ্ট্র, মরক্কো এবং ক্রোয়েশিয়াও। সর্বোচ্চ পয়েন্ট ৭ করে পয়েন্ট নিয়ে প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে নেমেছে নেদারল্যান্ডস, ইংল্যান্ড এবং মরক্কোর। কাতার বিশ্বকাপে সব ম্যাচ জিতে শেষ ষোলোতে ওঠেনি কোনো দল। বিস্ময়করভাবে আসরে এশিয়া থেকে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া উঠে আসা নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
এক দক্ষিণ কোরিয়া ছাড়া বিশ্বকাপে বলার মতো তেমন কিছু ছিল না এশিয়ানদের। কিন্তু এবার ভিন্ন গল্প লিখেছে এশিয়ান ৩ দল। যার নেতৃত্বে আছে জাপান। রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া ও অস্ট্রেলিয়া। প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে না উঠলেও চমক দেখিয়েছে সৌদি আরব। ইরানও খেলেছে লড়াকু ফুটবল। এবারে বিশ্বকাপে এশিয়া থেকে ৬টি দেশ খেলছে। আয়োজক দেশ হিসেবে খেলছে কাতার। বাকি ৫টি দেশ হলো- ইরান, সৌদি আরব, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও অস্ট্রেলিয়া। অস্ট্রেলিয়া সরাসরি এশিয়ার অংশ না-হলেও ওশিয়ানিয়ার অন্তর্গত। কিন্তু ফুটবলে তারা এশীয় ফুটবল সংস্থার অধীনে। বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন করেছে এশিয়ার ‘কোটা’ থেকেই। বিশ্বকাপের ৯২ বছরের ইতিহাসে এশিয়া মহাদেশ হয়ে এবারই প্রথমবারের মতো ৩টি দল নকআউট পর্বে উঠল। বিশ্বকাপে এর আগে এই মহাদেশ থেকে দুবার দুটি করে দল শেষ ষোলোর দেখা পেয়েছে। ২০০২ সালের বিশ্বকাপের শেষ ষোলোয় উঠেছিল দুই স্বাগতিক দেশ জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া। ২০১০ বিশ্বকাপেও জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া উঠেছিল শেষ ষোলোয়। এই মহাদেশ থেকে বিশ্বকাপে প্রথম শেষ ষোলোর দেখা পেয়েছে সৌদি আরব। ১৯৯৪ বিশ্বকাপের শেষ ষোলোয় উঠেছিল সৌদি। এশিয়া থেকে এ পর্যন্ত দুটি দল বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছে- ১৯৬৬ বিশ্বকাপে উত্তর কোরিয়া এবং ২০০২ বিশ্বকাপে দক্ষিণ কোরিয়া। ২০০২ সালে বিশ্বকাপের সহ-আয়োজক দক্ষিণ কোরিয়া সেমিফাইনালেও উঠেছিল।
এশিয়ায় এটা দ্বিতীয় আসর। এর আগে ২০০২ সালে যৌথভাবে বিশ^কাপ আয়োজন করেছিল এশিয়ার দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান। ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল কাতার বিশ্বকাপের আসর সমৃদ্ধ হয়েছে নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারে। এই আসরে ব্যবহৃত হয়েছে চার্জ দেওয়া টেকনো বল। যার মাধ্যমে নিখুঁতভাবে গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে। এই জন্য বলের ভেতরে ৫০০ হার্জ আইএমইউ সেন্সর প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। বিপদ সীমানায় ফাউল, গোল-অফসাইডের নিখুঁত সিদ্ধান্ত শতভাগ নিশ্চিত করতে ব্যবহার করা হয়েছে ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি (ভিএআর)। এই মাঠে ১২টি ট্র্যাকিং ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। নিজের খেলা সম্পর্কে বিশুদ্ধভাবে জানতে খেলোয়াড়দের জন্য তৈরি করা হয়েছে ডেটা অ্যাপ। এই প্রথমবার বিশ্বকাপে নারী রেফারিকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
কাতার বিশ্বকাপের মাঠের তুলকালাম, জয়-পরাজয় ছাপিয়ে নতুন নায়ক হিসেবে নাম লিখিয়েছে ভিএআর। চলতি আসরের গ্রুপ পর্বের ৪৮টি ম্যাচে ভারের সিদ্ধান্তে বাতিল হয়েছে মোট ১৭টি গোল। তার মধ্যে ওপেন প্লে থেকে ৯টি গোল বাতিল হয়েছে। অর্থাৎ, ফুটবলার গোল দেওয়ার পরে ফাউলের কারণে সেই গোল বাতিল করেছেন রেফারি। ৮টি গোল বাতিল হয়েছে অফসাইডের কারণে। আর সবটাই হয়েছে ভারের সাহায্যে। ভার প্রযুক্তির দায়িত্বে থাকা রেফারি মাঠের রেফারিকে পরামর্শ দিয়েছেন। সেই পরামর্শ মেনে গোল বাতিল করেছেন রেফারি। ভারের সাহায্যে এবারের বিশ্বকাপে ৮টি পেনাল্টি দিয়েছেন রেফারিরা। তার মধ্যে অবশ্য ৫টি পেনাল্টি মিস্ করেছেন ফুটবলাররা। ভারের সাহায্যে গোলও হয়েছে এবারের বিশ্বকাপে। দুটি গোল অফসাইডের কারণে বাতিল করেছিলেন লাইন্সম্যান। কিন্তু পরে ভার সেই সিদ্ধান্ত খারিজ করে দেয়।
কিছুদিনের মধ্যেই বিশ্ব পেয়ে যাবে পরবর্তী বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। আগের বিশ্বকাপের আসরে শিরোপা ঘরে তুলেছে ৮ দল। এবার কি নতুন কোনো দলের শোকেসে উঠবে সোনালি ট্রফি; না-কি পুরনো মুকুটে নতুন পালক যুক্ত হবে? সেই উত্তর পেতে অপেক্ষা করতে হবে ১৮ ডিসেম্বর ফাইনাল ম্যাচ পর্যন্ত।
লেখক : সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, উত্তরণ