Monday, December 4, 2023
বাড়িSliderপ্রবাসে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার চিঠি

প্রবাসে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার চিঠি

তবে দিল্লিতে ডাকে চিঠি গ্রহণের জন্য ভিন্ন একটি ঠিকানা ব্যবহার করা হতো। সেটিও গোপন রাখা হতো। বেশির ভাগ চিঠিতে প্রেরকের কোনো ঠিকানা লেখা থাকত না। অনেকগুলো চিঠির মধ্যে ওয়াজেদ মিয়ার একটি এবং শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার চারটি চিঠি এই লেখক শহীদ হোসেনের কাছ থেকে সংগ্রহ করেন।

সরাফ আহমেদ: দিল্লিতে পৌঁছানোর পর থেকেই শেখ হাসিনা, ওয়াজেদ মিয়া ও শেখ রেহানা দুর্ভোগের দিনগুলোতে জার্মানিতে ছায়ার মতো তাঁদের পাশে থাকা শহীদ হোসেনকে নিয়মিত চিঠি লিখতেন। চিঠিগুলো এখন ইতিহাসের অংশ। শহীদ হোসেন ছিলেন ওয়াজেদ মিয়ার সহকর্মী। প্রথম দিকের চিঠিগুলো দিল্লি থেকে সম্ভবত কূটনৈতিক ব্যাগে রাজধানী বনে ভারতীয় দূতাবাসে এসেছিল। পরে তা বনের ডাকঘর হয়ে কার্লসরুয়ে শহীদ হোসেনের ৪৪ গেরভিগ স্ট্রাসের ঠিকানায় পৌঁছেছিল। হয়তো নিরাপত্তার কারণেই তখন এভাবে চিঠি পাঠানো হয়। পরবর্তীকালে অবশ্য তিনি সরাসরি চিঠি পান। তবে দিল্লিতে ডাকে চিঠি গ্রহণের জন্য ভিন্ন একটি ঠিকানা ব্যবহার করা হতো। সেটিও গোপন রাখা হতো। বেশির ভাগ চিঠিতে প্রেরকের কোনো ঠিকানা লেখা থাকত না। অনেকগুলো চিঠির মধ্যে ওয়াজেদ মিয়ার একটি এবং শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার চারটি চিঠি এই লেখক শহীদ হোসেনের কাছ থেকে সংগ্রহ করেন। ওয়াজেদ মিয়ার চিঠিটি আমরা ইতিপূর্বে পুরোই উদ্ধৃত করেছি। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার চিঠি থেকে ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে সারকথা ও কিছু উদ্ধৃতি নিচে দেওয়া হলো।
দিল্লি পৌঁছেই দুই দিন পর ২৭ আগস্ট ১৯৭৫ সালে শেখ হাসিনা, কার্লসরুয়েতে শহীদ হোসেনকে চিঠি লেখেন। নিরাপত্তার কারণে চিঠিটি সম্ভবত কূটনৈতিক চ্যানেলে আসে এবং তখনকার রাজধানী বন থেকে ৮ সেপ্টেম্বর পোস্ট করা হয়।

২৭/৮/৭৫
ভাই শহীদ,
আমরা ভালো আছি। ভালোভাবে এসে পৌঁছেছি। আমাদের জন্য কোনো চিন্তা করবেন না। যদি সম্ভব হয় চাচিকে ফোন করে সংবাদ দিয়ে দিবেন যে আমরা ভালো আছি। জয়, পুতুলীও ভালো আছে।
আপনাদের ঋণ আমরা জীবনেও শোধ করতে পারব না। সুখ-দুঃখের মধ্য দিয়ে কয়েকটা দিন ভালোই কেটেছে। আপনাদের কথা জীবনেও ভুলব না। যদি বেঁচে থাকি একদিন দেখা হবে। ভালোভাবে থাকবেন। বাবলুর খবর কী?
আপনাদের জন্য শুভাশীষ রইল। বিশেষ আর কী লিখব।

ইতি
হাসুপা

দিল্লি পৌঁছানোর দুই দিন পর ২৭ আগস্ট ১৯৭৫ শেখ হাসিনা চিঠি লেখেন কার্লসরুয়ের শহীদ হোসেনকে সৌজন্যে : শহীদ হোসেন

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫
দিল্লি থেকে শহীদ হোসেনকে শেখ হাসিনার পরের চিঠি-

ভাই শহীদ,
আশা করি ভালোই আছেন। এর আগে দুখানা চিঠি দিয়েছি, বোধকরি পেয়েছেন। যে ঠিকানা দিয়েছি ঐ ঠিকানায় উত্তর দিবেন। আশা করি আমরা পাব। অবশ্যই দিবেন কিন্তু। আমাদের বাসায় কোনো চিঠিপত্র এলে পাঠিয়ে দিবেন।
দেশের কোনো সংবাদ আমরা জানি না। শুধু রেডিওতে যা বলে তাই। যদি কোনো সংবাদ জানেন অবশ্যই জানাবেন।
নিচে আমার ফুপুর ঠিকানা দিলাম। দয়া করে ওকে একটা চিঠি দিয়ে আমাদের ঠিকানাটি পাঠিয়ে দেবেন আর জানাবেন ওরা যেন ‘খোকা কাকাকে’ যে করেই হোক খোঁজ করে আমাদের ঠিকানাটা দিয়ে দেয় ও যোগাযোগ করতে বলে।
এ কথা লিখতে ভুলবেন না যে এই ঠিকানা অন্য কাউকে দিবেন না। আপনিও এ ব্যাপারে সাবধান হবেন। এখানে চিঠি দিলে আমরা যেখানেই থাকি না কেন চিঠি পৌঁছাবেই। তবে বেশি লোক জানাজানি না হওয়া সবার জন্য মঙ্গল। আপনাকে অনেক কষ্ট দিচ্ছি, কিন্তু আমরা কি করব বলেন? আমাদের তো কোনো উপায়ই নেই। ছেলেমেয়ে নিয়ে নিরাপদে, সুস্থ আছি। দোয়া করবেন। আপনার লিখে দেওয়া জিনিস আমরা মনোযোগ দিয়ে পালন করছি। আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন। আপনি যে কত বড় উপকার করেছেন তা বলবার নয়।

ফটোগুলি এলে আপনার কাছে রাখবেন। সবই তো হারিয়েছি। ওগুলি থাকবে শুধু স্মৃতি হয়ে। যাক অনেক লিখলাম আর বিরক্ত করতে চাইনা। বিশেষ আর কি। বাবলু ও আপনার জন্য শুভেচ্ছা রইল।

বিশেষ কারণে এই ব্যবস্থা নিচ্ছি, পরে আপনাকে জানাব। এই ঠিকানায় আমার চিঠি পাঠিয়ে দিবেন।

শহীদ হোসেনকে লেখা শেখ রেহানার চিঠি-

১০/১১/৭৫
শহীদ ভাই,
আশা করি ভালো আছেন। আপনার চিঠি পেয়েছি। আপনার চিঠি পাবার আগে সত্যিই খুব চিন্তিত ছিলাম। আমি আর আপা ভেবেছিলাম আমাদের জন্য বোধ হয় আপনাকে কোনো অসুবিধায় পড়তে হয়েছে। যাই হোক নিশ্চিন্ত হলাম। লন্ডন-এ এক কাকার সাথে ছাড়া অন্য কোনো আত্মীয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি। ঢাকায় আমাদের প্রায় সবাই নিহত। যাঁরা বেঁচে আছেন তাঁরা যে কোথায় আত্মগোপন করে আছেন, জানি না। সবই খোদার উপর ভরসা করে আছি।
বাবলু ভাই ইংল্যান্ড গিয়ে ভালোই করেছে। দেশের পরিস্থিতি খুবই খারাপ; দেশে না যাওয়াই ভালো। কত দিন যে এভাবে থাকব জানি না। তাই ঠিক করতে পারছি না কি করব। পড়াশুনা আমাকে করতে হবেই। আর কয়েক দিন যাক তারপর সিদ্ধান্ত নেব। দেশের খবর এইটুকু পেয়েছি আব্বার যত বন্ধু, সহকর্মী, সবাইকে বেছে বেছে মেরেছে এবং মারছে। ছাত্রদের ও জনতার মধ্যে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। কার্ফু বলবৎ রয়েছে। দেশে এখন আইনশৃঙ্খলা বলতে কিছুই নাই। আর নেই মানুষের জীবনের মূল্য।
আর কী বিশেষ লিখব। কোনো খবর জানলে জানাবেন। দোয়া করবেন। খোদা হাফেজ।

রেহানা

১৯৭৬ সালের ১৭ জানুয়ারি ভারতীয় ডাক বিভাগের এরোগ্রাম খামে শেখ রেহানা ও শেখ হাসিনা দুজনই চিঠি লেখেন শহীদ হোসেনকে। এরোগ্রামে পাতলা কাগজের একদিকে চিঠি লেখা হতো এবং অপরদিকে লেখা হতো প্রাপক ও প্রেরকের ঠিকানা। ভাঁজ করলেই এনভেলাপ হয়ে যেত। চিঠির প্রেরক ছিলেন রেহানা। ঠিকানা ছিল এ-১৬৮, ডিফেন্স কলোনি, নিউ দিল্লি, ইন্ডিয়া।

১৭/১/৭৬
শহীদ ভাই,
আশা করি ভালো আছেন। বেশ কিছুদিন আগেই আপনার চিঠি পেয়েছি। লিখতে একটু দেরি হলো। আমি ঠিক করেছিলাম এখানে কলেজে ভর্তি হব। এরাও প্রথমে বলেছিল তাই, কিন্তু এখন কোনো কথা বলছে না। আমার

এক চাচা লন্ডনে আছেন। ওনাকে লিখেছি ওইখানে যদি পারে আমার জন্য কোনো ব্যবস্থা করতে। কবে দেশে ফিরতে পারব জানি না। মি. গোয়েল কি ইন্ডিয়া বেড়াতে এসেছেন? দেশের খবর কিছু জানেন কি? এভাবে আর থাকতে ইচ্ছে করে না। জয়ের বাবা বোধ হয় খুব শীঘ্র জার্মানি যাবে। এখানে ভীষণ ঠাণ্ডা পড়েছে। এখানকার আবহাওয়া খুব বাজে। জয়, পুতুল খুব হিন্দি কথা শিখে গেছে। আর কী বিশেষ লিখব। উত্তর দিয়েন।

ইতি
রেহানা

এরোগ্রামের পৃষ্ঠার নিচের অংশে শেখ হাসিনা লিখেছেন-

ভাই শহীদ,
অনেক দিন আগে একটা চিঠি পেয়েছিলাম। মুন্না লিখেছিল বলে আর লিখিনি। অনেক দিন পর আপনার চিঠি পেয়েছিলাম। এখানে ভীষণ ঠাণ্ডা পড়েছিল। তার উপর গরম পানির ব্যবস্থা নাই বলে বেশ কষ্ট হচ্ছে। ঢাকার খবর পেলে জানাবেন। কেমন আছেন? জয় পুতুলী মোটামুটি ভালোই আছে। তবে এখানে সবাই আমরা বেশ অসুখে ভুগছি। একটা না একটা লেগেই আছে। কিছু ভালো লাগে না, কবে যে দেশে যাব জানি না। বিদেশে আর ভালো লাগে না। দোয়া করবেন যেন তাড়াতাড়ি ফিরতে পারি। বিশেষ আর কী লিখব। উত্তর দিবেন তাড়াতাড়ি।
শুভাশীষ রইল

ইতি
আপা

[গ্রন্থ : ১৫ আগস্ট হত্যাকা- : প্রবাসে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার দুঃসহ দিন, সরাফ আহমেদ]

পূর্ববর্তী নিবন্ধশেখ হাসিনা একটি পথপ্রদর্শক নক্ষত্র
পরবর্তী নিবন্ধআপনজন
আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য