সারাদেশে পাক-নরপশুরা নারীদের ওপর চরম নির্যাতন চালিয়েছে। গ্রামে গ্রামে এরা নিরীহ নারীদের সর্বনাশ করেছে। দেশের প্রতিটি ক্যান্টনমেন্ট এবং পাকবাহিনীর প্রতিটি অস্থায়ী বাংকার এবং ক্যাম্পেই মেয়েদের যুদ্ধের শেষদিন পর্যন্ত রাখা হয়েছে।
অধ্যাপক ড. জেবউননেছা: পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশের মানচিত্র স্থান পেয়েছে ৩০ লাখ শহিদের বুকের তাজা রক্ত, নারীদের সম্ভ্রম হারানোর দুঃখ দিয়ে। লেখার শুরুতে বিনম্রচিত্তে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি সেই বীরাঙ্গনা নারীদের। সালাম জানাই সেসব নারী যোদ্ধাদের, যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে স্বাধীনতাযুদ্ধকে সফল করেছেন। ১৯৭১-এ হানাদার নরপশুরা হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, নির্যাতন করেছে নারীদের রাজধানী থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত। তারই খণ্ডচিত্র তুলে ধরা হবে এ নিবন্ধে। যদিও দীর্ঘ ৯ মাসে পাকহানাদার এবং তাদের দোসর কর্তৃক নারী নির্যাতনের সকল ঘটনা এত অল্প পরিসরে আনা সম্ভব নয়। এ নিবন্ধে নির্যাতনের বিভীষিকার কিছু ঘটনার অবতারণা করা হয়েছে।
১৯৭১-এ বিভিন্নভাবে নির্যাতনের মাধ্যমে নারীরা স্বামী-পুত্র-কন্যা বা অভিভাবক হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন এর সংখ্যা প্রায় ১৪ লক্ষ [বাংলার নারী আন্দোলন]।
অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রকাশিত নিউজ ম্যাগাজিন ‘পিকস’-এর তথ্য মোতাবেক ’৭১-এ বর্বর পাকিস্তানি দ্বারা এদেশের ৩ লক্ষ নারী ধর্ষিতা হয়েছেন [ইত্তেফাক, ১৫ জুলাই ১৯৭২]।
’৭১-এর সময় মানবতাবাদী গবেষক ড. জিত্তফ্রে ডেভিস বলেছেন, বাংলাদেশে ধর্ষণের ফলে প্রায় ২ লক্ষ অন্তঃসত্ত্বা মহিলার মধ্যে ১ লক্ষ ৭০ হাজার গর্ভপাত ঘটিয়েছেন, যার বেশির ভাগই স্থানীয় গ্রাম্য ধাত্রী বা হাতুড়ে ডাক্তারের সাহায্যে গর্ভপাত ঘটান এবং বাকি ৩০ হাজারের মধ্যে অধিকাংশই সে-সময় আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন [প্রবাহ, ৬ নভেম্বর ১৯৯৭]।
ব্রিটিশ চিকিৎসক ডা. ম্যালকম পটস জানান, বাংলাদেশের মাত্র তিনটি জেলাতে ১২ হাজার ধর্ষিতা হতভাগিনীর সন্ধান পাওয়া যায় [ইত্তেফাক, ৩ মার্চ ১৯৭২]।
২ নভেম্বর ১৯৭২ যুদ্ধ অপরাধ তদন্ত এজেন্সি কর্তৃক প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, পাকিস্তানিদের ৯ মাস ব্যাপক ত্রাসের রাজত্বকালে বাংলাদেশে দুই লক্ষাধিক নারী নির্যাতিত হয়েছেন [ইত্তেফাক, ৩ নভেম্বর ১৯৭২]।
’৭১-এ নির্যাতনের বড় আখড়া ছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইন। মিলিটারি ট্রাকে, জিপে, যুবতী মেয়েদের আনা হতো। পাঞ্জাবি, বিহারি, পশ্চিম পাকিস্তানিরা ট্রাকের সামনে এসে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে তৎক্ষণাৎ তাদের শরীরের কাপড়-চোপড় খুলে উলঙ্গ করে মাটিতে ফেলে কুকুরের মতো ধর্ষণ করত। অতঃপর লোহার রডে ঝুলন্ত মেয়েদের ওপর চালাত অত্যাচার-নির্যাতন। ’৭১-এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনারা বাড়ি থেকে বাঙালি শিশু ও যুবতী এবং বৃদ্ধাদের টেনে রাস্তায় ফেলে জবাই করে। বাঙালি রমণীদের ধরে এনে রাস্তায় উলঙ্গ করে ফেলে উপর্যুপরি ধর্ষণ করে। তখনই ধারাল ছুরি দিয়ে স্তন ও পাছার মাংস কেটে নির্মমভাবে হত্যা করে। কাউকে কুচি কুচি করে কেটে ফেলার পরও গোপনস্থানে লোহার রড ঢুকিয়ে, কারও গায়ে আগুন দিয়ে হানাদার সেনারা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে [মুক্তিযুদ্ধে নারী সমাজ]।
ঢাকার বাসিন্দা ঊর্মি নামে নবম শ্রেণির এক ছাত্রীর জবানবন্দি থেকে জানা যায়, পাকবাহিনী একদিন তাদের বাড়িতে হামলা চালিয়ে তার সামনেই ৯ বছরের বোনকে পালাক্রমে পাশবিক অত্যাচার করে সঙ্গীন দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পেট ফেঁড়ে তাকে হত্যা করে এবং তার বাবা-মাকে গুলি করে হত্যা করে তার হাত ধরে টেনে টেনে নিয়ে যায় তাদের আস্তানায়। জিজ্ঞাসাবাদের নামে স্যাঁতসেঁতে ঘরের মধ্যে ঢুকে নরপশুরা তার নগ্নদেহে বেত দ্বারা আঘাত করত। বেয়োনেটের খোঁচায় দেহের বিভিন্ন অংশ ক্ষত-বিক্ষত করত [দৈনিক বাংলা, ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২]।
মে ১৯৭১, বর্বর পাকসেনাদের অফিসার মেজর ইফতেখার ভৈরবের বাজিতপুর এবং নিকলা থানার প্রায় দেড় শত লোককে ধরে আনে। তাদের মধ্য থেকে প্রায় ৩৫ জন নারীর ওপর পাশবিক অত্যাচার চালানো হয় [দৈনিক বাংলা, ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২]।
নরসিংদী টেলিফোন এক্সচেঞ্জের মধ্যে পাক-নরপশুরা ক্যাম্প খুলেছিল। এখান থেকে বর্বর পাকসেনারা স্থানীয় দালালদের সাহায্যে বাঙালি মেয়েদের ধরে এনে তাদের ওপর বর্বর অত্যাচার চালাত। নির্যাতন শেষে তাদের নরসিংদী তারাবো রাস্তায় খাটরা পুলের কাছে এনে হত্যা করত [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নারীর অবদান]।
২৫ মার্চ ১৯৭১ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে বর্বর পাকবাহিনী চট্টগ্রামের ঝিলনঝা, কুরশগঞ্জ, মহেশখালী এবং দুলাহাজরা থেকে প্রায় ২০০ মুসলমান, হিন্দু, মগ যুবতী ধরে নিয়ে প্রথমদিকে তাদের অনেককে নৃশংস অত্যাচার করে হত্যা করা হয় এবং বাকি বন্দিনী মহিলাদের ডিসেম্বর ১৯৭১ হত্যা করা হয়েছিল বলে অনুমান করা হয় [দৈনিক বাংলা, ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২]।
চট্টগ্রামের বৌদ্ধ অধ্যুষিত গ্রামের প্রায় ১,০০০ বৌদ্ধ নারীকে ধর্ষণ করা হয় [যুদ্ধ ও নারী]।
’৭১-এ সিলেট বিমানবন্দরে ৩০০ মেয়েকে পাকহানাদাররা বন্দী করে পাশবিক অত্যাচার করে। তাদের মধ্যে দুজন মেয়ে নিজ নিজ শাড়ির আঁচল গলায় বেঁধে আত্মহত্যা করলে বর্বর পাকসেনারা তখন অন্যান্য মেয়ের শরীর থেকে বস্ত্র কেড়ে নেয় [দৈনিক ইত্তেফাক, ২১ মার্চ ১৯৭২]।
রাজশাহীর বাঁশবাড়িয়া গ্রামে পাক-নরপশুরা দেড়’শ মা-বোনকে ঘর থেকে টেনে বের করে প্রকাশ্যে লোকজনের সামনে লাঞ্ছিত করে। এদের মধ্যে ১০ জনই ঘটনাস্থলে মারা যায়। রাজশাহীর গোপালপুরে এক পাঞ্জাবি মহিলার সহযোগিতায় বাঙালি নারী নির্যাতনই সবচেয়ে বড় ঘটনা হয়ে দাঁড়ায় [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নারীর অবদান]।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর এলাকায় ২৩ এপ্রিল মিলিটারিরা আসে এবং বহু নারীকে ধর্ষণ করে। ১৯ অক্টোবর পাকসেনারা সীমান্তবর্তী গ্রাম বোয়ালিয়া ঘেরাও করে। এখানে তারা বহু লোককে হত্যা করে এবং অসংখ্য নারীর ওপর অত্যাচার চালায় [মুক্তিযুদ্ধে নারী সমাজ]।
নাটোরের থার্ড ম্যাজিস্ট্রেটের খালি বাড়িটি মেয়েদের ওপর অত্যাচারের একটি বিশেষ স্থান ছিল। নাটোর মহকুমার এমন কোনো গ্রাম ছিল না সেখানে বর্বর হানাদার সৈন্যরা মেয়েদের ওপর অত্যাচার চালায়নি [দৈনিক বাংলা, ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২]।
১৯৭১-এ পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের নরপিশাচ দালালরা রংপুরে ১০ হাজারের অধিক কুমারীর সতীত্ব হরণ করে [দৈনিক আজাদ, ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২]।
ঠাকুরগাঁ মহকুমার ওয়াপদা রেস্ট হাউস, সিএন্ডবি, ইন্সপেকশন বাংলো এবং কিসমত ও তীরন নদীর তীরে পলাশবাড়ি সামরিক শিবিরগুলো নারী নির্যাতনের প্রধান কেন্দ্র ছিল, যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে এসব স্থানে হানাদারদের পরিত্যক্ত বাংকারে বহু নারীর ছিন্ন শাড়ি এবং অন্যান্য পোশাক পরিচ্ছদ পাওয়া গিয়েছিল [দৈনিক আজাদ, ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২]।
১৯৭১ সালের ২২ এপ্রিল ঠাকুরগাঁয়ের গড়েয়া ইউনিয়ন আক্রমণ করে কেবলমাত্র বগুলীগাছি, পিসামত সুকানপুকুরি গ্রামে ৬০ জন যুবতীকে ধর্ষণ করে [দৈনিক বাংলা, ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২]।
গাইবান্ধায় দালালদের সহায়তায় পাকদস্যুরা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে এবং দালালরা মেয়ে-বউদের বাড়ি থেকে জোরজুলুম করে বের করে নিয়ে পাকসেনাদের ভোগের সামগ্রী হিসেবে পাঠাতে শুরু করে [দৈনিক আজাদ, ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২]।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি শ্রী রণেশ মৈত্র উত্তরবঙ্গ সফর করে জানান, পাকহানাদার ও তাদের দালালরা বগুড়ায় কমপক্ষে আড়াই হাজার মহিলাকে ধর্ষণ করেছে। এছাড়া ওয়াপদা রেস্ট হাউস, মুরয়ল বৃন্দাবনপাড়া, ফুলবাড়ি শিবগঞ্জ প্রভৃতি জায়গায় অসংখ্য বিবাহিত ও অবিবাহিত মহিলাকে ধর্ষণ করা হয় [দৈনিক পূর্বদেশ, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২]।
নওগাঁয় পাকবাহিনী প্রায় ৫ সহস্রাধিক নারীর সম্ভ্রমহানি ঘটায় [দৈনিক পূর্বদেশ, ১ মার্চ ১৯৭২]।
পাবনা জেলায় বহু সংখ্যক নারীর ওপর পাক বর্বর সেনারা হৃদয়হীন নির্যাতন চালায়। কুমারী, সদ্য-বিবাহিতা ও বয়স্কা মহিলারাও তাদের পাশবিক নির্যাতনের শিকারে পরিণত হয়। নওগাঁর পাঠশালা স্কুলের বড় পানির কুয়োতে যুবতীদের ধর্ষণ করে, তাদের জবাই করে বা জীবন্ত অবস্থায় হাত-পা বেঁধে কুয়োতে নিক্ষেপ করত [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নারীর অবদান]।
সিরাজগঞ্জে পাকহানাদাররা সিএন্ডবি ও ওয়াপদায় রেস্ট হাউসে পাশের গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে যুবতীদের ধরে এনে অত্যাচার করত। তাছাড়া পাবর্তীপুর, থাউন-দাউন গ্রাম কোনো স্থানই বাদ যায়নি [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নারীর অবদান]। একমাত্র সিরাজগঞ্জেই দখলদার পাকবাহিনী প্রায় ৭০০ মহিলাকে ধর্ষণের পর যমুনা নদীতে ফেলে দেয় [দৈনিক বাংলা, ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২]।
দিনাজপুরে যুদ্ধ চলাকালীন বর্বর পাকসেনারা নারীদের ওপর নিষ্ঠুরভাবে পাশবিক অত্যাচার ও শারীরিক নির্যাতন করত। জানা যায়, স্কুলপাড়া ও কানপুর স্কুল- এ দুটি ক্যাম্প নরপশুদের প্রমোদ কেন্দ্র ছিল। এখানে বিভিন্ন স্থান থেকে নারীদের ধরে এনে পাশবিক অত্যাচার ও নির্যাতন করত। খানপুর স্কুল এলাকার এক প্রত্যক্ষদর্শী জানায়, প্রায় ২০০ নারীকে ধর্ষণ ও নির্যাতন করার পর স্কুলের পিছন দিকে অর্ধমৃত অবস্থায় চাপা কবর দেয় [দৈনিক ইত্তেফাক, ১৭ জুলাই ১৯৭২]।
দিনাজপুরে প্রায় স্থানেই পাকসেনারা তাদের বর্বরতা চালিয়েছে নারীদের ওপর। দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জ থানায় হানাদার বাহিনীর হাতে ৭ হাজারেরও বেশি মহিলা ও শিশুকে হত্যা করে এবং বর্বর পাকসেনা ও তাদের সহযোগীরা প্রায় ৫০০ মহিলার সতীত্ব হরণ করে [দৈনিক আজাদ, ২৪ জানুয়ারি ১৯৭২]।
যশোর ক্যান্টনমেন্টে ২৯৫ জন নারীকে আটকে রেখে তাদের ওপর নির্যাতন চালায়। যশোর পতনের পর ক্যান্টনমেন্টের বিভিন্ন কক্ষ থেকে কয়েকশত মহিলাকে উদ্ধার করা হয়। যারা যুদ্ধের শুরু থেকে শেষদিন পর্যন্ত পাকসেনাদের পাশবিকতার শিকার হয়েছে।
কুষ্টিয়ায় বিভিন্ন এলাকা যেমন- কুমারখালী, হাশিমপুর বাজার, দয়ারামপুর, কুমারখালীর মাটিরহাট, কল্যাণপুরসহ আরও অনেক স্থানে পাকসেনারা অত্যাচার চালিয়ে গেছে নিরীহ নারীদের ওপর।
’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভোলা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, ঝালকাঠিসহ বরিশালের বিস্তীর্ণ এলাকার পাকহানাদার সেনারা বিভিন্ন মাদ্রাসায় ক্যাম্প স্থাপন করে নারী-নির্যাতন ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যা চালায়। বরিশালে গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধে বীর মুক্তিযোদ্ধা ভাসীরনীকে বর্বররা নৃশংসভাবে হত্যা করে [মুক্তিযুদ্ধে নারী সমাজ]।
বরিশাল জেলার বিভিন্ন স্থানে নরপশুরা তাদের হিংস্র ছোবল হেনেছে। একমাত্র স্বরূপকাঠি থানাতেই প্রায় হাজারের বেশি মেয়েকে পাকহানাদার বাহিনী ধর্ষণ করে [রহমান, ১৯৮৪ : ২৪১]। বরিশালের গৌরনদী কলেজ থেকে একটু দক্ষিণ দিকের বাড়িটা বর্বর খানসেনাদের নাচঘর ছিল। বর্বর খানসেনারা গ্রাম থেকে মেয়েদের ধরে এ বাড়িতে আটকে রাখত এবং তাদের ওপর দিনের পর দিন পাশবিক অত্যাচার চালাত [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নারীর অবদান]।
ভোলার কলোনির রেস্ট হাউস ছিল খানসেনাদের পাশবিকতার কেন্দ্র। এ কেন্দ্রে প্রায় ৬/৭ মাস অজস্র মেয়েকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল [যুদ্ধ ও নারী]।
কুমিল্লার শাহপুরে এক মুসলিম লীগ নেতার বাড়িতে তিন শতাধিক নারী বন্দী ছিল বলে জানা যায়। কুটিবাজারে একজন, চণ্ডীদ্বার ইউনিয়ন অফিসে ১০ জন, হরিয়াবহ ও কুতুব মিয়ার বাড়িতে ২০ জন নারী নির্যাতিত হয়েছে [যুদ্ধ ও নারী]।
নোয়াখালী জেলার সোনাগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া, সুধারাম, লক্ষ্মীপুর, রায়পুরা, বেগমগঞ্জ, ফেনী প্রভৃতি অঞ্চলে গণহত্যা; নারী ধর্ষণ ছিল পাকহানাদারদের নিত্যদিনের কর্মকাণ্ড [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নারীর অবদান]।
সৈয়দপুরে টেকনিক্যাল কলেজে কমপক্ষে ৬০০ থেকে ৭০০ জন আটক নারীদের ওপর পৈশাচিকভাবে নির্যাতন করা হয় [যুদ্ধ ও নারী]।
ঢাকা, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর ৩টি বন্দিশিবিরে ৫০০-এর বেশি বাঙালি যুবতীকে বন্দী করে রাখা হয়। তাদের মধ্যে অনেককে তারা গুলি করে হত্যা করে। কাউকে লাথি মেরে, কাউকে জীবন্ত কবর দিয়ে হত্যা করে। দেশের নানা জায়গায় বধ্যভূমিতে মেয়েদের মাথার চুল, পোশাক পরিচ্ছদ ও নরকঙ্কাল পাওয়া যায় [দৈনিক ইত্তেফাক, ২১ মার্চ ১৯৭২]।
এসব ঘটনা থেকে যুদ্ধকালীন এদেশের মা-বোনদের ওপর পাকবাহিনীর বীভৎস নারী নির্যাতনের প্রমাণ পাওয়া যায়। এভাবেই সারাদেশে পাক-নরপশুরা নারীদের ওপর চরম নির্যাতন চালিয়েছে। গ্রামে গ্রামে এরা নিরীহ নারীদের সর্বনাশ করেছে। দেশের প্রতিটি ক্যান্টনমেন্ট এবং পাকবাহিনীর প্রতিটি অস্থায়ী বাংকার এবং ক্যাম্পেই মেয়েদের যুদ্ধের শেষদিন পর্যন্ত রাখা হয়েছে [যুদ্ধ ও নারী]।
১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার ধর্ষিত নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাব প্রদান করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, “কেউ যদি বীরাঙ্গনাদের পিতার নাম জিজ্ঞেস করে তবে বলে দিও তাদের পিতা শেখ মুজিবুর রহমান আর তাদের ঠিকানার পাশে লিখে দিও ধানমন্ডি ৩২ নম্বর।” তিনি বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসনের জন্য ‘নারী পুনর্বাসন বোর্ড’ স্থাপন করেন এবং ১৯৭৪ সালে সংসদের একটি অ্যাক্টের মাধ্যমে এই বোর্ডকে ‘নারী পুনর্বাসন কল্যাণ ফাউন্ডেশন’-এ উন্নীত করেন। পরবর্তীকালে তারই সুযোগ্য কন্যা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে জাতীয় সংসদে বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা মর্যাদা প্রদানের প্রস্তাব পাস করা হয়। এছাড়াও নির্যাতিতা নারীদের স্মৃতি রক্ষার্থে নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ধানমন্ডি সরকারি বালিকা বিদ্যালয়। ২০১৭ সালের ১৭ অক্টোবর এক্সিকিউটিভ কমিটি অন ন্যাশনাল ইকোনমিক কাউন্সিলে মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণ প্রকল্পে ধানমন্ডি সরকারি বালিকা বিদ্যালয়কে অন্তর্ভুক্ত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুমোদন প্রদান করেন। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে শুরু হয় বিদ্যালয়টিতে শহিদ মিনার তৈরির কাজ। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে লাল সবুজ বৃত্ত সম্বলিত শহিদ মিনার তৈরির কাজ সম্পন্ন হয়। যে শহিদ মিনারের প্রধান ফটকে ইতিহাস লিপিবদ্ধ রয়েছে এভাবে- “১৯৭১-এ মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৩১ আর্টিলারি ফিল্ড রেজিমেন্টের এই ক্যাম্পটিতে পাকহানাদার বাহিনী রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে নারীদের এনে বিদ্যালয়ের ছাত্রীনিবাসের অতিথি কক্ষে নির্যাতন করে বিবস্ত্র করে রাখত এবং ঐ কক্ষ থেকে একজন নারী জানালা দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন বলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী জানালাটিতে ইট গেঁথে বন্ধ করে দেয়। বিদ্যালয়ের অডিটোরিয়ামের মঞ্চের পেছনে গ্রীন রুমে ও নারীদের ওপর নির্যাতন চালাত। স্বাধীনতাযুদ্ধের পরবর্তীতে বিদ্যালয়ের গ্রীন রুমের পেছনে সজনে গাছের তলায় অনেক চুল এবং নারীদের ব্যবহৃত জিনিস পাওয়া যায়। নিরীহ মানুষদের ধরে এনে ব্রাশফায়ার করে বিদ্যালয়ের মাঠে গর্ত করে লাশ মাটিচাপা দিত এবং এক ধরনের রাসায়নিক পাউডার গর্তে দিয়ে দিত যেন মৃতদেহ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান এবং মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ড. জেবউননেছা উক্ত বিষয়টি অনুসন্ধান করেন।” এই বিদ্যালয়ের অতিথিনিবাসই ছিল ‘টর্চার সেল’, যা এখনও তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। এছাড়া গ্রীন রুমটিও পূর্বের আকৃতিতে রয়েছে। শত শত নারীর দীর্ঘশ্বাস এবং সম্ভ্রমহানির সাক্ষী হিসেবে ঝড়-বৃষ্টিতে এই শহিদ মিনার মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকবে। পাকহানাদার বাহিনীর নিমর্মতার সাক্ষী হিসেবে বিদ্যালয়ের বুকে দাঁড়িয়ে থাকবে নির্যাতিত মানুষের প্রতিবাদ হিসেবে। আহ্বান করবে অনাগত প্রজন্মকে, হার মানা যাবে না, পরাধীনতায়। মুক্তি স্বাধীনতায়। এই শহিদ মিনার অনাগত প্রজন্মকে আহ্বান করবে। অগ্নিঝরা মার্চে বীরাঙ্গনা বীর মুক্তিযোদ্ধা নারীদের জানাই সশ্রদ্ধ অভিবাদন।