অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন: কার্তিকের শুভ্র সকালে পটুয়াখালীর লেবুখালীতে সমবেত হয়েছিল হাজারো মানুষ। চারদিকে উৎসবের আমেজ। চোখে-মুখে প্রাপ্তির আনন্দ। কণ্ঠে জয় বাংলা ধ্বনি। সবকিছু মিলে ২৪ অক্টোবর ২০২১ (০৮ কার্তিক ১৪২৮ বঙ্গাব্দ) দিনটি ছিল দক্ষিণাঞ্চল তথা পটুয়াখালীবাসীর জন্য অন্যরকম। এই দিনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনা বহুল প্রত্যাশিত পায়রা সেতু উদ্বোধন করেন। নান্দনিক শোভাম-িত এ সেতুটি উদ্বোধনের মাধ্যমে সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্কে যুক্ত হলো আরেকটি মাইলফলক। পদ্মাসেতু উন্মুক্ত হলে রাজধানী ঢাকা থেকে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত পর্যন্ত ফেরিমুক্ত যোগাযোগ স্থাপিত হবে। সাগরকন্যা কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সমাগম বৃদ্ধি পাবে। পর্যটন শিল্পের প্রসার ঘটবে। এ সেতু দেশের তৃতীয় সমুদ্রবন্দর পায়রাকে ঢাকার সাথে সরাসরি সড়ক নেটওয়ার্কে যেমন সংযুক্ত করবে, তেমনি এ অঞ্চলে শিল্পায়নের ব্যাপক অবদান রাখবে। এখানকার উৎপাদিত বিপুল মৎস্য সম্পদ ও কৃষিপণ্য রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিবহন ও বাজারজাতকরণ সহজতর হবে। সেতুটি এ অঞ্চলের জনসাধারণের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পূরণের পাশাপাশি নিরাপদ, সময়সাশ্রয়ী ও স্বাচ্ছন্দ্যময় সড়ক যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রসার এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। কর্তৃপক্ষীয় সূত্রের তথ্যানুসারে জানা যায়, এ রুটে প্রশস্ততম খরস্রোতা পায়রা নদীতে নানাবিধ নির্মাণ জটিলতার সম্মুখীন হওয়ার পরও প্রকল্পের পূর্ত কাজের চুক্তিমূল্য ১১৭০.০৬ কোটি টাকা থেকে হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১১১৭.৮১ কোটি টাকা। অর্থাৎ পূর্তকাজে সাশ্রয় হয়েছে প্রায় ৫২.২৫ কোটি টাকা।
প্রধানমন্ত্রী তার উদ্বোধনী বক্তব্যে অত্যন্ত কঠিন এবং বৈরী সময়ে দক্ষিণাঞ্চলে তার বিভিন্ন সফরের কথা উল্লেখ করেছিলেন। কীভাবে তিনি গোপালগঞ্জ থেকে নদীপথে পটুয়াখালী গিয়েছেন, আবার ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কুয়াকাটার কাছাকাছি গিয়েও পরিবহনের অভাবে ফিরে এসেছিলেন দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে। একবার তো ঘূর্ণিঝড়ের তা-বের মধ্যেও কুয়াকাটায় অবস্থান করেছিলেন বঙ্গবন্ধু-কন্যা। এসব কথা যখন বলছিলেন, মনে হচ্ছিল এ এলাকার মানচিত্রটি পুরোটাই তার মুখস্ত। নেত্রীর স্মৃতিচারণের সময় ব্যক্তিগতভাবে আমিও ফিরে গিয়েছিলাম সেদিনের সেই ক্ষণে। দক্ষিণাঞ্চলে জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রায় সব কর্মসূচিতে একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে থাকার সুযোগ হয়েছে। আনন্দ-বেদনার স্মৃতিঘেরা সব ঘটনাপ্রবাহই যেন সেলুলয়েডের পর্দার মতো ভেসে ওঠে চোখের সামনে।
১৯৮৮ সালের কথা। বরিশাল থেকে কুয়াকটা যেতে ৬টি ফেরি পার হতে হতো। বঙ্গবন্ধু-কন্যা পটুয়াখালী এসেছেন। রাজনৈতিক কর্মসূচি শেষ করে কুয়াকাটার উদ্দেশে রওয়ানা হলেন। সাথে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ছাড়াও পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়, কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ আরও নিকটজন ছিলেন। এখনকার মতো কার্পেটিং রাস্তা ছিল না। ইট বিছানো হেরিংবন বন্ডের রাস্তা। ব্যবহৃত জিপ গাড়িটি ছেলে-মেয়েদের দিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা মাইক্রোবাসে চড়েছিলেন। ছাত্রলীগের একজন কর্মী হিসেবে নেত্রীর গাড়ির পেছনের সিটে বসার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। মনে পড়ছে, আমতলির নিজাম তালুকদারের কথা। সড়ক দুর্ঘটনায় ১৯৯০ সালে প্রয়াত হয়েছেন। দক্ষিণ জনপদের অত্যন্ত জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। নেত্রীকে স্বাগত জানিয়ে অনেকগুলো গেট করেছিলেন। প্রত্যেকটা গেটেই অসংখ্য মানুষ দাঁড়িয়ে নেত্রীকে অভিবাদন জানাচ্ছিলেন। এখনকার মতো তখন নিরাপত্তা বেষ্টনী ছিল না। সাধারণ মানুষ নেত্রীর গাড়ির কাছে চলে আসতেন। মহিলারা নেত্রীর সাথে হাত মেলাতেন, কেউ ছুঁয়ে দিতেন। কেউ কেউ তার বাড়ির গাছের লেবু, বরই, বিভিন্ন রকম দেশীয় ফল, আবার কেউবা পোষা মুরগির এক হালি ডিম নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলেন। সবকিছুই পরম ভালোবাসায় গ্রহণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু-কন্যা।
পটুয়াখালী থেকে খেপুপাড়া মাত্র ৫০ কিলোমিটার রাস্তা পার হতে গাড়িবহরের দুপুর গড়িয়ে গিয়েছিল। কলাপাড়া উপজেলা সদরে জনসভা শেষে জানা গেল আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে বহন করার লঞ্চ ঘন কুয়াশায় আটকে গেছে। মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে কুয়াকাটা। কিন্তু পরিবহনের অভাবে তাকে ফিরে আসতে হয়েছিল।
দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগের সেদিনের বেহালদশা নিশ্চয়ই নেত্রীর মানসপটে গভীর রেখাপাত করেছিল। বিরোধী দলে থাকাবস্থায় নেত্রী ১৯৯৫ সালের ১৫ মে প্রথমবারের মতো কুয়াকাটায় গিয়েছিলেন। তখনও কুয়াকাটায় থাকার মতো সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা ছিল না। জেলা পরিষদের দুই রুমের একটা ডাকবাংলোই সম্বল। নেত্রী সেখানেই অবস্থান করছিলেন। এবারও প্রকৃতি বেঁকে বসে। প্রচ- ঝড় শুরু হয়েছে। আশপাশের গাছপালা মড়মড় করে ভেঙে যাচ্ছে। রুদ্ররূপে সাগরের ঢেউ কিনারে আছড়ে পড়ছে। পাড় ভেঙে যাচ্ছে। নেতৃবৃন্দ ও প্রশাসন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। কিন্তু এত বিপদের মধ্যেও বঙ্গবন্ধু-কন্যা ছিলেন নিঃশঙ্কচিত্ত। সবার অনুরোধে সফর সংক্ষিপ্ত করে নেত্রীকে ফিরে আসতে হয়েছিল। পথে আবারও বিপদ ঘটে। প্রবল স্রোতে ফেরি ডুবুডুবু অবস্থা। ফেরিতে ওঠার সময় কাঠের সিঁড়ি সরে গিয়ে নেত্রীর গাড়ির একটি চাকা বাইরে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। আল্লাহ্র রহমতে এবং ড্রাইভারের দক্ষতায় সে-যাত্রায় বড় কোনো বিপদ ঘটেনি। সেদিন বিরোধী দলে থাকলেও বঙ্গবন্ধু-কন্যা ঘোষণা দিয়েছিলেন, আল্লাহ্ যদি তাকে সুযোগ দেয় তাহলে দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ সার্বিক উন্নয়নে তিনি উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।
সামরিক শাসনের গর্ভে জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলো দক্ষিণাঞ্চলের কোনো উন্নয়ন করেনি। কেন করেনি। সে উত্তর হয়তো তারাই দিতে পারবে। হতে পারে এ অঞ্চলের মানুষ বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসে। শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা রাখে, নৌকায় ভোট দেয়।
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে দক্ষিণ জনপদের উপকূলীয় অঞ্চলের ১০ লক্ষাধিক মানুষ জীবন দিয়েছিল। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী যখন মানুষের দুঃখ লাঘবে নির্বিকার ছিল, তখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ত্রাণ সহায়তা নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন অসহায় মানুষের কাছে। পটুয়াখালী, ভোলা ও বরগুনার মানুষ সে-কথা আজও ভুলেনি। বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকারী শেখ হাসিনাকেও দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ তাদের আপনজন মনে করে, হৃদয় দিয়ে ভালোবাসে। বঙ্গবন্ধু-কন্যাও ভালোবাসার মর্যাদা দিতে জানেন। তাই তো দক্ষিণ জনপদ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে।
১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর এ অঞ্চলের মানুষকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদে লাউলাঠি নদীতে পটুয়াখালী সেতু নির্মাণ করা হয়। পর্যায়ক্রমে কীর্তনখোলা নদীর ওপর শহিদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত সেতু (দপদপিয়া সেতু)। খেপুপাড়ার আন্দারমানিক নদীর ওপর শহিদ শেখ কামাল সেতু, হাজীপুরে সোনাতলা নদীর ওপর শহিদ শেখ জামাল সেতু এবং মহিপুরে খাপরাভাঙ্গা নদীর ওপর শহিদ শেখ রাসেল সেতু নির্মাণ করা হয়।
একসময় অবহেলিত এই জনপদ শেখ হাসিনার হাতের ছোঁয়ায় আজ উন্নত ও আধুনিক অঞ্চলে রূপান্তরিত হচ্ছে। পায়রা পোর্ট, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, পর্যটন কেন্দ্র, সাবমেরিন ক্যাবলের ল্যান্ডিং স্টেশন, নৌঘাঁটি, মেডিকেল কলেজ, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, সব মিলিয়ে পটুয়াখালীতে চলছে আজ উন্নয়নের এক মহাযজ্ঞ।
পায়রা সেতু উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘খাল-বিল নদী-নালার এই বাংলাদেশে দক্ষিণাঞ্চল জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে যাচ্ছে। কাজেই এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন যত দ্রুত আমরা করতে পারি, ততই মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন হবে।’
মাননীয় নেত্রী সশরীরে উপস্থিত থেকে পায়রা সেতু উদ্বোধন করতে না পারার মনোবেদনার কথাও বলেছেন। উপস্থিত হাজারো মানুষ ভার্চুয়ালি প্রিয় নেত্রীর কথা শুনেছেন। সবার আকাক্সক্ষা ছিল বঙ্গবন্ধু-কন্যা তার সৃষ্টি পায়রা সেতু সশরীরে এসে উদ্বোধন করবেন। নেত্রী যখন বলছিলেন, ‘এই প্রমত্তা পায়রায় একসময় জীবনবাজি রেখে চলাচল করেছি। মানুষের মাঝে ছুটে গিয়েছি। সেই নদীতে এমন সুন্দর সেতু হয়েছে। করোনা অতিমারির কারণে লেবুখালীতে উপস্থিত হতে পারলাম না। ইচ্ছে ছিল সেতুটি পায়ে হেঁটে পার হব।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আবেগঘন বক্তৃতা শুনে উপস্থিত জনতা মুহূর্তেই প্রিয় নেত্রীর প্রতি অন্যরকম এক কৃতজ্ঞতাবোধে নিজেদের সঁপে দেয়। এই সেতু শুধু পটুয়াখালী-বরিশালের মধ্যেই সংযোগ সৃষ্টি করেনি। এ যেন ভালোবাসার কৃতজ্ঞতায় বিনি সুতার সংযোগ স্থাপিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু-কন্যার সাথে দক্ষিণাঞ্চলবাসীর।
লেখক : সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ