পাট এখন আর দড়ি বা বস্তায় সীমাবদ্ধ নেই। এসেছে সময়োপযোগী পরিবর্তন। উৎপাদিত ৭০-৮০ শতাংশ পাট কাঁচামাল হিসেবে রপ্তানি করা হয়েছে। আমাদের পাট কিনে; অন্য দেশ প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে পণ্য উৎপাদন এবং বিপণন করে বিপুল পরিমাণ লাভ করছে।
রাজিয়া সুলতানা: একটি মাত্র ঘোষণা। কৃষিবান্ধব সরকারের ঘোষণা- ‘পাট হবে কৃষিপণ্য’। তাতেই ফিরেছে সোনালি আঁশ খ্যাত পাটের সোনালি দিন। এই ঘোষণা দিয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উত্তরসূরি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের পাটের এই নতুন দিগন্তের উন্মোচন নতুন স্বপ্ন দুয়ার খুলে দেবে।
পাট এতদিন ছিল শিল্পপণ্য। তারপরও স্বাধীনতা-উত্তর পাট এবং পাট জাতীয় পণ্য রপ্তানি করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হয়েছে। পাটই ছিল প্রধান অর্থকরী ফসল। কিন্তু নানামুখী জটিলতায় একসময় মুখ থুবড়ে পড়েছে পাট। পাটজাত পণ্যের স্থানীয় বাজারজাত এবং বিদেশে রপ্তানির প্রধান ভূমিকা ছিল পাট অধিদপ্তরের। স্বপ্ন-প্রত্যাশায় সেই পাট অনেকটা গলায় ফাঁস হতে চলছিল। পাটচাষিরা হতাশায় অন্ধকারের অনামিশা দেখছিল। ঠিক তখন সরকারের পাটকে কৃষিপণ্য ঘোষণায় চাষিরা সুদিন দেখছে। পাট এখন কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত এবং পাটপণ্য পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের অধীন। ফলে পাটচাষিরা অন্যান্য কৃষিপণ্যের মতো পাটেও সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাবে।
কৃষিজ পণ্যে সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়া যায়। পাট এখন সেই গোত্রের। পাটের উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন, বীজ উৎপাদন, পাট আবাদ, পাট উৎপাদন এবং রপ্তানিতে পাবে কৃষিপণ্যের সকল সুযোগ-সুবিধা। সরকারের এই উদ্যোগ পাটের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। সরকারের এমন সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছে সব শ্রেণির মানুষ।
বিশ্বে পরিবেশ রক্ষায় সিনথেটিক আঁশের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব পাটের আঁশের ব্যবহার হুহু করে বাড়ছে। ফলে পাটের উৎপাদন বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। এদেশের মাটি, জলবায়ু, পরিবেশ এবং আবহাওয়া পাট চাষের জন্য খুবই উপযোগী। এদেশের পাটের জাত, পাটের বীজ এবং আঁশ খুবই উন্নতমানের। দেশের চাহিদা মিটিয়ে পাটের বৈদেশিক বাণিজ্যে শক্ত অবস্থান দাঁড় করানোই বর্তমান সরকারের মুখ্য উদ্দেশ্য।
গত ৯ জানুয়ারি বর্তমান সরকারের ১০৮তম মন্ত্রিসভার বৈঠকের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাটকে কৃষিপণ্য করার প্রস্তাব অনুমোদন করেন। ওই সভায় ‘জাতীয় কৃষি বিপণন নীতি, ২০২২’-এর খসড়া অনুমোদনও করা হয়। কৃষি বিপণন নীতি, ২০২২-এ রয়েছে ১৯টি গুরুত্বপূর্ণ দিক-নির্দেশনা। কৃষিপণ্য হিসেবে পাট এখন থেকে এই নীতির সকল সুযোগ-সুবিধা পাবে। নির্দেশনার মধ্যে বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে- কৃষি ব্যবসায় বাজার সংযোগ বৃদ্ধি, কৃষি বিপণনের সহায়ক বাজারের তথ্য ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করা, কমিউনিটিভিত্তিক ও গ্রুপভিত্তিক বিপণন জোরদার, কৃষি উপকরণ ও বিপণনকে সহজ ও আধুনিককরণ, কৃষিপণ্যের গুদাম ও সংরক্ষণাগারের ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, কৃষি বিপণন-সংক্রান্ত অবকাঠামোর উন্নয়ন, কৃষি ব্যবসার মাধ্যমে যুবসমাজের উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বেকারত্ব কমানোর পদক্ষেপ নেওয়া, নারীর ক্ষমতায়নের সুযোগ তৈরি করা, ই-কৃষিবাজারকে সহায়তা এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় কৃষিপণ্যের মূল্য সহনীয় করার জন্য সরবরাহ ব্যবস্থার দেখভাল করা। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী পাট রপ্তানির সুবিধার্থে এবং পণ্যকে আধুনিক করার প্রয়োজনে কৃষিজাত পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের বিষয়েও একটি নীতিমালা তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন।
পাটের সোনালি অতীত ফিরিয়ে আনতে সরকার বদ্ধপরিকর। অতীতের মতো পাট এখনও সারাবিশ্বে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। বিশ্বব্যাপী বাড়ছে পাটের বহুমুখী চাহিদা। ভৌগোলিক কারণে আদিকাল থেকে বাংলাদেশে উন্নতমানের পাট চাষ হয়ে আসছে। একসময় বাংলাদেশ সমৃদ্ধ ছিল অসংখ্য পাট ও চটকলে। পাট উৎপাদন, আমদানি-রপ্তানির প্রতিযোগিতায় পাটকলগুলো ব্যাপক লোকসানের সম্মুখীন হয়েছে। চাষিরা পাট চাষ করে লাভ তো দূরের কথা হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল। পাট উৎপাদনের খরচও ঘরে তুলতে তারা হিমশিম খাচ্ছিল। পাটচাষিদের যাপিত জীবনে নেমে এসেছিল বিপর্যয়-দুর্ভোগ। লোকসান দিতে দিতে চাষিরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল।
পাটের প্রতিটা অংশই কাজে লাগে, তারপরও লোকসান- এটা মেনে নিতে চাননি কৃষিবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে পাট নিয়ে শুরু হলো নানামুখী গবেষণা। অনুসন্ধানে দেখা গেল- পাটকলগুলো আগের আদলে গড়া, সেই মান্ধাতা আমলের। পাট এখন আর দড়ি বা বস্তায় সীমাবদ্ধ নেই। এসেছে সময়োপযোগী পরিবর্তন। উৎপাদিত ৭০-৮০ শতাংশ পাট কাঁচামাল হিসেবে রপ্তানি করা হয়েছে। আমাদের পাট কিনে; অন্য দেশ প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে পণ্য উৎপাদন এবং বিপণন করে বিপুল পরিমাণ লাভ করছে।
সরকার ২০২০ সালে পাট চাষের জমির পরিমাণ বৃদ্ধি, কৃষকের উৎপাদিত পাটের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ এবং দেশ-বিদেশে পাটের বাজার সম্প্রসারণ করতে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ‘উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর পাটবীজ ও পাট উৎপাদন এবং সম্প্রসারণ প্রকল্প’ এর মধ্যে অন্যতম। কৃষক যে পাটবীজ ব্যবহার করে তার বেশির ভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কৃষক যাতে তাদের চাহিদা অনুযায়ী দেশি উফশী পাটের জাত ও পাটবীজ ব্যবহার করতে পারে, তা নিশ্চিত করা হয়েছে এ প্রকল্পের মাধ্যমে। দেশে ভোক্তা পর্যায়ে পাটের চাহিদা বাড়াতে পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পাট খাতের উন্নয়নে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। পাট শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করতে ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন, ২০১০’, ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার বিধিমালা, ২০১৩’, ‘পাট আইন, ২০১৭’, ‘জাতীয় পাটনীতি, ২০১৮’ প্রণয়ন করেছে বর্তমান আওয়ামী সরকার। পাশাপাশি ভেষজ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে পাট পাতা, তৈরি হয়েছে পাট পাতার চা। পাট দিয়ে হচ্ছে ডেনিম; পাটের আঁশ দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে উন্নতমানের কাপড়, পাট থেকে তৈরি হচ্ছে ঢেউটিন, কার্পেটসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ পণ্য ও উপাদান।
স্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে হুমকি হওয়ায় কৃত্রিম তন্তু বিশেষ করে পলিথিন থেকে মুখ ফিরিয়েছে বিশ্ব। পাশাপাশি টয়েটা, মিটসুবিসি এবং জিএম মোটর্সসহ মোটর গাড়ি কোম্পানিগুলো পাটের আঁশ ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কৃষ্টি ও ঐতিহ্যগতভাবে পাট দিয়ে তৈরি সুতা, দড়ি, বস্তা, প্যাকিং সরঞ্জাম, ব্যাগ বা থলে, হাতে বাছাই করা আঁশ ইত্যাদি ব্যবহৃত হচ্ছে অনেক আগে হতে। তাছাড়া পাট দিয়ে তৈরি হচ্ছে প্রসাধনী, টব, খেলনা, জুয়েলারি, নারী-পুরুষের জুতা-স্যান্ডেল, বাস্কেট, শাড়ি, পাঞ্জাবি, গৃহস্থালি, বিভিন্ন রংসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম। পাটখড়ি দিয়ে ঘরের বেড়া, ছাউনি দেওয়া হয়। তাছাড়া জ্বালানি হিসেবে পাটখড়ির ব্যবহার বহু পুরনো। বাঁশ এবং কাঠের বিকল্প হিসেবে পার্টিকেল বোর্ড, কাগজের মণ্ড এবং কাগজ তৈরিতে পাটখড়ি ব্যবহৃত হয়। সম্প্রতি পাট থেকে জুট পলিমার তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার করেন ড. মোবারক আহমেদ খান, যা ‘সোনালি ব্যাগ’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা পাটের জীবন-রহস্য আবিষ্কার করেছেন। জীবন বাঁচানোর অ্যান্টিবায়োটিকও পাট থেকে আবিষ্কার করেছেন দেশের বিজ্ঞানীরা।
পাট উৎপাদনে ভারতের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। রপ্তানিতে দ্বিতীয়। সুযোগ এসেছে পাট ও পাটজাত সামগ্রী নিয়ে সারাবিশে^ দাপিয়ে বেড়ানোর। পাট কৃষিপণ্য হওয়ায় কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট পাটজাত পণ্যের উন্নয়নে এবং পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের অধীন পাট অধিদপ্তর পাট উৎপাদন থেকে শুরু করে বহুমুখী পণ্যের উৎপাদন ও বিপণন কার্যক্রম করলে এ সেক্টরে আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। চাষিদের পাট আবাদে অনুপ্রাণিত করতে পাটের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ, পাট ক্রয়-বিক্রয় সহজীকরণের জন্য এসএমইভিত্তিক ব্যবস্থাকরণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আশা করা যায়, চাষিরা আবারও পাট চাষে ব্যাপকভাবে উদ্বুব্ধ হবে। পাট চাষে ফিরে আসবে হারানো ঐতিহ্য। চাষিদের মুখে ফিরবে সোনালি হাসি। পাট দিয়ে দেশের অর্থনীতি হবে মজবুত এবং সমৃদ্ধ।
দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পাট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরেই ২০৪১ সালের মধ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশে’ প্রবেশ করবে। স্মার্ট বাংলাদেশে পাট ফিরে পাবে হারানো গৌরব অধ্যায়।
লেখক : পিএইচডি গবেষক, প্ল্যান্ট প্যাথলজি
শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়