Wednesday, October 4, 2023
বাড়িউত্তরণ প্রতিবেদনপরমাণু শক্তির অংশ বাংলাদেশ

পরমাণু শক্তির অংশ বাংলাদেশ

উত্তরণ প্রতিবেদন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে আর যেন কখনও পিছিয়ে পড়তে না হয়, এদেশের ওপর আর কখনও যেন কোনো ‘শকুনির থাবা’ না পড়ে, বাংলাদেশের এই উন্নতি এবং অগ্রগতি যেন অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যায় সেজন্য দেশবাসীকে সজাগ ও সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, পরমাণু শক্তির অংশ হিসেবে বাংলাদেশ আজকে জায়গা করে নিতে পেরেছে। আমাদের লক্ষ্য বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। পরমাণু শক্তির একটা অংশ হিসেবে বাংলাদেশ আজকে স্থান করে নিল, সেটা শান্তির জন্য। পরমাণু শক্তি আমরা দেশের শান্তির জন্য ব্যবহার করব।
বিদ্যুতকে দেশের উন্নয়নের চাবিকাঠি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী দক্ষিণাঞ্চলে আরেকটি পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে তার সরকারের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে বলেন, তার সরকার দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে দেশের দক্ষিণাঞ্চলেই আরেকটি নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট স্থাপন করবে। আমরা জায়গা খুঁজছি এবং আশা করি এ ব্যাপারে খুব একটা অসুবিধা হবে না। এখানে যদি আরেকটি নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট আমরা করতে পারি তাহলে বিদ্যুতের জন্য আমাদের আর অসুবিধা হবে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১০ অক্টোবর পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুরে নির্মাণাধীন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মূল যন্ত্র রি-অ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল (আরএনপিপি-পারমাণবিক চুল্লিপাত্র) স্থাপনের কাজের উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী এটি উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশে অনেকে না জেনে সমালোচনা করেন মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের বাংলাদেশে একটু কিছু করতে গেলে এত সমালোচনা হয়। নানাভাবে না জেনে, কেউ না বুঝে অনেক কথা বলে ফেলে, অনেকে অনেক কথা লিখে ফেলে। টকশোতে অনেক কথা এটা হচ্ছে বাংলাদেশের নিয়ম।’
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে রাশিয়ার সহযোগিতার কথা স্মরণ করে তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, বঙ্গবন্ধু-২ স্যাটেলাইট আমরা নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। আর এই পাওয়ার প্লান্টটা হয়ে যাওয়ার পর আমরা দক্ষিণাঞ্চলে জায়গা খুঁজছি। যদিও দক্ষিণাঞ্চলে শক্ত মাটিওয়ালা জায়গা পাওয়া খুবই কঠিন। বিভিন্ন দিক এবং বিভিন্ন জায়গা আমরা সার্ভে করছি, আরেকটি পাওয়ার প্লান্ট আমরা করব। কোথায় ভালো জায়গা পাই এবং আমরা সেটা করতে পারব। আমরা বহুমুখী বিদ্যুৎ উৎপাদন করে যাচ্ছি এই জন্য যে, এই বিদ্যুৎ সুবিধা যাতে মানুষ পায় এবং এটা যাতে অব্যাহত থাকে।
প্রকল্প সূত্রমতে, পারমাণবিক চুল্লিপাত্র বসানোর এ ঘটনা পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এর ফলে প্রকল্পটি নির্ধারিত সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়েই এগিয়ে যাবে। ওই কেন্দ্রের যে যন্ত্রে নিউক্লিয়ার ফুয়েল (পারমাণবিক জ্বালানি) ইউরেনিয়াম থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় তার মূল কাঠামো হচ্ছে এই বিশেষ যন্ত্র, পারমাণবিক চুল্লি)। এটিকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের হৃদপি- বলা হয়।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমানের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন রোসাটমের মহাপরিচালক অ্যালেক্সি লিখাচেভ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সচিব জিয়াউল হাসান স্বাগত বক্তৃতা করেন। প্রকল্প পরিচালক ও পরমাণুবিজ্ঞানী ড. মো. শওকত আকবর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মূল যন্ত্র রি-অ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল স্থাপনের সময় আরএনপিপি থেকে ভিডিও কনফারেন্সে সংযুক্ত হন। অনুষ্ঠানে নির্মাণাধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ওপর একটি ভিডিও চিত্র পরিবেশিত হয়। ঈশ্বরদী প্রান্তে শামসুল হক টুকু এমপি, নুরুজ্জামান বিশ্বাস এমপি, গোলাম ফারুক প্রিন্স এমপি, আহমেদ কবীর ফিরোজ এমপি, সংরক্ষিত আসনের এমপি নাদিরা ইয়াসমিন জলি প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিরাপত্তার বিষয়টিতে সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখানে প্রায় তিন থেকে চার স্তরের নিরাপত্তার ব্যবস্থা আমরা করেছি। পাশাপাশি পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, এই রি-অ্যাক্টরের কাছে বা এর ভেতরে যারা কাজ করবেন তাদেরও অভিজ্ঞতা এবং প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে, তেমনি পুরো এলাকাটিরও নিরাপত্তার যে প্রয়োজন তা পূরণ করা হয়েছে। সেখানে সেনাবাহিনী, পুলিশসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং প্রতিষ্ঠানকে কাজে লাগানোর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রকল্পের শুরুতেই রাশিয়ার সঙ্গে তার সরকারের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চুক্তি করা হয়েছে। এখন নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টে পরিবেশ দূষণ আর হয় না। কারণ সেখানে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। যে কারণে দুর্ঘটনা ঘটারও খুব একটা সুযোগ থাকে না।
শেখ হাসিনা বলেন, এই রি-অ্যাক্টর বসানোর জন্য মাটি তৈরি করা থেকে নদী ড্রেজিং অর্থাৎ রাশিয়ার ভলগা থেকে পদ্মা আমরা পাড়ি দিয়েছি। কাজেই এটাও আমি মনে করি যে, ভবিষ্যৎ ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য আরও একটি আলোর দুয়ার খুলে গেল। তিনি বলেন, এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে যাবে, ইতোমধ্যে আমরা সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কাজ শুরু করে দিয়েছি। ২০২৩ সালে আমাদের প্রথম ইউনিট এবং ২০২৪ সালে দ্বিতীয় ইউনিটের কাজ শুরু হয়ে যাবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নতি আরও ত্বরান্বিত হবে, সেটাই আমরা বিশ্বাস করি।
জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের প্রসঙ্গ টেনে সরকারপ্রধান বলেন, এই সময়ে আমরা এই নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলাম, আমরা বিশেষ করে রি-অ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল আমরা স্থাপন করলাম। যেটা সত্যিই আমাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের। পাশাপাশি, ২০৪১ সালের মধ্যে এই উন্নয়নশীল বাংলাদেশকেই উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়তে চাই। আজকে আমরা উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছি। কিন্তু, এখানেই থেমে গেলে চলবে না, ১৯৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ আমরা গড়ব।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতা অর্জনের অনেক পূর্বেই জাতির পিতা এখানে বিদ্যুতায়নের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে অনুধাবন করেছিলেন এবং পাকিস্তান সরকারের কাছে তার দাবির প্রেক্ষিতেই ১৯৬১ সালে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। জমি অধিগ্রহণসহ বেশ কিছু কাজ তখন সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু, ১৯৭০ সালে পাকিস্তান সরকার হঠাৎ করে কাজ বন্ধ করে দিয়ে প্রকল্পটি পশ্চিম পাকিস্তানে সরিয়ে নিয়ে বিরাজমান বৈষম্যমূলক আচরণের পুনঃপ্রকাশ ঘটায়। আর স্বাধীনতার পরপরই যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনকালেই বঙ্গবন্ধু ‘আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা’ ‘আইএইএ’র সঙ্গে চুক্তি করে ফেলেন। সে-সময় দেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য পরিচালক হিসেবে তার প্রয়াত স্বামী বিশিষ্ট পরমাণুবিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ারও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনের কথা স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী।
জাতির পিতা বেঁচে থাকলে এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাংলাদেশ আরও আগেই নির্মাণ করতে পারত উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, স্বাধীনতা অর্জনের পর জাতির পিতা মাত্র ৯ মাসেই একটি সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন। ‘গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি বিপ্লব’ শিরোনামে সেই সংবিধানের ১৬ নম্বর অনুচ্ছেদে যুক্ত করেছিলেন ‘নগর ও গ্রামাঞ্চলের জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য ক্রমাগতভাবে দূর করিবার উদ্দেশ্যে কৃষি বিপ্লবের বিকাশ, গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতিকরণের ব্যবস্থা, কুটির শিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং শিক্ষা, যোগাযোগ-ব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের আমূল রূপান্তর সাধনের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য ’৭৫-এ জাতির পিতাকে হত্যার পর মার্শাল ল’ দিয়ে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী সরকারগুলো আর কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় দেশের এই কাক্সিক্ষত উন্নয়ন আর আলোর মুখ দেখেনি। ’৯৬ সালে ২১ বছর পর সরকারে এসেই আওয়ামী লীগ সরকার ২০২০ সালের মধ্যে ‘সবার জন্য বিদ্যুৎ’ সরবরাহের লক্ষ্য নিয়ে ‘ভিশন স্টেটমেন্ট ও পলিসি স্টেটমেন্ট অন পাওয়ার সেক্টর রিফর্মস’ প্রণয়ন ও অনুমোদন করে। পাশাপাশি জাতির পিতার স্বপ্নের ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প’ বাস্তবায়নের কার্যক্রম শুরু করে। কিন্তু পরবর্তীতে ২০০১ সালের পর বিএনপি-জামাত জোট সরকার ক্ষমতায় এসেই অন্যান্য জনবান্ধব প্রকল্পগুলোর মতো তার সরকারের এই প্রকল্পের কাজও বন্ধ করে দেয়।
শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর তার সরকার আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষিত রূপকল্প-২০২১ এর সঙ্গে সংগতি রেখে ‘পাওয়ার সেক্টর মাস্টার প্ল্যান-২০১০’ প্রণয়ন করে এবং আবার রূপপুর প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। বন্ধুরাষ্ট্র রাশিয়া এটি বাস্তবায়নে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় তাদের প্রতিও আন্তরিক ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মাইন অপসারণে রাশিয়ার বলিষ্ঠ সহযোগিতাসহ দেশের বিভিন্ন প্রকল্পে তাদের সহযোগিতার কথাও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন তিনি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভাসানচরে যুক্ত হলো জাতিসংঘ
পরবর্তী নিবন্ধশিথানে শেখ সাহেব
আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য