- রায়হান কবির
স্বাধীনতার ৫০ বছর পর নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের সুনির্দিষ্ট আইন প্রণীত হলো। গত ২৭ জানুয়ারি মহান জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে সংবিধান নির্দেশিত ও বহুল আলোচিত ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল-২০২২’। বিলে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের আনা রেকর্ড সংখ্যক মোট ২২টি সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর গেজেট আকারে প্রকাশ হলেই প্রথমবারের মতো প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে আইন পাবে বাংলাদেশ।
১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের সংবিধানে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠাসহ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করার বিধান সংযোজন করেন। সে-সময় বিশ্বের অনেক দেশেই নির্বাচন পরিচালনার বিষয়টি নির্বাহী বিভাগের হাতে রাখা হতো। জাতির পিতা তখন সংবিধানে নির্বাচন পরিচালনার সর্বময় ক্ষমতা একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত করেন এবং কোনোরূপ আইনি অস্পষ্টতা ও দুর্বোধ্যতা ব্যতিরেকে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠার বিধান প্রণয়ন করেন। গণতান্ত্রিক বিশ্বে যা এখনও একটি অনন্য নজির হিসেবে প্রতিষ্ঠিত আছে। বঙ্গবন্ধু সরকারের সময়ই বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়।
১৯৭২ সালে আরপিও প্রণীত হওয়ার পর দীর্ঘ সময় ধরে নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশন-সংক্রান্ত তেমন কোনো আইন ও অধ্যাদেশ প্রণীত হয়নি। ’৭৫-পরবর্তী সময়ে দু-তিনটি অধ্যাদেশ ও আইন প্রণয়ন করা হলেও প্রয়োজনীয় সকল আইন বা অধ্যাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই সম্পাদিত হয়েছে। ২০০৯-২০২১ সময়কালে জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন-সংক্রান্ত ৩২টিরও বেশি অধ্যাদেশ ও আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই ২০০৯ সালে ‘নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন’ প্রণয়নের মাধ্যমে এই কমিশনকে তার প্রয়োজনীয় সকল প্রশাসনিক, আর্থিক, লেজিসলেটিভ এবং রেগুলেটরি ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। ২০০৯ সালের পূর্বে নির্বাচন কমিশন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে একটি সংস্থা ছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আমাদের সময়ে নির্বাচন কমিশনের সকল আইনি এবং রেগুলেটরি ক্ষমতা প্রয়োগের লক্ষ্যে নানামুখী সম্পূরক বিধিবিধান, নীতিমালা ও গাইডলাইন্স প্রণীত হয়। নির্বাচন কমিশনের আইন ও রেগুলেটরি ব্যবস্থাকে পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সকল ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। বাংলাদেশে শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন এবং নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালীকরণে যা কিছু হয়েছে, তা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই অর্জিত হয়েছে।
তারই ধারাবাহিকতায় গত ২৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল-২০২২’। এর মধ্য দিয়ে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলসমূহ এবং সুশীল সমাজের নির্বাচন কমিশন গঠন-সংক্রান্ত দীর্ঘদিনের আশা পূরণ হলো।
এর আগে গত ২৩ জানুয়ারি আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক ওই বিলটি সংসদে উত্থাপনের পর তা অধিকতর পরীক্ষার জন্য সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে বিলের দুটি ধারায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনসহ পাসের সুপারিশ করে ২৬ জানুয়ারি সংসদে প্রতিবেদন জমা দেয় আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এরপর ২৭ জানুয়ারি স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে শুরু হওয়া অধিবেশনে বিলটি সংসদে পাসের প্রস্তাব করেন আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক। এরপর প্রায় তিন ঘণ্টার আলোচনা শেষে কণ্ঠভোটে বিলটি পাস হয়। বিলের ওপর সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন জাতীয় পার্টি, বিএনপি, জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টির সদস্যরা। যার মধ্য থেকে ২২টি প্রস্তাব গৃহীত হয়। অধিবেশনে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন সার্চ কমিটিতে দুজন বিশিষ্ট নাগরিকের মধ্যে একজন নারী রাখার প্রস্তাব দেন। আইনমন্ত্রী সেই প্রস্তাবে সায় দিলে, সংসদ তা ভোটে গ্রহণ করে। অর্থাৎ, ইসি গঠনের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে নাম সুপারিশের জন্য যে সার্চ কমিটি থাকবে সেখানে একজন নারী থাকবেন।
সংসদে উত্থাপিত বিলে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি ছয় সদস্যের অনুসন্ধান কমিটি গঠন করবেন, যার সভাপতি হবেন প্রধান বিচারপতি মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারক। সদস্য হিসেবে থাকবেন প্রধান বিচারপতি মনোনীত হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতি মনোনীত দুজন বিশিষ্ট নাগরিক। এখন রাষ্ট্রপতি মনোনীত ওই দুজন বিশিষ্ট নাগরিকের মধ্যে একজন নারী রাখার বিধান যুক্ত হয়েছে। বিলে সার্চ কমিটির কাজ ১০ কার্যদিবস করার বিধান রাখা হয়েছিল। সেটি এখন ১৫ কার্যদিবস করা হয়েছে। জাতীয় পার্টির মো. ফখরুল ইমামের এ-সংক্রান্ত সংশোধনী সংসদ গ্রহণ করেছে। ফখরুল ইমামের মোট ৭টি সংশোধনী গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া জাতীয় পার্টির রওশন আরা মান্নান, মুজিবুল হক চুন্নু ও পীর ফজলুর রহমান এবং বিএনপির রুমিন ফারহানার ৩টি করে সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এছাড়া জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশিদ ও জাসদের হাসানুল হক ইনুর একটি করে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণ শেষে আইনমন্ত্রী বলেন, এই বিলে যতগুলো সংশোধনী গ্রহণ করেছেন, এর আগে কখনও এত বেশি সংশোধনী কোনো বিলে গ্রহণ করা হয়নি।
সংসদে প্রধানমন্ত্রী
নির্বাচন কমিশন আইন প্রসঙ্গে জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতি হচ্ছে দেশের জনগণের ভোটের অধিকার রক্ষা করা, কেড়ে নেওয়া নয়। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে যে দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন তার বড় প্রমাণ। বিএনপি এই নির্বাচনেও নানা খেলার চেষ্টা করেছে; কিন্তু পারেনি। বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি, ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা প্রণয়ন, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স, জনগণের ভোটের অধিকার রক্ষাসহ সব কিছু আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ফসল। আওয়ামী লীগের আমলেই দেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত থাকে। আমরা সংসদে ইসি গঠন বিল পাস করলাম। এতে জনগণের ভোট সুরক্ষিত হলো এবং নির্বাচনের আরেকটা ধাপ আমরা এগিয়ে গেলাম। গণতন্ত্রকে আরও আমরা শক্তিশালী করলাম। জনগণের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে।
নির্বাচন কমিশন গঠনে তড়িঘড়ি করে আইন প্রণয়নের অভিযোগ নাকচ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এর প্রস্তুতি আগেই নেওয়া ছিল। তিনি বলেন, ২০১৭ সালে মহামান্য রাষ্ট্রপতি যখন আমাদের সকলকে ডেকেছিলেন তখনই তিনি বলেছিলেন, আমাদেরও প্রস্তাব ছিল। অনেক দিন থেকে মোটামুটি প্রস্তুত করে রেখেছিলাম। তিনি বলেন, গত ১৭ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংলাপ প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে যখন ডায়ালগ করতে গেলাম তখন তিনি বললেন, বিলটা তাড়াতাড়ি পাস করে দিতে। তিনি চান এই বিলের মাধ্যমে পরবর্তী নির্বাচন কমিশন এবং প্রধান কমিশনার এবং কমিশনাররা নির্বাচিত হোক। আমরা বিলটি সংসদে নিয়ে আসলাম। কিন্তু প্রস্তুতি তো আমাদের বহু আগে থেকে ছিল। অন্য কোনো দল করেনি। আওয়ামী লীগ আবার করল। এতে জনগণের ভোট সুরক্ষিত হলো এবং নির্বাচনের আরেকটা ধাপ আমরা এগিয়ে গেলাম। গণতন্ত্রকে আরও আমরা শক্তিশালী করলাম। জনগণের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে।
সরকারপ্রধান বলেন, এই পার্লামেন্টে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিলটা পাস করতে পেরেছি। যে বিলের মধ্য দিয়ে আজকে আমাদের বিরোধী দল থেকে উনারা বললেন কিছুই জানেন না। কিন্তু তারা যতগুলো সংশোধনী এনেছে এই বিলে, ২২টা সংশোধনী বিরোধী দলের কাছ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। এখানে জাতীয় পার্টির সংশোধনী, বিএনপির সংশোধনী, জাসদের সংশোধনী, আমাদের ওয়ার্কার্স পার্টির সংশোধনীÑ সকলের সংশোধনী আমরা গ্রহণ করেছি। তাতে এই বিল আর সরকারি বিল নাÑ এটা বিরোধী দলে তৈরি করা বিল হয়ে গেছে। একটা বিলে যদি ২২টা সংশোধনী গ্রহণ করা হয়, অধিকাংশ হয়ে গেল বিরোধী দলের। সবার হয়ে গেল। জাতীয় পার্টির, বিএনপির, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, গণফোরামÑ সবার। সকলে বক্তব্য দিয়েছেন। বিলটি পাস করার জন্য স্পিকারসহ সকল সংসদ সদস্যকে ধন্যবাদও জানান প্রধানমন্ত্রী।
সিইসি ও ইসিদের যোগ্যতা-অযোগ্যতা
আইনের বিধান অনুযায়ী সিইসি ও ইসি পদে কাউকে সুপারিশের ক্ষেত্রে ৩টি যোগ্যতা থাকতে হবে। এক্ষেত্রে তাকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে, ন্যূনতম ৫০ বছর বয়স হতে হবে এবং কোনো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, বিচার বিভাগীয়, আধা-সরকারি বা বেসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত পদে বা পেশায় পদে তার অন্যূন ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এই পদের জন্য ৬টি অযোগ্যতা বিলে উল্লেখ করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে আদালত অপ্রকৃতিস্থ ঘোষণা করলে, দেউলিয়া হওয়ার পর দায় থেকে অব্যাহতি না পেলে, কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নিলে কিংবা বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করলে, নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে কারাদ-ে দ-িত হলে, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) অ্যাক্ট-১৯৭৩ বা বাংলাদেশ কোলাবরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনালস) অর্ডার-১৯৭২-এর অধীনে কোনো অপরাধের জন্য দ-িত হলে এবং আইনের দ্বারা পদাধিকারীকে অযোগ্য ঘোষণা করছে না, এমন পদ ব্যতীত প্রজাতন্ত্রের কর্মে লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকলে।
পাস হওয়া বিলে সার্চ কমিটির (অনুসন্ধান কমিটি) কাজ সম্পর্কে বলা হয়েছে, এ কমিটি স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে দায়িত্ব পালন করবে। আইনে বেঁধে দেওয়া যোগ্যতা, অযোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও সুনাম বিবেচনা করে সিইসি ও ইসি পদে নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করবে। এ অনুসন্ধান কমিটি সিইসি ও কমিশনারদের প্রতি পদের জন্য দুজন করে ব্যক্তির নাম সুপারিশ করবে। কমিটি গঠনের ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশ রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দিতে হবে। সার্চ কমিটি সিইসি এবং নির্বাচন কমিশনার পদে যোগ্যদের অনুসন্ধানের জন্য রাজনৈতিক দল এবং পেশাজীবী সংগঠনের কাছ থেকে নাম আহ্বান করতে পারবে।
নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির সংলাপ
নির্বাচন কমিশন গঠনে গত ২০ ডিসেম্বর ২০২১ থেকে বঙ্গভবনে শুরু হয় নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সংলাপ। বঙ্গভবনে প্রথম দিনের সংলাপে অংশগ্রহণ করেন প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। সংলাপে রাষ্ট্রপতির কাছে জাতীয় পার্টি নতুন স্বাধীন, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের আগেই আইন প্রণয়নসহ তিন-দফা প্রস্তাব উপস্থাপন করে। ২২ ডিসেম্বর বিকালে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে অংশগ্রহণ করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ (ইনু)। দলটি নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে একটি সুনির্দিষ্ট ও স্থায়ী আইনি কাঠামো তৈরিতে রাষ্ট্রপতিকে ভূমিকা পালনেরও অনুরোধ জানান। ২৬ ডিসেম্বর চলমান সংলাপের তৃতীয় দিনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে আইন প্রণয়ণসহ সাত-দফা প্রস্তাব তুলে ধরে বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। দলটির পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। ২৭ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে অংশগ্রহণ করে নির্বাচন কমিশনে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী বা তার পরিবারবর্গের কাউকে না রাখাসহ চার-দফা প্রস্তাবনা দেয় বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন। ২৭ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে অংশগ্রহণ করে খেলাফত মসলিশ। সংলাপে স্বাধীনতার ৫০ বছরেও ইসি গঠনে আইন না থাকাকে দুঃখজনক বলে দাবি করে খেলাফত মজলিশ। ২৮ ডিসেম্বর সংলাপে অংশ নিয়ে নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের জন্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠন এবং আইন প্রণয়নসহ ৬টি প্রস্তাব তুলে ধরে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশন গঠন বিষয়ে ধারাবাহিক সংলাপের অংশ হিসেবে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনাকালে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনসহ তিন-দফা প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ)। ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে সার্চ কমিটির সদস্য হিসেবে সাংবিধানিক পদে থাকা একজন ব্যক্তিকে রাখার প্রস্তাব দেয় ইসলামী ঐক্যজোট। গত ২ জানুয়ারি ২০২২ পৃথক বৈঠকে একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে দ্রুত আইন প্রণয়নের জন্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে প্রস্তাব দেয় বিকল্পধারা বাংলাদেশ এবং গণফোরাম। বিকল্পধারা বাংলাদেশ তিন-দফা সুপারিশ পেশ করে। ১৭ জানুয়ারি নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের শেষ দিন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনা করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। সংলাপকালে সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের আলোকে একটি নতুন আইন প্রণয়ন, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের স্বার্থে সকল নির্বাচনে অধিকতর তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত, ইসির আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানোসহ রাষ্ট্রপতির কাছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট চার-দফা প্রস্তাব পেশ করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা।
উল্লেখ্য, বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি। পরদিন নতুন কমিশন দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। এর আগে রাষ্ট্রপতি ২০ জানুয়ারির মধ্যে নতুন সার্চ কমিটি গঠন করবেন। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে এবার তৃতীয়বারের মতো রাষ্ট্রপতির সঙ্গে রাজনৈতিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। সংলাপে অংশ নেওয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রস্তাব এবং এ-সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের দাবি জানায়। রাষ্ট্রপতির এই সংলাপকে ঘিরে রাজনীতিতে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়। এর আগে প্রথমবার ২০১১ সালের ২২ ডিসেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জিল্লুর রহমান বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপে ডাকেন। দ্বিতীয়বার ২০১৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সংলাপ শুরু হয়, চলে ২০১৭ সালের ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত। বঙ্গবন্ধু-কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাই ২০০৯ সালে প্রথম আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনকে একটি স্বতন্ত্র ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। বঙ্গবন্ধু-কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার আমলেই ২০১২ এবং ২০১৭ সালে সকল রাজনৈতিক দলের সাথে আলাপ-আলোচনা করে সকলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংবিধানসম্মতভাবে নির্বাচন কমিশন গঠনের অনন্য নজির স্থাপিত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা সরকারের সময়কালে গত ২৭ জানুয়ারি মহান জাতীয় সংসদে পাস হয় সংবিধান নির্দেশিত ও বহুল আলোচিত ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল-২০২২’।
লেখক : গবেষণা সহকারী, উত্তরণ