মানকী শরীফের পীর আমিনুল হাসনাত তখন একটি আলাদা সংগঠন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন এবং সেই নামে তিনি ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নাম দিয়ে প্রথম একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন।
খালেক বিন জয়েনউদদীন: বাংলাদেশ আওয়ামী (মুসলিম) লীগ একটি প্রাচীন রাজনৈতিক সংগঠন। এই সংগঠনটির রয়েছে সুদীর্ঘকালের ইতিহাস। সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অনেক পূর্বে উপমহাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে লর্ড কার্জন ঢাকায় এসে সেই ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে অবাঙালি নবাব সলিমুল্লাহর বাড়িতে থেকে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দেন। ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তাদের আন্দোলন ও ইংরেজদের ষড়যন্ত্রে বাঙালির ২ হাজার বছরের মাতৃভূমি হিন্দু-মুসলিম বিবাদে দুই টুকরো করা হয়। অবশ্য ১৯১১ সালে বাঙালি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের আন্দোলনে চতুর ইংরেজ তা রদ করেন। কিন্তু ঐ বঙ্গভঙ্গকারী মুসলিমরা বসে থাকে না। তারা দাঙ্গা বাধিয়ে ইংরেজদের বোঝাতে সক্ষম হয় হিন্দু-মুসলিম দুই জাত, দুই ধর্ম, তাই আলাদা রাষ্ট্র হওয়া উচিত। তাই আমরা ’৪৭-এ দেখি পাকিস্তান ও ভারতের টানাপড়েনের রাষ্ট্রের অভ্যুদয়। এই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় মুসলিম লীগের অবদানই বেশি। কিন্তু অসাম্য, নিপীড়ন ও শোষণের কারণে পাকিস্তানের বাঙালি অংশ টেকেনি। পূর্ব বাংলার মুসলিম বঙ্গসন্তানরা অচিরেই ’৪৭-এর স্বাধীনতার স্বাদ বুঝতে পারে। বাংলা ভাষার প্রশ্নে বাঙালিরা বুঝতে পারে পাকিস্তানি স্বাধীনতা মূলত যা পাকির অধীনতাই মেনে নেওয়া হয়েছে।
তখন মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশ, যারা পাকিস্তান আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল, সিলেট পর্যন্ত গিয়েছিল, সেই অংশের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, শামসুল হক, ফজলুল হক, শেখ মুজিবসহ অনেক নেতৃবৃন্দই বুঝলেন মুসলিম লীগ তথা পাকি শাসনের মরতবা। দলছুট হলেন তারা। আগেই এই অংশ ঢাকায় মিলিত হয়ে একটি দপ্তর খুলেছিলেন ১৫০ মোগলটুলিতে। ইতোমধ্যে শেখ মুজিব ১৯৪৮ সালে নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের নাম পাল্টিয়ে এবং শাহ আজিজকে বাদ দিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ গঠন করলেন। প্রথম কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচিত হন নইমুদ্দীন। ঐ মোগলটুলিতে আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মুসলিম লীগ ওয়ার্কার্স ক্যাম্প। এরপর কোটারি ও মুসলিম লীগের প্রশাসনের বিরুদ্ধে একটি প্লাটফর্ম গঠনের লক্ষ্যে প্রথমে নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের সভা এবং কাঠখড় পুড়িয়ে ও পাকিস্তানিদের রক্তচুক্ষ উপেক্ষা করে বাংলার নবাব সিরাজের পরাজয়ের দিন ঢাকার কেএম দাস লেনের বশির মিয়ার বাড়িতে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন বাঙালির নতুন সূর্য ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠিত হলো।
গঠিত সেই কাউন্সিলে শেরে বাংলা পর্যন্ত এসেছিলেন। প্রথম কমিটিতে মওলানা ভাসানী, শামসুল হক, শেখ মুজিব, মান্নান খান, ইয়ার মোহাম্মদ খান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ নির্বাচিত হয়েছিলেন। সম্মেলনে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জেলার সচেতন বাঙালি ৩৫০ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। শেখ মুজিব তখন জেলে। জেল থেকে মুক্তি পেয়েই দলের যুগ্ম-সম্পাদক হিসেবে পুরান ঢাকার সেকালের একমাত্র ময়দান আরমানিটোলায় জনসভা ডাকলেন। কিন্তু মুসলিম লীগ সরকার সমূহ বিরোধিতা করল পুলিশ-গুণ্ডা দিয়ে। ভাসানী সেই সভাতেই ঢাকায় প্রথম বক্তৃতা করেন। ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠার পূর্ণ বিবরণ বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে রয়েছে। আমরা তা বারবার পড়েছি। কিন্তু কোথায়ও আমরা উল্লেখ করি না আওয়ামী লীগের (লুপ্ত মুসলিম শব্দটি) নামকরণের কথা। কে এই দেশ ও জাতির প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগের নামকরণের ব্যক্তি? তবে বঙ্গবন্ধুপ্রেমী সচেতন বাঙালির কাছে এ বিষয়টি অজানা নয়। অনেকেই জানেন তার নাম আমিনুল হাসনাত। তার অধিবাস পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে। তিনি ছিলেন ঐ প্রদেশের মানকী শরীফের পীর ও প্রখ্যাত নেতা। ’৪৭-এর পর প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী আবদুল কাইয়ুম খান পুরনো লীগ কর্মীদের দল থেকে বাদ দেন এবং তাদের অত্যাচার করেন। আমিনুল হাসনাত এর প্রতিবাদ করলে তাকেও দল থেকে বহিষ্কার করেন। পাকিস্তান আন্দোলন ও মুসলিম লীগের আন্দোলনে তিনি অবদান রাখেন। তবুও তার স্থান মুসলিম লীগে হয়নি। মানকী শরীফের পীর আমিনুল হাসনাত তখন একটি আলাদা সংগঠন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন এবং সেই নামে তিনি ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নাম দিয়ে প্রথম একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। নামকরণটি তারই এবং ঢাকায় মুসলিম আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার আগেই তা সীমান্ত প্রদেশে গঠিত হয়েছিল, যার বিবরণ বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ১১৫ পৃষ্ঠায় রয়েছে –
“সীমান্ত প্রদেশের পীর মানকী শরীফ একটা প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। তার নাম দিয়েছেন, ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’। সীমান্ত প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী খান আবদুল কাইয়ুম খান মুসলিম লীগ থেকে পুরানা কর্মীদের বাদ দিয়েছেন এবং অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়ে দিয়েছেন। অনেক লীগ কর্মীকে জেলে দিতেও দ্বিধাবোধ করেন নাই। এখন তিনি ‘সীমান্ত শার্দুল’ বনে গিয়েছেন। পাকিস্তান আন্দোলনে সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গাফফার খান ও ডাক্তার খান সাহেবের মোকাবেলা করতে পারেন নাই। ফলে সীমান্ত প্রদেশে কংগ্রেস সরকার গঠন হয়। একমাত্র পীর মানকী শরীফই লাল কোর্তাদের বিরুদ্ধে মুসলিম লীগকে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তবু পীর সাহেবের জায়গাও মুসলিম লীগে হয় নাই। পীর মানকী শরীফ সভাপতি এবং খান গোলাম মোহাম্মদ খান লুন্দখোর সাধারণ সম্পাদক হয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেন।”
মানকী শরিফের পীর আমিনুল হাসনাত ছিলেন ধর্মপ্রাণ মুসলিম এবং অসাম্প্রদায়িক। বঙ্গবন্ধু দুবার চীন ভ্রমণ করেন। ১৯৫২ সালের সফরে এই আমিনুল হাসনাতই দলের কমান্ডার ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ‘আমার দেখা নয়া চীন’ গ্রন্থে তার পূর্ণ বিবরণ ও ছবি রয়েছে। আজকাল আওয়ামী লীগের অনুষ্ঠানে প্রথম সাধারণ সম্পাদক শামসুল হকের নামটি উচ্চারিত হয়, ছবিও টানানো হয়। কিন্তু কোনো রচনায় বা অনুষ্ঠানে এই মহৎ ব্যক্তিটির নাম আমরা দেখি না। বলতে দ্বিধা নেইÑ আমিনুল হাসনাতই মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করে সভাপতি নির্বাচিত হন এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত খান গোলাম মোহাম্মদ খান লুন্দখোর। পরবর্তীকালে ১৯৪৯ সালে ঢাকায় আওয়ামী (মুসলিম) লীগ। মানকী শরীফের পীর আমিনুল হাসনাতের দেওয়া নামটিও বাঙালির প্রিয় সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান। ইতিহাসের বরপুত্র। বঙ্গবন্ধু আমিনুল হাসনাতকে প্রচণ্ডভাবে শ্রদ্ধা করতেন।
লেখক : গবেষক ও বাংলা একাডেমির ফেলো