‘উদ্ভাবিত এই কিট দিয়ে মাটির অম্ল রক্ষার, নাইট্রোজেন, অ্যামোনিয়া, পটাশিয়াম, সালফার, ফসফরাস, অণুজীবের পরিমাণ কম সময়ে নির্ণয় করতে মাত্র ৫০ টাকা খরচ হবে। তবে গবেষকরা জানিয়েছেন, মানুষের যেমন ছয় মাস পরপর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা দরকার; তেমনি মাটিরও স্বাস্থ্য পরীক্ষা উচিত।’
রাজিয়া সুলতানা :
কৃষিপ্রধান দেশ বাংলাদেশ। উন্নয়ন-অগ্রযাত্রায় এই কৃষি অর্থনীতিতে প্রাণশক্তি দিয়ে যাচ্ছে। অথচ আবহমান কাল হতে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকরা এখনও সনাতন পদ্ধতিতে কৃষিকাজ করে আসছেন। তারপরও কৃষিই এদেশের অর্থনীতির অন্যতম উৎস্যমূল। দুঃখের বিষয় আধুনিকতার নামে ইট-কাঠ-পাথরের অবকাঠামো নির্মাণের ফলে কমে যাচ্ছে আবাদি জমির সংখ্যা। পাশাপাশি হুহু করে বাড়ছে জনসংখ্যা। ফলে ‘কম জমিতে বেশি উৎপাদন’ প্রযুক্তি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। খাদ্যশস্য উপাদান বাড়তে জমিতে প্রয়োগ করা হচ্ছে রাসায়নিক এবং জৈব সার। কিন্তু এতদিন হাতে-কলমে সার প্রয়োগ ব্যবস্থাই ছিল প্রধানতম প্রক্রিয়া। ফলে সঠিক মাত্রায় সারের প্রায়োগিক বিষয়টি খুব সামনে চলে আসে ডিজিটাল বাংলাদেশের। ঠিক সেই সময়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ আবিষ্কার করেছে ‘মাটি পরীক্ষণ যন্ত্র’ বা ‘বাউ সয়েল টেস্টিং কিট’। কৃষিতে প্রযুক্তি এই পরীক্ষণ যন্ত্রটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। উৎপাদনের এই নতুন দিগন্তের সূচনা বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে আরেক ধাপ এগিয়ে নেবে। এই যন্ত্র দিয়ে জানা যাবে জমিতে কোন সার কি পরিমাণ দিতে হবে।
সার্বিকভাবে বলতে গেলে মানুষের শরীরের বৃদ্ধির জন্য যেমন ভিটামিন ও খাবারের প্রয়োজন, তেমনি গাছের বৃদ্ধির জন্যও খাদ্য প্রয়োজন। গাছের খাদ্য হচ্ছে নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাসিয়াম, সালফার, বোরন, জিংক ইত্যাদি। গাছ তার খাদ্য মাটি থেকে মূলের সাহায্যে গ্রহণ করে। মাটিতে বিদ্যমান গাছের এসব খাদ্যই মাটির পুষ্টি-উপাদান। মাটিতে পুষ্টি-উপাদান কম থাকে; তাহলে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হবে। ফলনও কম হবে। গাছের বৃদ্ধি ও বেশি ফলনের জন্য মাটিতে প্রয়োজনীয় পুষ্টি-উপাদান থাকতে হবে। তা আছে কি না; মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যাবে আবিষ্কৃত ‘বাউ সয়েল টেস্টিং কিট’ দিয়ে।
১৯৭০-৭১ সালে বাংলাদেশে মাথা পিছু জমি ছিল ০.১২ হেক্টর, বর্তমানে যা এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ০.০৬ হেক্টরে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ক্রমেই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে

দাঁড়িয়েছে। আমাদের দেশের কৃষকরা এক ফসলি জমি থেকে দুই বা ততোধিক হাইব্রিড ফসল ঘরে তুলতে প্রয়োগ করছে অনুমাননির্ভর রাসায়নিক সার। এতে মাটির উর্বর শক্তি যেমন নষ্ট হচ্ছে, তেমনি অপচয় হচ্ছে মূল্যবান রাসায়নিক সার এবং অর্থের। মাটিতে উপস্থিত অণুজীবের কার্যকারিতা হারাচ্ছে। আবার অতিরিক্ত রাসায়নিক সার মাটির নিচ দিয়ে নদী-নালায় মিশেছে। আবার গ্যাস হয়ে বায়ুমÐলে মিশে পরিবেশ দূষিত করছে। একদিকে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে; অন্যদিকে মাটির উর্বরতা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। ফলে ফসলের আশানুরূপ ফলন হচ্ছে না। ‘অতি লোভে তাতী নষ্ট হওয়ার মতো’ কৃষক বেশি ফলনের আশায় না বুঝেই বেশি সার প্রয়োগ করছে। যা বাংলাদেশের প্রাকৃতিক উর্বরতা বলির শিকারে পরিণত হচ্ছে। অথচ পরিমিত পরিমাণ সার প্রয়োগ করলে এবং ফসলের উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা করতে পারলে মাটির উর্বরতা ও উৎপাদনক্ষমতা বাড়ে। এতে কাক্সিক্ষত পরিমাণে ফলনও পাওয়া যায়। কিন্তু মাটিতে কি পরিমাণ পুষ্টি-উপাদানের ঘাটতি রয়েছে; তা জানা না থাকলে ফসলের চাহিদা অনুযায়ী পরিমাণমতো সার প্রয়োগ করা যায় না।
সার প্রয়োগের পূর্বশর্ত- ফসলি জমির মাটি পরীক্ষা করে পরিমিত মাত্রায় সুষম সার দিতে হবে। সুষম সার হলো, সেই পরিমাণ সার; যতটুকু মাটির প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে রাসায়নিক ও জৈব সারের সমন্বয় করে সারের মাত্রা ঠিক করতে হয়। এতে মাটির উর্বরতা রক্ষার পাশাপাশি সারের অপচয় রোধ করাও সম্ভব। বলা বাহুল্য যে, গত ২০০৮-০৯ সালে দেশে মোট ৩০ লাখ ৫ হাজার মেট্রিক টন রাসায়নিক সার ব্যবহার হয়। এর মধ্যে শুধু ইউরিয়া সার ব্যবহার হয় ২৪ লাখ মেট্রিক টন। অথচ ইউরিয়া সারের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ ফসলের কাজে আসে। এই বিপুল পরিমাণ সারের জন্য সরকারের ভর্তুকি গুনতে হয়েছে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। অথচ মাটি পরীক্ষা করে পরিমিত মাত্রায় সার প্রয়োগ করলে সরকারের এই ভর্তুকি আর দিতে হবে না।
সারের প্রায়োগিক মাত্রা কতটুকু হবে; তা সমাধান করে দিয়েছে ‘বাউ সয়েল টেস্টিং কিট’। কৃষকরা নামমাত্র খরচে এই কিট ব্যবহার করে মাটির পিএইচ, নাইট্রোজেন, ফসফেট ও পটাশিয়ামের আনুপাতিক পরিমাণ জানতে পারবে। ফলে প্রয়োজন অনুপাতে সার প্রয়োগ করতে পারে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ‘বাউ সয়েল টেস্টিং কিট’ দিয়ে জমির মাটি পরীক্ষা করে সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার করায় প্রতি বিঘায় (৩৩ শতাংশে) ১৭.৪০ মণ হারে ধানের ফলন হয়েছে। অর্থাৎ ‘বাউ সয়েল টেস্টিং কিট’ ব্যবহার করে আগের চেয়ে বিঘাপ্রতি ২ মণ ফলন বেড়েছে। ফলে প্রায় দেড় হাজার টাকা লাভ হয়েছে কৃষকদের বিঘাপ্রতি।
ল্যাবরেটরিতে মাটি পরীক্ষা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ। ফলে কৃষকরা তা করতে পারছেন না। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের উদ্ভাবিত এই নতুন সয়েল টেস্টিং কিটের সাহায্যে কৃষক নিজের জমিতে বসেই মাত্র ৫০ টাকা ব্যয়ে মাটির গুণাগুণ জানতে পারবে। এবং মাটির চাহিদামাফিক সার প্রয়োগ করতে পারবেন।
২০১৮ সালে ৬ মার্চ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কৃষি জমিতে সার প্রয়োগের মাত্রা নিরূপণকারী কিটের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে, হেকেপ প্রকল্পের আওতায় এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এসিআই’র কারিগরি সহায়তায় সয়েল টেস্টিং কিটের বাজারে পরীক্ষামূলকভাবে ছাড়া হয়েছে। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে এই কিট ব্যবহার করে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকরা নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন।
বাকৃবির মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. মো. মজিবুর রহমান এই কিট উৎপাদন প্রকল্পের প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন। উদ্ভাবিত এই কিট দিয়ে মাটির অম্ল রক্ষার, নাইট্রোজেন, অ্যামোনিয়া, পটাশিয়াম, সালফার, ফসফরাস, অণুজীবের পরিমাণ কম সময়ে নির্ণয় করতে মাত্র ৫০ টাকা খরচ হবে। তবে গবেষকরা জানিয়েছেন, মানুষের যেমন ছয় মাস পরপর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা দরকার; তেমনি মাটিরও স্বাস্থ্য পরীক্ষা উচিত। এই সয়েল টেস্টিং কিটটি বাণিজ্যিকভাবে স্বল্প খরচে দ্রুত কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মোদ্দাকথা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চাকা গতিশীল রাখতে ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে কৃষি উৎপাদনের কোনো বিকল্প নেই। বাউ সয়েল টেস্টিং কিট খুলে দিচ্ছে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার।
লেখক : শিক্ষক; পিএইচডি গবেষক, প্ল্যান্ট প্যাথলজি
শেরে বাংলা কৃষি ইউনিভার্সিটি
raziasultana.sau52@gmail.com