সম্পাদকের কথা: টানা দুটি মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের কাছে গত ২৪ এপ্রিল ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন নতুন রাষ্ট্রপতিকে শপথ বাক্য পাঠ করান। অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, পদস্থ অসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ এবং বুদ্ধিজীবীসহ বিপুল সংখ্যক আমন্ত্রিত অতিথি উপস্থিত ছিলেন।
আমরা মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি। দেশবাসীর প্রত্যাশা নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিশ্বস্ততা, যোগ্যতা ও মর্যাদার সাথে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবেন।
এ প্রসঙ্গে আমরা অতীতের দিকে তাকাতে চাই। ১৯৭২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে গণপরিষদে সংবিধান গৃহীত হওয়ার আগেই, ১৯৭২-এর ১২ জানুয়ারি বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের সূচনা হয়। মুক্তিযুদ্ধকালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি কারাগারে বন্দি থাকাকালেই ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রথম সরকার মুজিবনগরে শপথ গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধুকে জাতীয় ঐক্য এবং বাংলাদেশের প্রতীক হিসেবে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয়। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি করা হয় সৈয়দ নজরুল ইসলামকে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং নতুন রাষ্ট্রপতি হন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। বলা যেতে পারে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাস্তবতা বাদ দিলে তিনিই ছিলেন সংসদীয় ব্যবস্থায় বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি।
আমরা ভেবেছিলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং ১৯৭১ সালে লন্ডনে প্রবাসী বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধে সংগঠিত করার ভেতর দিয়ে বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী যে-মর্যাদা অর্জন করেছেন, সে-মর্যাদা রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবেন। সংসদীয় ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির নির্বাহী ক্ষমতা না থাকলেও তিনিই হচ্ছেন, রাষ্ট্রীয় মর্যাদার প্রতীক; রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তি। সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশ ভারতে স্বাধীনতার পর থেকে এই পদে সেদেশের প্রখ্যাত সব দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী প্রমুখ এ পদটিকে অলঙ্কৃত করেছেন। তারা নির্বাহী ক্ষমতাহীন রাষ্ট্রপতির পদটিকে ভারতের সম্মান, মর্যাদা ও সর্বজনের শ্রদ্ধার আসনে পরিণত করেছেন।
দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে তা হয়নি। ক্ষমতালোভী বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী যেমন মন্ত্রিসভার সদস্য হতে পেরে এ পদটিকে কালিমালিপ্ত করেছেন, তেমনি পরবর্তী রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদউল্লাহ ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ডের পর খুনি মোশতাকের অধীনে উপ-রাষ্ট্রপতি হয়ে বিশ্বাসঘাতকদের দোসর হিসেবে নিজেকে আত্মমর্যাদাহীন খল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি পদের মর্যাদাকে ধুলায় লুণ্ঠিত করেছিল বিএনপি-জামাত অপশক্তি। নিজেদের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে তারেক-খালেদা গোষ্ঠী অত্যন্ত অপমানজনকভাবে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে। শিখণ্ডী রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের ন্যক্কারজনক ভূমিকা এ পদটিকে জনগণের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছিল।
রাষ্ট্রপতি পদের এই সম্মান ও মর্যাদাহীন অবস্থার অবসান হয় প্রথমে প্রয়াত জিল্লুর রহমান ও পরে আবদুল হামিদের কার্যকালে। দুজনেই চেষ্টা করেছেন রাষ্ট্রের প্রতীক হিসেবে সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে। অতীতে দল করলেও রাষ্ট্রপতি পদে দায়িত্ব নেওয়ার পর তারা কোনো দলবাজি করেননি এবং মর্যাদাহানির কোনো অভিযোগও তাদের বিরুদ্ধে ছিল না। বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমেদকে আওয়ামী লীগই রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেছিল। তার কাছে দলীয় আচরণ প্রত্যাশিত ছিল না। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শাহাবুদ্দীন রাষ্ট্রপতি পদের দল নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হন। তা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের মনোনীত এই তিন রাষ্ট্রপতি মর্যাদার সাথেই তাদের দায়িত্ব পালন শেষে বিদায় নিতে পেরেছেন।
নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি নিঃসন্দেহে অতীত ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রাখবেন। জাতীয় পর্যায়ে তিনি কম পরিচিত বলে কেউ কেউ কটাক্ষ করার চেষ্টা করেন। তাদের জন্য বলি, ‘বৃক্ষ তোমার নাম কী? ফলে পরিচয়’Ñ প্রবাদটি। বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সাহাবুদ্দিন ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ডের পর তিন বছর কারাবন্দি ছিলেন, সামরিক শাসকদের দৈহিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আত্মপ্রচারবিমুখ সাহাবুদ্দিন তার কাজ দিয়ে, অধ্যবসায় দিয়ে রাষ্ট্রপতি পদের মর্যাদা কেবল অক্ষুণ্নই রাখবেন না; দেশবাসীর প্রত্যাশা- এ পদটিকে তিনি নতুন মর্যাদায় অভিষিক্ত করবেন। তিনি প্রমাণ করবেন, নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি কোনো দলের প্রতি নয়- একমাত্র দেশ, জনগণ ও সংবিধানের প্রতি অনুগত। আমরা তার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।
নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে অভিনন্দন
আরও পড়ুন