রাজিয়া সুলতানা: আধুনিক জীবন প্রাত্যহিকায় একটি বড় অংশজুড়ে জায়গা করে নিয়েছে ফল। শুধু দেশি ফল নয়; যেখানে ক্রমেই বড় অংশীদার হয়ে উঠছে বিদেশি ফল। স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ পরিপাটি জীবনযাপনের জন্য খাদ্য তালিকায় দৈহিক পুষ্টি নিশ্চিত করতে নিয়মিত বেছে নিচ্ছেন ফল। ফলের চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশের সাম্প্রতিককালে বাড়ছে এর আবাদ। অনেকেই বসতবাড়ির ছাদে, বারান্দা-ব্যালকোনি, আঙিনায়, রাস্তায় পাশে, খেলার মাঠে, জমির আইল, পুকুরপাড়, খোলা জায়গায় ফলের আবাদে মনোযোগী হচ্ছে। যেখানে দেশি আম, জাম, পেয়ারা, কলা, পেঁপে, কাঁঠালের পাশাপাশি সুবিধামতো স্থানে আমদানিনির্ভর বিদেশি ড্রাগন ফ্রুট, স্ট্রবেরি, নাশপতি, রাম্বুটান, আঙ্গুর, টকআতা, চেরি-মাল্টার আবাদও করছে। এই আবাদ প্রক্রিয়া এখন আর সৌখিন পর্যায়ে থাকছে না। অনেকেই এই আবাদ থেকে বাণিজ্যিক লাভও খুঁজে নিচ্ছে।
বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। আম-জাম-কাঁঠালের ‘মধু মাস’ খ্যাত বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসেই বেশি দেখা মিলে পেট রসায়নের এই ফল-ফলাদি। এ-সময়ে দেশীয় ফলের পসরা বসে হাটে-ঘাটে সর্বত্রই। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষকে বছরের বাকিটা সময় নির্ভর করতে হয় বিদেশি ফলের ওপর। তাই তো সরকার বিদেশিসহ দেশি ফলের বছরব্যাপী আবাদ নিশ্চিত করতে নিয়েছেন নানা উদ্যোগ। তবে এর মধ্যে স্বার্থকভাবে যেসব বিদেশি ফল আমাদের দেশে অভিযোজিত হচ্ছে, সেগুলো হলো- ড্রাগন ফ্রুট, স্ট্রবেরি, রাম্বুটান, অ্যাভোকেডো, কাজুবাদাম, আঙ্গুর, ম্যাঙ্গোস্টিন, নাশপতি, পার্সিমন, প্যাসন ফ্রুট, রুটিফল, লংগান, শানতোল, আলুবোখারা, টক আতা, জাবাটিকাবা, ক্যানটালোপ, রকমেলন, পাইনবেরি, চেরি, মাল্টা, থাই সফেদা, খাটো হাইব্রিড জাতের নারিকেল ইত্যাদি।
সরকারি তথ্যমতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে উৎপাদিত ফলের পরিমাণ ছিল ১২১ দশমিক ১৩ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ২ শতাংশই ছিল বিদেশি ফল। ইতোমধ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে ‘ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন’ শীর্ষক এক প্রকল্প গ্রহণ করেছে। ১৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৫ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্প শেষ হবে ২০২০ সালে। প্রকল্পের আওতায় এখন পর্যন্ত প্রায় দেড় লাখ কৃষককে বিদেশি ফল চাষে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
কৃষি বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, ২০২০ সাল থেকে এই প্রকল্প থেকে দারুণ ইতিবাচক ও সম্ভাবনাময় ফলাফল মিলবে। অন্যদিকে ‘সারাবছর ফল উৎপাদন’ শীর্ষক আরেকটি প্রকল্প চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এই প্রকল্প ২০২৬ সালে শেষ হবে।
বিদেশি ফল মানেই এক সময়ে ছিল আমদানিনির্ভর। ক্রমেই সে-অবস্থা কাটিয়ে উঠছে বাংলাদেশ। দেশেই এখন বিপুল পরিমাণ বিদেশি ফলের আবাদ হচ্ছে। স্বাদে একটু হেরফের হলেও পুষ্টিগুণসম্পন্ন বিদেশি ফল কম দামেই দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। ফলে বিদেশি ফল চাষ আলাদা গুরুত্ব পাচ্ছে অর্থনৈতিক দিক থেকেও।
ড্রাগন ফ্রুট : যে ফলটি আমাদের দানবাকৃতি ড্রাগনের কথা মনে করিয়ে দেয়, সেটি হচ্ছে ড্রাগন ফল। ড্রাগন ফলের (Hylocereus sp) উৎপত্তিস্থল সেন্ট্রাল আমেরিকা। বাংলাদেশে এই ফলের আগমন ২০০৭ সালে। ড্রাগন ফল এদেশের জলবায়ু ও মাটিতে দারুণভাবে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। চাষ হচ্ছে ৪টি জাত। বাউ ড্রাগন ফল-১; বাউ ড্রাগন ফল-২; বাউ ড্রাগন ফল-৩ ও বাউ ড্রাগন ফল-৪।
স্ট্রবেরি : শীতকাল মৃদুভাবাপন্ন ও গ্রীষ্মকাল শুষ্ক সেখানে স্ট্রবেরি ভালো জন্মে। তবে উষ্ণমণ্ডলীয় জাতের স্ট্রবেরি বাংলাদেশের আবহাওয়ায় সফলভাবে আবাদ করা হচ্ছে। স্ট্রবেরির ফল দেখতে কিছুটা লিচুর মতোই, কিন্তু আকারে ছোট। চাষ হচ্ছে স্ট্রবেরি-১, রাবি স্ট্রবেরি-২ ও রাবি স্ট্রবেরি-৩ নামে ৩টি জাত। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বারি স্ট্রবেরি-১ নামে একটি জাত এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টার থেকে বাউ স্ট্রবেরি-১ নামে একটি জাত নিবন্ধন করেছে। এই জাতগুলো দেশের বিভিন্ন এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হচ্ছে।
রাম্বুটান : দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি অন্যতম প্রধান ফল রাম্বুটান। একে অনেকে Hairy Litchi, আবার অনেকে Queen of Fruits বলে থাকেন। ফলটি দেখতে লিচুর মতোই। কিন্তু খোসার ওপর খয়েরি রঙের লম্বা লম্বা লোম থাকে। অত্যন্ত সুস্বাদু ও মুখরোচক রাম্বুটানের আদি জন্মস্থান মালয়দ্বীপ এবং থাইল্যান্ডে। শীতকালে মৃদু শীত অথবা প্রায় সারাবছরই উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু বিদ্যমান এমন স্থানে রাম্বুটান সবচেয়ে ভালো জন্মে। বাংলাদেশের জলবায়ুতে সার্থকভাবে রাম্বুটানের চাষ হচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টার থেকে বাউ রাম্বুটান-১ নামে একটি জাত চাষ করা হচ্ছে।
অ্যাভোকেডো : একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর ফলের নাম অ্যাভোকেডো। এই ফলটির বিশেষত্ব হচ্ছে এতে শর্করার পরিমাণ কম; অথচ তেলের পরিমাণ অনেক। তাই অনেকে একে মাখন ফল বলে থাকেন। পুষ্টি সমস্যা নিরসনে এই ফল উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। এই ফলে আছে কোলেস্টেরলমুক্ত ৮৮ শতাংশ চর্বি। মধ্য আমেরিকা অ্যাভোকেডোর আদি জন্মস্থান। বাংলাদেশে অ্যাভোকেডোর গাছ প্রথম প্রবর্তন হয় মধুপুরের জলছত্র মিশনের তৎকালীন একজন ফাদারের মাধ্যমে। বর্তমানে চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও অন্যান্য পার্বত্য এলাকায় সীমিত আকারে এর চাষ হচ্ছে।
কাজুবাদাম : দারুণ মুখরোচক কাজুবাদাম একটি ‘নাট’ জাতীয় ফল। অনেকে এটিকে ফল না বলে বাদাম বলতে পছন্দ করেন। বর্তমানে এই ফলটি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের উঁচু পাহাড়ি অঞ্চলে সীমিত আকারে উৎপাদিত হচ্ছে। দক্ষিণ আমেরিকা (ব্রাজিল) কাজুবাদামের আদি জন্মস্থান। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টার থেকে বাউ কাজুবাদাম-১ নামে একটি জাত নিবন্ধন করেছে। এছাড়া বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) ভালো জাত অবমুক্ত করার জন্য নিবিড়ভাবে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে।
আঙ্গুর : আঙ্গুর পৃথিবীর প্রাচীনতম ফল। বেশিরভাগ মদ তৈরি করা হয় আঙ্গুর থেকে। আঙ্গুর ফল সবার কাছেই সুপরিচিত এবং সমাদৃত। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে এ-যাবত ৩টি উৎপাদনশীল আঙ্গুর গাছের জাত নির্বাচন করা হয়েছে। এইগুলো হচ্ছে- জাককাউ, ব্ল্যাক রুবি ও ব্ল্যাক পার্ল। ৩টি জাতই গ্রীষ্মকালীন। এগুলো জাতভেদে হালকা বাদামি, কালো ও করমচা রং ধারণ করে। ফলন আসতে সময় লাগে প্রায় দু-বছর। মিষ্টতার পরিমাণ ১৮ থেকে ২০ শতাংশ। বর্তমানে নওগাঁ জেলায় বাণিজ্যিকভিত্তিতে আঙ্গুর চাষ শুরু হয়েছে। পৃথিবীর অনেক উষ্ণমণ্ডলীয় দেশেই উৎকৃষ্টমানের আঙ্গুর উৎপন্ন হচ্ছে। সেদিক থেকে বাংলাদেশে উৎকৃষ্টমানের আঙ্গুর চাষের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে।
ম্যাঙ্গোস্টিন : স্বাদে ও গন্ধে অতুলনীয় ম্যাঙ্গোস্টিনের আদি জন্মস্থান হচ্ছে মালয়েশিয়া। বাংলাদেশে সাফলভাবে এর চাষ করা সম্ভব। সুনিষ্কাশিত গভীর দোঁআশ মাটি এর জন্য সবচেয়ে উপযোগী। তবে যে কোনো মাটিতেই ম্যাঙ্গোস্টিন চাষ করা যায়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টার এর চাষ শুরু করেছে। শীতের শেষে ফুল ফোটে ও বর্ষাকালে ফল পাকে। ফল গোলাকার, দেখতে দেশি গাবের মতো। পাকা ফলে সাদা রসালো কোয়া থাকে এবং সহজেই ফল থেকে খোসা ছাড়ানো যায়।
নাশপতি : শীতপ্রধান জলবায়ুর ফল নাশপতি। সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চলে অতি সীমিত আকারে নাশপতির চাষ শুরু হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে পরীক্ষামূলকভাবে নাশপতি জন্মানো সম্ভব হয়েছে। তবে ফলের মান খুব সন্তোষজনক হয়নি। সিলেটে যে জাতের চাষ হয় তা P. khasiana প্রজাতির, ইহা অনেকটা বুনো ধরনের, ফল নাশপতি আকৃতির।
পার্সিমন : জাপানের দক্ষিণাঞ্চল ও চীন পার্সিমন বাংলাদেশে এখনও প্রচলিত হয়নি। তবে চাষ হচ্ছে নিরীক্ষামূলকভাবে। জাপানের অন্যতম এই ফল এদেশের গাব একই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। পার্সিমনের গাছ পত্রমোচক মাঝারি আকারের বৃক্ষ, ফল দেখতে টমেটোর মতো, পাকা অবস্থায় হলুদ বা কমলা, ফুলের বৃত্তি স্থায়ীভাবে ফলের সাথে সংযুক্ত থাকে। সব জাতেই বিশেষ ধরনের আবহাওয়ায় বীজহীন ফল উৎপাদন করে। বাংলাদেশে জুলাই-সেপ্টেম্বরে ফল পাকে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টারে ৩টি বড় গাছ আছে, যা ২০১০ সাল থেকে ফল দিচ্ছে। দেশের অন্যান্য জেলায় গবেষণামূলকভাবে পার্সিমন ফলের চাষ হচ্ছে।
প্যাশন ফল : শরবত তৈরিতে ব্যবহার হয় প্যাশন ফল। গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের অনেক জায়গায় এখন শৌখিন ফলচাষিরা টবে, বাড়িতে এই ফলের আবাদ করছে। পাশাপাশি নার্সারির মালিকরা সীমিত আকারে প্যাশন ফলের চাষ করছেন। প্যাশন ফলের শরবতের স্বাদ ‘ট্যাং’ ড্রিংকসের মতো। সেজন্য প্যাশন ফল এদেশে ধীরে ধীরে ‘ট্যাং ফল’ অর্থাৎ শরবতি ফল নামে পরিচিতি লাভ করছে। এই ফলের উৎপত্তি দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন অঞ্চলে। বিশেষ করে ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে ও উত্তর আর্জেন্টিনাতে এর ফলের আদি নিবাস বলে ধারণা করা হয়। ফলটি দেখতে অনেকটা আপেলের মতো গোলাকার। লম্বা বোঁটাতে ফলগুলো ঝুলতে থাকে। যখন পাকতে শুরু করে তখন ফলের গায়ের রং হলুদ বর্ণ ধারণ করে। কাঁচা অবস্থায় সবুজ দেখায়। গাছ লতা-জাতীয়। মাচার ওপর অথবা অন্য কোনো অবলম্বনকে আঁকড়ে ধরে গাছটি বেড়ে ওঠে।
ব্রেড ফ্রুট : বিদেশি এই ফলের বাংলা নাম দেওয়া হয়েছে রুটি ফল। আঠারো শতকের শেষ দিকে ব্রিটিশ নাবিকরা দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের তাহিতি দ্বীপ থেকে ব্রেড ফলকে এ উপমহাদেশে নিয়ে আসেন। এখনও বেশ কিছু দেশে রুটি ফল প্রধান খাদ্য। ১৯৮২ সালে শ্রীলংকার কৃষিমন্ত্রী শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে রুটি ফলের কয়েকটি চারা এদেশে নিয়ে আসেন। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট চত্বরে সেগুলো লাগানো হয়েছিল। এখন সেসব গাছে ফল ধরছে। রুটি ফলের আর একটি বড় গাছ আছে আসাদগেট হর্টিকালচার সেন্টারে। সেই গাছেও নিয়মিত ফল ধরেছে। কুমিল্লার কোর্টবাড়িতে অবস্থিত বার্ড এই ব্রেড ফ্রুট ফল পাওয়া যায়। রুটি ফলের গাছ বড় বৃক্ষ, ফলের ব্যাস ১০-৩০ সেন্টিমিটার। ফলের গায়ে কাঁঠালের মতো কাঁটা কাঁটা আছে। ফল বীজবিহীন ও বীজধারী- দুই রকমই আছে।
লংগান : এই ফল লিচুর সহোদর। লিচু যখন ফুরিয়ে যায় তখন তার তেষ্টা মেটায়। বিভিন্ন দেশে ফলটি রপ্তানি করেও বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। থাইল্যান্ড, ভারত, মালয়েশিয়া, চীন ও সম্প্রতি তাইওয়ানে লংগানের চাষ হচ্ছে। ভারত আর বাংলাদেশে এটি ‘আঁশফল’ হিসেবে সমাদৃত। বাংলাদেশের কোনো কোনো এলাকায় এর নাম কাঠলিচু। বরিশালে এর নাম নাড়িয়া লিচু। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টার থেকে বাউ লংগান-১ এবং বাউ লংগান-২ নামে দুটি জাত নিবন্ধন করেছে।
শানতোল : শানতোল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি পরিচিত ফল। কেউ কেউ এটি বুনো ম্যাংগোস্টিন বলেও ডাকেন। বাংলাদেশে এই ফলের চাষ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টারে ও হর্টিকালচার সেন্টার, কল্যাণপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের খামারে বেশ কয়েকটি শানতোলের গাছে সফলভাবে ফল ধরছে। দেশের অন্যান্য স্থানেও চাষ সম্ভব। শানতোল ফলের আলাদা একটা সুগন্ধ আছে, যা প্রথমেই যে কোনো ক্রেতাকে আকৃষ্ট করতে পারে। শানতোলের শাঁস সিরাপে সংরক্ষণ করা যায়, জ্যাম বিদেশে রপ্তানিও করা যেতে পারে। এ হিসেবে শানতোল ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পও গড়ে উঠতে পারে।
আলুবোখরা : আলুবোখরা যা পিচ ও চেরি ফলের নিকটাত্মীয়। আলুবোখরা আদি জন্মস্থান উত্তর আমেরিকা ও জাপান। বড় গাছ ঠাণ্ডা সইতে পারে। গ্রীষ্মকালে ফল পাকে। আলু বোখরার গাছ বড় হতে একটু সময় নেয়। একটু বেশি বয়স না হলে গাছে ফল ধরে না। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টার ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে (বারি) এর ওপর গবেষণা চালাচ্ছে। কিছু ব্যক্তিগত নার্সারিতে এবং ব্যক্তি উদ্যোগে এই ফলের গাছ সংগ্রহ করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এর চাষাবাদের চেষ্টা চলছে।
টক আতা : টক আতা দেখতে মোটেই আতা বা শরিফার মতো নয়। গায়ে গোটা গোটা দাগ নেই, আছে ফলের গা ভর্তি ক্ষুদে ক্ষুদে কাঁটা। পাকলে কাঁটা অনেকটাই মিলিয়ে যায়। ফলটি সারাবিশ্বেই কম-বেশি পরিচিত। এই ফল শাঁস সুগন্ধযুক্ত ও টক স্বাদের। শাঁস প্রচুর ভিটামিন-সমৃদ্ধ। এদেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় তথা বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে টক আতার গাছ আছে। কেউ চাষ করে না, জঙ্গলে হয়। টক আতার আদি বাসভূমি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টার ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে (বারি) এর ওপর গবেষণা চালাচ্ছে।
জাবটিকাবা : জাবটিকাবার আদি নিবাস ব্রাজিল। ১৯৫৬ সালে কল্যাণপুর ছিল বিএডিসি ফার্মের কোয়ার্টার সংলগ্ন এলাকায় পথের ধারে ৩টি জাবটিকাবার চারা রোপণ করা হয়। এখন কল্যাণপুর হর্টিকালচার সেন্টারেই নয়, জাবাটিকাবার গাছ ফল দিচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের জার্মপ্লাজম সেন্টারে, কল্যাণপুর হর্টিকালচার সেন্টারের ফলবাগান ও দেশে আরও অনেক সৌখিন ফলপ্রেমীর বাগানে।
ক্যান্টালোপ : ক্যান্টালোপ প্রজাতির মেলন জাতীয় ফলগুলো বাঙ্গির মতো দেখতে হলেও বেজায় মিষ্টি। বাঙ্গির বাজারজাতকরণের সবচেয়ে বড় সমস্যা ফেটে যাওয়া। তবে ক্যান্টালোপ প্রজাতির ফলগুলো যতই পেকে যাক, তা ফাটে না। আর পুষ্টিগুণের দিক থেকেও অনেক উপকারী একটি ফল। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত বারো মাসই এই ফলগুলো চাষাবাদ করা যায়। মাত্র ৫৫ দিনে ফসল পাওয়া যায়। ফল সাশ্রয়ী এবং লাভজনক।
রক মেলন : রক মেলন অন্যতম সতেজ একটি রসালো ফল। প্রধানত তাইওয়ান ও ভারতে এই ফলের উৎপাদন হয়। মধ্যপ্রাচ্যে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশেও ধীরে ধীরে পরিচিতি বাড়ছে। বাণিজ্যিকভাবে রক মেলন চাষ হচ্ছে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে।
পাইনবেরি : পাইনবেরি শুধু দেখতেই নান্দনিক নয় এটি স্বাদেও অতুলনীয়। পাইনবেরি দেখতে পুরোপুরি স্ট্রবেরির মতোই, গায়ের রং শুধু সাদা হয়। এর স্বাদ আবার পাইন অ্যাপেলের মতো। স্বাদ ও চেহারা দুটি ফল থেকে ধার করায় এর নাম হয়েছে পাইনবেরি।
চেরি : চেরি হলো ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল। এই ফল শীতপ্রধান দেশের। সম্প্রতি হিউস্টন, ইউএসএ থেকে সংগৃহীত একটি চেরি জার্মপ্লাজম উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। এর বৃদ্ধি, ফলন এবং গুণগত মান ভালো। এটি বছরজুড়ে ফল দেয়। শিগগিরই দেশে চাষের জন্য জাত হিসেবে মুক্ত করা হবে।
মাল্টা : পাঁচ-সাত বছর ধরে মাল্টা চাষ দেশে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। বারি অবমুক্ত করা মাল্টা ফলের গায়ের রং সবুজ। এজন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর অস্ট্রেলিয়া থেকে উন্নত জাত এনে চাষের উদ্যোগ নিয়েছে।
থাই সফেদা : থাই সফেদা খুবই উন্নতমানের। এসেছে থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম থেকে। এই ফলে বীজ কম, খাওয়ার উপযোগী অংশ বেশি। সফেদা রোপণের পরের বছর থেকেই ফল দেওয়া শুরু হয়। এই ফল সম্প্রসারণে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের কয়েকটি অঞ্চলে পরীক্ষামূলকভাবে চাষ হচ্ছে।
নারিকেল : খাটো ও হাইব্রিড জাতের নারিকেল- বাংলাদেশের প্রচলিত নারিকেলের তুলনায় ফলনও অনেক বেশি। বিশ্বের সব উপকূলীয় দেশে এখন খাটো এবং হাইব্রিড জাতের নারিকেল চাষ হচ্ছে। খাটো ও হাইব্রিড জাতের নারিকেল চাষের সুফল পাওয়ার জন্য দুই বছর ধরে ভিয়েতনামি দুটি খাটো জাত এবং ভারতের একটি উন্নত হাইব্রিড জাতের নারিকেল চারা আমদানি করে, তা সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
আরবি খেজুর : আরবি খেজুরের সাথে আমরা সবাই পরিচিত। এতদিন ছিল আমদানিনির্ভর। উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে দেশেই চাষাবাদের। এ উদ্দেশ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সরকারিভাবে এই প্রথম আরব দেশ থেকে উন্নত জাতের খেজুর কলম আমদানি করে বিভিন্ন জেলার হর্টিকালচার সেন্টারগুলোতে এবং চাষি পর্যায়ে বাগান সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছে।
অপ্রচলিত কিন্তু দারুণ পুষ্টিগুণসম্পন্ন এবং সুস্বাদু বিদেশি এই ফলের বাজার ক্রমেই সম্প্রসারিত হচ্ছে। স্বল্প জমিতেই এসব ফলের আবাদ সম্ভব এবং লাভজনকও। ফলে প্রান্তিক পর্যায়ের অনেক চাষিই গতানুগতিক ফসলের পরিবর্তে পরিকল্পিত প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিদেশি ফলের আবাদে আগ্রহী হয়ে উঠছে। এসব ফল চাষে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ থাকায় শিক্ষিত বেকার যুবককরাও উদ্যোগী হয়ে উঠছে বিদেশি ফল চাষে। যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করছে।
লেখক : শিক্ষক; পিএইচডি গবেষক, প্ল্যান্ট প্যাথলজি, শেরে বাংলা কৃষি ইউনিভার্সিটি
raziasultana.sau52@gmail.com