সড়ক ও জনপদ ৪০০ কোটি টাকার একটি বড় প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এই প্রকল্প সড়ক উন্নয়নে ব্যয় হবে ২৯৫ কোটি টাকা। এটি বাস্তবায়ন হওয়ার পর ঢাকা থেকে কক্সবাজার দূরত্ব কমবে ৫০ কিলোমিটার আর কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব কমবে ১৫ কিলোমিটার।
ড. মাসুদা সিদ্দিক রোজী: একসময় যা ছিল স্বপ্ন আজ তা বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। শুধু দেশের মধ্যে নয়, দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেল হচ্ছে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে। বাংলাদেশের যে ক’টি বড় প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে এর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রকল্প হচ্ছে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী টানেল।
কর্ণফুলী নদীর মোহনায় তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশের একমাত্র টানেল। নির্মাণাধীন কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেলের মধ্য দিয়ে যুক্ত হচ্ছে নদীর উভয় পাড়। অর্থাৎ চট্টগ্রামের পতেঙ্গা পয়েন্ট ও আনোয়ারা পয়েন্ট। এর মাধ্যমে বন্দর নগরী চট্টগ্রাম হবে ওয়ান সিটি টু টাউন। দেশজুড়ে চলমান মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে সাপেবর বঙ্গবন্ধু টানেল প্রতিষ্ঠার কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর তা ঐতিহাসিক একটি ঘটনায় পরিণত হবে। করোনার সময়ও একদিনের জন্য টানেল নির্মাণের কাজ থামেনি। তবে করোনার কারণে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ ও প্রকৌশলী এবং শ্রমিক-কর্মচারীদের কেউ বিভিন্ন সময় কাজে যোগ দিতে না পারলেও এখন কাজ চলছে সারাদেশে। প্রায় ১০,০০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হতে চলেছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা পয়েন্ট থেকে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে আনোয়ারা পর্যন্ত একটি টিউবের বোরিং ও রিং প্রতিষ্ঠানের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
গত ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ নাগাদ টানেলের মাধ্যমে অন্যটিও প্রতিস্থাপনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এ প্রক্রিয়া অনুযায়ী এ-বছরের ডিসেম্বরে এই টানেল নির্মাণকাজ সম্পন্ন হবে।
চট্টগ্রামের পতেঙ্গা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের বাম পাশে কর্ণফুলী নদীর মোহনা সংলগ্ন এলাকায় টানেলের মুখ রাখা হয়েছে। মূল কাঠামো ২,৪৫০ মিটার দীর্ঘ টানেলের বেজ ১১.৮ মিটার, অন্যদিকে মূল টানেলের সাথে উভয় প্রান্ত ৫.৩৬ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক হবে। চার-লেনের টানেলের একেকটি টিউব ১০.৮ মিটার বা ৩৫ ফুট চওড়া, উচ্চতা ৪.৮ মিটার বা ২৬ ফুট। এই টানেল শুধু বাংলাদেশে প্রথম নয়, দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম সুড়ঙ্গ পথও বটে। টানেল নির্মাণ উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের একটি লাইন উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিলেন, ‘কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ তিনি বলেছিলেন, ২০৪১ সালে বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্নত সমৃদ্ধ দেশ। বাংলাদেশ যে উন্নয়নের রোল মডেল, তা দেশে চলমান মেগা প্রকল্পগুলোই প্রমাণ দিচ্ছে। সাংহাই টানেলের আদলে ওয়ান সিটি টু টাউন, চট্টগ্রাম কর্ণফুলী নদীর তলদেশ, অর্থাৎ ভূমি থেকে ১৮ থেকে ৩১ মিটার গভীরতায় টানেল নির্মাণকাজ চলছে।
২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর এই মেগা প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানেলের মূল খননকাজ উদ্বোধন করেন। নির্মাণকাজে জড়িত রয়েছে চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি ও চায়না রোডের ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। এছাড়া প্রজেক্ট ডিরেক্টরসহ কিছু বাংলাদেশি প্রকৌশলী ও এই কর্মযজ্ঞে জড়িত আছেন। টানেল নির্মাণের সব উপকরণ এবং প্রয়োজনীয় নকশা আসে চীন থেকে। ইতোমধ্যে টানেলের ৮৮ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এই প্রকল্পে বিশেষজ্ঞসহ ২১৯ চীনা নাগরিক কাজ করছেন এবং দেশীয় কর্মকর্তা ও শ্রমিক নিয়োজিত আছেন প্রায় ৫১২ জন। বর্তমান সরকারের আমলে একের পর এক মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব টানেল বিশেষ আকর্ষণীয়। দীর্ঘদিনের লালিত এই স্বপ্ন এখন বাস্তবায়নের পথে। মেগা প্রকল্পের যে ব্যয় ধরা হয়েছিল, তা এখন কিছুটা বেড়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তবে তা খুব বেশি নয়। এই প্রকল্পের অর্থ ব্যয় এই ঋণ হিসাবে চীনের এক্সিম ব্যাংক দিচ্ছে ৫,৯১৩ কোটি টাকা। অবশিষ্ট অর্থ জোগান হবে বাংলাদেশ সরকারের তহবিল থেকে।
নির্মাণ প্রক্রিয়া
বঙ্গবন্ধু টানেলের নির্মাণকাজ শেষ হবে ডিসেম্বরে। চীনের সাংহাই শহরের আদলে বন্দর নগরী চট্টগ্রামকে ওয়ান সিটি টু টাউনমডেলে গড়ে তুলতে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ করছে সরকার। দেশের প্রথম এই সুড়ঙ্গ টানেলের নামকরণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। শহরের দুই প্রান্তকে এখন একত্রিত করবে এই টানেল। এ বছরের ডিসেম্বরে শেষ হবে নির্মাণকাজ।
এ টানেলের দুই টিউবে খননকাজ ইতোপূর্বে সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এখন চলছে টানেল অভ্যন্তরে দুই টিউবের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের ক্রস প্যাসেজের কাজ। এ ধরনের প্যাসেজ হবে ৩টি। দুটির কাজ সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছে। বাকিটি হবে এরপরে। প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, এর পাশাপাশি প্রথম টিউবের পর দ্বিতীয় টিউবে সøাব স্থাপন কাজও সমানতালে এগিয়ে চলেছে। টানেলের সিভিল ওয়ার্ক শেষ হওয়ার পর ইলেক্টিফিকেশনের কাজ শুরু করা হবে বলে জানানো হয়েছে। অন্যদিকে, টানেলের পতেঙ্গা অংশে সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজও এগিয়ে চলছে। অনুরূপভাবে দক্ষিণ পাড়ে অর্থাৎ আনোয়ারা অংশে সংযোগ সড়কের নির্মাণ এগিয়ে নিচ্ছে সড়ক ও জনপথ এবং সেতু বিভাগ। প্রকল্প পরিচালক আবারও নিশ্চিত করেছেন, উচ্চমাত্রার ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে কোনোভাবেই টানেল অভ্যন্তরে সমুদ্রের লোনা পানি যাতে ঢুকতে না পারে সে-লক্ষ্য নিয়ে চউকের উদ্যোগে ইতোমধ্যে নির্মিত হয়েছে সিটি আউটার রিং রোড। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩০ ফুট উচ্চতায় এই রিং রোড নির্মিত হয়েছে এবং পতেঙ্গার শেষ অংশে নেভাল পয়েন্ট থেকে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে টানেলকে রক্ষার জন্য রিভাইসড (ডিপিপি) করা হয়েছে। কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ে আনোয়ারা। উত্তরে চট্টগ্রামের পতেঙ্গার অবস্থান। পাশেই শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এর পাশ দিয়েই নির্মিত হয়েছে সিটি আউটার রিং রোড, যা ফৌজদারহাট পর্যন্ত বিস্তৃত। অন্যদিকে, দক্ষিণ পাড়ে অর্থাৎ আনোয়ারা অংশে ছয়-লেনের ১১ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক কাজও পুরোদমে এগিয়ে চলেছে।
সর্বশেষ আপডেট
জিংজুয়া প্রদেশের জিংজুয়া শহরে এই টানেলের জন্য প্রস্তুত করা সেগমেন্ট নিয়ে আসার পর তা নির্মাণকাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। নদীর তলদেশ বোরিংয়ের পর একটি সেগমেন্টের ২ মিটার একটি রিং তৈরি করে তা প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে প্রতিদিন গড়ে ৪-৫ মিটার পর্যন্ত বোরিং কাজ চলছে। একই প্রক্রিয়ায় পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারা পয়েন্ট পর্যন্ত টিউবের কাজ চলছে। এভাবে পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারা পয়েন্ট পর্যন্ত টিউবের প্রথম কাজ, অর্থাৎ চ্যানেলের বাম লাইনের বোরিংয়ের সাথে রিং প্রতিস্থাপনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে গত আগস্ট মাসে। এর ফলে টানেলের পূর্ব ও পশ্চিম দিক সংযুক্ত হয়েছে। পতেঙ্গা হয়ে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ হয়ে আনোয়ারা অংশের কাফকু কর্ণফুলী ফাটি লাইজার কোম্পানি (সিইউএফএল) চিটাগং ইউরিয়া ফাটিলাইজার লিমিটেডের মাঝামাঝি স্থান দিয়ে মুখ হয়েছে। এখন ইউ টার্ন হয়ে আবার পতেঙ্গা পয়েন্টে চলে আসবে নির্মাণকাজ। প্রকল্পের সূত্রে জানা গেছে, ৯৪ মিটার দীর্ঘ ২২ টন ওজনের টানেল বোরিং মেশিন সংক্ষেপে যাকে বলা হয় টিবিএম, এই টিবিএম-এর শেষ অংশ অর্থাৎ লেজ পর্যন্ত ইউ টার্ন-এর কাজে ব্যবহৃত হতে নভেম্বর পর্যন্ত গড়িয়ে যাবে। এরপর শুরু হবে দ্বিতীয় টিউবের কর্মযজ্ঞ। এভাবে কাজ এগিয়ে গেলে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে টার্গেট অনুযায়ী শেষ হতে পারে স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু টানেলের নির্মাণকাজ।
এদিকে স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু টানেল নিয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে। শিকলবাহা ওয়াই জংশন থেকে আনোয়ারা পর্যন্ত প্রায় ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কের মাধ্যমে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক নেটওয়ার্ক যুক্ত হবে। সড়ক ও জনপদ ৪০০ কোটি টাকার একটি বড় প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এই প্রকল্প সড়ক উন্নয়নে ব্যয় হবে ২৯৫ কোটি টাকা। এটি বাস্তবায়ন হওয়ার পর ঢাকা থেকে কক্সবাজার দূরত্ব কমবে ৫০ কিলোমিটার আর কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব কমবে ১৫ কিলোমিটার।
লেখক : প্রকৌশলী