শেখর দত্ত: দুর্নীতিবিরোধী অভিযান
“যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি-
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।”
আওয়ামী লীগ সভাপতি, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু-কন্যা যখন দুর্নীতি, মাদক, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়ে নিজ দলের অঙ্গসংগঠন প্রথমে ছাত্রলীগ ও পরে যুবলীগের ওপর প্রয়োগ করে চলেছেন, তখন তরুণ বিপ্লবী কবি সুকান্ত লিখিত এবং বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের শেষে প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার ‘প্রত্যয় ও প্রতিশ্রুতি’ হিসেবে সংযোজিত উল্লিখিত কবিতার লাইনগুলো কেবলই মনে পড়ছে। প্রসংগত বলি, কেমন করে যেন বিগত নির্বাচনের আগে দলের প্রান্তস্থিত অবস্থানে থাকা একজন কর্মী হিসেবে নির্বাচনী ইশতেহার লেখার কাজের সাথে যুক্ত হয়ে গেলাম। ইশতেহার সম্পর্কে সভানেত্রীর চিন্তা ও প্রণয়ন কমিটির আলোচনার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান ও কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাকের সাথে বসে ইশতেহারের খসড়া প্রস্তুত করে দেওয়া হলো নেত্রীর কাছে। খসড়া সম্পর্কে কি বলেন, কি নির্দেশ দেন তা নিয়ে টেনশনের ভেতর থাকাটাই ছিল স্বাভাবিক। নির্বাচনের ব্যাপক ব্যস্ততার মধ্যে অন্তত আমাকে অবাক করে দিয়ে দ্রুতই তিনি খসড়া দেখে দিলেন। রাজ্জাক ভাই হাস্যোজ্জ্বল মুখে প্যাকেট থেকে সংশোধিত ও সংযোজিত খসড়াটা বের করলেন। পাতার পর পাতা উল্টানো হচ্ছে আর আমি বিস্মিত হচ্ছি। এত ব্যস্ততার মধ্যে এত দ্রুত এত খুঁটিনাটি বিষয়েও সংশোধন সংযোজন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেখে দিয়েছেন কীভাবে!
সংশোধিত খসড়ার শেষ পাতায় এসে বিস্ময়ের মাত্রা হিমালয়সম উঁচুতে পৌঁছাল। প্রিয় কবি সুকান্তের উল্লিখিত কবিতাংশটি ইশতেহারের শেষে সংযোজন করার নির্দেশ রয়েছে। প্রচণ্ড আবেগে চোখ সজল হয়ে উঠেছিল। পুরোটা দেখার পর স্বাভাবিকভাবেই ভাবনায় এলো, দেশের বর্তমান বাস্তবতায় দেশের জন্য সরকার কি করছে সে-সম্পর্কে তিনি যেমন সুস্পষ্ট ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অবগত, ঠিক তেমনি দেশের উন্নতি ও জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনে ইস্পিত লক্ষ্য বাস্তবায়নে কি করতে হবে সে-সম্পর্কেও তিনি দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসা এবং কাজে পরিপূর্ণভাবে নিমজ্জিত থাকলেই কেবল কোনো সরকারপ্রধান রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনার এতসব বিষয় নখদর্পণে রাখতে পারেন।
একই ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছিল ২০০৮ সালে নির্বাচনের আগে ইশতেহার লেখার প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকার সময়ে। সেবারও ‘দিনবদলের কর্মসূচি’তে তার নিজ হাতে করা সংশোধন ও সংযোজন দেখে অবাক হতে হতে শেষ পাতায় এসে সেই একইভাবে বিস্মিত হলাম। উপস্থিত আমরা সবাই আবেগে আপ্লুত। সভানেত্রী নিজ হাতে একটা চিরকুটে লিখে দিয়েছেন ‘নতুন প্রজন্মের যে তরুণ-তরুণীরা এবার প্রথম ভোটার হয়েছেন তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্মাণের লক্ষ্যে প্রণীত ভিশন-২০২১ আমরা তাদেরই উৎসর্গ করছি।… অপার সম্ভাবনাময় নতুন প্রজন্মের ভোটার তথা তরুণ-তরুণীদের শ্রম, মেধা, জ্ঞান ও মননকে আমরা কাজে লাগাতে চাই।’
২০২১ সাল সামনে। বাঙালি জাতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের দ্বারপ্রান্তে। ২০০৮ সালের তরুণ-তরুণীরা ইতোমধ্যে ১১ বছর অতিক্রম করেছে। আরও আরও নতুন প্রজন্ম কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে। গত ২৭ সেপ্টেম্বর পত্রিকায় দেখলাম লোটে প্যালেস নিউইয়র্ক হোটেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন মাইক্রোসফটের কর্ণধার বিল গেটস। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়, অটিজম অব বাংলাদেশের চেয়ারপারসন সায়েমা ওয়াজেদ হোসেন পুতুল ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন তখন উপস্থিত ছিলেন। বিল গেটস বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রগতির ব্যাপক প্রশংসা করেছেন এবং শিক্ষা স্বাস্থ্য প্রভৃতি খাতে ‘বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন’-এর পক্ষ থেকে বাংলাদেশে অর্থ সাহায্য বৃদ্ধি করতে সম্মত হয়েছেন। এমনি এমনি আকস্মিকভাবে বিল গেটস প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করেন নি।
গত বছর ২০১৮ সালের মাঝামাঝি কমনওয়েলথ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ফর সফটওয়ার অ্যান্ড ইনফরমেশন-এর সাবেক সভাপতি, ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহবুব জামানের কাছ থেকে শুনছিলাম, ওই সম্মেলনের এক সেমিনারে মূল বক্তা বিল গেটস-এর বক্তৃতার বিষয়বস্তু। তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ প্রতিভাবান তরুণদের দেশ।’ এই দেশ ‘গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন ও মহিলা ক্ষমতায়নে’ উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। এই নিবন্ধটি যখন লিখছি তখন দেখলাম, ফেসবুক খ্যাত জুকারবার্গ ‘মেনিনজাইটিস প্রাদুর্ভাবের কারণ খুঁজতে আইডিসেক নামের টুল ব্যবহার করার’ জন্য বাংলাদেশের সফটওয়ার গবেষকদের প্রশংসা করেছেন। আজ থেকে ১১ বছর আগে তরুণ প্রজন্মের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ সম্পর্কে যে ওয়াদা করেছিলেন, তা বাস্তবায়নের পথে আছে বলেই বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে বিল গেটস ও মাইকেল জুকারবার্গ বাংলাদেশের তরুণদের এমন প্রশংসা করেছেন।
প্রকৃত অর্থেই যথাযথ পরিকল্পনায় ডিজিটাল ক্ষেত্রে উন্নয়নের ধারায় নতুন আলোকোজ্জ্বল এক বাংলাদেশ গড়ে উঠছে। তরুণ-তরুণীরা এতে নেতৃত্ব দিচ্ছে। কিন্তু এটাই চির সত্য যে, আলোর সাথেই থাকে অন্ধকার। একটা অপরটাকে প্রতিনিয়ত পদানত করতে চায়। নতুবা তরুণ ও যুব সমাজের একটা অংশ অন্ধকার অবৈধ পথে যাবে কেন? ক্যাসিনোর পথ অন্ধকারের পথ। এই জুয়া চ‚ড়ামণির অনুষঙ্গ অন্ধকার জগৎ মাদক, অবৈধ ব্যবসা-টেন্ডার, যৌন অপরাধ সন্ত্রাস প্রভৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ঢাকায় ক্যাসিনো হচ্ছে এমন খবর বেশ কিছুকাল আগে পত্রিকায় উঠেছে। কিন্তু ধারাবাহিকভাবে যেমন প্রচার হয়নি, তেমনি তা নিয়ে উচ্চবাচ্য হয়নি। সরকার-বিরোধী কত কথা হয়। কিন্তু এই সুনির্দিষ্ট বিষয়টাকে কেউ ইস্যু করল না কেন? সুনির্দিষ্ট বিষয়ে এই নিবন্ধের লেখকও তো কিছুই লিখিনি। প্রধানমন্ত্রী যখন ক্যাসিনো উৎখাত করতে যাচ্ছেন, তখনই আমরা উচ্চকণ্ঠ হচ্ছি। নানা দিক থেকে সমালোচনা ও সংশয় প্রকাশ করছি। এদিক-ওদিক কত কিছু বলছি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ভালো কোনো কাজের পক্ষে দাঁড়াতে, প্রশংসা করতে আমরা ভুলে যাচ্ছি। ‘হাওয়া ভবন’, ‘খোয়াব ভবন’ কেলেঙ্কারি অবসান থেকে ক্যাসিনো-বিরোধী ধাক্কার পর কতটা সোপান অতিক্রম করতে সক্ষম হব, তা যেন হিসাবে নিতে পারছি না।
প্রসংগত বলি, পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর ঢাকার গোপীবাগ রামকৃষ্ণ মিশন রোডে থাকতাম। বেশ রাতে যখন বাসায় ফিরতাম, তখন দেখতাম বাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবে হাউজি নামের জুয়ার খেলা চলত। প্রচÐ ভিড় সেখানে। বঙ্গবন্ধু জুয়া বেআইনি করেছিলেন। কিন্তু জুয়া চলছে তখন থেকেই। কিছুদিন আগে ভ্রমণে একটি দলের সাথে খুলনা থেকে জাহাজে সুন্দরবন বেড়াতে গিয়েছিলাম। জাহাজে আনন্দ করতে রাতে অনুষ্ঠিত হলো হাউজি খেলা। নামাজি নারী-পুরুষ থেকে শুরু করে ছোট ছোট বাচ্চা সবাই বসে গেছে সিট নিয়ে। হংস মধ্যে বক হয়ে থাকাটা বেমানান। একেবারেই আনাড়ি আমরা, তবুও বসে গেলাম সেখানে। বেশ কিছুক্ষণ খেলার পর শিখেও নিলাম। গা সাওয়া তো আর এমনি এমনি হয়নি। পরিবেশে এমনটাই হয়ে গেছে। এত কথা এখন হচ্ছে। কিন্তু কেন আগে এ নিয়ে সোচ্চার কেউ হলো না। অপরাধী নয় কি সমাজের উচ্চাসনের আমি আপনি কম-বেশি সবাই! বলাই বাহুল্য হাউজি জুয়ার হাত ধরেই ক্লাবে ক্লাবে ক্যাসিনো জুয়া এসেছে।
বাস্তবে দেশব্যাপী পরিব্যাপ্ত অন্ধকার জগৎ সম্পর্কে নিবন্ধের লেখক তেমন জানে না। প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে ক্যাসিনো সম্রাটদের ধরপাড়ক যখন শুরু হয়, তখন সংবাদমাধ্যম দেখে পরে কিছু বিষয় জানলাম। ক্যাসিনোর স্থানে রয়েছে সাপের ছবি আর টেবিলে রয়েছে কষ্টিপাথর। খেলার শুরুতে কষ্টিপাথর ছোঁয়ানো হয় না-কি সাপের মাথায়! সাপ অন্ধকারের জীব, সাপকে নিয়ে আছে রহস্যময়তা, সাপের রয়েছে বিষ। সেই সাপ রাষ্ট্র ও সমাজ-জীবনকে বিষে জর্জরিত করছে। সাপের বিষ রাজনীতি ও সমাজের উচ্চাসনে বসা একটি ক্ষুদ্র অংশের মধ্যে ষড়রিপুÑ কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্যকে জাগিয়ে তুলেছে। সারাদেশে সব ছড়িয়ে যাচ্ছে। চোরে চোরে মাসতুতো ভাইদের চেইন গড়ে উঠছে! সেই বিষধর সাপের মাথায়ই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আঘাত করেছেন। ইতোপূর্বে মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়ে প্রধানমন্ত্রী জিরো টলারেন্স নীতি প্রয়োগ শুরু করেছেন। জঙ্গি দমনেও তিনি জিরো টলারেন্স দেখিয়ে সাফল্য পেয়েছেন। দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নিয়ে যারা সংশয় প্রকাশ বা সমালোচনা করেছিলেন, তারা এখন বুঝতে পারছে এর আসল স্বরূপ কি! অতীতে সেনাশাসক কেউ শুদ্ধি অভিযানের নামে গদিতে বসে কি করেছে তা দেশবাসী জানে। আর দুর্নীতি সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ ‘উপহার’ দিতে গিয়ে বিএনপি ও সৎ লোকের দল জামাতের জোট কি করেছে তাও কারও অজানা নয়। অতীতে শাসক কেউ যা সাহস করেনি; বরং ‘দুষ্ট ছেলে’ বলে আস্কারা প্রশ্রয় দিয়েছে, দেশ ও জনগণের স্বার্থে ভয়ঙ্কর সেই সাপের মাথায়ই দূরদর্শিতা ও সাহস নিয়ে দুর্নীতি, মাদক, অবৈধ ব্যবসা ও সন্ত্রাসের কেন্দ্রে আঘাত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ থেকে ফিরে আসা মানেই সাপের বিষাক্ত ছোবলে দেশবাসীকে ছেড়ে দেওয়া। তাই ফেরার পথ ভয়ঙ্কর কিন্তু অগ্রসর করার পথে আছে নব নব বিজয় কেতন।
একটা কথা রাজনৈতিক অঙ্গনে বহুল প্রচলিত যে, শেখ হাসিনা যাকে ধরেন তাকে ছাড়েন না। তিনি শেষ দেখে নেন। বঙ্গবন্ধু-কন্যা দলীয় রাজনীতির গণ্ডি অতিক্রম করে কীভাবে সবার হচ্ছেন, কীভাবে রাজনীতিক থেকে রাষ্ট্রনায়ক হচ্ছেন এটা এর প্রমাণ। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে আর বাস্তব মোকাবিলা করতে গিয়ে তিনি এই কৌশল আয়ত্ত করেছেন। তিনি যেমন কোমল তেমনি কঠিন। ‘ডান হাতে পূর্ণ কর সুধা/বাম হাতে চূর্ণ কর পাত্র’ কবিগুরুর এই দুটো লাইন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য প্রযোজ্য। এটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আওয়ামী লীগ রয়েছে শেখ হাসিনার মনপ্রাণজুড়ে। আওয়ামী লীগের বাইরে তার কোনো পৃথক সত্তা নেই। মৃত্যুর পরোয়া না করেই প্রায় ৩৯ বছর আগে তিনি দেশে ফিরে এসে সভাপতি হিসেবে আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন। জীবনের ওপর বারবার আঘাত সত্ত্বেও তিনি ওই হাল ছাড়েন নি। দলকে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছেন। পিতা-মাতা-ভাইদের হারানোর পর দলের নেতা- কর্মীরাই তার একান্ত আপনজন। সেই দলের ভেতরে ক্ষমতায় ১১ বছর থাকার পর অতীতের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামরিক শাসকদের ধারাবাহিকতায় জমে ওঠা আগাছা-আবর্জনা সরাতেই তাকে দেশ ও দলের কল্যাণের জন্যই কঠিন হতে হয়েছে। ৭৩তম জন্মদিনের আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ তাই বলেছেন, ‘গুটি কয়েক দুর্নীতিবাজ সন্ত্রাসী ও দুর্বৃত্তের জন্য পুরো আওয়ামী লীগ বদনামের ভাগিদার হতে পারে না। আওয়ামী লীগের ইমেজ যারা ক্ষুণ্ন করছে, দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর অ্যাকশন শুরু হয়েছে। অভিযানের শেষ না দেখে তিনি ছাড়বেন না।’
জাতির জন্মের উষালগ্নে জাতির পিতা এমনভাবে কঠোর হতে পারেন নি। স্বাধীনতার পর অতীতের ধারাবাহিকতায় সরকার ও দলের মধ্যে গজিয়ে ওঠা অন্ধকারের সঙ্গী ‘চাটার দল’, উগ্রবাম ‘রাতের বাহিনী’ ও পরাজিত শত্রুদের ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত দমন করতে তিনি বারবার সচেষ্ট হয়েছেন। আমি পর্যন্ত নামিয়েছেন। কিন্তু পিতার মতো কোমল ও উদার হৃদয় থাকার কারণে তিনি ওই সব অভিযান শেষ পর্যন্ত অগ্রসর করা সম্ভব হয়নি। অ্যান্থনি ম্যাসকার্নহাস ‘বাংলাদেশ : এ লেগ্যাসি অব ব্লাড’ বইতে লিখেছেন, ‘সব কিছুতেই তিনি সরলতার আশ্রয় নিতেন।’ তাই স্লোগান উঠেছিল ‘বঙ্গবন্ধু কঠোর হও’। তিনি তেমন কঠোর হতে না পেরে তখনকার সমাজতন্ত্র-ধনতন্ত্র ঠাণ্ডাযুদ্ধ যুগে তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের মতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে সবাইকে সাথে নিয়ে একদল ঐক্যবদ্ধ করে দেশকে অগ্রসর করতে চেয়েছিলেন। উদারতা ও সরলতা নিয়ে সবাইকে তিনি দেশ গড়ে তোলার কাজে লাগাতে চেষ্টা করেছেন। শত্রুরা সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে। জাতির ইতিহাসের রক্তের অক্ষরে লেখা হয়েছে ১৫ আগস্ট আর ৩ নভেম্বর। ইতোমধ্যে কোনো কোনো ব্যক্তি-গোষ্ঠীমহল এই সরলতা ও উদারতাকে বঙ্গবন্ধুর সীমাবদ্ধতা কিংবা ব্যর্থতা হিসাবে দেখেন। কিন্তু যত দিন যাবে, দেশ যত বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে, ততই জাতির পিতার এই মহৎ গুণ আরও সুস্পষ্ট হতে থাকবে। কেননা মানব সমাজের উন্নতি অগ্রগতিতে উদারতা-সরলতা, ধৈর্য-সমঝোতা, সম্প্রীতি-শান্তির প্রচেষ্টা চিরায়ত ও উচ্চ প্রশংসিত।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন, তিনি দল-সরকার-বাইরে বিন্দুমাত্র সেই ধরনের সুযোগ দিতে নারাজ। তিনি পিতার পথ ধরে অগ্রসর হতে চেয়েছিলেন। আদেশ-উপদেশ-হুঁশিয়ারি তিনি কম দেননি। রাজনীতিকে তিনি ‘জনসেবা’ হিসেবে সামনে আনতে চেয়েছেন। আমলা প্রশাসনকে তিনি বলেছেন, বেতন বাড়ানো হয়েছে, দুর্নীতি করা যাবে না। জনবান্ধব প্রশাসন করতে হবে। কিন্তু রাজনীতি বা প্রশাসনের অসৎরা তা মানেনি। চোরে শোনে না ধর্মের কাহিনি। ছাত্রলীগ কাণ্ডে দেখা গেল টেন্ডারে পার্সেন্টেজ নিয়ে ছাত্রনেতা-শিক্ষক অবৈধ চক্র গড়ে উঠেছে। আর যুবলীগ কাণ্ডে দেখা গেল, কেন পেশার লোক বাদ নেই এই অশুভ নেকসাসে, নেতা-কর্মকতা-
কর্মচারী-পুলিশ-ব্যবসায়ী-জুয়াড়ি-চাঁদাবাজ-মাস্তান সব চরিত্রহীনরাই এই অপরাধ জগতের সাথে জড়িত। জোরালো, সক্রিয় ও সোচ্চার গণসমর্থন এবং আইনের কঠোর প্রয়োগ ছাড়া এই নেকসাস ভাঙা খুবই কঠিন। এক ধাক্কায় হয়তো তা ভাঙাও যাবে না। তবুও অন্ধকার জগৎকে যথাসম্ভব পদানত করতে অবৈধ অন্ধকারের গণশত্রু দমনে প্রধানমন্ত্রী ‘জিরো টলারেন্স’ নিয়ে এখন মাঠে নেমেছেন। ‘ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দুর্বলতা/হে রুদ্র নিষ্ঠুর যেন হতে পারি তথা’ কবিগুরুর এই অমর বাণীকে তিনি ধারণ করেছেন। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অগ্রসর হচ্ছেন। কথা ও কাজের সম্মিলন ঘটাচ্ছেন। নিঃসন্দেহে দেশকে অগ্রগতির পথে নেওয়ার লক্ষ্যে এটা উদাহরণ-স্থানীয় ও উৎসাহজনক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের টেন্ডারে পার্সেন্টেজ ও ক্যাসিনো দমনে অ্যাকশন গ্রহণের পর থেকে বেশ কতক প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। প্রশ্নগুলোর মধ্যে সংশয় ও সমালোচনা যুক্ত হয়ে আছে। এত দেরি করে জিরো টলারেন্স শুরু করা হলো কেন, রাঘববোয়ালরা ধরা পড়ছে না বা পড়বেও না, চলমান এই অভিযানের শেষ কোথায়, অভিযান পথ হারাবে কি না, প্রশাসন ও পুলিশ এতদিন করল কি, দলে অনুপ্রবেশকারীরা এসব করছে, রাঘববোয়ালদের তালিকা প্রকাশিত হবে কি না, মূলে হাত পড়বে কি না, দুর্নীতি-সন্ত্রাসের সমাধান করা যাবে কি না ইত্যাদি ইত্যাদি। বলাই অপেক্ষা রাখে না, গণতান্ত্রিক সমাজে এসব প্রশ্ন ও সমালোচনা ওঠা অস্বাভাবিক নয়। তবে আগ্রহোদ্দীপক বিষয় হলো, কেউ কিন্তু এর বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে না কিংবা ইনিয়ে-বিনিয়ে বিরুদ্ধে দাঁড়ালেও প্রচÐ বিরোধিতা ও নিন্দার সম্মুখীন হচ্ছে। বলা যায়, অবৈধ আয়-দুর্নীতি-সন্ত্রাস-দখল-দাপটের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগের পক্ষে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠছে। মানুষ এতে ভরসা পাচ্ছে।
তবে সংশয় বা সমালোচনা যা রয়েছে, তা একদিক বিবেচনায় মন্দ নয়। কেননা এসবের জবাব দেওয়ার ভেতর দিয়ে একদিকে যেমন জনগণের মনে প্রশ্ন সংশয় দূর করা সম্ভব হচ্ছে, তেমনি যারা রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে সমালোচনা করছে বা প্রশ্ন তুলছে, তাদের মুখোশ উন্মোচিত হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউইয়র্কে আওয়ামী লীগ আয়োজিত নাগরিক সম্বর্ধনা সভায় যা বলেছেন, তা দিয়ে বোধকরি সব সংশয়, প্রশ্ন ও সমালোচনার জবাব দেওয়া হয়ে গেছে। তিনি পুনরায় দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে ‘দুর্নীতি না হলে দেশ আরও উন্নত হতে পারত’ মন্তব্য করে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘দুর্নীতিবাজ ও অসৎ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ অব্যাহত থাকবে।… আরেকটা জিনিস আমি দেখতে বলে দিয়েছি, সেটি হলোÑ কার আয়-উপার্জন কত? কীভাবে জীবনযাপন করে? সেগুলো আমাদের বের করতে হবে। তাহলে আমরা এই ব্যাধিটা, একটা অসম প্রতিযোগিতার হাত থেকে আমাদের সমাজকে রক্ষা করতে পারব, আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করতে পারব।… যে কেউ হোক-না-কেন, আমার দলের হলেও তাকে ছাড় দেওয়া হবে না।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘একজন সৎভাবে চলতে গেলে তাকে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা নিয়ে চলতে হয়, আর অসৎ উপায়ে অর্জিত অর্থ দিয়ে এই ব্রান্ড, ওই ব্রান্ড, এটা-সেটার, হৈচৈ খুব দেখাতে পারে।’ কাদের উদ্দেশ্যে এ-কথা বলেছেন, তা সহজেই অনুমান করা চলে।
আমাদের জাতির একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, বিশেষ বিশেষ সময়ে আমরা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শরণাপন্ন হই। ষাটের দশকে সামরিক আইন অমান্য করে আন্দোলন অগ্রসর করার জন্য আমরা রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালন করেছিলাম। পাকিস্তানি কারাগারের ফাঁসির মঞ্চ থেকে নবজাত বাংলাদেশে ফেরার পর সাংবাদিকরা জাতির পিতাকে প্রশ্ন করেছিল, আপনার অনুভূতি কী? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী/ভয় নাই ওরে ভয় নাই/নিঃশ্বেষে প্রাণ যে করিবে দান/ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’ বঙ্গবন্ধুর যে কোনো ক্ষয় নেই; বরং তিনি যে আরও উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে জাতির সামনে আলোকবর্তিকা রূপে রয়েছেন, এটা এখন সুস্পষ্ট। বঙ্গবন্ধু-কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ‘দুর্বলেরে রক্ষা করো, দুর্জনেরে হানো’Ñ এই নীতির প্রতি দৃঢ় থেকে, কোনো অন্যায়কে আর প্রশ্রয় না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অঙ্গুলিমেয় কিছু সংখ্যক ব্যক্তির অপরাধ-অনিয়ম-দুর্নীতি-দুর্বৃত্তপনার জন্য যে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হতে দেওয়া হবে না- এই ঘোষণাটা যে কেবল আপ্তবাক্য নয়, চলমান অভিযানে সেই সত্যটি প্রমাণিত হবে। অপরাধী যে-ই হোন, যত্ত বড় ক্ষমতাধারীই হোন- কাউকেই রেহাই দেওয়া হবে না।