Sunday, September 24, 2023
বাড়িউত্তরণ ডেস্কদুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর হুঁশিয়ারি

দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর হুঁশিয়ারি

যা করার আমিই করব
‘কোনো অপরাধীই ছাড় পাবে না, সে যে দলেরই হোক। ঋণখেলাপি কমিয়ে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। দুর্নীতি, জুয়া ও ক্যাসিনো সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অভিযান চলবে।’

উত্তরণ ডেস্ক: ওয়ান-ইলেভেনের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশে ওয়ান-ইলেভেন জাতীয় ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ তার সরকার আগে থেকেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, যাতে এ ধরনের ঘটনা পুনরায় না ঘটতে পারে।
নিউইয়র্কে স্থানীয় সময় গত ২৯ সেপ্টেম্বর বিকেলে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন।
সম্প্রতি দেশে শুরু হওয়া দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের যৌক্তিকতা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেছেন, সামগ্রিক স্বার্থেই সমাজে বৈষম্যের জায়গাটিতে এ ধরনের আঘাতের প্রয়োজন ছিল। তিনি বলেন, ওয়ান-ইলেভেনের পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে, সে জন্য আগে থেকেই ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমি এটুকু বলতে পারি, ওয়ান-ইলেভেন হওয়া লাগবে না। যদি কোনো অনিয়ম থেকে থাকে, আমি ব্যবস্থা নেব, আমরা ব্যবস্থা নেব এবং সে যে-ই হোক না কেন, এমনকি তারা আমার দলের হলেও। যদি আমি দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দিতে চাই, আমার ঘর থেকেই তা আগে শুরু করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রকল্প প্রস্তুতি থেকে শুরু করে প্রকল্পের কাজ পাওয়ার জন্য অর্থ বিতরণের সুযোগ নিয়ে কিছু লোক বিপুল সম্পদের মালিক বনে যাচ্ছেন। এই অর্থ চটের বস্তাতেও লুকিয়ে রাখা হচ্ছে এবং ওয়ান-ইলেভেনের পটপরিবর্তনের পর আমরা এটা দেখেছি। তিনি বলেন, হঠাৎ করে যে সম্পদ আসে তা দেখানো কিছু মানুষের স্বভাব। আমাদের সমাজের এই অংশটিকে আঘাত করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষ যত ওপরে ওঠে, তত ভদ্র হতে হয়, হাম্বল হতে হয়। আর আমাদের উল্টো। এটা হয় তখনই, যখন হঠাৎ করে পয়সার জোরে নিচ থেকে অনেক ওপরে যায়, তখন তারা ভাবে ‘মুই কী হনুরে’। সমাজের এই জায়গাটায় একটি আঘাত দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। অসৎ উপায়ে অর্জিত অর্থের বাহাদুরি, সে সম্পদের শো-অফ করা, আর যারা সৎপথে চলবে, তারা একেবারে মরে থাকবে, এটা তো হতে পারে না।
তিনি বলেন, আমি অভিযান চালাচ্ছি। কিছু মানুষ অখুশি হতে পারে। তাতে আমার কিছু আসে-যায় না। কারণ আমার কোনো সম্পদের মোহ নেই। ক্ষমতারও মোহ নেই। আমার বাবা দেশটা স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন। আমি দেশটাকে গড়ে তুলতে চাই তার আদর্শ দিয়ে, স্বপ্ন নিয়ে। আমি সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছি। আজ অর্থনীতি উন্নত হচ্ছে। সবাই ভালো থাকুকÑ এটা আমি চাই। কিন্তু এই সুযোগ নিয়ে মুষ্টিমেয় লোক সমাজটাকে কলুষিত করবে, এটা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ওয়ান-ইলেভেন আসবে না। ওয়ান-ইলেভেন আসা লাগবে না। যা করার আমি করব।
শেখ হাসিনা বলেন, কোনো অপরাধীই ছাড় পাবে না, সে যে দলেরই হোক। ঋণখেলাপি কমিয়ে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। দুর্নীতি, জুয়া ও ক্যাসিনো সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অভিযান চলবে।
এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনিরা যারা এই দেশে (যুক্তরাষ্ট্র) রয়েছে, তাদের বাংলাদেশের কাছে ফিরিয়ে দিতে এবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে একটি চিঠি দিয়েছি। এ-কথা তাকে আমি সরাসরি বলেছিও। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, কোনো অপরাধীকে তিনি তার দেশে থাকতে দেবেন না। সবচেয়ে বড় ক্রিমিনাল জাতির পিতার হত্যাকারী।
আরেকটি প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, আগামী বছর জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ পালিত হবে জাতিসংঘে। সেটা সেপ্টেম্বরে বিশ্বনেতাদের উপস্থিতিতেও হতে পারে। সেই সঙ্গে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সহায়তার জন্য হওয়া কনসার্ট ফর বাংলাদেশের আদলে স্বাধীনতার ৫০ বছরে যদি নিউইয়র্কের মেডিসন স্কয়ার গার্ডেনে কিছু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়, তাহলে সরকার সর্বাত্মক সহায়তা দেবে।
সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন এমপি, জাতিসংঘের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
দুর্নীতি-অনিয়ম-উচ্ছৃঙ্খলতায় জড়িত থাকলে দলের লোকদেরও কোনো ছাড় দেয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, দুর্নীতির কারণে দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দুর্নীতি না হলে দেশের চেহারা পাল্টে যেত। এ কারণে ফাঁকফোকর কোথায় এবং কারা উন্নয়ন প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত করছে তাদের খুঁজে বের করতে হবে। দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের চলমান অভিযান অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
গত ২৮ সেপ্টেম্বর বিকেলে নিউইয়র্কের ম্যারিয়ট মারকুইজ হোটেলে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক নাগরিক সম্বর্ধনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, আমরা ব্যাপক উন্নয়ন প্রকল্প নিচ্ছি। যত উন্নয়ন প্রকল্প আমরা নিচ্ছি, তার প্রতিটি টাকা যদি সঠিকভাবে ব্যয় হতো, ব্যবহার হতো, আজকে বাংলাদেশ আরও অনেক বেশি উন্নত হতো পারত। এখন আমাকে খুঁজে বের করতে হবে এখানে কোথায় লুপহোল, কোথায় ঘাটতিটা, কারা কোথায় কীভাবে এই জায়গাটা ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমি একটা কথা স্পষ্ট বলতে চাই, এই অসৎ পথ ধরে কেউ উপার্জন করলে, অনিয়ম, উচ্ছৃঙ্খলতা বা অসৎ কাজে যদি ধরা পড়ে, তবে সে যে-ই হোক-না-কেন, আমার দলের হলেও ছাড় হবে না, এর বিরুদ্ধে আমাদের ব্যবস্থা অব্যাহত রাখা হবে।
প্রবাসীদের সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেন, যারা সদ্ভাবে জীবনযাপন করতে চায়, তাদের জন্য বা তাদের ছেলেমেয়ের জন্য সদ্ভাবে জীবনযাপন করা কঠিন হয়ে যায়, যখন অসৎ উপায়ে উপার্জিত পয়সা সমাজকে বিকলাঙ্গ করে দেয়। কারণ একজনকে সদ্ভাবে চলতে গেলে তাকে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা নিয়ে চলতে হয়। আর অসৎ উপায়ে উপার্জিত অর্থ দিয়ে এই ব্র্যান্ড, ওই ব্র্যান্ড, এটা সেটা হৈচৈ… খুব দেখাতে পারে। শেখ হাসিনা বলেন, ফলাফলটা এই দাঁড়ায়, একজন অসৎ মানুষের দৌরাত্ম্যে যারা সদ্ভাবে জীবনযাপন করতে চায় তাদের জীবনযাত্রাটাই কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ ছেলেমেয়েরা ছোট শিশু, তারা তো আর এতটা বোঝে না। ভাবে যে ওরা এভাবে পারে তো আমাদের নেই কেন। এটা স্বাভাবিক, তাদের মনে এই প্রশ্নটা জাগবে। এত ছোট বাচ্চারা, তারা সৎ-অসতের কি বুঝবে। তারা ভাবে আমার বন্ধুদের এত আছে, আমাদের নেই কেন? স্বাভাবিকভাবে মানুষকে অসৎ উপায়ের পথে ঠেলে দেবে। সমাজের এই বৈষম্য দূর করার জন্য সরকার ইতোমধ্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আরেকটা জিনিস আমি দেখতে বলে দিয়েছি, সেটা হলো কার আয়-উপার্জন কত, কীভাবে জীবনযাপন করে সেগুলো আমাদের বের করতে হবে। তাহলে আমরা সমাজ থেকে এই ব্যাধিটা, একটা অসম প্রতিযোগিতার হাত থেকে আমাদের সমাজকে রক্ষা করতে পারব, আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করতে পারব।
এছাড়া, দুর্নীতির পাশাপাশি মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থানের কথাও অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান, সেটাও অব্যাহত থাকবে। এই মাদক একটা পরিবার ধ্বংস করে, একটা দেশ ধ্বংস করে। এর সঙ্গে কারা আছে সেটাও আমরা খুঁজে বের করব। বাংলাদেশ থেকে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, মাদক দূর করে বাংলাদেশের মানুষকে আমরা উন্নত জীবন দিতে চাই। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস যে কেবল বাংলাদেশের সমস্যা না, গোটা বিশ্বের জন্যই যে এটি একটি হুমকি, সে-কথাও মনে করিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, এখন দেশের উন্নতির জন্য শান্তিপূর্ণ পরিবেশ দরকার।
শেখ হাসিনা বলেন, জনগণের শক্তি সবচেয়ে বড় শক্তি এবং আওয়ামী লীগ জনগণের শক্তিতেই বিশ্বাস করে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দেশের উন্নতি হয় এবং জনগণ উন্নত জীবন লাভ করে বলেই আওয়ামী লীগের ওপর জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস আছে। তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের সময় দেশের শিক্ষাসহ বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া এবং বাজেট বাড়ানোর কথা অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন। শেখ হাসিনা বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান সেটাও অব্যাহত থাকবে। এই মাদক একটা পরিবার ধ্বংস করে, একটা দেশ ধ্বংস করে। এর সঙ্গে কারা আছে সেটাও আমরা খুঁজে বের করব। বঙ্গবন্ধু-কন্যা বলেন, বাংলাদেশ থেকে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, মাদক দূর করে বাংলাদেশের মানুষকে আমরা উন্নত জীবন দিতে চাই।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম ও ত্যাগের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একজন রাজনৈতিক নেতা হতে হলে দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করার মানসিকতা থাকতে হবে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার ঘটনা স্মরণ করে তিনি বলেন, যারা স্বাধীনতা ও বাঙালির বিজয়কে মেনে নিতে পারেনি, পাকিস্তানিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে যারা ধর্ষণ ও গণহত্যা চালিয়েছে, তাদের প্ররোচনাতেই ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যেভাবেই হোক সমুন্নত রাখতে হবে বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। দেশের অর্থনীতিতে প্রবাসীদের অবদানের কথা তুলে ধরে তিনি তাদের দেশে আরও বেশি বিনিয়োগের আহ্বান জানান।

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য