Tuesday, December 5, 2023

তোমার পথ কোথা হে পথিক

সম্পাদকের কথা: সমাজবিজ্ঞানীরা সভ্যতার বিকাশকে কয়েকটি পর্যায়ে বা ধাপে ভাগ করেছেন। হোমোসেপিয়ান মানুষ যখন আগুনের ব্যবহার, হাতিয়ারের ব্যবহার এবং সমাজবদ্ধভাবে বসবাস শুরু করল তখন থেকেই প্রাক-সাম্যবাদী সমাজের শুরু। তারপর হাজার হাজার বছরের বিবর্তনের ধারায় পশু শিকারী যুগ পেরিয়ে পশু পালন যুগে তখন থেকেই সংগঠিত উৎপাদিকা শক্তির উন্মেষ ঘটতে থাকে। সাধারণভাবে এই সময়কালকে ‘আদিম সাম্যবাদী’ যুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
আদিম সাম্যবাদী সমাজে যেহেতু সঞ্চয় ও উদ্বৃত্ত থাকার মতো অবস্থা ছিল না, তাই সেই পর্যায়ে সমাজে বেঁচে থাকার অবলম্বন ছিল যুথবদ্ধ মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। সেই সমাজে মানুষে মানুষে শ্রেণিভেদ, ধনভেদ বা বৈষম্য ছিল না। এ পর্যায়ের পরে শুরু হয় কৃষি সভ্যতার যুগ। কৃষি সভ্যতার যুগেই ধীরে ধীরে শুরু হয় সঞ্চয় ও উদ্বৃত্ত। আর এই সঞ্চয় ও উদ্বৃত্ত ভোগের প্রতিযোগিতা জন্ম দেয় শ্রেণিভেদ, ধনভেদ এবং তাকে টিকিয়ে রাখার জন্য অনুশাসন, সমাজ ও রাষ্ট্র-ব্যবস্থার। কৃষি সভ্যতাকে ঘিরেই শুরু হয় সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থা, ব্যক্তিগত সম্পত্তি, শোষণ ও বঞ্চনা। সামন্ততন্ত্রের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল রাজতন্ত্র। অর্থাৎ রাজা, নিজেই সাম্রাজ্য বা রাজ্যের মালিক। সাধারণ শ্রমজীবী মানুষকে নিজেদের ‘বশে’ রাখার জন্য চালু করা হয় ধর্মীয় অনুশাসন। ঈশ্বর সব কিছুর মালিক বা নিয়ন্তা। তবে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে রাজা বা রানি রাজ্য শাসন ও বিধান দেওয়ার মালিক। অর্থাৎ সামন্ততান্ত্রিক শাসন, শোষণকে এক ধরনের বৈধতা দেওয়া হয়।
সামন্ততন্ত্রের গর্ভে জন্ম নেয় পুঁজিবাদ বা ধনতন্ত্র। নানা মাত্রার, নানা রূপের ধনতন্ত্র থাকলেও, ধনতন্ত্রের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো ব্যক্তিগত সম্পত্তি। উৎপাদিকা শক্তি হিসেবে শ্রমিক বা শ্রমজীবী মানুষের ভূমিকা নিয়ামক হলে উৎপাদনের উপায় বা উপকরণগুলোর মালিক হন ধনিক-শ্রেণি। রাষ্ট্র চলে এই ধনিক-শ্রেণির স্বার্থে, তাদের নির্দেশে। মানুষের চেতনার বিকাশ, অধিকারের সম্প্রসারণ এবং পুঁজিবাদী সমাজের অনিবার্য শ্রেণি-সংগ্রাম পুঁজিবাদকে আধুনিক গণতান্ত্রিক খোলস পরাতে বাধ্য করে। রাজতন্ত্রের স্থলাভিষিক্ত হয় প্রজাতন্ত্র, নির্বাচন প্রথা, পার্লামেন্ট প্রভৃতি। বিশেষত ইউরোপে ফরাসি বিপ্লবের ভেতর দিয়ে পুরনো সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটে। মানুষ বিকাশের আরও একাধিক ধাপ পেরুবার লক্ষ্য স্থির করে। মানুষ স্বপ্ন দেখতে শুরু করে শোষণ-বঞ্চনা ও ভেদ-বৈষম্যমুক্ত সাম্যের সমাজের।
উনিশ ও বিশ শতকে নানা মাত্রার ও প্রবণতার সমাজতন্ত্রের ধারণা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে নতুন স্বপ্নে বিভোর করে তোলে। ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত অক্টোবর বিপ্লব মানুষকে নতুনভাবে জাগিয়ে তোলে। শুধু এক দেশে নয়, রাশিয়া, চীন, পূর্ব ইউরোপ, মধ্য এশিয়া, কিউবা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভিয়েতনাম ও উত্তর কোরিয়াসহ একগুচ্ছ দেশে সমাজতান্ত্রিক শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। এছাড়া বিশ্বের দেশে দেশে শোষিত-বঞ্চিত-পশ্চাৎপদ মানুষের কাছে ‘সাম্যবাদী’ সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘সমাজতন্ত্রই’ হয়ে দাঁড়ায় মানবমুক্তির একমাত্র বিকল্প পথ। এজন্য দেশে দেশে লড়াই-সংগ্রাম করতে গিয়ে লাখ লাখ মানুষ আত্মদানও করেছে। আমরা দেখেছি, ষাট-সত্তরের দশকে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার বিপুল জোয়ার। সদ্য-স্বাধীন ঔপনিবেশিক অনেক উন্নয়নকামী দেশের শাসকরা বাস্তবে পুঁজিবাদ করলেও দেশটিকে ‘সমাজতান্তিক’ দেশ হিসেবে বা সেদেশের রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছে। ভারত, শ্রীলংকা, ইথিওপিয়া, ঘানা, ইরাক, সিরিয়া, ব্রাজাভিল কঙ্গো, কতকাংশে মিশর ও আলজেরিয়া এ সমাজতন্ত্রকে তাদের লক্ষ্য বা রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে ঘোষণা করে। বাংলাদেশও মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে এ লক্ষ্য ঘোষণা করে। কিন্তু গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সেই স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপ ভেঙে পড়ে। এসব দেশ থেকে সমাজতন্ত্র নির্বাসিত হয়। চীন, কোরিয়া, ভিয়েতনাম ও কিউবায় এখনও কাগজে-কলমে সমাজতন্ত্র টিকে থাকলেও, আদপেই তা সমাজতন্ত্র কী না সে প্রশ্ন উঠেছে।
সমাজতন্ত্রের পতনের পর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘ইতিহাসের স্বপ্ন ভঙ্গ’ হয়েছে। ফরাসি দার্শনিক ফুকোওমা লিখেছেন, ‘ইতিহাসের যবনিকা’ (End of the Histoty), সবচেয়ে উল্লসিত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো। তারা বললেন, ইতিহাসের ‘কালো অধ্যায়ের’ সমাপ্তি। মুক্ত দুনিয়ার জয়। কেউ কেউ তত্ত্ব দিলেন, যেহেতু এতদিন দুই বিপরীত সমাজ-ব্যবস্থার মধ্যে বিশ্ব কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য লাগামহীন অস্ত্র প্রতিযোগিতা চলেছে, যুদ্ধ প্রস্তুতির জন্য বিপুল ব্যয় হয়েছে, এখন তার প্রয়োজন নেই। সোভিয়েত নেতৃত্বে ‘ওয়ারশ’ যুদ্ধ জোট আপসেআপ ভেঙে পড়েছে, এখন তাই আর ন্যাটো জোটকে টিকিয়ে রাখার প্রয়োজন নেই। শান্তির আবহে কেবল মানবকল্যাণ এবং পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর উন্নয়নের জন্য নতুন বিশ্বায়ন হবে। বিশ্বায়ন পৃথিবীকে বদলে দেবে।
কিন্তু হায় হত-হম্মি! সেই স্বপ্নও মানুষের ভেঙে পড়েছে। যে ‘পুজিবাদী বিশ্বায়ন’ ছিল একমাত্র নিদান, তা এখন স্বয়ং মার্কিন শাসকরাই বর্জন করার তালে আছে। পুঁজিবাদ ও বিশ্বায়ন চীন, ভিয়েতনামে সাম্প্রসারিত হয়েছে বটে; কিন্তু বিশ্বায়নের নেতিবাচক দিকগুলো এ-সময়ে বিভিন্ন উন্নত ও উন্নয়নগামী দেশে প্রকট হয়ে উঠেছে। গত দুই দশকে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন মধ্যপ্রাচ্যের তেল সমৃদ্ধ ইরাক, কুয়েত, সিরিয়া ও লিবিয়া প্রভৃতি দেশগুলোকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতার সুযোগ নিয়েছে ইসলামি মৌলবাদ ও অন্যান্য ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠী। মুসলমান তরুণদের প্রথমে ইরানের ইসলামি বিপ্লব, পরে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, মিশর, তুরস্ক ও পাকিস্তান আত্মঘাতী যুদ্ধে জড়িয়েছে। এমন কী বাংলাদেশেও ধর্মাশ্রয়ী বিএনপির ইন্ধন পেয়ে একাধিক মৌলবাদী গোপন দলের তরুণরা ইসলামি বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর হয়ে বহুবার নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়েছে। প্রতিবেশী সেকুলার ভারতে হিন্দুত্ববাদের উত্থান সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে।
আমাদের চারপাশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন নতুন জোট গঠনে চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করছে। বছর পেরিয়ে গেল মুক্ত অর্থনীতির দেশ রাশিয়া ও ইউক্রেন পশ্চিমা ফাঁদে পা দিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। ওই অন্যায় যুদ্ধ আমাদের দেশসহ সারাবিশ্ব অর্থনীতিতে সংকট ডেকে এনেছে? সমাজতন্ত্র ব্যর্থ। বিশ্বায়নী পুঁজিবাদ ব্যর্থ। ইসলামি মৌলবাদ ব্যর্থ। হিন্দুত্ববাদের মুখ থুবড়ে পড়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। এ পরিপ্রেক্ষিতে স্বাভাবিক প্রশ্ন : ‘তোমার পথ কোথা হে পথিক?’ অথচ মানুষ তো স্থবির নয়। মানুষ, বিশেষত তরুণরা স্বভাবত স্বপ্ন দেখতে অভ্যস্ত। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের যুগে আমরা, আমাদের তরুণরা নতুন কোনো পথানুসন্ধান করবে না, নতুন কোনো পথ রচনা করবে না, এটা হতে পারে না। এটা তো মানবধর্মের বিরোধী। সত্য বটে, সোভিয়েতের পতনের পর সারাবিশ্ব একটা ভাবাদর্শগত শূন্যতায় ভুগছে। সামন্তবাদের পতনের সময়ও এ-রকম শূন্যতা দেখা গেছে। ফরাসি বিপ্লবের আগেও ভাবাদর্শগত শূন্যতা ছিল। বর্তমান বিশ্বায়নী পুঁজিবাদী সংকটকালেও বিদ্যমান ভাবাদর্শগুলো কোনো নতুন পথÑ নতুন স্বপ্ন দেখাতে পারছে না। কিন্তু সে-জন্য সভ্যতা থেমে থাকেনি।
সমগ্র মানবজাতি নূতন পথানুসন্ধানে ব্রতী। শূন্যতা কোনোদিন চিরস্থায়ী হতে পারে না। ভেদ-বৈষম্যহীন সাম্যের সমাজ নির্মাণের আকাক্সক্ষাও কোনোদিন হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে না। যতদিন শোষণ থাকবে, যতদিন শ্রেণি-ভেদ থাকবে ততদিন মানুষ শোষণহীন-শ্রেণিহীন সমাজের পথ খুঁজবেই। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুও বলেছেন, “দুনিয়া দুই ভাগে বিভক্ত, শোষক ও শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।” আমরা বঙ্গবন্ধুর সাথে আছি। কেবল সৃজনশীলভাবে নতুন একটা পথ রচনা করতে হবে। স্বাধীনতার মাস অগ্নিঝরা মার্চে এই হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা : নাম যাই হোক, শোষণ ও ভেদ-বৈষম্যমুক্ত সমাজ গড়ার পথ আমরা রচনা করবই।

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য