১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তাদের বাড়িতে দুষ্কৃতিকারীরা গুলি করলে সেই গুলি শেখ রাসেলের পায়ের কাছে এসে পড়ে। সৌভাগ্যবশত তিনি বেঁচে যান। ছোট শিশুটি ১৯৭১-এর যুদ্ধে মায়ের সাথে গৃহবন্দি হয়ে পড়ে। আকাশে মেঘের মতো এয়ার রেইডের শব্দ হলে তুলা নিয়ে বোনের ছেলে জয়ের কানে গুঁজে দিত।
ড. জেবউননেছা: সময়টা ১৯৬৪ সাল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন পূর্ব পাকিস্তানে সর্বদলীয় ঐক্য পরিষদে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে সব রাজনৈতিক দলের মোর্চা সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রার্থী কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছোট বোন দন্ত চিকিৎসক এবং রাজনীতিবিদ ফাতেমা জিন্নাহর প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণায় চট্টগ্রামে ব্যস্ত। ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বরে জন্মগ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ সন্তান। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা তার সন্তানের নাম রাখলেন রাসেল। বঙ্গবন্ধু বার্ট্রান্ড রাসেলের ভক্ত ছিলেন। বঙ্গমাতাকে বঙ্গবন্ধু বার্ট্রান্ড রাসেলের জীবনী বাংলায় ব্যাখ্যা করে পড়ে শোনাতেন। বড় বোন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্মৃতিকথায় দেখা যায়, রাসেল যখন ছোট তখন তাকে বিছানায় শুইয়ে রাখতেন মা। আর পাশে বই পড়তেন বড় বোন শেখ হাসিনা। সেই বোনের চুলের বেণী ধরে খেলা করত ভাইটি। রাসেলের জন্মের প্রথম দিন থেকে বোন সব ছবি তুলে রাখতেন। সেই সকল ছবি হারিয়ে যায় ১৯৭১ সালের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর তাদের বাড়ি লুটতরাজের মধ্য দিয়ে। বড় বোনের হাত ধরেই হাঁটতে শিখেছিল সে। বোল ফুটতেই বড় বোনকে ডাকত হাসুপা বলে। ছোটবেলা তাকে একটা পিঁপড়া কামড় দিয়েছিল। এরপর থেকে সে বড় পিঁপড়া দেখলে বলত ‘ভুট্টো’। বাসার বারান্দায় কবুতরের ঘর ছিল। একসময় মায়ের কাছ থেকে শিখে সে কবুতরকে খাওয়াত। তাদের বাসায় কবুতরের মাংস খাবার রেওয়াজ থাকলেও সে কোনোদিন কবুতর খেতো না। ছোট ফুফার বাসায় গেলেই ফুফা তাকে শিখিয়েছিলেন ডিম পোচের সাথে চিনি দিয়ে খেতে। সেটাই পছন্দ ছিল। বেশ কয়েকবার এই খাবারটি খেতে দেখেছেন তাদের প্রতিবেশী অধ্যাপক ড. নাসরিন আহমাদ। তার স্মৃতিকথায় রাসেল আপন মনে ঘুরে বেড়াত বাড়ির লনে। তাদের একটি পোষা কুকুর ছিল, নাম ছিল টমি। যার সাথে রাসেল খেলত।
বঙ্গবন্ধুর প্রতিবেশী ড. আবদুস সামাদের চার ছেলে এবং শেখ রাসেল একসাথে খেলাধুলা করত। রাসেলের ছিল ৪টি সাইকেল এবং তাদের ছিল একটি সাইকেল। ৫টি সাইকেল নিয়ে পাঁচজন ধানমন্ডির বিভিন্ন সড়ক অনুসন্ধান করতে বেরিয়ে যেত দুপুর তিনটা বাজলে। মাঝে মাঝে পথ হারিয়ে ফেলত। বুদ্ধি খাঁটিয়ে বাড়িতে ফিরে আসত বন্ধুরা। একবার বাড়ির লনে বন্ধুদের সাথে এক ফুটের একটি গর্ত করে রাসেলের বাসার অ্যাকুরিয়ামের সব গোল্ড ফিস এনে সেই গর্তে দিয়ে দেয়। পরেরদিন দেখা গেল সেই মাছগুলোকে ব্যাঙ খেয়ে ফেলেছে। ১৯৭৫-এর প্রথম দিকে প্রচ- বৃষ্টিতে ধানমন্ডি প্লাবিত হলো। রাসেল বন্ধুদের সাথে করে বাসা থেকে বৈয়াম নিয়ে সেই পানি থেকে মাছ ধরে বৈয়ামে পুরে রাখলেন। পরে দেখা গেল সেগুলো ব্যাঙাচি। বাসার লনে স্ট্যাম্প প্যাড দিয়ে ক্রিকেট খেলত বন্ধুদের নিয়ে। বাবা যখন চলে আসতেন, গাড়ির হর্নের শব্দে সবাই গিয়ে রঙ্গন গাছের ঝোপে ইচ্ছে করে পালাত। কারণ রঙ্গন গাছের গোড়ায় পা দেখলে বঙ্গবন্ধু গাড়ি থেকে নেমে শেখ রাসেলের বন্ধুদের কোলে নিয়ে আদর করে বলতেন, ‘বাবা কেমন আছে? ভালো আছো তোমরা?’ একবার তো দুই বন্ধু মারামারি করে পরস্পরের মাথা ফাটলো। বঙ্গবন্ধু বাড়িতে এসে দেখে বললেন, ‘বাচ্চারা এমনই করে।’ বাড়ির লনে বৃষ্টির সময় গাছ থেকে পড়া আম খাবার স্মৃতি, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে রাসেলের আড়াই দিন তাদের বাসায় অবস্থানের স্মৃতি এবং ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট তাদের বাড়িতে প্রায় ১১টা পর্যন্ত খেলাধুলার স্মৃতিসহ এমন আরও অনেক স্মৃতি অমলিন রাসেলের খেলার সাথী সালমানের স্মৃতিতে।
১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনের সময় বাড়ির বারান্দা থেকে মিছিল দেখে বলত ‘জয় বাংলা’। পুলিশ দেখলে বলত ‘ও পুলিশ কাল হরতাল।’ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তাদের বাড়িতে দুষ্কৃতিকারীরা গুলি করলে সেই গুলি শেখ রাসেলের পায়ের কাছে এসে পড়ে। সৌভাগ্যবশত তিনি বেঁচে যান। ছোট শিশুটি ১৯৭১-এর যুদ্ধে মায়ের সাথে গৃহবন্দি হয়ে পড়ে। আকাশে মেঘের মতো এয়ার রেইডের শব্দ হলে তুলা নিয়ে বোনের ছেলে জয়ের কানে গুঁজে দিত। পাকসেনাদের অস্ত্র পরিষ্কারের পদ্ধতি জানালা দিয়ে দেখতে দেখতে একসময় অস্ত্রের নাম শিখে ফেলেছিলেন। ১৯৭১-এর বিজয়ের দিন রাসেল এবং তার চাচাত ভাই টিটো দুজন হেলমেট পরে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলেছিল। যে ছবি এখনও জীবন্ত। বন্দিদশা থেকে বাবা মুক্ত হয়ে যেদিন আসেন। সেদিন দাদার হাত ধরে বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন বাবাকে আনতে। তবে রাসেল অভ্যস্ত ছিল বাবাকে না পেতে পেতে।
বঙ্গবন্ধু তার গ্রন্থ ‘কারাগারের রোজনামচা’য় অসংখ্যবার রাসেলের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, “ছোট ছেলেটা আমার কানে কানে কথা বলে। একুশ মাস বয়স। বললাম, আমার কানে কানে কথা বললে আইবি নারাজ হবে। ভাববে একুশ মাসের ছেলের সাথে রাজনীতি নিয়ে কথা বলছি। সকলেই হেসে উঠল। এটা রাসেলের একটা খেলা, কানের কাছে মুখ নিয়ে চুপ করে থাকে আর হাসে। আজ আমার কাছ থেকে ফিরে যাবার চায় না। ওর মায়ের কাছে দিয়ে ভিতরে চলে আসলাম।” ছোট শিশুটি বাবার সাথে বেশি একটা ঈদও উদযাপন করতে পারেনি। করতে পারেনি জন্মদিন পালন। পায়নি যথেষ্ট পরিমাণে পিতৃস্নেহ। একসময় ১৮ মাস বয়সী রাসেল কারাগারকে বলত ‘আব্বার বাড়ি’। তাকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে নিয়ে গিয়েছিলেন তার ফুফাত ভাই শেখ শহীদুল ইসলাম। সে-সময় ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয় এবং পুরনো অনেক বিদ্যালয়ে ভর্তি না করে তাকে ভর্তি করা হয়েছিল সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে। তৎকালীন অধ্যক্ষ রাজিয়া মতিন চৌধুরী তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কেন পড়তে চাও এই বিদ্যালয়ে? শেখ রাসেল উত্তর দিয়েছিলেন, ভাইবোন বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ে, তাই আমিও পড়তে এলাম। ফুফাত ভাই এই স্মৃতিটি ভুলতে পারেন না। মাঝে মাঝে বঙ্গমাতা যেতেন রাসেলের খবর নিতে। তার সহপাঠী গীতাঞ্জলী বড়–য়ার স্মৃতিতে রাসেলের স্কুল পোশাক নেভি ব্লু প্যান্টের সাথে চ্যাপ্টা বেল্ট এবং আকাশি সাদা শার্ট এখনও ভাসে। ভাসে খেলার মাঠে রাসেলের খেলাধুলার স্মৃতি। সহপাঠী বন্ধুরা আবদার করেছিল, তারা বঙ্গভবন দেখতে যাবে। তখন শেখ রাসেল বলেছিল, আচ্ছা পরীক্ষা শেষ হোক তোমাদের সবাইকে বঙ্গভবন দেখাতে নিয়ে যাব। পরীক্ষা শেষ হয়েছে অনেকবার। কিন্তু বঙ্গভবনে আর যাওয়া হয়নি বন্ধুর সাথে। ৪৬ বছর ধরে তার সহপাঠী বন্ধু আসিফ জামান সেই কথা ভুলতে পারেন না। ভুলতে পারেননি রাসেলকে হারিয়ে ক্লাসের সবাই একসাথে কান্না করার স্মৃতি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চ্যান্সেলর হিসেবে অতিথি হয়ে উপস্থিত থাকার কথা ছিল। সেই অনুষ্ঠানে কীভাবে রাষ্ট্রপতিকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা হবে, সেই রিহার্সেল দিয়েছিলেন বিদ্যালয়ের সংগীত শিক্ষক জাহানারা খান। রিহার্সেল শেষে যখন রাসেলসহ সবাই শ্রেণিকক্ষে বসা, তখন বিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশিদা জামান ক্লাসে গিয়ে গল্প শোনাতে শুরু করার পর আর একজন শিক্ষক চলে আসায় তিনি বলেন, কাল তাহলে পুরো ‘গল্পটা শুনাব। কিন্তু শেখ রাসেল হাতটি ধরে বলেছিল, পুরো গল্পটি শেষ করেন ম্যাডাম। আমি গল্পটা শুনব।’ তিনি বলেছিলেন, ‘আচ্ছা কাল বাকিটা বলব।’ সেই কাল শিক্ষকের জীবনে বহুবার এসেছে। কিন্তু যে গল্পটি শুনতে চেয়েছিল, রাসেল আর গল্পটা শুনতে পারেননি। ৪৬ বছর ধরে সেই শিক্ষক এ-কথাটি ভুলতে পারেন না।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে মালা আর পরানো হয়নি শেখ রাসেলের। তবে রাসেল মালা পরিয়েছিল পিতার জন্মদিনে কারাগারে ১৭ মার্চ ১৯৬৭ সালে। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “ছোট মেয়েটা (শেখ রেহানা) আর আড়াই বৎসরের ছেলে রাসেল ফুলের মালা হাতে করে দাঁড়াইয়া আছে। মালাটা নিয়ে রাসেলকে পরাইয়া দিলাম। সে কিছুতেই পরবে না। আমার গলায় দিয়ে দিল।” হয়তো ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এর ফুলের মালাটি সে পরাতে পারবে না বলেই সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় আগেই পরিয়ে দিয়েছিল শিশু রাসেল। বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করত শেখ রাসেল। তার মধ্যে ছিল নেতৃত্ব গুণ। খেলার সময় ঘণ্টা পড়ে গেলে বন্ধুদের ক্লাসে ফিরিয়ে আনত। স্মৃতিচারণটি করেন রাসেলের শ্রেণি শিক্ষক সিসিলিয়া গুদা। তার মধ্যে কোনোদিন রাষ্ট্রপতির সন্তানের আভিজাত্য লক্ষ করেননি শিক্ষক। রাসেলের বিদ্যালয়ের সংগীত শিক্ষক জাহানারা খান, তাদের বিভিন্ন গান শেখাতেন। তার মধ্যে অন্যতম গান হলোÑ “মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, বাদল গেছে টুটি,… আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি,…” এমন আরও অনেক গান। কে জানত আকস্মিকভাবে পৃথিবীর কাছ থেকে ছুটি নিয়ে শেখ রাসেল হয়ে যাবে নীল আকাশের একখ- কালো মেঘ। শেখ রাসেলের গৃহশিক্ষক গীতালী দাশগুপ্ত তার স্মৃতিচারণে বলেছেন, তিনি জানতে চেয়েছিলেন, তুমি স্কুলে চকোলেট নিয়ে যাও তাহলে? বন্ধুদের দাও না? একা একা চকোলেট ওদের সামনেই খাও? উত্তরে বলে, “আপনি কিচ্ছু জানেন না। আমি ক্লাসের সবাইকে আগে দিয়া তারপর খাই। কোনোদিন আমার জন্য একটাও থাকে না।” পরিবার থেকে শিখে বড় হচ্ছিল, নিজের জন্য নয়, সবার জন্য বাঁচতে হয়। আর একদিন তার গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ার সময় অংক খাতা ছিঁড়ে ফেলেছিল। ছিঁড়ে আবার সে নিজেই মাটি থেকে তুলে নিয়ে তার শিক্ষককে বলেছিল, “আপা দেখেন, অংকগুলো ছিঁড়ে নাই! পাস দিয়া ছিঁড়েছে। অংকগুলো আস্থা আছে। ওরা (অংকগুলি) যদি দুই টুকরো হয়ে যেত তাহলে ওরা ব্যথা পেত, তাই না আপা?” অথচ কে জানত তার জীবনের অংক না কষতেই ছিটকে পড়বে জীবন থেকে। অত্যন্ত সহজ সরল এবং মিশুক প্রকৃতির ছেলে শেখ রাসেল। রাসেলের ইচ্ছে ছিল বড় হয়ে সামরিক কর্মকর্তা হবেন। টুঙ্গিপাড়ায় তার গ্রামে একটি খুদে বাহিনী ছিল। তাদের জন্য ডামি বন্দুক বানিয়ে দিয়ে প্যারেড করাতেন। সেই বাহিনীর জন্য বঙ্গমাতা কাপড় কিনে দিতেন। তার চাচা (শেখ নাসের) তাকে এক টাকার নোটের বান্ডিল দিতেন। সেই টাকাগুলো তার খুদে বাহিনীকে লজেন্স ও বিস্কুট কিনে দিতেন। শেখ রাসেল ডাকটিকিট সংগ্রহ করে কৌটায় ভরে রাখতেন এবং বন্ধুদের দেখাতেন। পোশাকের ব্যাপারে ছিল সচেতন। দেশের বাইরে গেলে প্রিন্স কোট পরতেন। তবে একবার কোনো পোশাক পছন্দ হলে তা আর ছাড়তে চাইতেন না।
বাবার সাথে ১৯৭২ সালে লন্ডন, ১৯৭৩ সালে জাপান এবং ১৯৭৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণ করেন। একবার ‘মপেট’ চালানোর সময় সাইকেলের পাইপে পা আটকে দিয়ে পা পুড়ে যায়। তখন পায়ে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়। ঐ সময় বঙ্গবন্ধু অসুস্থ হলে তিনি রাশিয়ায় চিকিৎসা গ্রহণ করতে যান, তখন রাসেলকে সাথে নিয়ে পায়ের চিকিৎসা করানো হয়। শেখ হাসিনা তার স্মৃতিচারণে বলেন, “এই ছোট্ট রাসেল, তাকেও তো গুলি করে মারা হলো। জানি না সেই বুলেটের যন্ত্রণা কী!” একটি বাচ্চা যার বিদ্যালয়ের খাতায় স্বাক্ষর করার জন্য বাবাকে নিয়মিত বাসায় পেতো না। দিনের পর দিন বাবাকে ছাড়াই মায়ের কাছে, ভাইবোনের কাছে বড় হয়েছে। যে কি না মাকেই আব্বা বলে ডাকত। এমন একটি নিষ্পাপ শিশুকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তার সাথে বাড়ির নিচতলায় আনা হয়েছিল তার চাচা শেখ নাসের, বাসার কাজের সহকারী আবদুর রহমান (রমা)-কে। বারে বারে সে আকুতি করছিল মায়ের কাছে যাবে। সে শিশু বাচ্চা, মায়ের লাশ দেখে আকুতি নিয়ে বলেছিল, “আমাকে হাসুপার কাছে নিয়ে যাও। যে কি না বাসায় যা বায়না ধরত তাই পেত। সে তার শেষ আবদারের বদৌলতে পেয়েছে বুলেট।” শেখ হাসিনা আফসোস করে তার স্মৃতিকথায় বলেন, “আমি জার্মানি যাবার সময় রেহানাকে আমার সাথে নিয়ে যাই। রাসেলকে সাথে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম; কিন্তু ওর হঠাৎ জন্ডিস হয়, শরীর খারাপ হয়ে পড়ে। রাসেলকে যদি আমাদের সাথে নিয়ে যেতে পারতাম, তাহলে আর ওকে হারাতে হতো না।” দুই বোন শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমাদের যদি সবকিছু নিয়ে আমার বাবা-মা, ছোট্ট রাসেলকে ফিরিয়ে দিলে আমরা কিছু চাই না। আমরা সব দিয়ে দিব।” ৪৬ বছর ধরে দুই বোন রাসেলের জন্য চোখের পানি ঝরিয়ে যাচ্ছেন। দিন আসে দিন যায়, রাসেল আসে না। হাসুপা বলে ডাকে না। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “দুই বছরের ছেলেটা এসে বলে আব্বা বাড়ি চলো। কি উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম। তো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো।” শেখ রাসেল সত্যিই এখন তার মায়ের কাছে থাকে বনানী গোরস্তানে। আর বঙ্গবন্ধু থাকেন টুঙ্গিপাড়ায় শ্যামল ছায়ায় তার বাড়িতে। কিন্তু কেউ কাউকে আর দেখতে আসে না। ‘রাসেল’ নামের আরবি অর্থ ‘প্রশংসনীয় পথ প্রদর্শক’। চকচকে এক জোড়া চোখের শেখ রাসেল বেঁচে থাকলে হয়তো হতে পারত কোনো বিষয়ে পথ নির্দেশক। তবে সে মরেও পথ নির্দেশ করে দিয়ে গিয়েছেন, জানিয়ে গিয়েছেন ১০ বছর ১০ মাসের এই আমি শেখ রাসেল হারিয়ে গেলেও ফিরে আসব শত কোটি রাসেলের মাঝে।
বাংলাদেশ সরকার শেখ রাসেলের জন্মদিনকে ‘শেখ রাসেল দিবস’ জাতীয় হিসেবে পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। শেখ রাসেলের বিদ্যালয়ে তার ছবিসহ ম্যুরাল এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে শেখ রাসেলের প্রিয় সাইকেল এবং বিদ্যালয়ে খাতার মাঝে শেখ রাসেল বেঁচে থাকবেন। ক্ষণজন্মা এই ছোট্ট রাসেলকে ৫৭তম জন্মদিনের শুভেচ্ছা। শুভ জন্মদিন শেখ রাসেল। বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছিলেন, “পিঁপড়ে ও বুনোরা আগন্তুককে অক্কা পাইয়ে ছাড়ে।” হ্যাঁ স্বল্পায়ু শেখ রাসেলকে কতিপয় পিঁপড়ে এবং বুনোরাই তার দেহকে বুলেট বিদ্ধ করেছে। শেখ রাসেলের জন্মদিনে তার হত্যাকারীদের ধিক্কার জানাই। ‘নীল লোহিত’ ছদ্মনামের লেখক প্রথিতযশা বাঙালি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘শিশু রক্ত’ কবিতায় লিখেছেন, “রাসেল, অবোধ শিশু তোর জন্য আমিও কেঁদেছি’/খোকা, তোর মরহুম পিতার নামে যারা এতদিন তুলেছিল আকাশ ফাটানো জয়ধ্বনি/তারাই দুদিন বাদে থুতু দেয়, আগুন ছড়ায়, বয়স্করা এমনই উন্মাদ।”
লেখক : অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়